এশিয়ার সর্ববৃহৎ সাফারি পার্ক ভ্রমণের গাইড
গাজীপুর সাফারি পার্ক বা সাফারি পার্ক: গাজীপুর বাংলাদেশের গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলাধীন মাওনা ইউনিয়নের বড় রাথুরা মৌজা ও সদর উপজেলার পীরুজালী ইউনিয়নের পীরুজালী মৌজার খন্ড খন্ড শাল বনের ৪৯০৯.০ একর বন ভূমি ছোট বড় বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণির জন্য নিরাপদ আবাসস্থল হিসাবে পরিচিত। এর মধ্যে ৩৮১০.০ একর এলাকাকে সাফারী পার্কের মাস্টার প্ল্যানের আওতাভূক্ত করা হয়েছে। গাজীপুর সাফারী পার্ক শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১০ সালে ৬৩.৯৯ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে একনেক কর্তৃক অনুমোদিত হয় এবং পার্ক প্রতিষ্ঠা কার্যক্রম শুরু হয় এবং ২০১১ সালের ২ ফেব্র“য়ারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্ক, গাজীপুর নামে এর আনুষ্ঠানিকভাবে নির্মাণ কার্যক্রম শুরু হয়। প্রকল্পের শুরুতে কোন মাষ্টার প্লান প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় আন্তর্জাতিক মানের সাফারী পার্কে উন্নীত করার লক্ষ্যে একটি মাষ্টার প্লান তৈরী করা হয়। মাষ্টার প্লানে বর্ণিত কার্যক্রম বাস্তবায়ন ও ভূমি অধিগ্রহণের জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যে ৪ অক্টোবর ২০১১ তারিখে ’’বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্ক, গাজীপুর (১ম সংশোধিত) প্রকল্পটি একনেক কর্তৃক বর্ধিত আকারে ২১৯.৮৯ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে অনুমোদিত হয়।
সাফারী পার্কটি দক্ষিণ এশীয় মডেল বিশেষ করে থাইল্যান্ডের সাফারী ওয়ার্ল্ড এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও ইন্দোনেশিয়ার বালি সাফারী পার্কের কতিপয় ধারণা সন্নিবেশিত করা হয়েছে। সাফারী পার্কের চারদিকে নির্মাণ করা হচ্ছে স্থায়ী ঘেরাা এবং উহার মধ্যে দেশী/বিদেশী বন্যপ্রাণীর বংশবৃদ্ধি ও অবাধ বিচরণের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে যাতে পর্যটকগণ চলমান যানবাহনে অথবা পায়ে হেঁটে ভ্রমণ করে শিক্ষা, গবেষণা ও চিত্তবিনোদনের সুযোগ লাভ করবেন। সাফারী পার্কের ধারণা চিড়িয়াখানা হতে ভিন্নতর।
চিড়িয়াখানায় জীবজন্তুসমূহ আবদ্ধ অবস্থায় থাকে এবং দর্শনার্থীগণ মুক্ত অবস্থায় থেকে জীবজন্তু পরিদর্শন করেন। কিন্তু সাফারী পার্কে বন্যপ্রাণীসমূহ উন্মুক্ত অবস্থায় বনজঙ্গলে বিচরণ করবে এবং মানুষ সতর্কতার সহিত চলমান যানবাহনে করে ভ্রমণ করতে পারবে। ৫ আগস্ট ২০২৪, শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় ভাঙচুর ও লুটপাটের কারণে জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ গাজীপুর সাফারি পার্কটি দীর্ঘ ৩ মাস ১১ দিন বন্ধ রাখা হয়। পরবর্তীতে, পার্কটির সংস্কার শেষে ১৫ নভেম্বর ২০২৪ অতীতের নাম (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্ক) পরিবর্তন করে "গাজীপুর সাফারি পার্ক" নামকরণ করে যথারীতি নিয়মে পার্কটি চালু করা হয়।
