Breaking News

তীব্র ও লুৎফার প্রেম কাহিনী । পর্ব - ১০

দরজায় নিরন্তর করাঘাতের শব্দে বিরক্ত হোলো মিথিলা। চ সূচক শব্দ করল,
শোয়া থেকে উঠে এসে ছিটকিনি টানল।
মেয়ের অক্ষত মুখখানা দেখতেই প্রাণ পেলেন খোরশেদুল।
প্রকাশ না করলেও, গোপনে বুক ভরে দম টেনেছেন তিনি। তারপর
গম্ভীর গলায় বললেন,
“ সকাল থেকে দরজা খুলছিলে না কেন?”
মিথিলা যত যাই হোক বাবাকে মানে,ভয় পায়। উত্তরে, মাথা নুইয়ে বলল,
“ ভালো লাগছিল না কিছু। ”

“ ভোরবেলা অত চেঁচামেচি শোনোনি? তোমার মা যে পরে ব্যথা পেয়েছেন,হাসপাতালে নিয়ে গেলাম টের পাওনি?”
মিথিলা ভীষণ আশ্চর্য বনে চাইল। অবাক কণ্ঠে বলল,
“ মা হাসপাতালে? কেন, কী হয়েছে? ”
পালটা অবাক হলেন খোরশেদুল। এই ঘর আর বসার ঘর কতটা দূরে? সাউন্ডপ্রুফ তো নয়। সালমার মাথা ফাঁটা নিয়ে সকালে হূলস্থুল বাঁধালেন ওনারা। এমনকি আলেয়া অবধি নাকে কাঁদলেন। অথচ মেয়েটা কিছুই জানেনা?
খোরশেদুল ব্যথিত হলেন! ঠিক বুঝেছেন তাহলে। মেয়েটা অধিক শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েছে। স্বামীর ফেলে যাওয়া,আর অত মানুষের খোঁচাখোঁচি! তার মেয়ে বড় আদরে,আহ্লাদে মানুষ। এরকম পরিস্থিতিতে কী কখনও গিয়েছে?
খোরশেদুলের মায়া হলো। পিতৃসুলভ মমতার চাউনী উপচে এলো দু চোখে। এখন মায়ের কথা শুনলে মেয়েটা এরওপর আবার আরেক চিন্তায় পড়বে। থাক বরং!
মিথ্যে বললেন,

“ তেমন কিছুনা। দূর্বল,স্যালাইন দিচ্ছে।”
মিথিলার ছোট জবাব, “ ওহ।”
খোরশেদুল প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললেন,
“ পলাশের সঙ্গে কথা হয়েছে?’’
অচিরে মুখে মেঘ জমল মিথিলার। আগের থেকেও ভার ভার স্বরে জানাল,
“ না। ”
“ ফোন করোনি?”
মিথিলার বলতে খুব লজ্জা লাগছে। তাও জানাল,
“ করেছিলাম। আমাকে ব্লক করে দিয়েছে।”
খোরশেদুল এবার সোজাসুজি শুধালেন ,
“ ওই বখাটে গুলো যা যা বলে গেছিল,সেসব সত্যি?”
মিথিলার চিবুক গলার কাছে ছিল এতক্ষণ। প্রশ্নটায় এবার গলা ফুড়ে বেরিয়ে যাওয়ার প্রয়াস জানাল। যথাযথ উত্তর দিতে ব্যর্থ সে। মিথ্যা বলতে গেলেও সুনিশ্চিত ধরা পড়বেই। চুপ করে থাকলেও বিপদ! কোন দিকে যাবে? কী বেছে নেবে? বিয়ের দুদিনের দিন মানুষ ঘুরেফিরে শহর ছাপিয়ে ফেলে,আর সে কী না এসব প্রেম-ট্রেম নিয়ে পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটছে?
মিথিলার রাগের সবটুকু চড়াও হলো নাহিদের ওপর। কোন কুক্ষণে বলদটার সাথে সম্পর্কে গিয়েছিল কে জানে! নিজেও ভালো থাকবে না,ওকেও ভালো থাকতে দেবে না। সামনে পেলে চড়িয়ে লাল করে দেবে একদম।

