Breaking News

ইন্ধুবালা । পর্ব - ০৬



তখন সাঁঝেরবেলা।তপন পূর্বেই বৃহৎকার আকাশে হেলে পড়েছে।গা ঢাকা দিয়েছে সুদুর ধূসর রঙের আকাশের আড়ালে।চাঁদ মামার পাশে উজ্জ্বল জ্বলজ্বল মিটিমিটি করে হাসছে সন্ধ্যা তারাটি।মহলের আঙিনায় সঠান হয়ে বাদশারের ন্যায় শুয়ে আছে নেড়ি কুকুর ছানাটি।

ভাবখানা তার এমন যেন এখানে একমাএ তারই রাজত্ব ও শাসনকাল চলে।সাগরের উত্তাল ঢেউের শব্দ স্পষ্ট ভেসে আসছে কর্ণকুহরে।বিশাল বিশাল পাহাড়ের বুকের মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়েছে ছোট খাট সমুদ্র। তারই পাশে বেড়ে উঠেছে লম্বা বৃক্ষরাজগুলি।ছোট ছোট বরফ কণাগুলি তার মাথার ওপর যেন তাজ হয়ে সমার্থনা জানাচ্ছে।

তিমির ঢাকা অন্ধকার চিড়ে বেড়িয়ে এল একজন গুপ্তচর।কালো কাপড়ে তার মুখশ্রী ঢাকা।খুব সাবধানে মহলে ঢুকে পড়ল।সর্তকতা অবলম্বন করে আশ পাশ পর্যবেক্ষণ করে জমিদারের কক্ষে অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করল।

সালাম জমিদার সাহেব।
হুম। ঐ দিকের কি খবর বল?
সাহেব ইন্ধুবালা নামের মেয়েটি তার গৃহ থেকে পালিয়েছে।আর তাকে পালাতে সাহায্য করেছে
তার বড় বোন কিরণ।বলা যায়,ইন্ধুবালাকে আপনি তুলে আনবেন বলে হুমকি দিয়েছেন।
সে কথা শুনে সর্তক হল তার বড় বোন।এর পরে সে তার শহরের এক বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করে
সেখানে পাঠানোর ব্যবস্হা করে।তবে আশ্চর্যজনক ব্যপার হল সাহেব মেয়েটা শহরে পৌঁছাতে পারেনি।
তার আগেই সে হুট করে গুম হয়ে গেল।তার কোন আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
তারপরে তার বোন কিরণ শহরে গিয়ে শুনতে পায় যে
যার সাথে তার বোনকে পাঠানোর ব্যবস্হা করা হয়েছিল।
সে বন্ধুটি সেদিন যায়নি।এমনকি সে শহরেও আসেনি। বিষয়টি অত্যন্ত জটিল।
হুম।আর কিছু...।

আপনার গোপন শএুটির কথা এখনও জানতে পারেনি।তবে মহলের আশেপাশে ষোল বছরের যত কন্যা আছে তাদের বন্ধি করে নিয়ে পরখ করে দেখেছি কারও পিঠে কোন রাজ চিহ্ন নেই।এ পর্যন্ত দশ থেকে পনেরজন কন্যাকে বন্ধি করে পরিক্ষা করা হল।সকলের পিঠে কোন প্রকার জমিদার বংশের রাজ চিহ্ন ছিল না।
--তুমি এক কাজ করো সিমান্তে পৌছাও।ওখানে তুমি কোন রকম কিছু পেলেও পেতে পারো।আর হ্যাঁ ইন্ধুবালার ব্যপারটা আমার হাতে ছেড়ে দেও।ও যদি ইঁদুরের গর্তেও লুকিয়ে থাকে ওকে খুঁজে বের করবো।এ ব্যপারে তোমার কোন সাহায্যের প্রয়োজন নেই।
--আচ্ছা।সাহেব আরেকটা কথা।ইদানীং ডাকাত আর জলদস্যুদের উৎপাত বেড়ে চলেছে। সাবধানে থাকবেন।শুনেছি জলদস্যুরা সমুদ্র ওপারের দ্বীপে তারা তাবু ফেলেছে।যে কোন সময় তার অচিনপুরের লোকালয়ে আক্রমন করতে পারে। তাই সাবধানে থাকবেন।আসছি।
সোলাইমান....।( জমিদার মহলের অর্থসচিব)

