Breaking News

ইন্ধুবালা । পর্ব - ০৫



তখন ভর দুপুর।ক্লান্তি মাখা দেহটা নিয়ে বাড়ির আঙিনায় প্রবেশ করলেন সৈয়দ উল্লাহ্।বারান্দার চেয়ারে বসে গলা ছেড়ে ডাকলেন তার বিবি সরলা বানুকে।হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলেন তার বিবি সরলা বানু। স্বামীর ক্লান্তি মাখা গোমরা মুখখানা দেখে আঁতকে উঠলেন তিনি।আঁধারে নিমজ্জিত হল তার ছোট্ট কোমল হৃদয়খানা।স্বামীকে তড়িঘড়ি স্টীলের গ্লাসে করে ঠান্ডা পানি এগিয়ে দিলেন।পাশে বসে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন মুখখানার দিকে।বললেন,"আপনার মুখখানা এত ক্লান্তি দেখাচ্ছে কেন?পরিশ্রম কি আজ বেশি পরেছে।"

পানির গ্লাসটি নৈঃশব্দ্য পাশে রাখলেন সৈয়দ।স্ত্রীর হাতখানা তখন ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন।আশ্চর্য হয়ে তাকাল তার বিবি সরলা বানু।সহসা এই লোকটাকে কাঁদতে দেখা যায় না।অতিরিক্ত কস্ট সহ্য করতে না পারলে বেচারা কেঁদে ফেলে।তাহলে কি তিনি আজ অতিরিক্ত কস্ট পেয়েছেন?তিনি আর ধৈর্য ধরতে পারলেন না।জিব দ্বারা রাঙা অধরখানা দু'টি ভিজিয়ে নিলেন।রয়ে সয়ে প্রশ্ন করলেন।
--আপনার কি হয়েছে? কাঁদছেন কেন?বলুন আমাকে।
--বিবিরে ঝড়,ভয়ংকর কাল বৈশাখি ঝড় আসতে চলেছে।যে ঝড়ে তান্ডব লীলা চালাবে। আমাদের আপনজনদের বিচ্ছেদ ঘটাবে।তছনছ করে দিবে আমাদের সাজানো গোজানো সংসারটাকে।
বোকা,নির্বোধ সরলা বানু কিছুই বুঝলনা।কেবল পলকহীন দৃষ্টিতে উৎসুক হয়ে চেয়ে রইল।
সৈয়দ উল্লাহ্ বুঝলেন তার বোকা সরলা বানু বিবি কিছুই বুঝল না।

সে তার সরলা বানুকে বক্ষ মাঝে চেপে ধরল।মাথায় শীতল হাত বুলিয়ে দিলেন।বলল,
--বিবিরে আমার হায়াত বুঝি শেষ হতে চলল।আর বেশিদিন বুঝি পৃথিবীতে আমার থাকা হবে না।
স্বামীর মুখে এমন কথা শুনে কেঁদে উঠলেন তৎক্ষনাৎ তিনি।হস্ত দু'খানা চেপে ধরলেন।ক্রন্দন মিশ্রিত গলায় বলল,
--এসব কি বলছেন আপনি?আপনার কিছু হবে না।আপনার আগে আমি মরমু।
সৈয়দ উল্লাহ্ নিষ্পাপ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল।তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল,
--বিবি আজ জমিদার প্রলয় আমাকে জরুরি তলফে ডেকে ছিলেন।তিনি কি বলেছেন জানো?
উৎসুক হয়ে তাকাল সরলা বানু।মুখশ্রীতে এক মুঠো কৌতূহল বিদ্যামান।তর যেন তার আর সইছে না।ঝটপট বলল,

