বন্দি তোমার মাঝে । পর্ব - ০১
্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র
আপাই, আজকে তোর বিয়ে। "
দৌড়ে রুমে আসা চাচাতো ভাই সাকী'র মুখে এ কথা শুনে চমকে উঠে মাধবী।
কয়েক সেকেন্ড পর হেসে দিয়ে বলে,
ভাই, একদম ফাজলামো করবি না। সকাল সকাল উল্টো পাল্টা কথা বলিস না তো।
কাকিমনিকে এখনই ডাকবো না হলে।
বড় আব্বু তীব্র ভাইয়ের সাথে তোর বিয়ে ঠিক করেছে, মাত্র বসার ঘরে শুনে এলাম।
এবার খানিকটা ভয় পেয়ে যায় মাধবী। বিশ্বাস না করতে চেয়েও কেমন খটকা লাগছে।
রুম থেকে বেরিয়ে আসবে তখনই সেখানে হাজির হয় নাসিমা শেখ।
সম্পর্কে মাধবীর জেঠি। রাগী রাগী ভাব নিয়ে তাকিয়ে দেখছে তাকে আর পেছনে থাকা সাকীকে ।
এই মানুষটাকে ভয় পায় মাধবী।
মাধবীর দিকে আরেকবার তাকিয়ে নাসিমা বলেন,
আশা করি সাকী এসে এতক্ষনে তোমায় কথাটা শুনিয়েছে।
বিকেলের দিকে তৈরি হয়ে থাকবে।
এ কথা বলে যেভাবে এসেছিলেন সেভাবেই যেতে নিতেই মাধবী বলে,
বড় মা, এসব হুট করে কি হচ্ছে? আমাকে না জানিয়ে...
বাকিটা না বলতেই মাধবী জবাব পায়,
তুমি কে? আমি আর তোমার বড় আব্বু সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সেটাই হবে।
এতোদিন পেলে পুষে বড় করেছি, এখন আপত্তি জানানোর স্পর্ধা করো না।
শান্ত কন্ঠের এই জবাবেই জমে যায় মাধবী। আর কিছু বলার সাহস পায় না।
নাসিমা শেখের চোখের ইশারা পেয়ে সাকী ও তার পিছু পিছু চলে যায়।
সাকীর খারাপ লাগছে তার আপাইয়ের জন্য। সাত বছরের সাকী,
বয়সে ছোটো হলেও মাধবীর প্রতি তার অগাধ টান, ভালোবাসা।
মাধবী শেখ। বয়স ২১। অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট।
উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রঙ, উচ্চতা পাঁচ ফুট,
মিডিয়াম স্বাস্থ্য তবে উচ্চতা স্বাস্থ্য মিলিয়ে অনেকটা গুলুমুলু দেখায়।
স্বভাবে খানিকটা চঞ্চল তবে যাকে ভয় পাবে তার সামনে একদম নিশ্চুপই থাকে।
এ বাড়িতে তার ছোটো কাকা, কাকিমনি আর সাকী বাদে কারোর সামনে সে নিজের চঞ্চলতা দেখায় না।
শেখ বাড়ির মেঝ ছেলে মহিউদ্দিন শেখের একমাত্র মেয়ে মাধবী ।
মেয়ের বয়স যখন চার বছর,
তখন এক ট্রাকের সাথে নিজের প্রাইভেট কারের এক্সিডেন্টে মারা যান মহিউদ্দিন শেখ।
উনার মৃত্যুর পর স্ত্রী সূচনা ও মেয়ে মাধবীর জীবন যেন ধমকে যায়।
কম বয়সে বিধবা হওয়ায় সূচনার বাপের বাড়ির লোকজন তাকে এসে নিয়ে যায় সাথে মাধবীকেও।
এক বছর কেটে গেলে, সূচনাকে বিয়ের জন্য চাপ দেয় তার পরিবার।
