সুধারানী ও নবীন সন্ন্যাসী । পর্ব - ০১
সুধারানী দাসী, থ্রি হরিচরণ মিটার লেন, সোনাগাছি, ক্যালকাটা ।
ইংরেজিতে টাইপ করা ঠিকানাটা একটা সুন্দর খামের ওপর ঝকঝক করছে।
পোস্ট অফিসের যে পিয়নটি এপাড়ায় মাঝেমাঝে টেলিফোনের বিল কিংবা
মনিঅর্ডারের রসিদ পৌঁছে দিতে আসে তার বয়স অল্প, উৎসাহ বেশী ।
চিঠিপত্র কদাচিৎই তাকে বিলি করতে হয় এখানে ।
তিন নম্বরে টেলিফোন নেই, ওবাড়ির কেউ মনিঅর্ডার সম্ভবত করে
না বলেই ছেলেটির যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না ।
অতএব এই খামটি হাতে পাওয়ামাত্র সে বেশ হতভম্ব হয়ে পড়েছিল।
তার ওপর ভারতবর্ষের ভেতর থেকে এই চিঠি পোস্ট হয়নি, চিঠিটা এসেছে সাগরপারের দেশ থেকে।
হরিচরণ মিত্র লেন বেরিয়েছে সেন্ট্রাল এভিন্যুর বাসস্টপ থেকে ।
খানিকটা সোজা গিয়ে ডানদিকে বেঁকে গেছে ঘোড়ার নালের মত।
ওই মোড়ে প্রায় নব্বুই বছরের একটা চায়ের দোকানের নাম 'নেশা'।
পিয়নটি এপাড়ায় এলে মাঝে মধ্যে নেশায় বসে চা খায়।
দোকানের মালিকের একটু কৌলীন্য আছে।
তাঁর পিতামহের নামেই ওই রাস্তার নামকরণ হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে।
এককালে বেশ কয়েকটি বাড়ির মালিকানা তাঁদের ছিল।
রেসকোর্সের কল্যাণে সেগুলো হাত বদল হলেও তিনি রেস-এর সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করতে পারেননি। কলকাতা বম্বে ম্যাড্রাস,
ব্যাঙ্গালোর যেখানেই রেস হোক না কেন ওঁর দোকানে হলুদ বই হাতে চর্চাকারীদের ভিড় বসে যায়। এপাড়ার সমস্ত মেয়ে, দালাল এবং রইসী খদ্দেরকে তিনি চেনেন ।
ষাট পেরিয়েছে বয়স, চুলের রঙে কালোর বিন্দুমাত্র ছোঁয়া নেই,
কিন্তু এখনও লাল পাঞ্জাবি এবং আলিগড়ি পাজামা ছাড়া পরেন না ।
পুলিশ থেকে মাস্তান কোন এক অজ্ঞাত কারণে মানুষটিকে খাতির করে।
পিয়নটি প্রয়োজনেই এই মিত্তিরদার সাহায্য নিয়ে থাকে।
ভর সকালে সে উত্তেজিত হয়ে হাজির হল নেশায়।
অবশ্য এগারটাকে কলকাতার অন্যত্র সকাল বলা না হলেও এপাড়াতে তো তা না বলে চলবে না । বিবিদের ঘুমই ভাঙ্গে দশটার পরে। অনেক বাড়িতে চায়ের পাট নেই ।
কেটলি নিয়ে ঝি-এর দল ভিড় জমায় নেশাতে।
মিত্তিরদার একটি ব্যাপারে সুস্পষ্ট নীতি আছে।
তিনি চা ছাড়া অন্য কোন তরল দ্রব্য দোকান থেকে বিক্রী করবেন না।
কর্মচারী দুজন ভিড় সামলাচ্ছিল, মিত্তিরদা ক্যাশে ।
পিয়নটি সোজা তাঁর কাছে উপস্থিত হয়ে বলল, 'দাদা, দারুণ খবর আছে!'
মিত্তিরদা মাথা নাড়লেন, 'বসো। এইড্স এখনও এপাড়ায় আসেনি।
'মানে?' পিয়নটি ঘাবড়ে গেল।
'এইড্স ছাড়া আমাদের পাড়ায় কোন খবর হতে পারে না।
খিদিরপুরের সেই মেয়ে তো এখন পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে ভারতবর্ষের জনতার মধ্যে মিশে গেছে।
কলকাতা অবশ্য এখনও তার প্রতিদান টের পায়নি। এপাড়াতে তো নয়ই।
মিত্তিরদার হাত এবং মুখ সমানে চলছিল ।
পিয়নটি এতক্ষণে একটু থিতিয়েছে। কায়দা করে প্রশ্ন করল, 'সুধারানী দাসী কে দাদা ?'
