Breaking News

শখের জামাই । পর্ব - ০৪



আমি...” বুকে এক সমুদ্র কান্না নিয়ে অলোক কিছু বলতে চাইলো‚ কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাকে সেই সুযোগ দিলো না। মিহি উত্তেজিত হয়ে পিছিয়ে গেল। দুই হাত নাড়িয়ে বলতে লাগলো‚ “আমি কী? কোনো কৈফিয়ত আর ব্যাখ্যা আমি শুনতে চাই না। যান গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।” বলে মিহি ঘুরে দাঁড়িয়ে আঁচলে মুখ লুকিয়ে নিঃশব্দে ফুঁপিয়ে উঠলো। নির্বাক চোখে ক্রন্দনরত বউয়ের কেঁপে উঠা শরীর দেখে অলোকের দুই চোখ ভিজে গেল।

“আয়েশা?” অলোকের ভেজা কণ্ঠে নামটা শুনে চমকে উঠে মিহি৷ কান্না থেমে যায় তার বিনা নোটিশে। ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখে‚ তার শখের জামাইয়ের কপোল ভেসে গেছে নোনা জলে।
আয়েশা আক্তার মিহি— বড়ো শখ করে মিহির দাদা এই নাম রেখেছিল। কিন্তু বাড়ি সুদ্ধ সবাই তাকে মিহি বলেই ডাকে। আয়েশা নামের অস্তিত্ব আর দেখা যায় না। বাসর ঘরে মিহি তাই অলোককে বলেছিল‚ তাকে যেন আয়েশা নামে ডাকে। তবে আজ অবধি অলোক তাকে কোনো সম্বোধনই করেনি‚ কিন্তু এ কি হলো আজ! অলোক তার এই নামটা মনে রেখেছে?

“আমি তোমার কষ্টের উপহার ডিভোর্স দিয়ে দিতে চাইনি আয়েশা। কিন্তু... কিন্তু আমি যে কোনোদিনও তোমায়...” অলোক মুখ নামিয়ে কেঁদে উঠে। মিহি ছুটে আসে। জামাইয়ের চিবুক আঁজলা করে নিয়ে বলে উঠে‚ “আমি আপনাকে নিয়ে বাঁচতে পারবো ইন শা আল্লাহ। মা না হওয়ার বিষয়টাকে না-হয় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কোনো এক হুকুম বলে মেনে নিবো। আমার আপত্তি নেই... বিশ্বাস করুন।” বিস্ময়ে অলোকের চোখ ঠিকরে আসার উপক্রম হয়‚ “তুমি... তুমি কী করে জানলে?”
অলোকের বলিষ্ঠ বুকে নিশ্চিন্তে মাথা রেখে মিহি বলে উঠলো‚ “জানি গো জানি। তোমার সব জেনেই তো তোমার গলায় জুলে পড়েছি। আমায় ফেলে দিয়ো না। দোহায় লাগে লক্ষীটি।” পবিত্র নারীর মুখের পবিত্র সম্বোধনে অলোক আক্রান্ত হলো। ভেজা চোখের ভার সামলেও টের পেল‚ তার ঠোঁটের ডগায় এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। প্রথমবারের মতো অলোকও আগলে নিলো বউকে। দুই হাতে জড়িয়ে নিয়ে বললো‚ “আমায় ‘তুমি’ করে বোলো। খুব মিষ্টি লাগছে তোমার মুখে।”
“বলবো না।”
“কেন?”

“এত মিষ্টি তোমার সইবে না গো। ডায়াবেটিস যদি হয়ে যায়‚ তখন?” অলোক হেসে উঠলো। আলিঙ্গনে আপ্লুত হয়ে শুধালো‚ “তুমি রাগ করোনি তো?”
“করিনি। তবে খুব দুঃখ পেয়েছি।”
“এমন আর করবো না আয়েশা। আমাকে একটা সুযোগ দাও।” মিহি চট করে উত্তর দেয় না। অলোক ব্যস্ত হলো‚ “দিবে না?”
“না। আগে ওযু করে এসো। আমরা দুই রাকাআত নফল নামাজ পড়বো। বাসর ঘরে তো পড়লে না। আজও কি মানা করবে?”
ছয় মাস পর...
অদ্ভুত এক আওয়াজে অলোকের ঘুম ভেঙে যায়। হুড়মুড় করে সে শোয়া থেকে উঠে বসে। আশেপাশে তাকিয়ে ঘড়িতে নজর রাখে‚ তিনটা বাজে আর বাইরে রোদ চকচকে। অর্থাৎ এখন দুপুর‚ কিন্তু আওয়াজ আসছে কোত্থেকে?