সবে খানা খেতে বসেছিল বেচারা সোলাইমান। তখনি জমিদারের ডাক পড়ে। অর্ধ খাওয়া খাবার রেখে বেচারা দৌড়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল।তার বিশাল বড় নামটি নিতে সকলে কম বেশি বিরক্ত হয়।তাই সংক্ষিপ্ত করে কেউ কেউ ডাকে সোলা কেটে ইমান।
--জমিদার সাহেব ডাকছিলেন।
--হ্যাঁ।ঘোড়াশালা থেকে ঘোড়া প্রস্তুত করো আমরা বের হবো।গোপন সূএে জানতে পেরেছি জলদস্যুরা সমুদ্রের ছোট দ্বীপে তাবু ঘেরেছে।যে কোনো সময়ে তার অচিন পুরে আঘাত হানতে পারে।তার আগে আমার রাজ্যকে নিরাপত্তা দিতে হবে।কিছু সৈনিক প্রস্তুত করো।
--জি জমিদার সাহেব।

জীর্ণশীর্ণ দেহটা নিয়ে শুয়ে আছেন বৃদ্ধা সরলা বানু।আজ সপ্তাহ দুয়েক হতে চলল তার স্বামীর মুখখানা দেখে না।বেচারা আজও জীবিত আছে নাকি মৃত সেটাও তার অজানা।প্রখর চেতনায় সে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে।খাবাবের প্রতি তার রুচি একদম কমে গিয়েছে।সারাক্ষণ চিন্তান্বিত সংকীর্ণ মনে তার দিন কাটছে।তার ওপর ছোট নাতি দু'টোও নিরুদ্দেশ। বড় নাতিটা সারাক্ষণ কি যেন চিন্তা করে।সে দেখে কিছু বলে না।কেন জানি এখন আর তার আগের ন্যায় বকবক করতে ইচ্ছে করে না।কত দিন বিবি বলে কেউ ডাকে না।

বুড়ো মানুষ পুকুর থেকে উযু করে এসে হাঁপিয়ে উঠলেন।ধড়ধড় করে শরিরটা কাঁপছে। অত্যন্ত দুর্বলচিত্তের অধিকারি সে।সেখানে এসব ঘটনা ঘটার পরও সে যে সুস্থ আছে এটাই আলহামদুলিল্লাহ।
মাগরিবের সালাত আদায় করে কিরণ জানলা খুলে বসে রইল।দৃষ্টি জঙ্গলের দিকে।ঝি ঝি পোকাড়া ডাকার যেন আজ প্রতিযোগিতায় নেমেছে।সে বিরক্ত হলো না।বরং ভালোই লাগল।তার একাকিত্বের সঙ্গী হল তারা।তার বোন ইন্ধুর আজ কত দিন যাবদ খোঁজ খবর পায় না।মেয়েটা সেই যে গেল আর দেখা হল না।কথা মতন সে দু'দিন পর ঢাকা গিয়েছিল।তখন তার বান্ধবীর থেকে শুনতে পায় ইন্ধুকে যে নিয়ে আসার কথা ছিল সে সেদিন যায়নি।কথাটা শুনে কিরণের অবস্থা হয়েছিল করুন।

বেদনাজনক ব্যথা নিয়ে ফিরে এসেছিল গৃহে।এর পরে কত জায়গায় খোঁজ লাগাল পেল না সে।কত চিন্তা তার মাথায় মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।একবার মনে হচ্ছে জমিদার প্রলয় ইন্ধুকে তুলে নেয়নি তো।পরবর্তীতে মনে হল জমিদার জানবে কি করে ইন্ধু ঐ পথে ছিল।তাছাড়া মেয়েটা আত্মরক্ষা করার জন্য যথেস্ট কৌশল জানে।এইদিক দিয়ে সে যথেস্ট চিন্তা মুক্ত।

