প্রথম দেখায় প্রেম
জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত থাকে, যেগুলো এক মুহূর্তেই বদলে দেয় তোমার পৃথিবী। একটি চোখের দেখা, একটি হাসির বিনিময়, এমনকি একটি শব্দই কিছু সময়ে হয়ে দাঁড়ায় জীবনের মোড় পরিবর্তনের কারণ। এমনই একটি ঘটনা ঘটেছিল আমার জীবনে, যখন আমি প্রথমবারের মতো প্রেমে পড়েছিলাম। কীভাবে, কখন, আর কোথায় তা হয়েছিল—এটি এমন একটি গল্প, যা আজও আমার হৃদয়ে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে।
তখন আমি কলেজে পড়তাম, সবে প্রথম বর্ষ শেষ করেছি। কলেজের জীবন আমার কাছে এক ধরনের রহস্যের মতো ছিল, যেখানে নতুন নতুন বন্ধু, নতুন নতুন পরিবেশ এবং বিভিন্ন ঘটনা ঘটছিল। কিন্তু তার মধ্যেও আমি মনে করতাম, জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হলো নিজে ভালো থাকা এবং পড়াশোনায় মনোনিবেশ করা। তবে, আমার সেই একঘেয়ে জীবনে একদিন এমন একটি ঘটনা ঘটল, যা আমি কখনো ভুলতে পারব না।
এটা ছিল ১৮ অক্টোবর, শীতের মৌসুমের শুরু। সকালটা বেশ সুন্দর ছিল, গাঢ় নীল আকাশ, মৃদু বাতাস, এবং সোনালী রোদে আলোকিত ছিল ক্যাম্পাসের সিঁড়ি। সেই দিনটা আমি একটু ভিন্নভাবে শুরু করেছিলাম, কারণ আমি ঠিক করেছিলাম যে, আজকেই আমার প্রজেক্টের কাজ শেষ করে ফেলব। আমি যেন একটু বেশি উদ্যমী হয়ে উঠেছিলাম। কলেজে আসার পর, বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে যখন ল্যাবের দিকে যাচ্ছিলাম, তখন হঠাৎই চোখে পড়ল একজন নতুন ছাত্রী। তার উপস্থিতি এমনভাবে আমার সামনে এল, যেন পুরো দুনিয়া থমকে গিয়েছিল। তার হাঁটার ভঙ্গি, তার মাথার সোজা অবস্থান, আর তার সাদা রঙের কটন শার্ট আর জিন্স—সবকিছুই যেন একটি বিশেষ মাধুর্য তৈরি করছিল।
সে সবে কলেজে ভর্তি হয়েছিল। তার নাম ছিল রিতু। প্রথম দেখাতেই কিছু একটা ছিল, যা আমাকে আটকে রেখেছিল। তার সোজা চোখ, লম্বা চুল, এবং সেই শান্ত হাসি যেন আমার হৃদয়ে এক অদ্ভুত কম্পন সৃষ্টি করছিল। আমি যেন বুঝতে পারছিলাম না কেন, তবে ওই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, কিছু একটা ঘটতে চলেছে। যাই হোক, সে চলে গেল এবং আমি আমার পথ ধরলাম। কিন্তু তার কথা মাথা থেকে চলে যাওয়ার নামই ছিল না। মনে হচ্ছিল, কিছু একটা খুঁজে পেয়েছি, যা আমার জীবনে ছিল না।
দিন কয়েক পর, একদিন লাইব্রেরিতে বসে পড়াশোনা করছিলাম। আচমকা আমি লক্ষ্য করলাম, রিতু এসে আমার পাশে বসেছে। সে একেবারে সোজা বসে, বই খুলে পড়তে শুরু করল। আমি জানতাম না কীভাবে তাকে কথা বলানো যাবে, কারণ আমি আগে কখনো তাকে ভালোভাবে চিনতাম না। তবে সাহস জোগালাম এবং বললাম, “হাই, তুমি কি এখানে পড়াশোনা করতে আসো?” রিতু একটু মাথা তুলে আমার দিকে তাকাল এবং মৃদু হাসি দিয়ে বলল, “হ্যাঁ, এই প্রজেক্টের কাজটা শেষ করতে হবে। তুমি?” আমি বললাম, “আমি তো এখনো কিছুই শুরু করি নি। তবে দেখা যাক।”
