ফারহানের দেওয়া কাগজটা নিয়ে ঘরে এসে ঘরের দরজা আটকালো অর্পা। এর আগেও অনেক চিঠি সে পেয়েছে ছেলেদের কাছ থেকে।
কেউবা ক্লাসরুমে বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে দিয়েছে, কেউবা রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় অর্পার সামনে ছুঁড়ে মেরেছে, কেউবা কারো হাত দিয়ে দিয়েছে এমন অনেক ভাবেই অর্পা এর আগেও চিঠি পেয়েছে তবে সেগুলো পড়ার প্রতি তেমন আগ্রহ না দেখালেও এই কাগজটার ভিতর কি লিখা আছে তা পড়ার জন্য তর সইছেনা অর্পার; তাইতো স্কুল থেকে বাড়ি এসে কোন দিক না তাকিয়েই ঘরের দরজা দিয়েছে সে।
ঘরে এসে প্রথমে কাঁধের ব্যাগটা পড়ার টেবিলে রাখলো অর্পা এরপর কাঠের চেয়ারটা বের করে পড়ার টেবিলে চার ভাজ করা সাদা রঙের কাগজটা মেলিয়ে রাখলো।
সাদা কাগজের ওপরে কালো রঙের কালিতে খুব সুন্দর ঝরঝরে অক্ষরে লিখা আছে "তোমার হাসিটা খুব সুন্দর।" তোমার হাসিটা খুব সুন্দর এই এতটুকুই লিখা আছে কাগজের উপরে। অর্পা লিখাটা কয়েকবার পড়লো তারপর নিজে নিজেই বললো, "এই কথাটা মুখে বলতেই পারতো, এত নাটক করে কাগজে লিখে দেওয়ার কি আছে বাপু।
একা একা কথা বলা শেষ করে কাগজটা আবার আগের মত চার ভাজ করে তার ডায়েরিতে রেখে দিলো অর্পা। ডায়েরিটা সে লুকিয়েই রাখে কারণ অথৈ দেখলে সমস্যা হবে।
ডায়েরিতে সে তার দৈনন্দিন সব ঘটনা লিখে রাখে। ডায়েরিটাকে অর্পা তার গোপন জায়গায় রেখে স্কুল ড্রেসটা খুলে বাড়িতে পড়ার সালোয়ার কামিজ পড়ে নিয়ে বাইরে আসার জন্য দরজা খুলতেই দরজার সামনে তার বড় ভাইয়ের বউকে দেখতে পেলো। অর্পারা পাঁচ ভাইবোন।
তিন ভাই আর দুইবোন। অর্পা চার নাম্বার ভাইবোনের মধ্যে। বড় তিন ভাইয়ের মধ্যে দুই ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে তিন নাম্বারটার এখনো বিয়ে হয়নি। সে পড়াশোনা করে। অর্পার বড় ভাবি আশা মুচকি হেসে অর্পাকে বললো, "কি ব্যাপার ননদিনী, স্কুল থেকে এসেই দরজা দিয়েছো ঘরের ব্যাপার কি?"
অর্পা চিঠির কথাটা চেপে গিয়ে আশাকে বললো, "ড্রেস চেঞ্জ করছিলাম ভাবি।"
"ওহ আচ্ছা, তাই বলো!" আশা কথাটা বলে শাড়ির আঁচলের তল থেকে একটা টকটকে লাল গোলাপ আর তার সাথে একটা খাম বের করে অর্পাকে বললো,
"দরজার সামনে এই ফুল আর খামটা পড়ে ছিলো। হাতে নিয়ে দেখি খামের ওপরে তোমার নাম লিখা। ভাগ্যিস আমি দেখেছিলাম। অন্য কেউ দেখলে তোমার আজ খবর হয়ে যেতো অর্পা।" অর্পা খামটা আর ফুলটা হাতে নিয়ে বললো,
"কোন ফাজিল এইটা দিয়েছে! তাও আবার এইভাবে। কোন আক্কেল নাই নাকি ব্যাটার।"
আশা এদিক- ওদিক তাকিয়ে সাবধানী গলায় বললো,
"কে দিয়েছে কে জানে! তোমার কোন আশিক মনে হয় যাইহোক এখন লুকিয়ে রাখো পরে দেখো কে দিয়েছে এখন যাও গোসল করে নাও নাহলে আম্মা আবার রেগে যাবে।"
"হ্যাঁ ভাবি, তুমি যাও আমি আসছি।"