খোরশেদুল মেয়ের হাবভাবেই যা বোঝার বুঝে নিলেন। হতাশ হলেন ভীষণ! আক্ষেপ জানিয়ে বললেন,
“ তোমার থেকে আমি এসব আশা করিনি মিথিলা! ওরকম একটা মাস্তানের বন্ধু তো মাস্তানই হবে। কী রুচিহীনের মতো কাজ করেছ,ছি!ছি! আজ সব মান ইজ্জত এইভাবে জলে ডুবল আমার। ”
মিথিলা আর্ত চোখে তাকায়, ভেজা স্বরে বলে,
“ আব্বু প্লিজ! এনিয়ে কাল থেকে সবার উল্টোপাল্টা কথা শুনছি। অন্তত তুমিও এসব বোলো না।”
খোরশেদুল লম্বা শ্বাস ঝাড়লেন। বললেন,
“ ঠিক আছে। ব্লান্ডার যা করার তো করেই ফেলেছো। এখন কীভাবে কী ঠিক করবে কিছু ভাবলে?”
মিথিলা কালো চেহারায়,দুপাশে মাথা নাড়ল। সে কাল থেকে ভেবেছে,কিন্তু কোনও সুরাহা করতে পারেনি। পলাশ এত শক্ত মানুষ! ঠিক কী বলে ওকে বাগে আনা যাবে,মস্তিষ্কে ধাঁরাল বুদ্ধিটা কোনও মতেই আসেনি!
খোরশেদুল বললেন,
“ তাহলে আমি যা বলছি শোনো,পলাশের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করো। হাল ছেডো না। চেষ্টা করতেই থাকো। তোমার নম্বর ব্লক করলে অন্য নম্বর থেকে কল দাও। এভাবে বিয়ের পরদিন বউ ফেলে রাখা তো ভালো কথা নয়। তাও একটা নরমাল ইস্যু নিয়ে এত রিয়াক্ট করবে কেন? ”
মিথিলা দুঃখভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলল,
“ ও মনে হয় আর আমাকে ফিরিয়ে নেবেনা আব্বু। ”

খোরশেদুল শক্ত কণ্ঠে বললেন,
“ ফিরিয়ে নেবেনা বললেই হলো? এটা কি মগের-মুল্লুক পেয়েছে? দেশে আঈণ-কানুন বলেও একটা কথা আছে। ভালোয় ভালোয় আসতে বলো,নাহলে আমিও অন্য ব্যবস্থা নেব। ”
গজগজে ক্রোধ ঝেড়ে চলে গেলেন তিনি। কিন্তু মিথিলার নিভু নেত্র জ্বলজ্বল করে উঠল । দপদপ করে সাড়া দিলো মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষ।
এইত,এইত উপায় পেয়েছে। এতটা সময় ভেবে ভেবেও যা উদ্ধার করতে পারেনি,বাবার এক কথায় তা নিজে থেকে হানা দিলো এক্ষুণি।
মিথিলা ত্রস্ত দোর চাপাল। বিছানা থেকে ফোন হাতে তুলল । ঝটপট কল লাগাল পলাশ লেখা নম্বরে।
তবে,ব্লাকলিস্ট থেকে নম্বরটা তখনও সরায়নি পলাশ।
মিথিলা নাক ফুলিয়ে স্ক্রিনে চোখ বোলায়। ঠিক আছে, কোনও ব্যাপার না।
কীভাবে ব্লক ছোটাতে হয় ভালো করে জানা আছে ওর।
মিথিলা তৎপর হস্তে গোটা গোটা মেসেজ টাইপ করে পাঠাল,
“ তুমি কি ফোন ধরবে? নাকী আমি কোনও স্টেপ নিতে বাধ্য হব পলাশ? আর যেরকম ভাবছি তেমনটা করলে,সেটা অবশ্যই তোমার জন্য সুখের হবেনা।”
তারপর অপেক্ষা করল উত্তরের ৷ ডোজে কাজ হবে কী না চিন্তিত সে।
পুরো চার মিনিট ফোন হাতে নিয়ে পায়চারী করার মধ্যেই স্ক্রিন জ্বলে ওঠে। পলাশ কল ব্যাক করেছে। ক্রুর হাসল মিথিলা। রিসিভ করে কানে গুঁজতেই, ওপাশ থেকে শশব্যস্ত প্রশ্ন এলো,