--কি বললেন জমিদার সাহেব?
--আমার ইন্ধুরে ও বিছনায় নিতে চায়।কত বড় বেয়াদব! নিলজ্জ কোথাকার।রাজি না হলে বলল, তুলে নিবে ।আমি একজন দাদা হয়ে কি করে ওরে ঐ নরঘাতকের কাছে দেই বল বিবি।ওরা যে হিংস্র পশু।ছিঁড়ে ছিঁড়ে খুবলে খাবে আমার ময়নাটারে।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় সরলা বানু।হৃদয়ের কম্পনের শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সৈয়দ।সে সরলা বানুকে আশস্ত করে বলল,
--চিন্তা করিস না বিবি।ঐ শয়তানটার হাতে কিছুতেই ইন্ধুরে তুলে দিব না।এতে আমার মৃত্যুদন্ড হলে হোক।আমি পরোয়া করব না।
শেষোক্ত বাক্যটি শুনে কেঁপে উঠল বোকা সহজ সরল সরলা বানু।
--এ আপনি কেমন কথা বললেন।আপনার কিছু হলে আমার কি হবে?
--বিবিরে এই পৃথিবীতে আজিবন কেউ বেঁচে থাকবে না।একদিন না হয় একদিন মরতে হবে।আজ না হয় একটি নারীর সম্মান বাঁচাতে গিয়ে মরলাম।

থেমে পরল সৈয়দ।
চোখের পানি মুছে সরলা বানু বলল,
--এখন আপনি কি করতে চান?
--আমি ইন্ধুরে কিছুতেই ঐ পাপিষ্ঠের হাতে তুলে দিব না।এতে আমার পাঠশালার চাকরি গেলে যাক।জিবনও যদি চলে যায় যাক।এতে আমি ভয় করি না।ন্যায়পথে জিবন বিসর্জন দিলেও লাভ।অন্ততপক্ষে, পরকালে বিধাতার সামনে গিয়ে বলতে পারব,ন্যায়ের পথে জিবন দিয়েছি।আর শুনো ওদের এ ব্যপারে কিছু বইলো না।অযথা চিন্তা করবে ওরা।
মাথা নাড়ল সরলা বানু।
আচ্ছা।

বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে ছিল কিরণ।উপস্থিত ঘটনা তার দৃষ্টির সীমা অতিক্রম করেনি।সে সবটাই স্পষ্ট শুনেছে।মনে মনে ভয়ংকর ক'খানা গালি দিল জমিদার প্রলয়কে।ভাবল,অতুল কিছু।
দিন দুয়েক পেরুলো। অথচ জমিদার প্রলয় এর মধ্যে আর কোন প্রকার ঝামেলা পাকাচ্ছে দেখে স্বস্তি পেল সৈয়দ উল্লাহ্।ভাবল,লোকটার মাথা থেকে বুঝি ইন্ধুর ভুত নামল।পাঠলাশার চাকরিটিও যায়নি।হঠাৎ জমিদারের শান্তশিষ্ট,ঠান্ডা,নিস্তব্ধতা আচারন ঠিক মানা যাচ্ছে না।তাহলে কি তার এই আচারন ঝড় আসার পূর্বাভাস বলা চলে।তারই আগামবার্তা দিচ্ছে।

এর মধ্যে কেটে গেল বেশ কয়েকদিন।দিন চারেক পেরুলো।হুট করে সাঁঝের বেলা ঊর্মি নিখোঁজ। তার নিখোঁজ বার্তা দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়লেও সেটা আয়ত্তে রেখেছে কিরণ।এইতো সকাল সকাল সৈয়দ উল্লাহ্ পাঠশালার উদ্দেশ্য বের হল।সকাল গিয়ে দুপুর,দুপুর গড়িয়ে সাঁঝের বেলা গড়াল।অথচ তার হদিস মিলল না।দুই দু'খানা আস্ত মানুষ নিখোঁজ। দু'জনে হাওয়া হয়ে তো আর চলে যেতে পারে না ।নিশ্চয়ই এর পিছনে বড়সড় কোন কারন রয়েছে।ঘরে কারও চোখে তন্দ্র নিদ্রা নেই।অন্ন না খেয়ে সকলে অনাহারে ভুগছে। তারপরেও তাদের চিন্তাধারা কমেনি।বরং দিন দিন বাড়ছে।
এর মধ্যে একদিন মধ্য রজনীতে বাড়ির আঙিনায় কিছু পরপুরুষের প্রতিচ্ছবি দেখা গেল।যাদের হাতে চকচকে ধাড়াল অস্ত্র বিদ্যামান। কিছু একটা আঁচ করতে পারল কিরণ।তৎক্ষনাৎ তার শ্যামবর্ণ মুখশ্রীতে মেঘের ন্যায় আঁধারে ডুবে গেল।