তখনি অন্ধকার পেরিয়ে একজন আগুন্তকের দেখা মিলল।আগুন্তককে দেখা মাএই কিরণ জানলার খিল লাগাতে চাইল। তার আগে আগুন্তক জানলা ঠাস করে খুলে ফেলল।চোখাচোখি হল দু'টো প্রাণের। একজনের চোখে মুগ্ধতা অপর জনের চোখে কেবল রাশি রাশি ঘৃণা।
কিরণ চোখ রাঙিয়ে বলল,
"সমস্যা কি?রাত নেই দিন নেই হুটহাট কোথা থেকে চলে এসে হাজির হন।বের হন বলছি বাড়ির আঙিনা থেকে।"
"তুমি ক্লান্ত হও না কিরণ।"
পথিমধ্যে থেমে পড়ল কিরণ।চিৎকার করে উঠল তক্ষৎনাৎ। বলল,"সুভাস....।"
সুভাস কানে আঙুল দিয়ে চমৎকার হাসি দিল ।
"বাব্বাহ এটা গলা নাকি ফাটা বাঁশ। আস্তে চিল্লাও গো সুবাসিনী ।
জিব দিয়ে শুষ্ক অধরজোড়া ভিজিয়ে নিয়ে পুণরায় বলল,
এতক্ষণ খোলস ছেড়ে বেড়িয়েছো দেখছি।

কি দরকার বল এত নাটকবাজি করার?আমি জানি আমার মতন তুমিও তীব্র যন্ত্রণায় ভুগছো।তাহলে দেরি কেন সুভাসের সুবাসিনী। মিলন হোক দু'টো আত্মার,দু'টো দেহের। মুছে যাক অতিতের যত সকল গ্লানি।"
"বন্ধ করুন আপনার মূর্খতম কথাবার্তা।মানুষ এত নির্বোধ হয় কেমনে?আপনাকে না দেখলে তা বুঝতাম না।চলে যান আমার এিসীমানা থেকে।আপনার মুখশ্রী দর্শন করাও পাপ।"
"আমার অপরাধ কি বল? আমি জমিদারের বন্ধু শুধু অতটুকুই।উওর দেও সুবাসিনী।"
"মূর্খের মতন তর্কে জরাতে চাচ্ছি না।তবে কিছু কথা না বলেও পারছি না।তোমার ঐ জমিদার বন্ধুর জন্য আজ যত সমস্যার শুরু। তার ভাই আমার বোন ঊর্মিকে বাইজিগৃহে নিয়ে গিয়ে আমদ ফুর্তি করছে।আর সে কি করেছে জানো, আমার বৃদ্ধ দাদা মশাইকে বন্ধি করে রেখেছেন তার গৃহে।না জানি আমার ইন্ধুটা কোথায় আছে।"

"ইন্ধু....।অবাক হয়ে তাকাল সুভাস।
তার কি হয়েছে?"
"একদম নাটক করতে আসবে না আমার সামনে।এমন ভাব ধরছো যেন ভাজা মাছটাও উল্টিয়ে খেতে পারো না।তোমায় বলবো কি আর?সব দোষ তো ঐ নিষ্ঠুর জমিদারের।কথায় আছে না,"সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে।"সুযোগ পেলে ওকেও আমি ছাড়ব না।ধনুকের সবচেয়ে বড় তীরটা ওর বক্ষে নিক্ষেপ করব।"
"দেখ কিরণ যা বলার আমাকে বল।প্রলয়কে টানছো কেন?"
"বন্ধুর সংলাপ এসেছে বলে খুব গায়ে লাগছে না।"
"তোমার সঙ্গে কথা বলাই বৃথা।আসছি।"
"হ্যাঁ যাও যাও। আর আমার বাড়ির এিসীমানায়ও যেন তোমার মুখশ্রী দর্শন না দেখি।তাহলে পা ভেঙে হাতে ধরিয়ে দিব কিন্তু।"
" সাংঘাতিক কথাবার্তা । মূর্খ!নির্বোধ নারী।হায় আবছুস,এত কিছু করার পরও তোর মন পেলাম না রে নিষ্ঠুর নারী।"

