বয়সের ছাপ দূর করার কিছু অসাধারণ ঘরোয়া উপায়
বয়স ৩০-এর কোঠায় আসতেই চোখের কোণায়, কপালে, নাকের পাশ ঘেষে আপনার মুখমণ্ডলের চামড়া কুচকে যেতে পারে। একে বলিরেখা বলা হয়, ইংরেজিতে এজ রিংকাল। শুষ্ক তাপমাত্রা বা সূর্যের রশ্মির সংস্পর্শে এলে, অতিরিক্ত ডায়েট, ধূমপানের অভ্যাস বা অতিমাত্রায় উদ্বেগ ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে বলিরেখা বয়সের আগেই চেহারায় ছাপ ফেলতে পারে।
কিছু স্বাস্থ বিশেষজ্ঞের মতে:- বয়স বাড়ার সাথে সাথে ত্বকে বয়সের ছাপ দেখা দিতে শুরু করে। বলিরেখা, ফাইন লাইন, ডার্ক সার্কেল-এই সব সমস্যা ত্বকে অল্প বয়সেই দেখা দিতে পারে। তবে কিছু প্রাকৃতিক উপায় অনুসরণ করলে আপনি ঘরোয়া উপায়ে বয়সের ছাপ কমাতে পারেন এবং ত্বককে আরও সুন্দর ও সতেজ রাখতে পারেন।
আয়ুরবেদিক বিশেষজ্ঞের মতে:- বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ত্বকের কোলাজেন ও ইলাস্টিন নামক দুটি প্রোটিনের উৎপাদন কমে যায়। এই দুটি প্রোটিন ত্বককে তার স্থিতিস্থাপকতা ও দৃঢ়তা প্রদান করে। ফলে ত্বক শুষ্ক ও পাতলা হয়ে যায় এবং এর ফলে বলিরেখা দেখা দেয়।
বয়সের ছাপ দূর করার কিছু অসাধারন ঘরোয়া উপায়
ওটমিল, দই ও মধুর মাস্ক: ওটমিল একটি চমৎকার প্রাকৃতিক ময়েশ্চারাইজার যা ত্বকের অস্বস্তিকর ভাব এবং বলিরেখা কমাতে সাহায্য করে। এটি ত্বকের অতিরিক্ত তেল কমাতে সাবানের মতোও কাজ করে থাকে। মধু ও দইয়ের সঙ্গে মিক্স হয়ে এটি ডেড সেল পরিষ্কার করে এবং চেহারায় তারুণ্য ধরে রাখে। এই মাস্কটি তৈরি করতে আপনাকে কেবল ১ টেবিল চামচ ওটমিল, দই এবং মধু মেশাতে হবে। মিশ্রণটি ১৫ থেকে ২০ মিনিটের জন্য মুখে লাগিয়ে নিন। এরপর হালকা গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
মধু ও লেবুর প্যাক: মধু ত্বকের জন্য একটি প্রাকৃতিক ময়েশ্চারাইজার। এটি ত্বককে আর্দ্র রাখে এবং বলিরেখা কমাতে সহায়তা করে। লেবু একটি প্রাকৃতিক স্কিন ব্রাইটনার। মধু এবং লেবুর রস মিশিয়ে মুখে লাগান এবং ১৫ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন। এটি ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে সাহায্য করবে এবং বয়সের ছাপ কমাবে।
কলার মাস্ক: কলা ত্বককে সতেজ রাখতে সাহায্য করে। এই মাস্কটি বাসায় তৈরি করা সবচেয়ে সহজ মাস্কগুলোর মধ্যে একটি। এটি তৈরি করার জন্য শুরুতে একটি কলা নিয়ে তা মসৃণভাবে ভর্তা করতে হবে। আপনার ত্বক যদি খুব শুষ্ক হয় তবে কিছু টক দই যোগ করতে পারেন। এটি আপনার মুখে ৩০ মিনিটের জন্য মেখে নিন। তারপর পানি দিয়ে ভালোমতো ধুয়ে ফেলুন। আপনার প্রয়োজনের ওপর নির্ভর করে সপ্তাহে কয়েকবার এটি ব্যবহার করতে পারেন।
সানস্ক্রিন: বয়সের ছাপ কমাতে নিয়মিত সানস্ক্রিন ব্যবহার সবচেয়ে ভালো উপায়। সূর্যালোক ত্বকের বয়সের ছাপ বাড়ায়, বলিরেখা ও অন্যান্য দাগকে স্পষ্ট করে তোলে। সূর্যের ক্ষয় থেকে বাঁচতে, বয়সের ছাপ ধীর করতে এবং ত্বক সুস্থ রাখতে নিয়মিত এসপিএফ ৩০ যুক্ত সানস্ক্রিন ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়।