তখন সাঁঝ সাঁঝ বেলা।মাগরিবের আযান না পড়লেও হিন্দু সম্প্রদায়ের সাকের শব্দ তীরের মতন কর্ণধারে এসে ঠেকছে।হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করল কিরণ।হাতে তার কিছু অর্থকড়ি।ইন্ধু তখন ঘুমাচ্ছিল।মেয়েটা দু'দিন যাবদ বেশ চিন্তান্বিত।তার সমবয়সী বোনটা নিখোঁজ। তার ওপর দাদাজানও নিখোঁজ।
মানতে তার বড্ড কস্ট হচ্ছে।দু'দিন যাবদ কোন রকম প্রশিক্ষণে অংশ্রগ্রহণ করছে না সে।
নিশ্চয়ই মাস্টার খুব রেগে আছে।
এবার তিনি বলছিলেন কিভাবে শএুকে হুট করে পিছন দিক দিয়ে আক্রমণ করতে হয় সেই কৌশল শিখাবে।অথচ সে যায়নি।অবশ্য সে অনেক আগেই তার দাদাজানের থেকে এই কৌশলটি শিখেছে।
প্রশিক্ষণ প্রায় তার শেষ বললে চলে।তার পরেও মাস্টার যেহেতু বলেছে।
তার উচিত ছিল যাওয়ার।এইদিকে বোন,দাদা হাড়ানো বেদনায় সে জর্জরিত।
যার কারনে শারীরিক শক্তির চেয়ে সে মানসিক ভাবে আক্রান্ত বেশি।
এই তো আসরের আযানের পর তার ঘুম আসল।চোখ দু'টি যেন একটু বিশ্রাম চায় এখন।

সে আপন মনে তন্দ্রাচ্ছন্নে তলিয়ে গেল।তখনি তার সামনে কিরণ আসল।
ঝাঁকিয়ে তুলল তাকে।ঘুমে টুলুমুলু দৃষ্টিতে ইন্ধু কেমন আঁতকে মাখা মুখশ্রীতে নিয়ে তাকিয়ে রইল।
কিরণ হয়ত বুঝল তবে জিজ্ঞেস করল না।তার এখন একটাই কাজ।
সেটা হল ইন্ধুকে নিরাপদ বাসস্হান দেওয়া। অচিনপুরের শকুন থেকে লুকিয়ে রাখা।
সে একদম সঠিক।
জমিদার প্রলয়ের ঊর্মি আর দাদাজানের নিখোঁজ হওয়ার পিছনে হাত রয়েছে।
এইতো কিছুক্ষণ আগে খবর পেল।
ঊর্মিকে জমিদার বাড়ির বড় ছেলে প্রহর তুলে নিয়ে গিয়েছে বাইজি গৃহে।
কথাটা শোনা মাএ তার মাথা আগুনে থপথপ করে জ্বলতে লাগল।
সে চেয়েছিলে বাইজিগৃহে যেতে।
পরবর্তীতে মনে হল তাকে তো জমিদার বাড়ির বাইজিগৃহে কেন?
সে বাড়ির আঙিনায়ও ঢুকতে দেওয়া হবে না।
এতক্ষণে বুঝি তার নিষ্পাপ ছোট বোনটির সতিত্ব হরন করেছে ঐ নরপশুটা।
ভাবতেই তার শরির কেবল কম্পন মেরে নিঃশেষ হতে চাচ্ছে।
অতটুকু মেয়ে ওদের অত্যাচার সহ্য করতে পারবে না।কি করবে সে ভেবে পাচ্ছে না।
গা কেমন ছমছম করে শিউরে উঠছে।মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে যেন।
ইন্ধুরও যদি একই হাল হয়।ভাবতেই তার শরির অবশ হয়ে আসছে।
সেই দৃশ্য সে সহ্য করতে পারবে না।ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এল।
ছোট একটি থলি ইন্ধুর নিকট এগিয়ে দিল।
হাত ধরে টানতে টানতে জঙ্গলের পথ দিয়ে নিয়ে চললো তাকে।গভির জঙ্গল।
দিনের বেলাই এখানে আসতে গা ছমছম করে।
তার বেলায় তো এখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত আটটা বাজতে চললো।
বন্য পশুটা কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিমায় ডেকে চলেছে।তবে একটি বিষয়ে কেমন অদ্ভুত।
তার কেন জানি ভয় হচ্ছে না।বরং ভালই লাগছে।কিরণ জঙ্গলের শেষ প্রান্তে এনে তাকে দাঁড় করাল।বলল,