জল দস্যুদের সাথে ভয়াবহ যুদ্ধ ঘটেছে জমিদার ও জমিদারের সৈন্যদের।
তাদের মধ্যে অনেক সৈন্য আহত হয়েছে।কয়েকজন নিহত হল।
কিছু সময়ের জন্য জলদস্যুরা পরাজয় শিকার করলেও তারা যে পুণরায় সমুদ্র দ্বীপে ঘাপটি মারবে
এতে কোন সন্দেহ নেই।জমিদার প্রলয় বড্ড ক্লান্ত।শরিরে তার অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন।
যুদ্ধের পোশাকটি খুলে মহলের গেটে প্রবেশ করল ।
তক্ষৎনাৎ সে শএুর করা বড় ফাঁদে মুখ থুপড়ে পড়ে গেল।
ঢালাই করার সিমেন্টের রাস্তার ওপর পড়ে হাতের কেনু ছিলে গিয়েছে।
সেখান থেকে তরল জাতীয় রক্তের স্রোত দেখা গেল।
এটা যে তার জন্য ফাঁদ ফেলা ছিল সে সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারল।
শক্তিহীন শরিরটা টেনে নিয়ে উঠবার চেস্টা করল।
তন্মধ্যে কোথা থেকে তার ডান হাতে একটি ধাড়াল তীর এসে গেঁথে গেল।
মুহূর্তে ডান হাতটা যেন বিষে নীল হয়ে আসল।রক্তের স্রোত বহমান হতে লাগল।
'আহ' করে চিৎকার করে উঠল সে।
খুব আস্তে শোনা গেল তার গলার আওয়াজ।
কয়েকজন সৈন্য তক্ষৎনাৎ জমিদারকে ধরে ফেলল।হাত থেকে টেনে তীরটা বের করল।
তন্মধ্যে সুলাইমান আর কায়কোবাদ দৌড়ে আসল।
প্রলয় দাঁত চেপে ব্যথা হজম করার চেস্টা করল।
কায়কোবাদ সুলাইমানের দিকে চেয়ে আঁতকে উঠল।

"জমিদার সাহেবের শরিরে মৃত্যু বিষ প্রয়োগ করেছে।এই মুহূর্তে তাকে সঠিক চিকিৎসা না দিলে মৃত্যু অনিবার্য। জলদি কবিরাজকে জরুরি তলফ পাঠাও।কয়েকজন সৈন্য আসো জমিদার সাহেবকে তার কক্ষে নিতে হবে।"
সকলে ধরাধরি করে জমিদার সাহেবকে তার কক্ষে নিয়ে খাটে শুয়ে দিল।বিষাক্ত বিষে তার হাত অবশ হওয়ার মতন অবস্হা।তার চোখ দু'টি হিংস্র হয়ে আছে।মুখ দিয়ে গরম ধোয়া বের হচ্ছে। তখন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল কবিরাজ মশাই।তিনি তক্ষৎনাৎ তার চিকিৎসা শুরু করে দিলেন।হাতে কিছু ঔষুধি পাতার রস ছেঁচে দিয়ে তিনি হাত ব্যান্ডেজ করে দিলেন।

বের হওয়ার পর কবিরাজ সুলাইমান আর কায়কোবাদকে ডেকে নিলেন।বললেন,
"সময় মতন তোমরা আমাকে খবর দিয়েছো।আরেকটু দেরি হলে তার প্রাণ যেত।এই বিষটি খুবই ভয়ংকর বিষ।বিশেষ করে খুশি নামক ফুল থেকে এই বিষ সংগ্রহ করা হয়।এটার গন্ধ নাসিকারন্ধ্রে ঢুকলেও সাথে সাথে প্রতিশোধক না নিলে মৃত্যু নিশ্চিত। সেখানে এটা তীরে ব্যবহার করা হয়েছিল। আর যাইহোক যিনি কাজটা করেছেন তিনি খুব নিখুঁত ভাবে কাজটা করেছেন।যাতে কেউ বুঝতে না পারে।তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল জমিদারকে হত্যা করা।কবিরাজের কথা শুনে সকলে বাক্য হাড়িয়ে বিমূঢ়। হ্যাঁ জমিদারদের অসংখ্য শএু রয়েছে।তাই বলে মহলের ভিতরে ঢুকে তাকে আঘাত করার মতন ক্ষমতা আজ পর্যন্ত কার হয়নি।সেখানে কিনা তুচ্ছ কোন এক মানব এসে আঘাত হানল।না এ মানব কোন তুচ্ছ মানব নয়।হয়ত,সে খুবই বুদ্ধিমতি ও দুরন্ত সাহসী মানব। নয়ত,এমন সাহস আধও কার হয়নি।

