Breaking News

মুসলিম শিশুর জন্ম পরবর্তী করণীয়। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর করণীয়

সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর করণীয়

তাহনীক ও দো‘আ করা: নবজাত শিশুর জন্য প্রথম করণীয় সম্পর্কে আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,

أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم كَانَ يُؤْتَى بِالصِّبْيَانِ فَيُبَرِّكُ عَلَيْهِمْ وَيُحَنِّكُهُمْ، 

‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে নবজাত শিশুদের নিয়ে আসা হ’ত, তিনি তাদের কল্যাণ ও বরকতের জন্য দো‘আ করতেন এবং তাহনীক করতেন’।

সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর খেজুর, মধু বা মিষ্টি জাতীয় কোন খাদ্য বস্ত্ত চিবেয়ে শিশুর মুখে দেওয়াকে তাহনীক বলা হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) খেজুর নিয়ে তা চিবিয়ে নরম করে মুখের লালা মিশ্রিত চিবানো খেজুর দিয়ে তাহনীক করতেন। যেমন আবূ মূসা আল-আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,

 وُلِدَ لِى غُلاَمٌ، فَأَتَيْتُ بِهِ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم فَسَمَّاهُ إِبْرَاهِيمَ، فَحَنَّكَهُ بِتَمْرَةٍ، وَدَعَا لَهُ بِالْبَرَكَةِ، 

‘আমার একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করলে তাকে নিয়ে নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে গেলাম। তিনি তার নাম রাখলেন ইব্রাহীম এবং খেজুর দিয়ে তার তাহনীক করলেন’।

সুতরাং সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মুত্তাক্বী আলেম বা পরহেযগার ব্যক্তির নিকট শিশুকে নিয়ে গিয়ে তাহনীক ও দো‘আ করে নিতে হবে। তাহনীক করার সময় নিম্নোক্ত দো‘আ পাঠ করবে,

اللَّهُمَّ بَارِكْ لَهُمْ فِى مَا رَزَقْتَهُمْ

(আল্লাহুম্মা বারিক লাহুম ফীমা রাযাক্বতাহুম) ‘হে আল্লাহ তাকে সর্ব বিষয়ে বরকত দান কর এবং যে রিযিক দান করেছ তাতেও বরকত দান কর’।

শিশুর নাম রাখা: সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর দ্বিতীয় করণীয় হচ্ছে তার অর্থপূর্ণ ভাল নাম রাখা। বিভিন্ন হাদীছ থেকে প্রমাণিত হয় যে, সন্তান জন্মগ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম দিন, দ্বিতীয় দিন, তৃতীয় দিন কিংবা সাত দিনের মধ্যে সুবিধা মত যেকোন দিন নাম রাখতে হয়। নাম রাখার জন্য ৭ম দিনে আক্বীক্বা করা পর্যন্ত বিলম্বিত করার প্রয়োজন নেই। আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, গত রাতে আমার একটি পুত্র সন্তান জন্ম নিয়েছে। আমি তার নাম রেখেছি আমার পিতার নামানুসারে ইবরাহীম।

শিশু জন্মগ্রহণের পর বর্জনীয় বিষয়সমূহ:

১. আযান ও ইক্বামত : শিশু জন্মগ্রহণের পর প্রথম করণীয় হিসাবে ডান কানে আযান ও বাম কানে ইক্বামত দিতে হবে অথবা তার কানে আযান দিতে হবে মর্মে বর্ণিত হাদিসগুলির একটিও ছহীহ নয়। বরং এর কোনটি যঈফ আবার কোনটি মওযূ বা জাল। কেবলমাত্র আযান দেওয়া সংক্রান্ত আবূ রাফে‘ (রাঃ) বর্ণিত অতি প্রসিদ্ধ হাদীছটি সম্পর্কে শায়খ নাছেরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) বলেন, ‘আমি ইতিপূর্বে আবূ রাফে‘ (রাঃ) বর্ণিত এ হাদিসটি হাসান বললেও এখন আমার নিকট বর্ণনাটি যঈফ হিসাবে স্পষ্ট হয়েছে।