নিশ্চয়ই এতক্ষণ তোর মনে অনেক প্রশ্ন জমা হয়ে আছে।শোন আমার বালা,আজ আমি নিরুপায়।এই মুহূর্তে তোকে বলার মতন কোন পরিস্থিতিতে নেই।পরিস্থিতি যখন অনুকূলে পৌঁছাবে তখন একদিন তোকে সব খুলে বলব।শুধু এতটুকু বলি।এই জায়গা তোর জন্য নিরাপদ নয়। হাতে কাগজের টুকরোটি দেখিয়ে বলল, এটা আমার একজন বন্ধুর ঠিকানা।এখান থেকে দু' ক্রোস পথ হাঁটলে একজনের দেখা পাবি।তার সাথে তুই চলে যাবি।সেই তোকে আমার বান্ধবী ঐমির কাছে নিয়ে যাবে।তবে সাবধান কেউ যেন টের না পায়।আর হ্যাঁ এখান থেকে বের হবার পর আর কখনো এখানে ফিরে আসবি না।আমার নামে কোনো প্রকার চিঠি পাঠাবি না।আমি দিন দুয়েক পর শহরে যাব। তখন তোর সাথে দেখা হবে।ভাল স্কুল দেখে তোকে তখন ভর্তি করে দিব।
ইন্ধুর চোখের পানি বাঁধ মানছে না।সে কিরণকে জরিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে দিল।বলল,
--বুবু গো তোমারে ছাড়া কোনদিন একা থাকি নাই।এখন কিভাবে থাকব?আমাকে অচেনা শহরে কেন পাঠাচ্ছ অন্তত তা একবার বলো?

ইন্ধুর গালে হাত রাখল কিরণ।
--এমন করে কাঁদিস না সোনা।কলিজায় লাগে।তুই তো দুর্বল চিত্তের অধিকারী নয় বরং সহসী নারী।আমার সাহসী ইন্ধু।অস্ত্র, তীর,ধনুক যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছিস এমনি এমনি নাকি।মাঝে মধ্যে পরখ করবি নয়ত ভুলে যাবি।শোন সোনা ভয় পাস না।বুবু সব সময় পাশে থাকবে ।আর হ্যাঁ সবটা সময় হোক তোকে সব জানাব।
আর ঊর্মি, দাদামশাই তাদের দেখা কি কোন দিন পাব না বুবু?
ভাগ্যে থাকলে একদিন না একদিন পাবি ।এখন জলদি কর।
বুবু তুমিও চল।
--আমি তোর সাথে যেতে পারব না।জানিস তো দাদির অবস্হা ভাল না।দাদাজানের নিখোঁজ হওয়ায় সে ক্ষণে ক্ষণে অস্হির হয়ে জ্ঞান হারাচ্ছে।এমন পরিস্থিতিতে আমার যাওয়া ঠিক হবে না।তুই যা।
ইন্ধু চোখের পানি মুছে ধীরে ধীরে পথ চলতে লাগল।এই গন্তব্যের শেষ কাঠি কোথায় সে জানে না।শুধু জানে তার বুবু বলছে পালাতে হবে।তার তাই করতে হবে।