ঘুম: শরীর পুনর্গঠনের জন্য পর্যাপ্ত ঘুম আবশ্যক। ঘুম বয়সের ছাপ, দাগছোপ ও ত্বকের ভাঁজ কমায়। দৈনিক সাত থেকে নয় ঘন্টা ঘুম প্রয়োজন। ঘুমের স্বল্পতা ও মানসিক চাপ বয়সের ছাপ কমাতে সহায়তা করে।
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা বাড়ায় এবং অকালে বয়সের ছাপ পড়া রোধ করে। প্রচুর শাক সবজি ও ফল যেমন- মরিচ, ব্রকলি, গাজর, ডালিম, বেরি, ইত্যাদি খাওয়া উপকারী। এছাড়াও গ্রিন টি এবং জলপাইয়ের তেল খাওয়া এক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
অতিরিক্ত রাত জাগার অভ্যাস থাকলে ধীরে ধীরে কমিয়ে ফেলা: ঘুম শরীরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ঘুমের মাধ্যমে আমাদের শরীর পুনরায় কর্মক্ষম হয়। আমাদের ত্বকের কোষ পুনর্গঠন ছাড়াও অন্যান্য ত্বকের সমস্যাও ঘুমানোর মাধ্যমে ধীরে ধীরে দূর হতে পারে। প্রত্যেকের জন্য ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো খুবই প্রয়োজন। অতিরিক্ত রাত জাগা শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর। চোখের চারপাশে কালো দাগ, চোখ গর্তে চলে যাওয়া, ত্বকের মলিনতা এ সব কিছুই হয়ে থাকে রাত জেগে থাকার কারণে। তাই ত্বকের তারুণ্য ধরে রাখতে রাতে অতিরিক্ত জেগে থাকা কমিয়ে ফেলুন এবং দ্রুত ঘুমানোর অভ্যাস তৈরি করুন।
নারকেল তেল: নারকেল তেল ত্বকের জন্য একটি ভালো ময়েশ্চারাইজার। এটি ত্বককে নরম করে এবং বলিরেখা কমাতে সাহায্য করে।
অলিভ অয়েল: অলিভ অয়েল ত্বকের জন্য একটি ভালো অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এটি ত্বকের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে এবং বলিরেখা কমাতে সাহায্য করে।
প্রতিদিন অন্তত একটি হলেও ফল খাওয়া: আমরা সবাই জানি, ফলমূলে থাকা বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ও নিউট্রিয়েন্ট আমাদের শরীরের জন্য কতটা জরুরি। বিভিন্ন ধরনের ফল ত্বকের কোলাজেন বৃদ্ধি করে ত্বকের তারুণ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। তাই অন্ততপক্ষে একটি হলেও ফল প্রতিদিন খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। যেকোনো ধরনের ফলই আপনি খেতে পারেন, মৌসুমি ফল থেকে শুরু করে কলা, সফেদা, পেঁপে ইত্যাদি। ত্বকের তারুণ্য ধরে রাখতে ফল খাওয়ার অভ্যাস শুরু করুন, কিছুদিন পর পার্থক্য নিজেই বুঝতে পারবেন।
ঘরোয়া স্ক্রাবিং: ত্বকে এক্সফোলিয়েশন খুব গুরুত্বপূর্ণ। ডিমের সাদা অংশ এবং চিনি মিশিয়ে একটি স্ক্রাব তৈরি করুন এবং মুখে হালকা হাতে ঘষুন। এটি ত্বকের মৃত কোষ দূর করে ত্বককে মসৃণ এবং তারুণ্যদীপ্ত রাখবে।
শরীরচর্চা: নিয়মিত শরীরচর্চা ত্বকে রক্ত সঞ্চালন বাড়ায় এবং ত্বককে স্বাস্থ্যকর রাখে।
ধূমপান পরিহার: ধূমপান ত্বকের ক্ষতি করে এবং বলিরেখা তৈরির কারণ।
মুলতানি মাটি: মুলতানি মাটি ত্বকের শিথিলতা দূর করতে বেশ কার্যকর। এটি তৈলাক্ত ত্বকের সমস্যাও দূর করে। মুলতানি মাটির সঙ্গে ডিমের সাদা অংশ আর দই ভালো করে মিশিয়ে মুখে মেখে নিন। এরপর তা শুকিয়ে গেলে জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