২. জন্মকালীন প্রচলিত কুসংস্কার ও বিদ‘আত : শিশু জন্মগ্রহণের সময় আমাদের দেশে অনেক প্রকার কুসংস্কার প্রচলিত আছে। এর কোনটি শিরক আবার কোনটি বিদ‘আত। যেমন-

(১) প্রসব বেদনায় কষ্ট হলে অথবা প্রসবে বিলম্ব হলে গর্ভবতীর দেহে তাবীয-কবয বাঁধা। যা সুস্পষ্ট শিরক। বরং এ সময়ে করণীয় হচ্ছে, অভিজ্ঞ ডাক্তার বা ধাত্রীর সাহায্য নেওয়া।

(২) প্রসূতির ঘরে ছেঁড়া জাল, মুড়ো ঝাড়ু, লোহার বস্তু প্রভৃতি টাঙ্গানো।

(৩) শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর জিন-ভূতের আছর বা মানুষের বদ নজর লাগার ভয়ে হাত, পা বা গলায় তাবীজ-কবজ বেঁধে দেওয়া।

(৪) শিশুকে বদ নজর থেকে রক্ষার জন্য কপালের পাশে কালো ফোঁটা বা টিপ দেওয়া।

(৫) শিশু জন্মের সপ্তম দিনে ‘সাতলা’ অনুষ্ঠান করা।

(৬) শিশু ভূমিষ্ঠের ৪০ দিনে প্রসূতির ‘পবিত্রতা’ অর্জনের জন্য বাড়ী-ঘর ধোয়া-লেপার বিশেষ আয়োজন করা।

যেকোন অবস্থায় সকল প্রকার তাবীয ব্যবহার করা শিরক। সেটা কুরআনের সূরা, আয়াত বা বানোয়াট নকশা দিয়ে লেখা হোক অথবা গাছ-গাছড়া জাতীয় দ্রব্যাদি দিয়ে হোক না কেন। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,

 مَنْ عَلَّقَ تَمِيْمَةً فَقَدْ أَشْرَكَ

যে ব্যক্তি তাবীজ লটকাল সে শিরক করল’

করণীয়: বদ নযর থেকে শিশুদের রক্ষার জন্য রাসূল (ছাঃ) নিম্নোক্ত দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন

-أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّةِ مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ وَّهَامَّةٍ، وَمِنْ كُلِّ عَيْنٍ لاَمَّةٍ- 

‘আঊযু বিকালিমা-তিল্লা-হিত তা-ম্মাতি মিন কুল্লি শাইত্বা-নিন ওয়া হাম্মা-তিন ওয়া মিন কুল্লি ‘আয়নিন লাম্মাহ’। অর্থাৎ আমি আল্লাহর নিকটে পূর্ণ গুণাবলীর বাক্য দ্বারা সকল শয়তান, বিষাক্ত প্রাণী ও ক্ষতিকর চক্ষু থেকে পরিত্রাণ চাই। সকল প্রকার অনিষ্ট থেকে শিশুদের রক্ষার জন্য উক্ত দোয়া ও সাথে সূরা ফালাক্ব ও নাস ৩ বার করে পাঠ করতঃ সকাল-সন্ধ্যায় ঝাড়-ফুঁক করতে হবে। যা বিভিন্ন ছহীহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।

আকিকা করা: শিশু জন্মের সপ্তম দিনে নবজাতকের পক্ষ থেকে যবহ করা পশুকে আকিকা বলা হয়। আকিকা সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

كُلُّ غُلاَمٍ مُرْتَهَنٌ بِعَقِيقَتِهِ تُذْبَحُ عَنْهُ يَوْمَ السَّابِعِ وَيُسَمَّى وَيُحْلَقُ رَأْسُهُ- 

প্রত্যেক শিশু তার আকিকার সাথে বন্ধক থাকে। অতএব জন্মের সপ্তম দিনে শিশুর পক্ষ থেকে পশু যবহ করতে হয়, নাম রাখতে হয় ও তার মাথা মুন্ডন করতে হয়।