রক্তাক্ত অবস্থায় নিধর হয়ে পড়ে আছে ঊর্মি। দেহে এক টুকরো কাপর পর্যন্ত অবশিষ্ট নেই।
মানুষ খেকো শকুনেরা তার দেহটাকে ছিড়েখুঁলে খুবলে খেয়েছে।ঠোঁটের কোনে রক্ত জমাট বেঁধে আছে।
কিছুক্ষণ বাদে একজন রমনি এল।নাম তার শিখা।
বয়স আনুমানিক সতের ঘরে ছুইছুই হবে।
হাতে তার নরম কাপড় আর স্যাবলন মেশানো গরম পানি।
ঊর্মির অবস্হা দেখে তার অন্তআত্মার রুহ কেঁপে উঠল।
এখানে প্রথম যখন সে এসেছিল তার অবস্থা হুবহু একই রকমের ছিল।
কি যন্ত্রণাকর ছিল সে দিনটি!কি করে ভুলে সে?আজও মনে আছে তার সেই নিকৃষ্ট দিনটির কথা।
ভাবলেই কেমন শরির শিউরে উঠে।সে গরম পানির পাএটি রেখে ঊর্মির শরির মুছে দিতে লাগল।
তৎক্ষনাৎ চিৎকার করে উঠল ঊর্মি।ছিটকে দু'কদম দুরে সরে বসল।বলল,

--"ছুবেন না আমায়।ভিষণ যন্ত্রণা। অনেক যন্ত্রণা হচ্ছে।আমার কস্ট হচ্ছে।বড্ড কস্ট হচ্ছে।আমাকে আর কস্ট দিয়েন না অনুরোধ করছি।দয়া করুন।"
ঊর্মি আত্মচিৎকার শুনে শিখা নামের মেয়েটির অন্তআত্মা কেঁপে উঠল।
কতটা কস্ট পেলে মানুষ এমন পাগলের ন্যায় আচারন করে।ওরা মানুষটা নয় পশু।কি করেছে মেয়েটির অবস্হা?
সে ঊর্মির হাতটি টেনে বসাল তাকে। আশস্ত করে বলল,
--"কান্না কিংবা চিৎকার করো না বোন।প্রধান বাইজি শুনলে খুব খারাপ হবে।তখন তিনি আরও অনেক মারবো।এখানে চুপচাপ বস।আহো আমার ধারে মলম লাগিয়ে দেই।"
পুণরায় চিৎকার করে উঠল ঊর্মি।
--না! না! আমি মলম লাগাব না।আমি বাড়ি যাব। যেতে দিন আমাকে।
শিখা মলিন হাসল।

এই জনমে আর তোমার বাড়ি ফেরা হচ্ছে না বোন।
এখানে যে একবার আসে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত এখান থেকে বের হতে পারে না।
এটাই নিয়ম এখানকার।এখন এটাকে তোমার বাড়ি বলে মেনে নিতে হবে।
নতুন তো তাই একটু কস্ট হচ্ছে।ধীরে ধীরে সব অভ্যসে পরিণত হবে।
তখন সব ঠিক হয়ে যাবে।আর কস্ট হবে না।তোমার মতনই আমার অবস্থা ছিল।
আর এখন দেখো সময়ের সাথে সাথে সব মানিয়ে নিয়েছি।
তোমাকেও বলব মানিয়ে নিতে শিখো।এতেই তোমার মঙ্গল।
যদি নিজের ভাল চাও অন্তত সব মেনে নেয়।নয়ত, মৃত্যু অনিবার্য।
শিখার কথা শুনে ডুকরে কেঁদে উঠল ঊর্মি।বিড়বিড় করে কয়েকবার ইন্ধুর কথা স্মরণ করল।
মেয়েটা বরাবরই জমিদারদের প্রতি তীব্র রাগ,
ঘৃণা পোষণ করে ছিল।দু'চোখেও তাদের সহ্য করতে পারত না।
তার মাঝে মধ্যে মনে হত জমিদাররা বুঝি ইন্ধুর বহিরাগত শএু।
নয়ত,এদের প্রতি ওর এত রাগ ঘৃণা পোষণ করে থাকার কথা নয়।
ইন্ধু তো একবার বলেছিল প্রশিক্ষণ শেষ করে সে একজন পরিপূর্ণ সাহসী বীর যোদ্ধা হয়ে গড়ে উঠবে।
হতে কি পেরেছে সে?কতটা দিন দেখা হয় না ওদের সাথে।

