Breaking News

গল্পটা এমনই । পর্ব - ০১

হাঁটুতে ভর দিয়ে কোর্টের মেঝেতেই বসে পড়লো ফারহান। মুখে লেপ্টে আছে অপমানের কালো ধোঁয়া, চোখে অবিশ্বাসের পাহাড়। সেই পাহাড় সমান অবিশ্বাস নিয়ে সে তাকিয়ে আছে সামনে হেঁটে চলে যাওয়া তার ভালোবাসার মানুষ অর্পার দিকে।

যে অর্পা একটু আগে কোর্টের এক ঘর ভর্তি লোকের সামনে তাকে প্রত্যাক্ষান করে এখন বাবা- মায়ের সাথে চলে যাচ্ছে তার নিজ বাসায়। ফারহান ভাবতে পারছেনা অর্পা তাকে এভাবে সকলের সামনে প্রত্যাক্ষান করলো। এভাবে তাকে অপমান করলো।

ফারহানের চোখের দিকে তাকিয়ে কোর্টের এক ঘর ভর্তি মানুষের সামনে অবলিলায় বলে দিলো সে ফারহানকে ভালোবাসেনা, ফারহান তাকে ভূলভাল বুঝিয়ে, ভয় দেখিয়ে তার বাড়ি থেকে, বাবা-মা'য়ের কাছ থেকে নিয়ে পালিয়ে এসেছিলো। পালিয়ে আসার পিছনে সম্পূর্ণ দ্বায়ভার ফারহানের। সে না বুঝে, ভয় পেয়ে পালিয়েছিলো ফারহানের সাথে।

ফারহান মানতে পারছেনা অর্পার এমন হঠাৎ বদলে যাওয়াটাকে।
এক মাস আগে অর্পার কথাতেই সে পালিয়েছিলো অর্পাকে নিয়ে।
ঢাকায় বন্ধুর খালার বাড়ি গিয়ে উঠেছিলো সে অর্পাকে নিয়ে।
সেখানেই বন্ধুদের সহযোগীতায় সে অর্পাকে বিয়েও করেছে।
অবশ্য অর্পা এটাই চেয়েছিলো কারণ অর্পার বাড়ি থেকে অর্পার বিয়ের জন্য ছেলে দেখা হচ্ছিলো।
সদ্য এস এস সি পরীক্ষা শেষ করা অর্পা তাই ফারহানকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছিলো।
ফারহান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।
সে প্রথমে পালিয়ে যাওয়ার জন্য রাজি না হলেও
অর্পার কান্নাকাটি আর ভালোবাসার অর্পাকে হারাতে চাই না বলেই পালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো।
পালিয়ে গেলো, বিয়েও করলো সুখে কয়দিন দু'জনে বসবাসও করলো একসাথে
কিন্তু এখন অর্পা তাকে অস্বীকার করে চলে গেলো।
অর্পার বয়স এখনো আঠারো না হওয়ায় ফারহানের তিন মাসের জেলও হয়ে গেলো।
নাবালক মেয়েকে নিয়ে পালানোর অপরাধেই এই শাস্তি তাকে কোর্ট দিলো।

হাজারো চিন্তার মাঝে ডুবে থাকা ফারহানকে পুলিশের একজন কর্মকর্তা বললেন
চলেন এবার, উঠে পড়েন। আমাদের যেতে হবে এখন।
অজান্তেই কখন ফারহানের চোখে নেমে এসেছিলো কয়েক বিন্দু অস্রু কণা।
সেগুলোকে তাচ্ছিল্যের সাথে হাত দিয়ে মুছে উঠে দাঁড়ালো ফারহান।
পুলিশের কর্মকর্তাটিকে বললো, "চলুন।"

এদিকে ফারহানের মা ছেলের এভাবে বিনা অপরাধে জেলে যাওয়া মেনে নিতে পারছেননা।
কাঁন্নায় ভেঙে পড়েছেন তিনি। অন্যদিকে ফারহানের বাবা রাগে-দুঃখে কোর্টেই আসেননি।
এই অপমান তিনি সহ্য করতে পারছেননা বলে।
ফারহানের ছোট বোন তার মা'কে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে বাড়ির দিকে আনতে সার্থক হলো কারণ ফারহানের মা ফারহানকে ছাড়ছিলোনা।
ফারহানকে পুলিশ হাতকড়া পড়িয়ে জেলে নিয়ে যাচ্ছে এই দৃশ্য দেখে তিনি পাগলের মত আচরণ করছিলেন। ওদের বংশে কারো এমন অবস্থা হয়নি, ফারহানের যা হলো।
.
নিজের ঘরে এসে পাথরের মত বসে আছে অর্পা। মুখে কোন কথা নাই।
নিষ্পলকভাবে চেয়ে আছে সে জানালার দিকে।
জানালা দিয়ে যতদূর দেখা যাই ততদূরে তার চোখ নিবদ্ধ।
জানালার দিকে চেয়ে থেকেই অর্পা অতীতের সেই দিনটিতে ডুব দিলো।
যে দিনটিতে সে প্রথম ফারহানকে দেখেছিলো সে দিনটিতে।