ঢাকা থেকে ৪০ কিলোমিটার উত্তরে ঢাকা - ময়মনসিংহ মহাসড়কের বাঘের বাজার থেকে ৩ কিলোমিটার পশ্চিমে সাফারী পার্কটির অবস্থান। এর আয়তন ৩৬৯০ একর।
সাফারি কিংডম
৫৫৬ একরের মধ্যে তৈরি করা এই অংশে ঢুকতে গেইটের পাশেই ম্যাকাও ল্যান্ড। এখানে আছে নীল-সোনালি ম্যাকাও, সবুজ ম্যাকাও, আফ্রিকান গ্রে প্যারট, টিয়া, পেলিকেন, লুটিনো রিংনেক প্যারটসহ প্রায় ৩৪ প্রজাতির পাখি। সবগুলোই আফ্রিকা থেকে আনা হয়েছে। ম্যাকাও ল্যান্ডের পাশেই মেরিন অ্যাকুরিয়াম। রয়েছে প্রায় ২০ প্রজাতির মাছ। ক্রোকোডিল ফিস, টাইগার ফিস, লুকিয়ে থাকা ব্ল্যাক গোস, অস্কার। রয়েছে চিকলেট মাছ যা ২০ সেকেন্ড পর পর রং পরিবর্তন করে। এছাড়াও রয়েছে প্রজাপতি সাফারি। যেখানে প্রায় ২৬ প্রজাতির প্রজাপতি রয়েছে। সাফারি কিংডমে রয়েছে প্রকৃতিবীক্ষণ কেন্দ্র, ফ্যান্সি কার্প গার্ডেন, জিরাফ ফিডিং স্পট, আইল্যান্ড, বোটিং ও লেইক জোন।
তাছাড়া অর্কিড হাউজ, শকুন ও পেঁচা কর্নার, এগ ওয়ার্ল্ড, ক্যাঙারু, হাতি শো গ্যালারি। সাফারি কিংডমের পশ্চিমে অংশে আলাদাভাবে নির্মাণ করা হয়েছে বিশালি তিনটি পাখিশালা। ধনেশ পাখিশালায় রয়েছে প্রায় আট প্রজাতির পাখি। এরইমধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির প্যারট, ফিজেন্ট ধনেশ, ফ্লেমিংগো, ব্ল্যাক সোয়ান ও বিরল প্রজাতির মান্ডারিন ডাক ছাড়া হয়েছে।
যাত্রা শুরু: গুলিস্তান থেকে গাজীপুর
আমাদের যাত্রা শুরু হচ্ছে ঢাকার ব্যস্ততম গুলিস্তান এলাকা থেকে। গুলিস্তান থেকে গাজীপুর যেতে জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ৮০ টাকা এবং সময় লাগবে প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা। গাজীপুরে পৌঁছানোর পর, আপনাকে বাঘের বাজারের উদ্দেশ্যে মিনি বাসে যেতে হবে। সেখানে পৌঁছানোর পর অটোর মাধ্যমে সাফারি পার্কে যেতে হবে, যার ভাড়া ২০ টাকা।
সাফারি পার্কে প্রবেশ
সাফারি পার্কে প্রবেশ করতে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ৫০ টাকা, ১২ বছরের নিচে ২০ টাকা এবং ৬ বছরের নিচে বিনামূল্যে প্রবেশ করতে পারবেন। বিদেশীদের জন্য প্রবেশ মূল্য ১০০০ টাকা।
সাফারি পার্কের মানচিত্র
পার্কে প্রবেশ করার পর, হাতের ডানে একটি ডিসপ্লে ম্যাপ দেখতে পাবেন। এই ম্যাপটি আপনাকে পুরো পার্কের স্থানগুলো চিনতে সাহায্য করবে।
মিউজিয়াম এবং কোষ সাফারি
শুরুতে আমরা মিউজিয়ামের দিকে যাই, যেখানে প্রজাপতি কর্নার এবং ফেন্সি কাপ রয়েছে। মিউজিয়ামে প্রবেশ করতে হলে ৬০ টাকা দিতে হবে। এরপর আমরা কোষ সাফারির দিকে এগোই, যা সাফারি পার্কের প্রধান আকর্ষণ। এখানে জনপ্রতি ১৫০ টাকা দিয়ে বাসে করে বন্য প্রাণী দেখতে পারবেন।
কোষ সাফারি: বন্য প্রাণীর দেখা