মনে মনে বিড়বিড় করে আওড়াল,
"ইন্ধু ও ইন্ধুরে তুই না সাহসী বীর যোদ্ধা হবি।ছিন্নভিন্ন করবি নরপশুদের।ধ্বংস করবি মানুষ খেকো হায়নাদের। জলিদ আয় বোন।আমি অপেক্ষা করছি তোর জন্য। আজ থেকে আমার অপেক্ষা করার দিনগুলি শুরু।কবে আসবি তুই? কবে মুক্তি মিলবে এই নরক থেকে।
জানা নেই তার।কেবল এক বুক আশা নিয়ে প্রাণের প্রিয় বোনটির জন্য অপেক্ষা করে যাচ্ছে।তার অবুঝ বোনটি যে তার অপেক্ষায় চেয়ে বসে আছে।সে কথাটি কি সে আধও জানবে?"

চাবুকের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে বৃদ্ধ সৈয়দ উল্লাহে্র দেহটি।বৃদ্ধ মানুষ শরিরের শক্তির সঞ্চয় ক্ষমতা এমনিতেই কম।তার ওপর অতিরিক্ত চাবুকের আঘাত সইতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে গেল।অজ্ঞান হওয়ার আগেও স্পষ্ট গলায় বলল,ক্ষমা করুন জমিদার প্রলয়।ও ছোট মানুষ ভুল করে ফেলেছে।মাপ করুন তাকে।
কথাটা শুনে যেন জমিদার প্রলয় ভিষণ মজা পেয়েছে।বাম গালটা ব্যথায় এখনও যেন টনটন করছে।মানতে হবে মেয়েটা দুরন্তর সাহসী।ভারি বেয়াদবও।একে একবার শুধু পাই।এর দৌড় কতটুকু দেখে নিব।
পুরো এলাকায় লোক লাগিয়েও ইন্ধুর হদিস মিললো না।রেগে জমিদার প্রলয় কারাগারে বন্ধি রাখা সৈয়দের কাছের উপস্থিত হল।বৃদ্ধের গলা এক প্রকার চেপে ধরল।
--খুব চালাক হয়েছিস আজকাল।জমিদারেরটা খেয়ে তারেই বাঁশ দিচ্ছিস।বল তোর নাতি কোথায়?কোথায় লুকিয়েছিস ওকে।সেচ্ছায় বল নয়ত তোর বুড়ি বিবির অবস্থা কি করতে পারি জানিস তো।
আঁতকে উঠল বৃদ্ধ সৈয়দ।কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
--জানিনা আমি বিশ্বাস করুন।সত্যি বলছি জমিদার সাহেব আমি এ ব্যপারে অজ্ঞাত।
--প্রহরি.....।
রাগে ফোসফোস করে গর্জে উঠল জমিদার প্রলয়।তার গর্জনে কেঁপে উঠল পুরো কারাগার।
--জি সাহেব। ওকে আরও একশত চাবুক ছুড়ো।
--জি আচ্ছা।