'সুধারানী ? কোন সুধারানীকে চাও? পাঁচজন আছে।'
'ফরেনে আত্মীয় টাত্মীয় থাকে যার। পিয়নটি গম্ভীর গলায় বলল ।
তিনজনের ফরেনে আত্মীয় আছে বলে শুনেছি।
দুজন পাকিস্তানের সময়ে এসেছিল, একজন বাংলাদেশ হবার পর।'
_পিয়নটি শেষ পর্যন্ত হাল ছাড়ল, 'দাদা, বাংলাদেশ নয়, এ খোদ সাগরপারের চিঠি ।
এসেছে যে সুধারানী দাসীর নামে তিনি থাকেন তিন নম্বব হরিচরণ মিত্র লেনে
'তিন নম্বরের সুধারানী ? দেখি চিঠিটা।
টাকা পয়সা থেকে মন তুলে মিত্তিরদা হাত বাড়ালেন চিঠিটার উদ্দেশে।
খামটি নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে ঠিকানায় নজর রাখলেন।
যে কালিতে টাইপ করা হয়েছে তাতে নিশ্চয়ই কিছুর মিশেল ছিল ।
ফরেনে আজকাল কত না নতুন কায়দা বেরিয়েছে।
খামের ওপর সাঁটা টিকিট দুটো ভাল করে পরীক্ষা করে দেখতে দেখতে তিনি সোজা হয়ে বসলেন ।
এ চিঠি এসেছে খোদ প্যারিস থেকে।
স্ট্যাম্পটা ভাল করে পড়া না গেলেও বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না।
প্যারিস থেকে সুধারানীকে কে চিঠি দেবে ?
খামটাকে কাউন্টারে রেখে ছোট তোয়ালে টেনে নিয়ে মুখ মুছলেন মিত্তিরদা।
লাভার এসেছিল বোধহয় কয়েক রাত।
রঙ ধরে আছে মনে এখনও, বিদেশে গিয়েও তার জের টানতে চাইছে।
তবে সত্যি ব্যাপারটা অভিনব। এ পাড়ার রাতের অতিথিরা একবার বেরিয়ে গিয়ে সম্পর্ক টানতে চায় না।
আগেকার দিনে যেটা ছিল গৌরবের এখন তা হয়েছে লজ্জা, ভয়ের।
গাড়িওয়ালা বাবুরা নাম্বার প্লেট চিনে রাখবে এই ভয়ে গাড়ি রেখে আসে বাড়িতে।
হঠাৎ মিত্তিরদার মনে হল এই সুধারানী দাসীর মুখ তিনি ভাল করে মনে করতে পারছেন না।
মেয়েটা দুপুরের শো-তে সিনেমায় যায় না, বাবু ধরতে বাইরে বের হয় না।
যতদূর মনে পড়ছে পুলিশ আজ অবধি শুকে তুলে নিয়ে যায়নি কেস লেখাতে।
এসবের একটা হলেই তাঁর মনে পড়ে যেত।
মুখে কিছু না বললেও পিয়নের কাছে কথাটা চেপে গেছেন তিনি ।
তিন নম্বরের ঠিক কোন মেয়েটি সুধা তা তাঁর জানা নেই ।
যদি থাকে তাহলে পাঁচের জায়গায় ছ'জন সুধারানী আছে এপাড়ায়।
অবশ্য তিন নম্বর খুব খানদানী বাড়ি।
তাঁর পিতার আমলে আলোময়ীর কাছে রইসী আদমীদের ভিড় লেগে থাকত গান শোনার জন্যে। আলোময়ীর মা লীলাময়ী গান শিখেছিল গহরজানের কাছে।
সেসব কালোয়াতী গানের সমজদার তখন ছিল।
বড় বড় ওস্তাদ খাঁ সাহেবরা কলকাতায় এলেই লীলাময়ীর কাছে আসত সঙ্গত করতে ।
আলোময়ী সেইসব কালোয়াতী সুর নিয়ে বাংলা গান বেঁধেছিল।
রবিঠাকুরের গানও গাইত সেইসঙ্গে।
আলোময়ীর মেয়ে সুরবালার যৌবন ছিল সেই পরিমাণে সুর নয় ।
এখন নিচের তলাটায় ভাড়াটে বসেছে।
তিরিশ চল্লিশে ঘন্টা বিকোয় আর পাঁচটা বাড়ির মতনই।
কিন্তু দোতলায় ওঠার আগে আছে কোলাপসিবল গেট ।
সেখানে তিনগুণ দাম না দিলে উঠতে দেবে না সুরবালা ।
চলবে....
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com