অতীত..
দিনটা ছিলো শুক্রবার। শুভ্র রঙের শাড়ি পড়ে মাথায় বেলি ফুলের মালা গেঁথে,
চোখটা গাঢ় কাজলে আঁকিয়ে,
ঠোঁটে লাল রঙের লিপস্টিক দিয়ে হাত ভর্তি চুড়ি পড়ে অপ্সরার মত সেজে ছাদের ওপরে ছবি তুলছিলো অর্পা। অর্পার বান্ধবী নিশা তার ছবি তুলে দিচ্ছিলো বিভিন্ন ঢংয়ে আর সেই ঢংগুলো বসে বসে উপভোগ করছিলো অর্পার ছোট বোন অথৈ। অবশ্য অথৈ একাই উপভোগ করছিলো না,
উপভোগ করছিলো পাশের ছাদে থাকা আরো দুইজন।
সেই দুইজনের মধ্যে একজন পাশের বাড়ির ছেলে নিহাল আর একজন নিহালের খালাতো ভাই ফারহান।

নিহাল অবশ্য নিশাকে দেখেই তার চোখ জুড়াচ্ছিলো আর ফারহান অর্পাকে দেখে।
অর্পা যখন ছবি তুলে ক্লান্ত হয়ে ছাদের ওপরে রাখা কাঠের বেঞ্চের ওপরে বসতে গিয়েছিলো
তখনই ফারহানের সাথে তার চোখাচোখি হয়।
প্রথমবারের মত সে অচেনা ফারহানকে দেখে থমকে যাই,
থমকে যাই তার হৃদপিন্ড, ফুসফুস, যকৃত সহ আরো কত কি!
ফারহান যখন পাশের ছাদ থেকে চিল্লিয়ে বলেছিলো, "ও শুভ্র পরি, তুমি কোন গ্রহের নাগরিক?
তোমাকে তো আগে কখনো দেখিনি এই অঞ্চলে!"
ফারহানের পাশে থাকা নিহাল ফারহানের পিঠে চাপড় দিয়ে ফারহানকে থামিয়ে বলেছিলো ও অর্পা।
তুই হয়তো আগে ও'কে দেখেছিস কিন্তু চিনতে পারছিসনা।"
ফারহানের চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে কথা বলা দেখে অর্পা সেদিন নিহালকে বলেছিলো
নিহাল ভাইয়া, এই ষাড়ের মত গলার এলিয়েনটাকে কোথায় থেকে আবিষ্কার করলে গো?
কেমনভাবে চেঁচিয়ে কথা বলে!"
ফারহান সেদিন অর্পার মুখে 'ষাড়' কথাটা শুনে ভিষণ ক্ষেপেছিলো মনে মনে।
মুখে অবশ্য আর কিছু বলেছিলো না; তবে মনে মনে বলেছিলো, "এই ষাড়ের পেছনে তোমাকে একদিন ঘুরতে হবে, ঘুড়তে হবেই তুমি দেখে নিয়ো শুভ্র সুন্দরী।"