আচ্ছা তাড়াতাড়ি।" আশা চলে গেলো অর্পার ঘরের দরজার সামনে থেকে। অর্পা ঘরে এসে চিঠির খামটা আর ফুলটা লুকিয়ে রেখে দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে গোসলখানায় গিয়ে ঢুকলো। অর্পা মনে করেছিলো আজ গোসল করার সময় চুলে শ্যাম্পু করবে কিন্তু এই চিঠিগুলোর চক্করে পড়ে দেরি হয়ে গেলো তাই শ্যাম্পু না করেই সে গোসল করে নিলো।
ভাত খেতে বসে অর্পার খুশখুশানি লক্ষ্য করে অর্পার মেজো ভাবি 'তমা' অর্পাকে বললো, "কি ব্যাপার অর্পা? রান্না ভালো হয়নি? খাচ্ছোনা কেনো?" অর্পা এক লোকমা ভাত সাথে তরকারি মিশিয়ে মুখে নিয়ে বললো, "খুব ভালো রান্না হয়েছে ভাবি। কে রান্না করেছে?" তমা গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বললো, "আমি রেঁধেছি।" অর্পা আরো এক লোকমা ভাত মুখে নিয়ে সেটা গিলে নিয়ে বললো, "খুব ভালো রান্না হয়েছে। তোমার হাতে জাদু আছে" বলে এক গাল মুচকি হাসলো অর্পা।
তমাও মুচকি হেসে আশার দিকে তাকিয়ে বললো, "ভাবি আরো ভালো রান্না করে। আমিতো ভাবির মত পারিইনা।" অর্পার পাশে বসে খাচ্ছিলো অর্পার তিন নাম্বার ভাই 'আকাশ'! আকাশ মিনমিনিয়ে অর্পার কানের কাছে এসে তমাকে উদ্দেশ্য করে কিন্তু তমাকে না শুনিয়ে বললো, "আজিবন সাধনা করলেও তুমি 'বড় ভাবি'র মত রাঁধতে পারবেনা তমা বেগম।" অর্পা আকাশের কথা শুনে ফিসফিসিয়ে বললো, "চুপ করো ছোট ভাইয়া। শুনলে তোমার খবর করবে মেজো ভাবি।"
তাড়াতাড়ি দুপুরের খাওয়া শেষ করে অর্পা চলে আসলো রুমে। আসার আগে আকাশের পিঠে কিল বসাতে ভূলেনি। রুমে এসে সেই খামটা আর গোলাপ ফুলটা বের করে ফুলটাকে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে টেবিলের উপর রেখে দিলো এরপর খামের একটা মাথা ছিড়ে ভেতরে রাখা চিঠিটা বের করে চিঠির ভাজটা খুললো। সেই একই হাতের লেখা চিঠিটায়। অর্পার আর বুঝতে বাকি থাকলোনা চিঠিটা ফারহান দিয়েছে। চিঠিতে বেশি কিছু লিখা নাই তবে আগের চিঠিটার থেকে একটু বেশি লিখা আছে।
চিঠিতে গোটা গোটা অক্ষরে ফারহান লিখেছে, " এত সুন্দরভাবে কথা বলো কেনো তুমি? এখন আমার তোমার কথা শুনতে ইচ্ছা করছে। আমার ফোন নাম্বারটা দিলাম। এই নাম্বারে মিসকল দিয়ো প্রিয়তমা।" অর্পা চিঠিটা হাতে ধরে রেখেই মনে মনে বললো, "তমা তো মেজোভাবির নাম। এবার কি সে এই চিঠিটা মেজো ভাবিকে দিয়েছে! ছেলে দেখছি ভারি লুচু মার্কা। বিবাহিত মেয়েদের দিকেও নজর দেয় ছ্যা ছ্যা ছ্যাহ..."!
"এই অর্পা, আজ বাথরুমেই থাকার মতলব এটেছিস নাকি? বের হচ্ছিসনা ক্যান? বের হ!" অর্পার মায়ের চিল্লানিতে অর্পা অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে আসলো। স্মৃতির দরজাটাকে আস্তে করে বন্ধ করে দিলো মনের চাবিকাঠি দিয়ে।
"কিরে, কথা বলছিস না ক্যান? ঘুমিয়ে গেছিস নাকি?"