তারপর থেকে প্রতিদিন আমরা একসাথে লাইব্রেরিতে পড়তে শুরু করলাম। প্রথম প্রথম বেশ সাধারণভাবে কথা হতো, কিন্তু একটু একটু করে আমরা একে অপরকে জানতাম। রিতু খুবই মেধাবী, কিন্তু বেশ শান্ত এবং গম্ভীর ধরনের। সে কখনো খুব বেশি হাসত না, কিন্তু যখনই হাসত, তার মুখে এক ধরনের কোমলতা ফুটে উঠত। তার হাসি আমাকে বরাবরই এক অদ্ভুত শান্তি দিত। একদিন, আমি তাকে বললাম, “তুমি খুব মেধাবী, রিতু। আমি কখনো তোমার মতো এত ভালোভাবে পড়াশোনা করতে পারব না।” সে মৃদু হাসল এবং বলল, “ধন্যবাদ, তবে তুমি যদি একটু বেশি মনোযোগী হতে, তুমি আমার থেকেও ভালো করতে পারবে।”
এভাবেই আমরা একে অপরের সাথে সময় কাটাতে শুরু করলাম। একদিন রিতু বলল, “তুমি জানো, আমি ছোটবেলায় খুব ভীতু ছিলাম। নতুন জায়গায় গিয়ে নতুন বন্ধু বানানো, সবসময়ই কঠিন মনে হতো। কিন্তু কলেজে এসে ধীরে ধীরে আমি অনেক কিছু শিখতে শুরু করেছি।” তার কথা শুনে আমি মনে মনে ভাবলাম, কিভাবে সে এত সুন্দরভাবে নিজের জীবনের কঠিন সময়গুলো কাটিয়েছে। আর ঠিক তখনই, আমি বুঝতে পারলাম, রিতু আমার কাছে বিশেষ কিছু হয়ে উঠেছে। আমি তার সম্পর্কে আরো জানতে চাইছিলাম, তার জীবনের গল্প শুনতে চাইছিলাম। কিন্তু একে অপরকে জানার এই প্রক্রিয়া খুবই ধীরে ধীরে চলছিল।
একদিন বিকেলে, আমরা ক্যাম্পাসে হেঁটে যাচ্ছিলাম। সেদিন আকাশে মেঘ ছিল এবং কিছুটা ঠাণ্ডাও পড়েছিল। আমি রিতুকে বললাম, “এটা মনে হচ্ছে, এক ধরনের মেলানকোলি আবহাওয়া, না?” রিতু সেদিন কিছুটা ভিন্ন মেজাজে ছিল, যেন কিছু মনে করছিল। সে বলল, “হ্যাঁ, কখনো কখনো মনে হয়, পৃথিবীটা এত বড়, আর আমাদের জীবনের কিছু কিছু মুহূর্ত আসলে হারিয়ে যায়।” তার কথা শুনে আমি চুপ হয়ে গেলাম। আমি জানতাম না কীভাবে তার মনের গহীনে প্রবেশ করতে হবে। তবে আমার মধ্যে এমন একটা অনুভূতি তৈরি হচ্ছিল, যে অনুভূতি আমি আগে কখনো অনুভব করিনি।
এদিন, রিতু আর আমি ক্যাম্পাসের এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিলাম, হালকা বাতাস আমাদের মুখে লাগছিল। সেদিনের সেই বিশেষ মুহূর্তে, আমি জানতাম, কিছু একটা ঘটছে, কিছু একটা বদলে যাচ্ছে। আমি আর রিতু একে অপরকে একটু বেশী বুঝতে শিখছি। আমাদের কথা, আমাদের সময় একে অপরের সাথে কাটানো—এগুলো যেন হয়ে উঠছিল জীবনের এক অপরিহার্য অংশ। আমাদের মধ্যে একটা দারুণ সম্পর্ক তৈরি হচ্ছিল, যদিও আমি জানতাম না যে, সেটা ভালোবাসা কিনা।
অতঃপর একদিন, আমি রিতুকে বললাম, “তুমি জানো, আমি খুবই অদ্ভুত কিছু অনুভব করছি তোমার জন্য। আমি জানি না, এটা কি... কিন্তু এমন কিছু যেন হচ্ছে। তুমি জানো, প্রথম দেখায় প্রেমে পড়া কেমন লাগে?” রিতু আমার দিকে তাকাল, এবং কিছু সময় নীরব থেকে বলল, “হ্যাঁ, এটা খুবই অদ্ভুত, কিন্তু আমি জানি, আমি মনে মনে তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তবে, আমাদের জীবনে অনেক কিছু অপেক্ষা করছে, তাই এখনই কিছু তাড়াহুড়া করার দরকার নেই।”
আমাদের প্রথম দেখা, প্রথম কথা, প্রথম হাসি—সব কিছু যেন ধীরে ধীরে একটা এক্সপ্রেশন হয়ে উঠেছিল। তবে, ঠিক সেই মুহূর্তে, আমি জানতাম, আমরা একে অপরকে গভীরভাবে অনুভব করি। প্রথম দেখায় প্রেমের সেই মধুর মুহূর্ত কখনোই আমার স্মৃতির পাতায় মুছে যাবে না। এটি ছিল জীবনস্মৃতির এক অমূল্য রত্ন, যা হয়তো শুধু আমরাই জানতাম, কিন্তু তার পরও, সেটি কখনো ভুলতে পারব না।
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com