বর্তমান..
"কিরে এখনো বোরখা খুলিসনি ক্যান?
যা, বোরখা খুলে একদম গোসল শেষ করে বের হয়ে আসবি বাথরুম থেকে।
তারপর এসে ভাত গিল। শোক পালন করতে বসেছিস, ওই ছেলের জন্য শোক পালন করছিস?
শোন একটা কথা বলে রাখি, কোনদিন ভূলেও ওই ছেলের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করবিনা।
যদি করিস তাহলে তোর বারাত খারাপ আছে বুঝেছিস। যা এখন গোসল কর।
অর্পার মা অর্পার চুলের মুঠি ধরে শেষের কথাগুলো বলে অর্পার রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
অর্পা চোখের ঝড়ে পড়া অবাঞ্চিত পানিগুলোকে দুই হাত দিয়ে মুছে গোসল করার জন্য প্রস্তুত হলো। বাথরুমে ঢুকেও সে আবার অতীতে ডুব দিলো।
অতীত..
"ওই অর্পা পেছনে তাকিয়ে দেখ কে আসছে।" ফিসফিস করে বললো নিশা অর্পাকে।
অর্পা পেছনে তাকিয়ে আবার সামনে তাকিয়ে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিয়ে সেও ফিসফিসিয়ে নিশাকে বললো,
ও আমাদের পেছনে পেছনে আসছে ক্যান?
আব্বা যদি দেখে আমার পেছনে কোন ছেলে হেঁটে হেঁটে আসছে তাহলে আমার খবর করে দিবে।
নিশা বললো, "তোকে একাই না আমাকেও পিডাবে আমার মা। আম্মু প্রতিদিন আমাকে বলে
নিশা, স্কুলে যাওয়ার সময় মাথা নিচু করে যাবি, আসার সময়ও মাথা নিচু করে আসবি।
ডানে, বামে, সামনে, পেছনে তাকাবিনা। কোন ছেলের দিকে তো তাকাবিনা অবশ্যই।
যদি তাকাস তাহলে তোর চোখ আমি গেলে দিবো বুঝেছিস?"
এভাবে আমাকে আম্মু বলে জানিস!" অর্পা পেছনে আরেকবার তাকিয়ে সাথে সাথে
সামনে মাথা ঘুরিয়ে নিশাকে বললো, "তুই তো সারা রাস্তা প্রতিদিনই ছেলে দেখতে দেখতে যাস আবার দেখতে দেখতে আসিস।" নিশা অর্পার কথার প্রতুত্তরে বললো, "কি করবো বল, ছেলেদের দেখতে ভালোলাগে। কি সুন্দর ওরাও আমাদের দিকে তাকায়, আমিও সেই ফাঁকে ওদের দিকে তাকায়।
আম্মু তো আর দেখতে পাচ্ছেনা তাইনা!
অর্পা আড়চোখে পেছনে তাকিয়ে নিশাকে বললো,
নিহাল ভাইয়ার খালাতো ভাইটা এখনো আসছেরে নিশা।
নিশাও আড়চোখে পেছনে তাকিয়ে দেখলো ফারহান এখনো তাদের পেছন পেছন আসছে।

অর্পা আর নিশা স্কুল থেকে বাড়ির দিকে যাচ্ছে হেঁটে হেঁটে।
দুপুরবেলা হওয়ায় রাস্তায় তেমন মানুষজন নাই।
অর্পারা এখন যে জায়গাটায় আছে এই জায়গাটা একটু বেশিই নিরিবিলি।
ফারহান দৌঁড়ে অর্পার সামনে এসে দাঁড়ালো।
অর্পা আর নিশাও হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো রাস্তার মাঝে।
এভাবে হঠাৎ করে ফারহানকে সামনে দাঁড়াতে দেখে অর্পা আর নিশা দুজনেই চমকে গেছে।
অর্পা বুকে ফুঁ দিয়ে ধমকে উঠলো ফারহানের ওপর।
এভাবে কেউ সামনে এসে দাঁড়াই? ভয় পেয়ে গেছি! সরেন সামনে থেকে।"
ফারহান চোখের পাতা কয়েকবার খুলে আর বন্ধ করে অর্পাকে বললো
তুমি এবার কোন ক্লাসে যেনো?" অর্পা চোখ মুখ কুচরি করে বললো, "বলবো কেনো?"

ফারহান এক গাল হেসে প্যান্টের পকেটে হাত ভরে বললো, "এইটে!" অর্পা আগের মতই
চোখ-মুখ কুচরি করে বললো, "জানেন যখন তখন প্রশ্ন করলেন কেনো? যান, সরেন।
আমাদের যেতে দেন।" ফারহান পকেট থেকে হাত বের করে বুকের ওপর দুই হাত ভাজ করে বললো,
"তুমি আমাকে 'জান' বললে?" অর্পা মুহুর্তেই রাগে ফেটে পড়ে কঠিন গলায় বললো, " জান না যেতে বলেছি সামনে থেকে।" ফারহান মুচকি হেসে বললো, "ওহ আচ্ছা। আমি ভাবলাম আমাকে আদ...না থাক কিছুনা। যাও তাহলে পরে দেখা হবে।"

ফারহান রাস্তা থেকে সরে দাঁড়ালো। অর্পাও নিশার হাত ধরে গটগটে পায়ে বাড়ির দিকে হেঁটে চললো।
বাড়ির কাছাকাছি অর্পা আসতেই ফারহান বাইক নিয়ে এসে অর্পার হাতে হঠাৎ করে
একটা কাগজ গুজে দিয়ে আবার ভ..ভ করে চলে গেলো।
অর্পা এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো মানুষজন আছে কি না!
এরপর হাতের কাগজটা না ফেলে সেটা নিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লো।
চলবে...

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com