ইতিমধ্যে কয়েকজন প্রহরি চিহ্নিত করল কোথা থেকে তীরটি এসেছে। তার অনুসন্ধান করতে নেমে পড়েছে।এক সময় তারা ছাদে পৌঁছে গেল।সেখানে খুঁজে বিশেষ কিছু পেল না।আসার সময় কায়কোবাদের চোখে পড়ল একটি ছোট্ট কাগজের টুকরো। তার ওপর ছোট নুড়ি পাথর রাখা।বুঝা যাচ্ছে,আগুন্তক ব্যাক্তি তার অস্তিত্বের জাগান দিতে কিছু জিনিস ইচ্ছাকৃতভাবে রেখে গিয়েছে।ছোট কাগজের টুকরোটি সে হাতে নিল।সেখানে স্পষ্ট ভাষায় লেখা।
"ই,ন,ব,ল।"৷ এই স্বরবর্ণ আর ব্যাঞ্জনবর্ণ মিলিয়ে আগুন্তক ব্যাক্তি কি লিখে বুঝাতে চাইছে ঠিক মাথায় ঢুকল না কায়কোবাদের।সে জমিদারকে নিয়ে কাগজটি দেখাল।এতে জমিদার সাহেবের কোন ভিন্ন প্রতিক্রিয়ার লক্ষ্মণ দেখা গেল না।কায়কোবাদ মহা বিরক্ত হয়ে কক্ষ ছেড়ে গেল।
ঝটপট উঠে পড়ল জমিদার প্রলয়।আজকেই তার জ্যোতিষীর সাথে অত্যন্ত জরুরী দেখা করা প্রয়োজন।সে একজন প্রহরিকে পাঠাল তাকে ডাকার জন্য।

ঘন্টা খানিক পর জ্যোতিষী এল।ইতিমধ্যে কিছু একটা মহলে হয়েছে বলে তিনি আচ করতে পাচ্ছেন।জমিদারের মুখে সবটা শুনে তার মুখাবয়বের পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল।
"আপনার ধ্বংসকারী এসেছে গিয়েছে সাহেব।আগেই সাবধান হতে বলেছি।আপনি শুনেনি আমার কথা।এবার আর আমার কিছুই করার নেই।"
কথাটা বলে আর এক মুহূর্ত ব্যয় করেননি জ্যোতিষী।চোখের পলকের মধ্যে সে বিদায় হল।
তখন কক্ষের বাহির থেকে মেয়েলি কন্ঠ শোনা গেল।
--আসব জমিদার সাহেব।
--আসো।
"আপনার দুপুরের ভোজন তৈরি করেছি।হাত মুখে ধুয়ে আসুন।আমি ততক্ষণে খাবার প্লেটে বাড়ছি।"
"আমার হাতে ভিষণ ব্যথা। খেতে পারব না।তুমি খাইয়ে দেও।"
আশ্চর্য হয়ে তাকাল ইন্ধু।সকাল সকাল তো খুব চটপটে এক বস্তা দম্ভ নিয়ে বের হয়েছিল।হঠাৎ কি এমন ঘটল দুপুরে হাতে আঘাত নিয়ে ফিরল।
তার ভাবনা মাঝে জমিদারের রাগান্বিত স্বর ভেসে এল।
"কি বলছি কানে যাচ্ছে না।খাইয়ে দেও।কথা না শুনলে পশ্চিমের জঙ্গলে হাত পা বেঁধে ফেলে আসব।পরদিন সকালে হাড্ডি ছাড়া এক টুকরোও মাংসও অবশিষ্ট থাকবে না।"

পশ্চিমের জঙ্গলে কথা শুনে আঁতকে উঠল ইন্ধু।লোকসমাগমে শোনা জঙ্গলটি অত্যন্ত ভয়ংকর ও বিপজ্জনক। এ রাস্তা দিয়ে দিনের বেলাও কেউ প্রবেশ করে না সহসা।সেখানে কিনা লোকটা তাকে ফেলে আসবে ।না এটা হতে পারে না।এটা কিন্তু অতিরিক্ত রকমের বাড়াবাড়ি।যা শয়তান যত বাড়াবাড়ি করে নে।সময় ও সুযোগ আসুক।আমিও সুযোগ বুঝে কোপ বসাবো সোজা তোর বুকে। বুঝেছিস নির্বোধ জমিদার।
খাবার মেখে মুখে ধরতেই পরপর কয়েক লোকমা ভাত ঝটপট কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে জমিদার সাহেব গিলে ফেললেন।ইন্ধু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। মনে মনে আওড়াল।
"আজকে এটার পেটে কি ঢুকেছে কি? ইঁদুর ঢুকেছে নাকি। এত খবার কিভাবে খাচ্ছে শয়তানটা?"
"যাও আরও খাবার নিয়ে এসো।প্রচন্ড ক্ষুধার্ত আমি।"
ইন্ধুর ভিষণ ইচ্ছে করছে খাবারের ভিতরে বিষ মিশিয়ে দিতে।তারপর বলতে ইচ্ছে করছে। নে যত ইচ্ছা খা।এরপর তো আর খেতে পারবি না।চির নিদ্রায় শায়িত হবি তখন।সত্যি বলতে এটা সে কখনও বলতে পারবে কিনা সন্দেহ।