“ স্টেপ নেবে মানে? কী বলতে চাইছো তুমি?”
“ তুমি যা বুঝেছ তাই।”
“ আমি কী বুঝব? তোমার থেকে শুনতে চাই। ”
“ সেসব পরে শোনাচ্ছি। আগে তুমি বলো,এভাবে আমাকে এখানে রেখে যাওয়ার মানে কী?”
“ মানে কী আবার? বলেইত এলাম। তোমার মত লোভী,গোল্ড ডিগার মেয়ের আমার ঘরে কোনও জায়গা নেই। সবই তো শুনছি। কী বাঁধাই করা রেকর্ড তোমার! অত মানুষের মধ্যে আমার মান -সম্মান যাস্ট ধূলোয় মিশিয়ে দিয়েছ।”
মিথিলা তেঁতে ওঠে,
“ একদম ফালতু কথা বলবে না! বিয়ের আগে সবারই কম-বেশি এসব থাকে। তোমার নেই মনে হয়? খোঁজ নিলে দেখা যাবে তোমার রেকর্ড আমার থেকেও সুন্দর! ”
পলাশ কাঠখোট্টা জবাব দিলো,
“ আমার এরকম ফালতু ক্যরেক্টর না। ”
মিথিলা ফুঁসে বলল,
“ চুপ করো। দুচারটে প্রেম এ যুগের খুব কমন ব্যাপার। এসব দিয়ে তুমি আমার চরিত্র মাপতে পারো না। ”
তারপর চোখ বুজে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করে বলল,
“ আচ্ছা বেশ,এত কথার দরকার নেই। আমি যা বলছি এখন তাই শোনো,চুপচাপ ভদ্র ছেলের মতোন এসে আমাকে নিয়ে যাও ।”

পলাশের জবাব আসে,
“ মাথা খারাপ নাকী? শোনোনি কী বললাম? তোমাকে আমি ফিরিয়ে নিচ্ছি না।”
মিথিলা ভ্রু উঁচাল,
' আচ্ছা? বেশ,নিতে হবেনা। আমি বরং থানায় গিয়ে একটা মামলা ঠুকে আসি? বলি যে,আমার স্বামী বিয়ের পরদিন বিনা কারণে আমাকে বাপের বাড়ি ফেলে গিয়েছে। কারণ সে অন্য নারীর সঙ্গে পরকীয়ার সম্পর্কে লিপ্ত। বা বলব যে,আমার বাবা যৌতুক দিতে চাননি দেখে নারাজ হয়েছে।”
পলাশ বিস্ময়ে হা হয়ে বলল,
“ হোয়্যাট রাবিশ! আমি এরকম কিছু করিনি। তাছাড়া প্রমাণ কী এসবের?”
“ তাহলে আমি বিয়ের আগে যা যা করলাম,তোমার কাছে সেসবের প্রমাণ কোথায়? তুমিও তবে অযথা ব্লেইম করছো আমাকে। তাও কে এসে কী না কী বলে গেছে সে নিয়ে। শোনো পলাশ,একশটা বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেক আপ করলেও আঈনে কিন্তু শাস্তি নেই। কিন্তু বিয়ের পর অহেতুক কারণে বউ রেখে গেলে,ফেরত না নিতে চাইলে আঈণে কিন্তু এর শাস্তি অনেক ভয়াবহ। অন্তত মামলার চক্করে ইঞ্জিনিয়ারিং করা ছুটে যাবে তোমার। আর বিদেশ যাওয়ার কথা তো বাদই দাও। এখন তোমার একার সম্মান যাচ্ছে,তখন তোমার পুরো পরিবারের সম্মান কোথায় যাবে ভাবতে পারছো?”