“অলোক? আরে অ্যাই অলোক? কই গেলি রে বাপ?” মায়ের কণ্ঠ শুনে অলোক হন্তদন্ত হয়ে রুম ছাড়ে। বসার ঘরে এসে দেখে‚ মিহি ফ্যাকাশে মুখে আর ভেজা মাথায় বসে কেমন করে হাঁপাচ্ছে। তার মা মিহির মাথায় গামছা চেপে কীসব জিজ্ঞাসা করছে।
“মা‚ আয়েশার কী হয়েছে? আর কীসের যেন শব্দ পেলাম।”
“এখনো কিছু হয় নাই। তবে আলহামদুলিল্লাহ এবার হবে। 
ফোন করে তোর আব্বারে বল‚ বাড়ি আসার সময় মিষ্টি নিয়ে আসতে।
মায়ের কথা অলোক বুঝতে পারছে না। এদিকে মিহির চোখ নামিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে।

“মিষ্টি কেন? আর আয়েশার কিছু না হলে এমন লাগছে কেন ওকে? ও মা‚ কী হয়েছে ওর?”
“দেখলে বউ? আমার পোলার কোনো আক্কেল নাই।” মিহিকে কথাটা বলে মা এবার অলোককে বলে‚ “বিয়ের পর মেয়েরা বমি করার পর মিষ্টি আনতে কেন বলে তা তুই জানিস না? আমি দাদী হতে চলেছি আলহামদুলিল্লাহ আর তুই বাপ। এবার বুঝতে পেরেছিস?” শুনে পাথর হয়ে যায় অলোক। সে বাপ হবে মানে? কীভাবে সম্ভব? ডাক্তার তো বলেছিল‚ সে কোনোদিনও বাপ হতে পারবে না। হাবিজাবি অনেক কিছু ভাবার মাঝে অলোকের চোখমুখ শক্ত হয়ে যায়।

“অলোক‚ যা তো। ওরে নিয়ে বিছানায় শোয়ায় দে। আমি গিয়ে আসমা আর ওর মাকে খবর দিয়ে আসি। পোয়াতি বাড়িতে থাকলে অনেক কাজ করতে হয়।” অলোক দ্বিরুক্তি করে না। মিহি ধরে আস্তেধীরে ঘরে এনে বিছানায় শুইয়ে দেয়। মিনি কিছুক্ষণ চোখ বুজে পড়ে থাকে। অলোক মিহির একটা হাত ধরে বললো‚ “আয়েশা‚ মা তো সেকালের মানুষ। তাই ভুল বুঝেছে।”
মিহি চোখ খুললো‚ “কীসের ভুল?”

“তোমার হয়তো ফুড পয়জনিং হয়েছে অথবা অতিরিক্ত গরম থেকে বমি করেছো। কিন্তু মা ভাবছে‚ তুমি প্রেগন্যান্ট।” মিহি শান্ত ও ক্লান্ত চোখে অলোককে দেখে বললো‚ “মা মিথ্যা বলেনি।”
“মানে?”
“আমি প্রেগন্যান্সির কিট দিয়ে টেস্ট করেছি। আমি আলহামদুলিল্লাহ সত্যিই প্রেগন্যান্ট।” শুনে আঁতকে উঠলো অলোক‚ “মানে? কী যা-তা বলছো তুমি? এটা কোনোদিনও সম্ভব নয়। তুমি জানো‚ আমি বাবা হতে অক্ষম। তাহলে... না না‚ তুমি আমার সাথে মজা করছো।”
“আমায় অবিশ্বাস করছো লক্ষীটি?” বমি করে মিহির শরীর ভেঙে গেছে‚ কিন্তু গলার স্বরের মিঠে ভাবটা একটুও মলিন হয়নি। অলোক সস্নেহে মিহির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো‚ “না আয়েশা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সেই স্পর্ধা আমায় কোনোদিনও দেবেন না।”
“তাহলে আমার কথা মানছো না কেন?”