জমিদারের মুখে এক এক লোকমা ভাত যখন ঠেলে দিচ্ছিল তখন তার হাতটাকে সবচেয়ে বেশি কুৎসিত মনে হল ।হাতখানা যেন তাকে তাচ্ছিল্যের সুরে উপহাস করছে।
ছিঃ! ইন্ধু ছিঃ!এভাবে একজন পাপিষ্ঠ, নারী লোভি, নিষ্ঠুর জমিদারকে তুমি খাইয়ে দিচ্ছো।তোমার লজ্জাবোধ করছে না পাপিষ্ঠের মুখে অন্ন তুলে ধরতে।
সে ভিষণ বেকায়দায় পড়ে গেল তখন।মনটাকে ভিষণ আচ্ছা করে শাষাল।বলল,খবরদার উল্টাপাল্টা কথা বলবা না।সে আমার মনিব।আর আমি তার ব্যাক্তিগত দাসি।তার হুকুম মানতে আমি বাধ্য।না মানলে জানোই তো সে আমার মন্ডু কেটে উল্লাস করবে নয়ত মাঠে নিয়ে ফুটবল খেলবে।তুমি চাও কি সেটা।নিশ্চয়ই চাও না আমার মন্ডু দিয়ে জমিদার উল্লাস করুন কিংবা ফুটবল খেলুক।তাই চুপচাপ থাকো।
খবার শেষে জমিদারকে শুইয়ে দিয়ে সে বেড়িয়ে গেল।তার এখন অনেক কাজ পড়ে আছে।
পথিমধ্যে প্রধান দাসী নিরুপনার সাথে দেখা হল।তাকে দেখা মাএই চোখ মুখ কুচকে ফেলল।

তর্জনী আঙুল উঠিয়ে বলল,
"তুমি জমিদার সাহেবকে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছো না।এটা কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি রকমের হয়ে গেল। নিজের সীমাবদ্ধের ভিতর থাকো।"
ইন্ধুর মেজাজ চওড়া হতে চাইল সে নিজেকে সংযত রাখার প্রশ্বাস চালাল।
প্রধান দাসি নিরুপনার সামনে গিয়ে বলল,
"আপনি নিশ্চিত জমিদার সাহেবকে পছন্দ করেন।"
তার উপস্থিত বাক্য শুনে মেয়েটি স্তব্ধ হয়ে গেল।বলল,"তুমি জানো কি করে ?"
"কারও কারও চোখের ভাষা বোঝার মতন ক্ষমতা বিধাতা কিছু দিয়েছেন।আপনার উচিত ছিল আমার বদলে জমিদার সাহেবের ব্যাক্তিগত দাসি আপনার হওয়া। তারপরে আপনি তার সেবাযত্ন নিজে নিজে করতেন।এতে অপরকে দেখে তখন ঈর্ষান্বিত হতে হত না।

"তুমি জানো,কার সামনে বসে কথা বলছো।একদম মুখ ছিড়ে ফেলব।আমার কি করা উচিত না অনাচিত সেটা আমাকে বুঝতে দেও বুঝেছো।পথ ছাড়ো অকৃতজ্ঞ মেয়ে।সেদিন কৃতজ্ঞ না করলে তুমি জমিদারের ব্যাক্তিগত দাসি হতে পারতে না। সেটা মনে রেখে তোমার শুকরিয়া আদায় করা উচিত।"
"কৃতজ্ঞতা কেন শিকার করবো?আপনি কি আমাকে কোন রকম সাহায্য করেছেন,করেননি। বরং আমি নিজের চেষ্টা, যোগ্যতা দিয়ে ব্যাক্তিগত দাসি হতে পেরেছি।"
"যতবড় মুখ নয় ততবড় কথা।দেখ,তোমার কি হাল করি?তন্মধ্যে সে ইন্ধুর হাত পিছনের দিকে নিয়ে পিঠের সাথে মুচড়ে ধরল।"