ইমাম খাত্ত্বাবী বলেন, ‘আকিকার সাথে শিশু বন্ধক থাকে’-একথার ব্যাখ্যায় ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেন, যদি বাচ্চা আকিকা ছাড়াই শৈশবে মারা যায়, তাহলে সে তার পিতা-মাতার জন্য কিয়ামতের দিন শাফাআত করবে না। কেউ বলেছেন, আকিকা যে অবশ্য করণীয় এবং অপরিহার্য বিষয়, সেটা বুঝানোর জন্যই এখানে ‘বন্ধক’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যা পরিশোধ না করা পর্যন্ত আল্লাহর নিকট সে দায়বদ্ধ থাকে।

অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,

مَعَ الْغُلاَمِ عَقِيقَةٌ فَأَهْرِيقُوا عَنْهُ دَمًا وَأَمِيْطُوْا عَنْهُ الْأَذَى- 

সন্তানের সাথে আকিকা যুক্ত। অতএব তোমরা তার পক্ষ থেকে রক্ত প্রবাহিত কর এবং তার থেকে কষ্ট দূর করে দাও (অর্থাৎ তার জন্য একটি আকিকার পশু যবহ কর এবং তার মাথার চুল ফেলে দাও)।

সপ্তম দিনে আক্বীক্বা দেওয়া সুন্নাত। রাসূল (সাঃ) তাঁর নাতি হাসান ও হুসাইনের আকিকা সপ্তম দিনে করেছিলেন।

ইমাম শাফেঈ বলেন, সাত দিনে আক্বীক্বার অর্থ হ’ল, ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ সাত দিনের পরে আক্বীক্বা করবে না। যদি কোন কারণে বিলম্ব হয়, এমনকি সন্তান বালেগ হয়ে যায়, তাহলে তার পক্ষে তার অভিভাবকের আকিকার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। এমতাবস্থায় সে নিজের আকিকা নিজে করতে পারবে।

যদি কেউ আক্বীক্বা ছাড়াই মারা যায়, তবে তার আক্বীক্বার প্রয়োজন নেই।আর সামর্থ্য না থাকায় পিতা আক্বীক্বা দিতে ব্যর্থ হ’লে তার উপর কোন দোষ বর্তাবে না।

আকিকার পশু হারিয়ে গেলে বা মারা গেলে তার বদলে আরেকটি পশু আকিকা দিবে।

আকিকার পশু: রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,

عَنِ الْغُلاَمِ شَاتَانِ وَعَنِ الْجَارِيَةِ شَاةٌ، لاَ يَضُرُّكُمْ أَذُكْرَانًا كُنَّ أَمْ إِنَاثًا-

নর হোক বা মাদী হোক, ছেলের পক্ষ থেকে দু’টি ছাগল ও মেয়ের পক্ষ থেকে একটি ছাগল আক্বীক্বা দিতে হয়।

সপ্তম দিবসে অন্যান্য করণীয়: শিশু জন্মের সপ্তম দিনে আকিকা করা ছাড়াও নবজাতকের মাথা মুন্ডনের পর চুলের ওজন পরিমাণ রূপা বা রূপার মূল্য পরিমাণ অর্থ ছদকা করা উত্তম।

ইসলামী নামের গুরুত্ব: সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের জন্য, বিশেষভাবে ঈমানদার মুমিনের ক্ষেত্রে নামের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা আরও বেশী। আর তা এজন্য যে, সকল শুভ কাজের সূচনা তাকে তার মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে তথা বিসমিল্লাহ বলে শুরু করতে হয়।

মহান আল্লাহ তাঁর নিজ নামকে এতই ভালবাসেন যে, তিনি বলেন, আল্লাহর সুন্দর সুন্দর নাম রয়েছে, সে নামে তাঁকে ডাকো’ (আ‘রাফ ৭/১৮০)। কিয়ামতের ময়দানে সকল বনি আদমকে আল্লাহ বিচারের জন্য সমবেত করে ডাকবেন পিতা ও পুত্রের নাম ধরে।