সে প্রথমে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে না করলেও সবার বুঝানোতে রাজি হয়ে যায়।
তার বাবা বিপত্নীক আবু রায়হান নামক এক লোকের সাথে সূচনার বিয়ে ঠিক করে
এতে সূচনা সম্পূর্ণ মত দেয়।
আর তার এই একটি সিদ্ধান্ত মাধবীর জীবনটাকে পুরোপুরি ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো।
পাঁচ বছরের বাচ্চা মাধবী সেদিন বুঝে নি তার মা বিয়ে করে অন্য বাড়িতে চলে যাচ্ছে,
তাকে নিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও বিয়ের দিন বরের পরিবার সেটা অস্বীকার করে।
এক বাচ্চার জন্য নিজের মেয়ের নতুন বিবাহিত জীবন নষ্ট করবে না
ভেবে সেটা মেনে নেয় সূচনার বাবা।
সেদিন সূচনার মাধবীর জন্য কষ্ট হলেও তার বাবার ভরসায় ,
নিজের কথা ভেবেই বাচ্চাটাকে রেখে চলে যায় নতুন সংসারে।
এর কিছুদিন পর শেখ বাড়ির বড় ছেলে শফিউদ্দিন শেখ এসে মাধবীকে
শেখ বাড়িতে নিয়ে আসেন সারাজীবনের জন্য।
সূচনার বাবা মা ও আপত্তি করেন নি।
যাদের বংশের বাচ্চা তারা নিয়ে যেতে চাইলে আর কি করার!
এতে বরং সূচনার পরিবার খুশিই হয়েছিলো।
সেই থেকে মাধবী শেখ বাড়িতেই বেড়ে উঠেছে।
মহিউদ্দিন শেখ ও নাসিমা শেখ সম্পর্কে তার জেঠু,
জেঠী হলেও কখনো অবহেলা করে নি আবার নিজ সন্তানের মতো বুকে টেনেও নেয় নি।
মাধবীর যখন যেটা প্রয়োজন সেটা পূরন করে গেছেন।
শফিউদ্দিন শেখ হলেন এ বাড়ির কর্তা ।
সফল ব্যবসায়ী হিসেবে নাম ডাক, অর্থ সব দিকেই বেশ সচ্ছল তিনি।
এজন্য তার দাপট বরাবরই বেশি, তাই তার অর্ধাঙ্গীনি হিসেবে নাসিমা শেখ
সেই প্রভাব নিজের মাঝেও ধারণ করে চলে। তাদের দুই ছেলেমেয়ে,
ছেলে পড়াশোনা শেষ করে নিজেদের ব্যবসায় যুক্ত হয়েছে।
বড় ছেলে নাকিব বিয়ে করেছে এক বছর আগে, মেয়ে নাবিলা এখনো অবিবাহিত।
মাধবীর থেকে তিন বছরের বড়।
মাধবীর ছোটো কাকা রফিকউদ্দিন শেখ।
আটত্রিশ বছর বয়সী রফিকউদ্দীন নিজেকে এখনো ইয়াং মনে করে।
মাধবীকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসে তবে বড় ভাই ভাবীর জন্য
বেশি আহ্লাদ দিতে পারে নি মাধবীকে।
তবুও তার স্ত্রী তরী ও ছেলে সাকীকে সব সময় মাধবীর সাথে ভালোভাবে মিশতে বলেন।
মেয়েটাকে দেখলে মায়া হয় তার।
মাধবীর সাথে তার ছোটো কাকীর ভীষণ ভাব, তরীও মিশুক।
মাধবীকে আগলে রাখার চেষ্টা করে।
মাধবীর একমাত্র ফুপু মনোয়ারা শেখ। সিরিয়ালে মহিউদ্দিনের পরেই মনোয়ারা শেখ ।
ভাইদের এক বোন হিসেবে সবাই উনাকে যথেষ্ট ভক্তি করে চলে।