তখন মধ্য রজনী।পিনপিন নিরবতা।
নিস্তব্ধতা ভেঙে শেয়াল ভায়ার হাঁক শোনা যায়।
ইন্ধু চৌরাস্তা মোড়ে সেই কখন থেকে দাঁড়ানো।
অথচ আগত ব্যক্তির কোন হদিস মিলছে না।তার বু্ুবুর ভাষ্যমতে,লোকটা আরও আগে আসার কথা।
তাহলে এখনও আসছে না কেন?সে ঘন্টা খানিক আরও অপেক্ষা করল।
লোকটার দেখা নেই।চাঁদটা মাথার কাছাকাছি।
ভরা জোসনা।চাঁদের আলোয় নদীর জল চিকচিক করছে।ইন্ধু দৃষ্টি ঘুরাল।
তখনি হুট করে কোথাও মনে হল যুদ্ধ ক্ষেএের তান্ডবলীলা লেগেছে।
সে গাছের আড়ালে তড়িঘড়ি করে লুকানোর চেস্টা করল।
দেখা গেল মুখোস পরিহিত দু'দল ভয়াবহ যুদ্ধলীলা খেলায় মেতে উঠেছে।
পরল সে মহা ভাবনায়।

লোকটা বোধহয় আজ আর আসবে না।।সে কি চলে যাবে?যাবেই বা কোথায়?
বুবু পইপই করে নিষেধ করেছে গৃহে ফিরতে।কোথায় যাবে এতরাতে সে একজন নারী হয়ে।
ঐ তো দুরে লোকালয় দেখা যাচ্ছে।
সেখানে কারো হাত পায়ে ধরে না হয় আজকের রাতটা কাটিয়ে দিবে।
সে জঙ্গলের সরু পথটা দিয়ে হাঁটা ধরল। মাঝে মধ্যে অদ্ভুত ভয়ংকর ভাবনারা হানা দিচ্ছে।
শিশির কণা পাতার উপর টুপটুপ শব্দ করে পড়ে তীব্র ভয়ের আন্দোলন সৃষ্টি করছে।
শিশিরের জলকণা চরণখানায় লাগতেই কেমন শরির শিরশির করে উঠল।
শকুনের ডাকে যেন জঙ্গলটা মুহূর্তে ভয়ংকরে পরিণত হচ্ছে।
সে পা চালাল অতি দ্রুত।খানিকটা পর লোকালয়ের দেখা মিলল।
সে বাঁশ আর ছন দিয়ে তৈরি কুড়ের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
দু'বার দরজায় ঠকঠক শব্দ করল।কারও সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না।
তৃতীয় বার কড়া নাড়ার আগেই একজন মাঝ বয়স লোক দরজা খুলে দিল।
মুখোস পরিহিত ইন্ধুকে দেখে লোকটা হকচকিয়ে উঠল।বলল,

তুমি কেঠা গো মেয়ে?এই মধ্য রজনীতে কুঠিরের বাহিরে কি করছো?
আমি এক পথিক। পথ ভুলে রাস্তা হাঁড়িয়ে ফেলেছি।
দয়া করে আজ রাতটুকু থাকতে দিলে কৃতজ্ঞ প্রকাশ করতাম।
না না সম্ভব নয়।তোমাকে দেখে জলদস্যুদের মতন মনে হচ্ছে।
বিশ্বাস করুন আমি জলদস্যু নই।
আর একটি বাক্যও ব্যয় করেনি মহিলাটি।সে দরজা তৎক্ষনাৎ বন্ধ করে দিল।
ইন্ধু আশাহত হল। আকাশের দিকে তাকিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলল।রজনীর শেষাংশ মুহূর্তে বলা চলে ।
আঁখি দু'টি যেন বলছে আমাকে এবার একটু বিশ্রাম দেও ইন্ধু।আমি তার চেয়ে থাকতে পারছি না।
অথচ সে ভাবশীল চিন্তান্বিত সংকীর্ণ মনে দাঁড়িয়ে ।
এখন সে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।

চলমান...

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com