কোষ সাফারিতে প্রবেশ করার পর, আপনি জিরাফ, জেব্রা, হরিণ, সিংহ, এবং বাঘসহ বিভিন্ন প্রাণী দেখবেন। এই অভিজ্ঞতা সত্যিই অবিস্মরণীয়।
সাফারি কিংডম
কোষ সাফারি শেষে আমরা সাফারি কিংডমে প্রবেশ করি। এখানে আপনার ১০০ টাকার টিকেট দিয়ে ৫টি আলাদা আকর্ষণীয় স্থান দেখতে পারবেন, যেমন প্যারট এভিয়ারি, মেরিন একুরিয়াম, এবং প্রজাপতি বাগান।
বঙ্গবন্ধু স্কয়ার
সাফারি পার্কের ৩৮ একর জায়গা নিয়ে বঙ্গবন্ধু স্কয়ার তৈরি করা হয়েছে। পার্কিং এলাকা, বিনোদন উদ্যান ও প্রশাসনিক কাজে নির্মিত ভবনগুলো বঙ্গবন্ধু স্কয়ারে স্থান পেয়েছে। এছাড়াও এখানে রয়েছে আকর্ষণীয় ম্যুরাল ও মডেল সজ্জিত প্রধান ফটক, ফোয়ারা ও লেক। প্রশাসনিক ভবনগুলোর পাশাপাশি আরও রয়েছে ডিসপ্লে ম্যাপ, পার্ক অফিস, তথ্যকেন্দ্র, বিশ্রামাগার, ডরমেটরি, নেচার হিস্ট্রি মিউজিয়াম, ইকো-রিসোর্ট ইত্যাদি।
কোর সাফারি
১২১৭ একর অঞ্চল জুড়ে গঠিত কোর সাফারি অংশে গাড়ি ছাড়া পর্যটক প্রবেশ সম্পূর্ন নিষেধ। এখানে দর্শনার্থীদের জন্য দুটি জিপ ও দুটি মিনিবাস বরাদ্ধ রাখা হয়েছে। নির্দিষ্ট ফি’র বিনিময়ে যে কেউ গাড়ি বা জিপে প্রাকৃতিক পরিবেশে রাখা বিভিন্ন বন্য প্রাণী দেখতে পারবেন। এখানে বাঘ, সিংহ, কালো ভাল্লুক, আফ্রিকান চিতা, চিত্রা হরিণ, সাম্বার, গয়াল, হাতি, মায়া ও প্যারা হরিণ ছাড়াও অনেক বন্য প্রাণীকে খোলা পরিবেশে ঘুরতে দেখবেন।
বিভিন্ন আকর্ষণীয় স্থান
- ম্যাকাউ ল্যান্ড
- ছোট পাখিশালা
- কুমির পার্ক
- প্রজাপতি বাগান
- ধনেশ এভিয়ারি
- হাতি শালা
- শিশু পার্ক
খরচের বিস্তারিত
এখন চলুন খরচের দিকে তাকাই। গুলিস্তান থেকে গাজীপুর, গাজীপুর থেকে বাঘের বাজার এবং বাঘের বাজার থেকে সাফারি পার্কের মোট খরচ প্রায় ৫০০ টাকার মতো।
- প্রাপ্তবয়স্ক - ৫০ টাকা
- অপ্রাপ্তবয়স্ক (১২ বছরের নিচে) - ২০ টাকা
- ছাত্র/ছাত্রী- ১০ টাকা
- বিদেশী পর্যটক - ১০০০
- শিশু (৩ বছরের নিচে) 0.00 ( ফ্রি )
এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা সফরে আগতদের জন্যে স্পেশাল প্রবেশ ফি রয়েছে। যদি শিক্ষা সফরে আসা শিক্ষার্থীদের গ্রুপ ৪০-১০০ জন হয় তাহলে সবার প্রবেশ করতে ৪০০ টাকা লাগবে। যদি শিক্ষার্থী সংখ্যা ১০০ এর বেশি হয় তাহলে প্রবেশ করতে ৮০০ টাকা লাগবে।
খাবারের ব্যবস্থা
পার্কের ভিতরে বাইরের খাবার নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ। পর্যটকরা “টাইগার রেস্টুরেন্ট” বা “লায়ন রেস্টুরেন্ট” থেকে খাবার কিনতে পারেন। দুপুরের খাবারের মূল্য ২২০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে।
পার্কিং ভাড়া
প্রতিটি বাস, কোচ বা ট্রাক এর পার্কিং ভাড়া ৪০০ টাকা। মাইক্রোবাস বা মিনি বাসের পার্কিং ভাড়া ২০০ টাকা। জিপ, প্রাইভেট কার পার্কিং ভাড়া ১০০ টাকা। অটোরিক্সা বা সিএনজির পার্কিং ভাড়া ৫০ টাকা ও মোটরসাইকেল ২৫ টাকা।
সাফারি পার্কের সময়সূচি