ক্যাস্টর অয়েল: ক্যাস্টর অয়েল ত্বকের জন্য উপকারী। এটির এক ধরনের নিরাময় ক্ষমতা রয়েছে, যা ত্বকের বলিরেখা ও অন্যান্য দাগ সারিয়ে তারুণ্য নিয়ে আসে। দিনে দুবার কয়েক ফোঁটা ক্যাস্টর অয়েল মুখে মেখে নিন এবং প্রতিবার ১০ মিনিটের জন্য আলতোভাবে ম্যাসাজ করুন। ৩ থেকে ৪ সপ্তাহের মধ্যেই এর সুফল পেতে পারেন।
চিনিযুক্ত ও কার্বোনেটেড সফট ড্রিংকস এড়িয়ে চলা: অতিরিক্ত চিনিযুক্ত জুস, যেমনঃ ফলের জুস বা কার্বোনেটেড সফট ড্রিংকস ত্বক ও শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর। অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার ত্বকের কোলাজেন ভেংগে ফেলে। এর বদলে বাসায় তৈরি অল্প চিনিযুক্ত মিল্কশেক, কফি, আইসড টি, ইয়োগার্ট শেক খেতে পারেন।
বাইরের অতিরিক্ত তেল মশলাযুক্ত ও ভাজাপোড়া খাবার এড়িয়ে চলা: বাইরের খাবার একে তো হাইজেনিক নয়, তার উপর এসব প্রসেসড খাবারে থাকে অতিরিক্ত মশলা, লবন, চিনি, তেল ইত্যাদি। বাইরের খাবার খাওয়ার অতিরিক্ত প্রবণতা একদিকে যেমন ওজন বাড়ায়, অপরদিকে অ্যাসিডিটি তৈরি করে এবং ত্বকের স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে নষ্ট করে ফেলে। তাই বাহিরের খাবার গ্রহণের অভ্যাস ধীরে ধীরে কমিয়ে ফেলুন। একই সাথে ভাজাপোড়া খাবার ও প্যাকেটজাত খাবার খাওয়ার পরিমাণও কমিয়ে আনুন। সবসময় বাড়িতে বানানো খাবার খান। চেষ্টা করুন ব্যালেন্সড ডায়েট মেনটেইন করার।
পর্যাপ্ত পানি: পান ত্বককে আর্দ্র ও কোমল রাখতে পর্যাপ্ত পানি পান করার বিকল্প নেই। পানি ত্বকের কোষগুলোকে ভেতর থেকে সজীব করে এবং ত্বকের নমনীয়তা বজায় রাখে। প্রতিদিন অন্তত আট গ্লাস পানি পান করা উচিত। এতে ত্বকের বলিরেখা কমে ত্বকে হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত।
ত্বক ভালো রাখতে আমলকির ব্যবহার: রূপচর্চার কাজে যেসব জিনিস কার্যকরী তার ভেতরে অন্যতম হলো আমলকি। এটি শুধু ত্বকই নয়, চুলের যত্নেও সমান কার্যকরী। শরীরে জমা দূষিত পদার্থ বের করে দিতে কার্যকরী এই আমলকি। এতে থাকা প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বকে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি সারাতে কাজ করে। যে কারণে রূপচর্চার উপাদান হিসেবে আমলকি রাখলে তা আপনার চেহারায় বয়সের ছাপ পড়তে দেবে না।
নারিকেল তেল ব্যবহার করবেন যে কারণে: সাধারণ নারিকেল তেল নয়, ভার্জিন কোকোনাট অয়েল ব্যবহার করবেন ত্বকের যত্নে। কারণ এই তেলের সবটুকু গুণ বজায় থাকে। সাধারণ নারিকেল তেল উত্তাপের সংস্পর্শে এলে অনেক পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়ে যায় এবং যে কারণে এর কার্যকারিতাও কমে যায়। ত্বকের যত্নে ভার্জিন কোকোনাট অয়েল ব্যবহার করলে তা আপনার চেহারায় উজ্জ্বলতা ধরে রাখবে।
পরিশেষে, বয়সের ছাপ দূর করতে প্রাকৃতিক উপায়গুলি আপনাকে দীর্ঘদিন ধরে কার্যকরী ফল দিতে পারে। তবে মনে রাখবেন, এই উপায়গুলির পাশাপাশি পর্যাপ্ত পানি পান করা এবং সুষম খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা ত্বকের সৌন্দর্য ধরে রাখতে অত্যন্ত জরুরি।
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com