“ তুমি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছো?”
মিথিলা ভণিতাহীন বলল,
“ দেখাচ্ছি। আর তুমি নিতে না এলে,কাজটা আমি করবও। তুমি আমাকে চেনো না। এখন বলো, তুমি কী করতে চাও? ভালোয় ভালোয় আমাকে নিয়ে সংসার করবে,নাকী নিছক এসব ঝামেলায় জড়াবে?”
ওপাশে তৎক্ষনাৎ নীরবতা নামল । কপালে ভাঁজ পড়ল মিথিলার। দুদিনের আলাপে পলাশকে অত ভালো সে আয়ত্ব করতে পারেনি। তাই এখনও ওর মতিগতি নিয়ে শঙ্কিত।
কিন্তু পলাশ একটু চুপ থেকে বলল,
“ ঠিক আছে। বিকেলে আসব। ’’
মিথিলার মিইয়ে থাকা অনুচিন্তিত মুখখানা চকচক করে উঠল। স্ফুর্ত চিত্তে বলল,
“ ঠিক আছে, রাখছি। ”
পলাশ লাইন কাটল। মিথিলা বিজয়ী হাসল বুক ফুলিয়ে।
ঠোঁট ভর্তি গাঢ় পৈশাচিক আনন্দ! সে স্ক্রিনের দিক চেয়ে বলল,
“ তোমাকে চালাক ভেবেছিলাম৷ অথচ তুমি সেই নাহিদের মতোই আরেকটা গাঁধা বের হলে। ”

সালমা বেগমকে হাসপাতাল থেকে সন্ধ্যে নাগাদ ছাড়া হলো। ওনার দূর্বলতায় কাবু দেহটা সবাই ধরা-ধরি করে নিয়ে এলো বাড়িতে।
খোরশেদুল অফিস থেকে আবার হাসপাতালে গিয়েছিলেন। অতটুকু সময়, আলেয়া বানু আর সালমার ভাইয়ের বউ ছিলেন কাছে।
রাহাত দরজা খুলল। ওকে আর হাসপাতালে নেওয়া হয়নি। ছোট মানুষ, রোগীদের ভেতর গিয়ে কাজ নেই।
রাহাত মাকে দেখতেই গতিতে জড়িয়ে ধরল । এক প্রকার হামলে পড়ল ওনার বুকের ওপর। প্রকোপে সালমা পরে যেতে নিলেন।
খোরশেদুল দাঁড়িয়ে ছিলেন পেছনে। চট করে ধরে ফেললেন স্ত্রীকে। সালমা বেগম চাইলেন একপল। গম্ভীর মুখে আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতেই আহত হলেন ভদ্রলোক ।
সেদিনের পর থেকে সালমা এখন অবধি একটি কথাও ওনার সঙ্গে বলেননি। রাহাত মাকে জড়িয়ে রেখেই বলল,
“ আম্মু তোমার খুব লেগেছিল? ব্যথা কী একটুও কমেছে?”
আলেয়া বানু বললেন,
“ দাদুবাই,এগুলান সব পরে হুইনো, অহন মায়রে বইতে দাও। ”
সালমা মাথায় হাত বুলিয়ে একটু হাসলেন। রাহাত সরে এলো। তিনি ভেতরে ঢুকে, আস্তে-ধীরে সোফায় বসলেন। পাশে বসলেন আলেয়া। এদিক-ওদিক চেয়ে বললেন,
“ কী রে,তোর মাইয়া কই খোরশেদ?”

খোরশেদুল বিষয়টা এতক্ষণে খেয়াল করেছেন। সেই যে মেয়েটাকে দুপুরে পলাশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে গেলেন, তারপর আর কথা হয়নি। ত্বরিত মেয়েকে হাঁক ছুড়লেন তিনি।
দুবার ডাকেই দরজা খুলল মিথিলা। অথচ এত সময়ে বসার ঘরের একটা কথাতেও তার সাড়া ছিল না। মিথিলার বেশ-ভূষা দেখতেই আলেয়া বানু ভ্রু তুললেন কপালে ।
গাঢ় রঙের দামী জামদানি,গয়না, পরিপাটি করে বাঁধা চুল, চেহারায় অল্প-বিস্তর মেক- আপ। আলেয়া বানু পাতা ঝাপটালেন চোখের। স্বামী ওইভাবে রেখে গেল,মা এলো হাসপাতাল থেকে তিনি ধরেই বসেছিলেন, মেয়েটা হয়ত কেঁদে চোখ-মুখ ফোলাবে। কিন্তু এ তো….
মিথিলা হাসি- হাসি মুখে বাবার পাশে এসে দাঁড়াল।
“ ডাকছিলে আব্বু?”
খোরশেদুল মেয়ের আপাদমস্তক দেখে বললেন,
“ কোথাও যাচ্ছো?”
সে হৃষ্ট চিত্তে জানাল,
“ হ্যাঁ। পলাশ আসছে নিতে। তাই তৈরী হলাম ।”