“কীভাবে মানবো বলো? আমি অক্ষম আর আমার পবিত্র স্ত্রী প্রেগন্যান্ট— এমন অদ্ভুত বিষয় মানা আমার পক্ষে কোনোকালেই সম্ভব নয়।” মিহি চুপ করে থাকে। একটু কি ভেবে নিয়ে অলোকের কাছে জানতে চাইলো‚ “একটা কথা বললে রাগ করবে?”
“একদমই না।” মিহি মিনমিন করে বলে‚ “আমার পেটে তোমারই বাচ্চা আর তুমি বাবা হতে অক্ষম নও।” শুনে অলোক হাসে। ওকে হাসতে দেখে মিহি জানতে চাইলো‚ “হাসছো কেন?”
“হাসার মতো কথা বললে হাসবো না?”

“তাই? ঠিক আছে‚ তবে এবার রাগ করার মতো কথা বলি। তুমি বরং রাগ করো।” অলোক হো হো করে হেসে উঠলো‚ “ঠিক আছে।”
“তোমার চেকআপ যে করিয়ে ছিল‚ সে আমার দুঃসম্পর্কের মামা হয়। আমি তো তোমার উপর নজর রাখতাম। তাই...” অলোকের চোখ সরু হয়ে আসে‚ “তাই কী?”
“আমি রিপোর্ট বদলে দিতে বলি।”
“কী!”

“রাগ করো না লক্ষীটি। আমি... আমি আসলে...” অলোক ভীষণ রেগে যায়। বিছানা থেকে নেমে চট করে শার্ট বদলে নিলো। এরপর টুঁশব্দ না করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মিহি পিছন থেকে ডাকলো‚ মানুষটা কোনো সাড়া দিলো না। নিজের অপ রাধে মিহির দুই চোখের নোনতা জলে বালিশ ভিজে গেল।

মন খারাপ আর কান্না নিয়ে মিহি কখন ঘুমিয়ে পড়লো তা টেরও পেল না‚ 
কিন্তু এখন মাথায় একটা স্পর্শ পেয়ে ঘুম ছুটে গেল। 
চোখ খুলে দেখলো‚ অলোক আদুরে ভঙ্গিতে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। 
জামাইকে দেখে তড়াক করে উঠে বসে দুই হাতে জড়িয়ে ধরলো। 
বুক উজাড় করা কান্নায় নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে মিহি বললো
ওগো‚ আমাকে মাফ করে দাও। আমি অনেক বড়ো অন্যায় করে ফেলেছি। তুমি প্লিজ আমাকে...”

তোমার উপর আমি কি রাগ করে থাকতে পারি?”
“তাহলে তখন অমন করে আমায় ফেলে গেলে কেন?”
“তুমি যে আচার খেতে ভালোবাসো। এখন তো আরও বেশি করে আচার লাগবে। তাই আচার আনতে গেলাম।” শুনে মিহির কান্না বাড়ে। অভিমান আর ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বললো‚ “আমার কিচ্ছু চাই না। আমার শুধু তোমাকে চাই।” অলোক আনমনে হাসলো। ভাবলো‚ “আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা‚ এমন নেককার স্ত্রীর অছিলায় আপনি আমাকে কত বদলে দিলেন। হালাল আর সুস্থ জীবন দিলেন আলহামদুলিল্লাহ।

মিহির কান্না উঠানামা করছে। আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে কথা বলার চেষ্টা মিইয়ে গেল তার। তাই নীরবে শুধু অশ্রুপাত করলো। এদিকে অলোক মিহিকে পরম যত্নে আগলে নিলো। মাথায় একটা হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো‚ “আয়েশা‚ কেঁদো না আর। আমি তো আছি‚ ইন শা আল্লাহ থাকবো। তোমায় নিয়ে জান্নাতেও সংসার পাতবো।”

<>সমাপ্ত<>

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com