গাজীপুর সাফারি পার্ক মঙ্গলবার ছাড়া সপ্তাহের ছয় দিন সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত খোলা থাকে। সপ্তাহের প্রতি মঙ্গলবার পার্কটি বন্ধ থাকে। পুরোটা ঘুরে দেখতে চাইলে সারাদিন চলে যাবে। তাই সবচেয়ে ভালো হয় যদি সকাল সকাল চলে যান। তাহলে আরামে সারাদিন ঘুরে ঘুরে সব অংশ দেখতে পারবেন।
বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের বন্ধের দিন
সাফারি পার্কের মূল আকর্ষণ
বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক ৬টি প্রধান বিভাগে বিভক্ত:
- কোর সাফারি
- সাফারি কিংডম
- বায়োডাইভারসিটি পার্ক
- এক্সটেনসিভ এশিয়ান সাফারি পার্ক
- বঙ্গবন্ধু স্কয়ার
- চিলড্রেন’স পার্ক
এই বিভাগগুলিতে পর্যটকরা বিভিন্ন ধরনের বন্যপ্রাণী ও পাখি দেখতে পারেন। এখানে রয়েছে ৮টি বাঘ, ৪টি সিংহ, ১৫০টি হরিণ, ৬টি মায়া হরিণ, ৬টি সাম্বার হরিণ, ১১টি গয়াল, ৩০টি জেব্রা, ২টি জিরাফ, ১২টি নীলগাই, ১৪টি ভালুক, ২০০টি টিয়া পাখি, ১১টি উটপাখি এবং ৮টি মদনটাক।
নিষেধাজ্ঞা এবং নিরাপত্তা
সাফারি পার্কে প্রবেশের সময় কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। যেমন, প্রাণীদের কাছে যেতে বা তাদের খাবার দেওয়া নিষিদ্ধ। এছাড়াও, সাফারি চলাকালীন সময়ে বাসের বাইরে বের হওয়া যাবে না।
কী পরিধান করবেন
সাফারি পার্কে যাওয়ার সময় হালকা রঙের কাপড় পরিধান করা ভালো। এছাড়াও, সানগ্লাস, হ্যাট এবং জল নিয়ে যাওয়া উচিত। সাফারি পার্ক ভ্রমণের শেষে আপনাদের বাঘের বাজারে ফিরে যেতে হবে। সেখান থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবেন।
এশিয়ার সবচেয়ে বড় সাফারি পার্ক ভ্রমণ একটি চমৎকার অভিজ্ঞতা। এখানে আসলে প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার এক অনন্য সুযোগ পাবেন। আশা করি, এই ব্লগটি আপনাদের সাফারি পার্ক ভ্রমণে সাহায্য করবে।
পর্যটকদের জন্য পরামর্শ
- পানীয়ের বোতল, পলিথিন বা কোন অপচনশীল দ্রব্যসহ, যেকোন আবর্জনা নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে ফেলুন।
- বাঘ ও সিংহের পরিদর্শনকালে চলন্ত গাড়ি থেকে নামবেন না।
- হিংস্র বন্য প্রাণীর খাচা থেকে দূরে থাকবেন।
- সতর্কতা বার্তা যেখানে যা লিখা আছে মেনে চলুন।
- মাইক বাজানো বা উচ্চ শব্দ সৃষ্টিকারী কোন যন্ত্র ম্যবহার করবেন না।
- বিশ্রামাগার ব্যবহার করতে চাইলে অগ্রিম বুকিং দিয়ে নিন।
- বন্যপ্রাণিদের খাবার প্রদান থেকে বিরত থাকুন।
- বাইরে থেকে কোন খাবার নিয়ে পার্কে প্রবেশ করা যাবেনা।
যোগাযোগ
বন সংরক্ষক বন্য প্রানী ও প্রক্তি সংরক্ষক অঞ্চল বন ভবন, আগারগাও, ঢাকা
মোবাইল: +88-01727-329816
পিকনিক, স্পট বুকিং ও যে কোন প্রয়োজনে: 01973-000044, 01823-000044, 01823-004484
E-mail: safarikarpgazipur@gmail.com
Facebook Page: https://www.facebook.com/safariparkgazipur
ওয়েবসাইট: safariparkgazipur.info.bd
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com