খোরশেদুলের বক্ষ হতে দুশ্চিন্তার ভারি পাথরটা তত্র নেমে গেল। এ নিয়ে গতকাল থেকে কী যে ভাবনায় পড়েছিলেন!
সালমা বেগম অবাক হয়ে বললেন,
“ নিতে আসবে মানে? কোথায় গিয়েছে ও? আর কাল এলি আজ যাবি কেন?”
গতকালকের ঘটনার এক ফোঁটাও জানেন না তিনি। পরপর ঘটে যাওয়া দূর্ঘটনায় কিছু টেরও পাননি। আলেয়া বানু হা করলেন বলতে, ওমনি খোরশেদুল চোখ ইশারা করলেন।
বৃদ্ধা ইঙ্গিত বুঝে থেমে গেলেন। ছেলের ওপর দিয়ে তো আর চলা যায় না।
মিথিলা আমতা-আমতা করে বলল,
“ না আসলে,ওর একটা কাজ পড়েছিল, তাই চলে গিয়েছে। তুমি অসুস্থ তাই আর থেকে বাড়তি ঝামেলা করবে না বলল।”
সালমা বললেন,
“ এতে ঝামেলার কী আছে? জামাই মানুষ। প্রথম বার শ্বশুর বাড়ি আসবে। বেড়াবেনা? আমি যতটুকু পারি করার চেষ্টা করব।”
খোরশেদুল বললেন,
“ থাক না। এই সময় এত প্রেশার ঠিক হবেনা তোমার। ওরা আবার পরে সময় করে আসবে না হয়। ”
মিথিলা তাল মিলিয়ে বলল, “ হ্যাঁ হ্যাঁ আবার পরে আসব আম্মু।”
আলেয়া ফোস করে শ্বাস ফেললেন। টেনে টেনে বললেন ,
“ তোর কইন্ন্যা আবার মার পেশারও বুজে? এই যে কত সমায় হইল মায়ডা আইল হাসপাতাল দিয়া। একবার ত জিগাইলও না ভালা মন্দ। মায়ের মাথাত যে এত্ত বড় একখান পট্টি, ফিইরাও তো দেখল না।”
মিথিলা কটমট করে উঠল।
খোরশেদুল মেয়ের পক্ষ নিয়ে বললেন,
“ থাক আম্মা, ছেলেমানুষ! অত শত বোঝে না।”
“ হ পোলামানুষ। আকাম তো ঠিকই করবার পারে।'
সালমা বুঝতে না পেরে বললেন,
“ ও কী করেছে আম্মা?”

মিথিলা জ্বলে উঠল, “ আব্বু তোমার মাকে থামতে বলো। বুড়ি মানুষ এত কথা বলে কেন?”
খোরশেদুল চুপ থাকলেও সালমা ধমক দিলেন মেয়েকে। কড়া কণ্ঠে বললেন,
“ মিথিলা! উনি তোমার দাদু। গুরুজনের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে?”
মিথিলা চুপ করলেও চেহারায় বিরক্তি। আলেয়া বানু পূত্রবধুর দিকে আপ্লুত চোখে চাইলেন। ছেলে তার সম্মান না রাখলেও,পরের মেয়ে ঠিক রাখছে।
রাহাত কাচের গ্লাসে পানি হাতে ছুটে এলো তখন। মায়ের দিক বাড়িয়ে বলল,
“ নাও।”
জলের কথা সালমা বলেননি । ছেলেটা নিজে থেকে আনায় সবাই বিস্মিত হলো। সালমা মৃদু হেসে গ্লাস হাতে নিলেন। চুমুক দিতে গিয়ে খেয়াল করলেন পানিতে চুল ভাসছে । হেসে ফেললেন আরো। বললেন,
“ এটাতে ময়লা আব্বু। খাওয়া যাবেনা।”
রাহাত ভেজা হাত পেটের কাছে জামায় মুছছিল। কথাটায় চোখ প্রকট করে বলল,
“ ময়লা? কিন্তু আমিতো ভালো করে দেখে আনলাম। আচ্ছা দাও, পালটে আবার ভালো পানি আনছি।”
গ্লাস নিয়ে রাহাত আবার চলে গেল। ফিরে এলো মিনিটে। আলেয়া বানু গদগদ হয়ে বললেন,
“ কী সুন্দার আমার নাতিডা! মার দিক কত খেইল। মাইয়ারে মানুষ করতে না পারলেও পোলা খুব সুন্দার মানুষ করছো বউ।'

