Breaking News

ছোটবেলার ভালোবাসা


প্রথম স্কুলের দিনগুলো ছিল জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুত yet সুন্দর সময়। তখন জীবন ছিল একরঙা, অথচ সেই একরঙার মধ্যে নানা রকম অনুভূতির মিশেল ছিল। আমাদের গ্রামটিতে তখন আধুনিকতার ছোঁয়া তেমন ছিল না। গ্রামের রাস্তা, গাছপালা, ছোট ছোট বাড়ি আর স্কুলের মাঠ ছিল আমাদের পৃথিবী। সেখানেই শুরু হয়েছিল আমার ছোটবেলার ভালোবাসার গল্প।

স্কুলের প্রথম দিন যখন মা আমাকে নিয়ে গিয়েছিল, আমি অদ্ভুত এক অনুভূতি নিয়ে স্কুলে পা রেখেছিলাম। প্রথমবারের মতো আলাদা হয়ে যেতে হবে মায়ের কাছে, নতুন পরিবেশ, নতুন শিক্ষক, নতুন বন্ধু। কিন্তু সব কিছুই যেন একটু অদ্ভুত আর নতুন ছিল। তখনকার সেই দিনগুলোতে, স্কুলের বেঞ্চগুলো, শিক্ষক-শিক্ষিকা, সহপাঠীদের মুখমন্ডল সবই ছিল এক নতুন পৃথিবীর মতো। ঠিক সেই সময়ই আমার চোখে পড়েছিল একটি মিষ্টি মুখ। তার নাম ছিল সুমি।

সুমি ছিল আমার ক্লাসের প্রথম বাচ্চা, আর তার মুখ ছিল যেন একটি ফুলের পাপড়ি। ছোট্ট, সাদা জামা আর সোনালি চুলের সুমি ছিল খুবই হাস্যোজ্জ্বল। তার হাসি ছিল মধুর, এমনভাবে হাসত যেন পুরো পৃথিবী হাসছে। প্রথম দিন থেকেই সুমি আমার চোখে পড়ল। সে কখনো আমাকে চোখে চোখে দেখে না, তবে আমি তাকে সবসময় খুঁজতাম। স্কুলের সময়ে আমাদের মধ্যে অনেক কিছুই হতো না, তবে তার সেই মিষ্টি হাসির পেছনে একটা চিরন্তন রহস্য ছিল, যা আমি বোঝার চেষ্টা করতাম।

আমার মতো সুমিরও সেদিনের মতো প্রথম স্কুলে আসা। কিন্তু সুমি ছিল একটু বেশী স্মার্ট, একটু বেশী আত্মবিশ্বাসী। সুমি জানত কিভাবে সবাইকে সাথে নিয়ে চলতে হয়, তার সঙ্গে কথা বলার জন্য সবাই যেন মুখিয়ে থাকত। আর আমি, একটু লাজুক, একটু অগোছালো, সুমি আমাকে প্রায়ই হাসাতে থাকত। কখনো সে আমার সঙ্গে খেলত, কখনো আবার কোনো অদ্ভুত প্রশ্ন করত। একদিন সুমি বলল, "তুমি কি জানো, সিংহের মুখে কী আছে?" আমি ভাবলাম, "এটা কি ধরনের প্রশ্ন?" কিন্তু সুমি তখন বলেছিল, "সিংহের মুখে রয়েছে তার রাজত্বের অহংকার।"

সুমি যে ছেলেমানুষি প্রশ্নগুলো করত, তা আমাকে হাসানোর জন্যই ছিল। আর আমি সেগুলো কখনো মনে মনে ভাবতাম, কখনো আবার সরাসরি বলতাম। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার ছিল, স্কুলের খেলার সময়, সুমি আর আমি একসঙ্গে ক্রিকেট খেলার চেষ্টা করতাম। যদিও আমি একেবারেই ভালো খেলতাম না, তবুও সুমি আমাকে নিজের দলের সদস্য হিসেবে নিতো। তার ছোট ছোট পায়ে যখন ব্যাট ধরতো, তখন তার মধ্যে একটা বিশেষ মায়া ছিল।

দিন চলছিল, বছরের পর বছর পার হচ্ছিল। সুমির সঙ্গে আমার সম্পর্কটা খুবই ভালো ছিল, তবে আমি কখনো তাকে বলিনি যে আমি তাকে ভালোবাসি। ভালোবাসার অনুভূতি তখন খুবই অগোছালো ছিল। তবে একদিন, যখন আমরা দশম শ্রেণীতে পড়ি, এক বিকেলে স্কুলের মাঠে বসে থাকতে থাকতে সুমি বলল, "তুমি জানো, তুমি আর আমি অনেক ভালো বন্ধু।" আমি মুচকি হেসে বলেছিলাম, "হ্যাঁ, সুমি। আমরা তো অনেক ভালো বন্ধু।"

তারপর সুমি বলেছিল, "আচ্ছা, তুমি কখনো ভাবো, যদি আমাদের জীবনে কিছু ভুল হয়ে যায়, কিছু হারিয়ে যায়, তাহলে কী হবে?" আমি তাকে চোখে চোখে দেখেছিলাম, সুমি তখন খুবই সিরিয়াসভাবে বলেছিল। আমি কিছু না বলে মাথা নেড়ে সুমি বললাম, "সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে, সুমি।" কিন্তু সত্যি বলতে, আমি জানতাম না কীভাবে এই অনুভূতি প্রকাশ করব, কিভাবে তাকে বলব যে, ছোটবেলা থেকেই আমি তাকে ভালোবাসি।

এভাবেই স্কুলের দিনগুলো একসাথে কেটেছিল। কিন্তু সুমি একদিন আমাকে বলেছিল যে তার পরিবারের জন্য তারা অন্য শহরে চলে যাবে। আমি খুবই দুঃখিত হয়েছিলাম, কিন্তু কিছুই করতে পারলাম না। সুমি চলে গেল, আর আমার মনটা খুব ভারী হয়ে গেল। সে চলে যাওয়ার পর, স্কুলের সেই পরিচিত মঞ্চ, সবার হাসির আওয়াজ সবকিছুই যেন অচেনা হয়ে গিয়েছিল। সুমি ছিল আমার ছোটবেলার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। সে চলে যাওয়ার পর, আমি জানতাম না কখনো তাকে আবার দেখব কিনা। তবে সুমি চলে যাওয়ার পরেও আমার মনের মাঝে তার হাসি, তার মুখ, তার ভালোবাসা যেন বেঁচে ছিল।

আজও সেই ছোটবেলার ভালোবাসার গল্পটিকে মনে করলে এক অদ্ভুত সুখ অনুভব হয়। হয়তো তখন আমরা কিছুই বুঝতাম না, তবে আজও আমি জানি, সুমির সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত ছিল আমার জীবনের অমূল্য রত্ন। সে চলে গিয়েছিল, কিন্তু তার উপস্থিতি আমার জীবনে চিরকাল রয়ে গেছে। সুমির ছোটবেলার সেই হাসি, সেই স্নিগ্ধতা, সেই নির্দোষ ভালোবাসা এখনও আমার হৃদয়ে বাস করে।

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com