তার ছেলে তীব্র আর এক মেয়ে তান্নি। স্বামী গত হয়েছে বছর পাঁচেক আগে।
সে থেকে আরও কঠোর ভাব ধারণ করে চলেন মনোয়ারা শেখ।
তাইরান হাবীব তীব্র। বয়সটা ত্রিশ ছুইছই।
পড়াশোনা শেষে বাবার রেখে যাওয়া শাড়ির ব্যাবসার দায়িত্ব নিয়েছে।
বলতে গেলে নিজ বুদ্ধিমত্ত্বায় ব্যবসাটাকে অনেক উঁচু মানের করতে পেরেছে।
নিজস্ব ফ্যাক্টরি, শো রুমগুলো আরও ভালো করে সাজিয়েছে।
আগের থেকে তাদের অবস্থা এখন অনেক ভালো।
উচ্চ বিলাসি না হলেও বেশ ভালো সচ্ছল জীবন দিতে পেরেছে তার মা বোনকে।
দেখতে সুদর্শন, পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চি উচ্চতার শক্তিশালী শারীরিক গঠনে তাকে এক
দেখায় কেউ অসুন্দর বলবে না।
গম্ভীর, স্পষ্টভাষী তীব্রের থেকে ভাইবোনরা যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে চলে।
ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবের তীব্র সবার সাথে সহজে মিশতে পারে না।
তবে দায়িত্বের দিক থেকে সে সব সময় সচেতন।
ছেলের দিকে তাকিয়ে তার হাবভাব বোঝার চেষ্টা করছে মনোয়ারা।
তবে কোনো অনীহা বা বাড়তি খুশি কিছুই দেখতে পান না। তাই সরাসরি জিজ্ঞেস করে,
-তোকে আবারও জিজ্ঞেস করছি , আমার সিদ্ধান্ত তুই মেনে নিয়েছিস তো?
তোর অমত আছে?
নি:সংকোচ ভঙ্গীতে জবাব দেয় তীব্র,
- অমত থাকলে নিশ্চয়ই বলতাম। তোমার কথা কখনো উপেক্ষা করি নি,
তুমি তোমার মতো সব আয়োজন করো।
- ঠিক আছে তবে। আমরা বিকেল চারটার পর পরই ও বাড়ির দিকে রওনা দিবো।
- ওকে, আমি তৈরি থাকবো।
এ বলেই মায়ের সামনে থেকে উঠে নিজের রুমে চলে যায় সে।
এতোক্ষণ ধরে মায়ের কাছে মিথ্যা কিছু বলে নি তীব্র ,
মায়ের অনুরোধকে সে সাদরে মেনে নিতে রাজী। এটা তার কর্তব্য।
মামা বাড়িতে তেমন একটা যাওয়া হয় না। প্রায় দুই বছর আগে গিয়েছিলো সে,
এর মাঝে তার মা ও বোন গিয়ে ঘুরে এসেছে।
সে গেলেও মাধবী তার সামনে আসতো না, ভয় নাকি উপেক্ষা কোনোটাই জানা নেই।
মাধবীর ছোটোবেলাটাই তীব্রের মনে আছে এরপরের ধারণা তার কাছে পরিষ্কার নয়।
এজন্য মাধবীকে এখন ভালো করে মনে করতে পারছে না তীব্র।
অন্যদিকে মাধবী নিজের রুমে বসে তার কাকী মনিকে জড়িয়ে ধরে অনবরত কাঁদছে।
তরী শেখ বয়সে মাধবীর থেকে বড় হলেও কাছ থেকে বুঝতে পারে মাধবীকে।
সান্ত্বনা দিয়েও লাভ হচ্ছে না।
তাকে ছেড়ে সরে দাঁড়ায় মাধবী। দুহাত ধরে বলে,
ও কাকীমনি, বড়মাকে বলো না আমি রাজি না। এখন বিয়ে কেন দিচ্ছে?
আমি এতোই বোঝা তোমাদের কাছে?