সালমা ছোট্ট করে শ্বাস নিলেন। আলেয়া বানু আগের দিনের মানুষ। মেয়ে নাতীর প্রতি প্রথম থেকেই বিমুখ ছিলেন। যতটা নারাজ হয়েছিলেন মিথিলা হওয়ার সময়, ততটাই প্রসন্ন ছিলেন রাহাত আসার খুশিতে। এমনকি ওনার দৃষ্টিতে পুষ্পিতাকে বাড়িতে ঠাঁই দেওয়ার মত ভয়াবহ অপরাধটাও মাফ পেয়েছিল এই একটা কারণে।
ঢাকায় বেড়াতে এলে,বা শ্বশুর আলয়ে গেলেই মিথিলার সঙ্গে বৃদ্ধার সর্বদা ঠান্ডা যুদ্ধ বাঁধত। তাই আজকেও ধরে নিলেন হয়ত এজন্যে এসব বলছে।
অন্যদিকে মিথিলা দাদীর প্রতিটা কথায় খটমট করছে নীরবে। মায়ের জন্য কিছু বলতেও পারছে না। তবে, এত এত ঘটনার মধ্যেও, একমাত্র মহিদুল আলম নিশ্চুপ বসে। পৌঢ় লোকটি হ্যাঁ তেও নেই,না তেও নেই।
সালমা স্বামীর দিক চাইলেন। কণ্ঠে নম্রতা,
“ তোমার ওপর আজ অনেক ধকল গেল তাইনা? ”

খোরশেদুল একটু নড়েচড়ে দাঁড়ালেন,
“ হু? না কীসের ধকল? ”
“ সকাল থেকেই তো কত ছোটাছুটি করতে দেখলাম,তাই আর কী!”
খোরশেদুল মনে মনে খুশি হয়েছেন। ভাবলেন, সালমা তাহলে পুষ্পিতাকে তাড়িয়ে দেওয়া নিয়ে আর রাগ করে নেই। সহজ ভাবে কিছু বলতে নিলেন, সহসা আটকে গেলেন ওনার পরের কথায়,
“ আজ যদি পুষ্পিতাটা থাকত,কারোর কিছু করতে হতোনা। সব একা হাতে সামলাতো মেয়েটা। আমার যত্ন নিতো৷ কতবার অসুস্থ হয়েছি, ঘরের কেউ টেরই পায়নি। পাবে কেমন করে,এর আগেই হূলস্থুল বাঁধিয়ে সেবা করে একদম সুস্থ বানিয়ে ফেলেছে।”
চোখের অশ্রুজলটুকু বেঁয়ে ওনার গাল অবধি এলো। খোরশেদুলের শান্ত মেজাজ মুহুর্তে চটে যায়। কঠিন কিছু বলবেন ভেবেও গিলে নিলেন সালমা অসুস্থ বলে।
আশ্চর্যজনক ভাবে আলেয়া বানুও স্বায় মেলালেন আজ। মন খারাপ করে বললেন,
“ হ কথা-খানা সোটিক। আগে যেতবার আইছি,মায়টা যত্ন-আত্তির তুরটি রাহেনাই। আন্তরিক আছিল। যেন আমি ওর নিজেরই দাদী।”
মিথিলা আরেক দিক ফিরে,দুই গাল ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল। তিঁতিবিরক্ত সে। অতীষ্ঠ পুষ্পিতার প্রসংশা শুনতে শুনতে।