অর্থহীন নাম পরিহার করতে হবে: প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর সামনে কোন নবাগত লোক আসলে, তিনি তার নাম জিজ্ঞেস করতেন। ভাল নাম হ’লে সন্তুোষ প্রকাশ করতেন। অপসন্দ হ’লে তা পরিবর্তন করে দিতেন। তিনি অশুভ, ঘৃণাদায়ক, অর্থহীন, অতি বিশেষণমূলক ও আত্মঅহংকার প্রকাশ পায় এমন বহু নামের পরিবর্তন করেছেন। যেমন তিনি আসীয়া (বিদ্রোহীনি, পাপিয়সী) নামটি পরিবর্তন করে বললেন, তুমি জামীলা (সুন্দরী)। বাররাহ (অত্যন্ত ধার্মিকা) নাম পরিবর্তন করে তাঁর নাম রাখেন যয়নাব (সুগন্ধময় ফুল)। হাযন (শক্ত মাটি) নাম পরিবর্তন করে নাম রাখেন সাহল (নরম মাটি)। এভাবে নাম পরিবর্তনের কথা বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।

তাই অর্থহীন নাম আরবী ভাষার হলেও তা পরিবর্তন করতে হবে। খাঁটি বাঙ্গালী সাজতে গিয়ে অনেকে পিতৃপ্রদত্ত আরবী নামের সাথে বাংলা নাম মিশ্রণ করে নামকরণ করে থাকেন। যেমন অমিত হাসান, ফটিক রহমান, অনিক মাহমূদ, শুভ রহমান ইত্যাদি। ইদানীং কেউ কেউ পিতৃপ্রদত্ত আরবী নাম বিকৃত আকারে প্রকাশ করছেন। যেমন মালেক মেহমুদ, শফিক রেহমান, রেহমান সোবহান ইত্যাদি। এভাবে রহমানকে রেহমান, মাহমূদকে মেহমুদ উচ্চারণ করা গুরুতর অপরাধ।

প্রচলিত আরবী ভুল নাম: বাংলাদেশে মুসলিম সমাজে প্রচলিত সব আরবী নামই কিন্তু নির্ভুল নয়। যেমন আল্লাহ ব্যতীত নবী ও রাসূল, পীর, ইমাম প্রভৃতি মাখলূকের নামের পূর্বে আরবী ‘গোলাম’ এবং ফার্সী শব্দ ‘বখ্শ’ (দান) যোগ করে নামকরণ করা। যা শিরক। যেমন আব্দুন্নবী (নবীর দাস), আব্দুর রাসূল (রাসূলের দাস), গোলামুন্নবী (নবীর দাস), গোলাম রাসূল (রাসূলের দাস), গোলাম মুহাম্মাদ (মুহাম্মাদের দাস), গোলাম মোস্তফা (মোস্তফার দাস), আলী বখশ (আলীর দাস), মাদার-বখশ (মাদার বা পীরের দান), গোলাম মহিউদ্দীন (মহিউদ্দীনের দাস), গোলাম হোসায়েন (হোসায়েনের দাস) প্রভৃতি।

যেসব নাম রাখা সর্বোত্তম: ইবনে ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, মহীয়ান-গরিয়ান আল্লাহর নিকটে তোমাদের নামগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রিয়তম নাম হল আব্দুল্লাহ ও আব্দুর রহমান। তদ্রূপ ‘আসমাউল হুসনা’ (আল্লাহর সুন্দর নাম সমূহ)-এর পূর্বে ‘আব্দ’ শব্দ যোগ করে নাম রাখা হলে তা উক্ত হাদীসের মর্মানুযায়ী আল্লাহর নিকট প্রিয় ও পছন্দনীয় হবে ইনশাআল্লাহ। কারণ তাতে আল্লাহর দাসত্ব প্রকাশ পায়।

নাম রাখার ক্ষেত্রে সঠিক নিয়ম: রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, নবীদের নামে নাম রাখ, আল্লাহর কাছে প্রিয় নাম হ’ল আব্দুল্লাহ ও আব্দুর রহমান। সবথেকে যথার্থ নাম হ’ল হারেছ (পরিশ্রমী), হাম্মাম (আগ্রহশীল)। সর্বাধিক নিকৃষ্ট নাম হল হারব (যুদ্ধ) ও মুররা (তিক্ত)।

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com