ইন্ধু ঠান্ডা মস্তিষ্ক বলল,
"ব্যথা পাচ্ছি প্রধান দাসি নিরুপনা। হাত ছেড়ে দিন। আমি ধরলে তখন লুকাবার জায়গা পাবেন না।
"কি এত বড় স্পর্ধা তোমার।আমার গায়ে হাত তুলবে।তুলে দেখ সাহস থাকলে।যদি এক বাপের মেয়ে হয়ে থাকো তাহলে দেখি গায়ে হাত তুলো।আমিও দেখি তোমার সাহসের পরিধি।"
মুহূর্তে চোখ দু'টি প্রহিংসার আগুনে জ্বলজ্বল করে উঠলো।ক্রোধে কেঁপে উঠল তার সবাঙ্গ। চোখ দিযে ঝরছে আগুনের লেলিহান ফুলকি।সে লেং মেরে ফেলে দিলো প্রধান দাসি নিরুপনাকে। তার হাত দু'টোকে জব্দ করে ঠিক পিছনে বরাবর পিঠের সাথে মুচড়ে ধরল।কিছুক্ষণের মধ্যে নিরুপনার মনে হল তার হাত দু'টি বুঝে জোড়া থেকে ছিড়ে গিয়েছে। তখন কিছু সৈন্যদের বুটের শব্দ পাওয়া গেল। ইন্ধু নিরুপনাকে এক প্রকার ছুড়ে মারল।
"ফের আমার সাথে লাগতে আসবে না।আমি কিন্তু অত ভাল মানুষ নই।যতটা আমাকে দেখো।এবার তো হাত মুচড়ে ধরেছি।পরের বার ভেঙে ফেলব।"
সে হনহনিয়ে চলে গেল।রেখে গেল প্রহিংসায় জর্জরিত ঈর্ষান্বিত নিরুপনাকে।
নিরুপনা ঠোঁট উল্টিয়ে কেঁদে দিল।বলল,"
"তোমাকে বের করছি দাঁড়াও মহল থেকে।আজই জমিদার সাহেবের কাছে তোমার বিরুদ্ধে নালিশ করবো।"
সে তার কথা রাখল।

সন্ধ্যার সময় জমিদার প্রলয়ের কক্ষে প্রবেশ করে সবটা গড়গড় করে বলে দিল।
তাই জরুরি তলফে ডেকেছে তাকে জমিদার।সে কক্ষে প্রবেশ করতেই দেখল,নিরুপনা মিথ্যা কান্নার নাটক ভালই করছে।
ইন্ধুকে দেখে জমিদার উঠে বসল।বলল,
"সিন্ধু তুমি নিরুপনাকে আঘাত করেছো।"
সোজাসাপ্টা ইন্ধুর উওর।
"জি।"
"সে তোমার বড় তার সাথে বেয়াদবি করা তোমার উচিত হয়নি।কঠিন শাস্তি পাবে তুমি।
এই কে আছো এই মেয়েটাকে নিয়ে যাও। আজ তার রাতের খানা বন্ধ। সারারাত মহলের বাহিরে শিমুল গাছের সাথে উল্টো করে মাথা নিচের দিকে রেখে ঝুলিয়ে রাখো।কাল ভোরে খুলে দিবে ঠিক আছে।"
"জি জি সাহেব।"

একটা শব্দ করল না ইন্ধু।কার কাছে অনুরোধ করবে ঐ নির্দয় জমিদারের কাছে।তার আগেই তার মৃত্যু হোক।নির্বোধ একটা।সত্যি মিথ্যার যাছাই না করে তাকে শাস্তি দিচ্ছে।সেও বোকার মতন মানছে।নেহাৎ পরিস্হিতির শিকার। নয়ত,সব কয়টার মাথাহীন শরির রক্তের গঙ্গায় ভাসত।
ইন্ধুবালার যাওয়ার পথ চিহ্নের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল জমিদার প্রলয়। এই পর্যন্ত যতজন দাস কিংবা দাসীকে সে শাস্তি দিয়েছে। সকলে কম বয়সি তার কাছে ক্ষমা চেয়েছে। অনেকে তো পা ধরে প্রাণ ভিক্ষা পর্যন্ত চেয়েছে।অথচ এই নির্বোধটাকে দেখো কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় নি।বরং এক বুক দম্ভ নিয়ে তার শাস্তি চুপচাপ মেনে নিচ্ছে।ব্যপারটা তার কাছে ভাড়ি অদ্ভুত ঠেকল। এমন কাঠখোট্টা মেয়ে সে আঁধও দেখেনি।দেখা যাক মেয়েটার তার শাস্তির পরিধি নিতে পারে কিনা।

চলমান...

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com