"এইতো আম্মা বের হচ্ছি, আর একটু সময় লাগবে।
"তাড়াতাড়ি বের হোন নবাবজাদি। আপনার ভাবিরা আপনার জন্য খাবার গরম করে বসে আছে।" অর্পার মা কথাগুলো বলে বাথরুমের সামনে থেকে চলে গেলো। অর্পার মা চলে যাওয়ার কিছু সময় পর অর্পা বের হলো বাথরুম থেকে। অনেক্ষণ পানির নিচে থাকার কারণে আর কাঁদার কারো অর্পার চোখদুটো লাল ফকটকে হয়ে আছে নেশাখোরদের মত। মাথাটাও খুব ব্যাথা করছে সাথে শরীরটাও জ্বর জ্বর ভাব। অর্পা ডাইনিং রুমে আসতেই আশা তাকে চেয়ারে বসালো।
তমা অপলকভাবে অর্পার মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললো, "ওই ছেলেটাকে বিয়েও করেছো অর্পা?"
তমার কথা শুনে অর্পা আর আশা তমার দিকে তাকালো।
আশা বললো, "এসব কথা এখন থাক তমা।
আম্মা শুনতে পেলে রাগারাগি করবে। তুমি বরং অর্পার জন্য এক কাপ রঙ চা বানিয়ে নিয়ে আসো।
অর্পা আশার হাতের ওপর হাত রেখে বললো, "এখন চা খাবোনা ভাবি।
আশা অর্পার মাথায় হাত রেখে আদুরে গলায় বললো,
অনেকক্ষণ পানির নিচে ছিলে, মাথা যে তোমার ধরেছে তোমার চোখ-মুখ দেখেই বুঝতে পারছি।
এক কাপ রঙ চা খাও, শান্তি পাবা।" অর্পা মাথায় প্যাঁচানো গামছাটা চুল থেকে ছাড়াতে ছাড়াতে
তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো, "আর শান্তি! শান্তির মা গায়েব হয়ে গেছে বড় ভাবি।
আর আমার জীবনে শান্তি আসবেনা।"
"তোমার গল্পে আমি না থাকলেও,
আমার গল্পে থাকবে তুমি আজীবন।
আমার প্রতিটি নিশ্বাসে থাকবে তোমার বিচরণ।
তুমি চাও আর নাইবা চাও।"
জেলখানায় গুটিশুটি মেরে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে ফারহান।
বন্ধ চোখের আড়ালে সে অর্পার মুখটাকে স্মরণ করছে। কি সুন্দর মুখখানা অর্পার।
ফারহান যেদিন ছাদে অর্পাকে সাদা রঙের শাড়ি পড়া অবস্থায় দেখেছিলো
সেদিনি সে অর্পার মাঝে হারিয়ে গিয়েছিলো।
সেদিন বার বার নিজেকে শাসন করেছিলো সে!
নিজেই নিজেকে বলেছিলো "হারিয়ে যাসনা ফারহান।
মেয়েরা ছলনাময়ী, এরা শুধু নিজেকে ভালোবাসে! অন্য কাউকে এরা ভালোবাসেনা।
আতিক ভাইয়ের সাথে কত অন্যায় হয়েছিলো তুই তো নিজে দেখেছিলি।
তাই সাবধান করছি তাকাস না। দেখিসনা ওই শুভ্র রঙের শাড়ি পড়া রুপবতী ললনাকে।
দেখলেই তুই নিজেকে ওর মাঝে হারিয়ে ফেলবি।"
আতিক নামের লোকটা ফারহানের খুব কাছের মানুষ।
আতিক এক মেয়েকে খুব ভালোবাসতো।
মেয়েটাও তাকে খুব ভালোবাসতো কিন্তু
একদিন হঠাৎ আতিক শোনে তার প্রেমিকা টাকাওয়ালা এক ছেলেকে বিয়ে করে ফেলেছে।
এরপর আতিক সুইসাইড করতে যাই কিন্তু ভাগ্য ভালো ছিলো সে বেঁচে গিয়েছে।
আতিকের প্রেম-কাহিনীটা পুরোটাই ফারহান জানতো।
আতিককে ছ্যাকা খেতে দেখে ফারহান মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো যে সে কখনো প্রেম করবেনা।
কখনো কোন মেয়েকে দেখে পাগল ও হবেনা কিন্তু
অর্পাকে দেখে সব কিছু কেমন উলট-পালট হয়ে গেলো ফারহানের।
নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলোনা সে। হারিয়েই গেলো সে অর্পার মাঝে।
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com