অধৈর্য্য চোখে দেয়ালঘড়ি দেখল ও। পলাশ আসবে কখন? ও বাড়ি গিয়ে কত কাজ ওর! কত গোছ-গাছ বাকী। এই বৃহস্পতিবারই তো কানাডার ফ্লাইট। ভাগ্যিস আগে-ভাগে তার ভিসা -পাসপোর্ট করা ছিল। নাহলে এত দ্রুত তো আর যাওয়া হোতো না। মিথিলার লোঁচনদ্বয় ধীরে-ধীরে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বৈদেশের বিলাসবহুল জীবনের চিত্রটাও এঁকে এঁকে লোভে টলমল করল ভেতরটা।
খোরশেদুল ও সমান ভাবে পুষ্পিতার প্রসংশা শুনতে অনীহ। প্রসঙ্গ কাটাতে বললেন,
“ আম্মা,আমি বাজার আনছি। ফ্রিজে মাছ আছে। ওর তো শরীর ভালো না, আপনি একটু কষ্ট করে এ বেলার রান্নাটা করে দিয়েন।”
আলেয়া ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“ ক্যান? আমি রান্দুম ক্যান? তোর এত্ত বড় কইন্যা কী কইরব? হেয় থাকতে রান্দোন-বারোন আমি পারতাম না।”
মিথিলা তাজ্জব বনে বলল
“ আমি রান্না করব? আমি? আমার হাতের মেহেদী এখনও ওঠেনি আর আমি কী-না মাছ কাটব?মশলা ঘুঁটব? ইয়াক!”

আলেয়া মুখ বেঁকিয়ে বললেন,
“ এহ, আইছে আমার রাইজরানী! শউর বাড়িত গেলে, দুইডা দিন পর এমনেই চূলার আগুন ঠেলোন লাগব। তহন এইসোমোস্ত মেহেন্দী ছুইট্টা যাইব বুইঝছো? ”
মিথিলা রেগেমেগে কিছু বলতে চাইল।
সালমা থামিয়ে দিয়ে বললেন,
“ কাউকে কিছু করতে হবেনা আম্মা। আমি করব যা করার। ”
আলেয়া প্রতিবাদ করে উঠলেন,
“ ক্যান? তুমি এই রোগা শইলে কাম করবা ক্যান? এইসব কইরাই মাইয়াডারে মাথায় তুইলা ফ্যালছো। রানলে হেতির জাত যাইব? পরের ঘরে যাইয়া রানব না?”
মিথিলা সাথে সাথে বলল,
“ নো ওয়ে! পলাশদের বাড়িতে রান্নার আলাদা লোক আছে। আমি কী যেন তেন ঘরের বউ হয়েছি নাকী!'
“ তা হইবা কেন,তুমি তো.. ”
খোরশেদুল মাঝপথে, ‘চ’ সূচক শব্দ করে বললেন,
“ উফ! থামো তো তোমরা। রান্না আমি করব, হয়েছে? যত্তসব।”
“ হেইয়া তো করবাই বাপ! যা মাইয়া বানাইছো! এহন রানবা,দুইদিন পর দেকবা এই মাইয়ার লইগা আরো কত কী করোন লাগতাছে।”
আলেয়া বিরতি নিতেই কলিংবেল বাজল। খোরশেদুল আর দ্বিতীয় জবাবে গেলেন না। মিথিলা উৎফুল্ল চিত্তে বলল,
“ পলাশ এসছে মনে হয়। ”
খোরশেদুল সদর দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। ছিটকিনি টানলেন রাতা-রাতি। সত্যি সত্যি ওপাশে পলাশ দাঁড়িয়ে। ওনাকে দেখে ছেলেটা সালাম দিলো। খোরশেদুল উত্তর করলেন, ভেতর ভেতর হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। যাক! ঘটনা বেশি দূর গড়ানোর আগেই মিটে গিয়েছে।

চলবে....

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com