- তুই বোঝা হবি কেন মাধবী? তুই তো আমার সোনা মেয়ে।
বড় ভাবির উপর কথা বললে উনি শুনবেও না,
এতোদিনের সংসারে এটা বুঝতে পারি রে।
বড় ভাই, বড় ভাবীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তবে উনারা তোর খারাপ করবে না।
আজকে তো শুধু আকদ হবে, কয়েকমাস পর অনুষ্ঠান করে তোকে তুলে নিয়ে যাবে তীব্ররা।
কাকীর হাত দুটো ছেড়ে দিয়ে মাধবী বিছানায় বসে পড়ে বলে,
- আমি জানি না কিছু। সাকী যে বললো তীব্র ভাইয়া! শুনেছি উনি কতটা রাগী ,
আমাকে যদি সহ্যই না করতে পারে? দেখে অপছন্দ করতে পারে,
আমি চোখে পড়ার মতো সুন্দরী তো নই! উনার নিজের পছন্দ থাকতে পারে।
আমার ভয় লাগে উনাকে।
- ভয় পাস না বাবুই। আজকেই তো আর নিয়ে চলে যাবে না তোকে।
আর তীব্র যদি অমত করতো তাহলে কথা বিয়ে অবধি গড়াতো না।
তাছাড়া নিজস্ব পছন্দ থাকলে মনোয়ারা আপাকে জানাতোই।
এখন এতো মাথায় চাপ নিস না। দোয়া করি, সুখী হবি।
মাধবী আর জবাব দেয় না। একটু পর তরীও চলে যায় নিজের কাজে।
রেখে যায় ভয়ে, অস্থিরতায় কাতর হওয়া মাধবীকে।
নিজের মা'কে কখনো ঘটা করে মনে করে নি মাধবী।
যখন থেকে বুঝতে পারে তার মা তাকে চায় না সেদিন থেকেই মনকে মানিয়ে নিয়েছে সে।
তবুও আজকে বারবার একটা কথাই মনে মনে বলছে,
-" আমার নিজের বাবা মা থাকলে এভাবে কেউ সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতো না।
আমার কথা শুনতো একটু হলেও। কেন বাকিদের মতো আবার জীবন হলো না!
নিজের জন্য কেউ নেই! বড় মা, বড় আব্বুর বিপক্ষে কথা বলার সাহস
কোনো কালেই নেই তাই আজও হেরে যাবো পরিস্থিতির কাছে। "
বিকেল চারটা।
সেজেগুজে ভাইয়ের রুমের সামনে পায়চারি করছে তান্নি।
পিংক কালারের একটা গর্জিয়াস রাউন্ড জামা পড়ে সুন্দর করে সেজেছে সে।
একটা মাত্র ভাইয়ের আকদ বলে কথা। তবে এই রাগী ভাইকে তাড়া দেয়ার সাহস পাচ্ছে না।
এসব ভাবতেই রুমের দরজা খুলে বের হয় তীব্র। স্বভাবতই চুপচাপ মুডে আছে সে,
গায়ে হোয়াইট কালারের দামী পাঞ্জাবি, পাজামা।
পাঞ্জাবীর উপরে ব্রাউন কালারের কোটি, হাতে দামী ঘড়ি,
চুলগুলো জেল দিয়ে পরিপাটি করে রাখা।
বের হয়ে কোটির পকেটে ফোন রাখতে রাখতে বোনের দিকে তাকায় তীব্র ।
- কি হয়েছে? কি দেখছিস?
- ভাইয়া তোমাকে কি জোশ লাগছে! আল্লাহ, মাধবী আপু চক্কর খেয়ে পড়ে না যায়।
- উল্টো পাল্টা না বকে মা'কে বের হতে বল।
- আমি, মা দুজনই রেডি। তোমার অপেক্ষা ছিলো শুধু ।
আর কিছু না বলে সোজা বাইরে চলে যায় তীব্র। গিয়ে দেখে তার মা
কাজের মেয়ে বাতাসিকে দিয়ে কতগুলো ডালা গাড়িতে রাখছে।
মাত্রই সব রাখা শেষ হলো। সে যেতেই ভুবন ভুলানো হাসি দেন মনোয়ারা।
ছেলেকে দেখেই তার প্রান জুড়িয়ে যায় সব সময়।
- সব তো রেডি, চল বাবা।
- হ্যাঁ, তোমরা উঠো আগে।
একে একে সবাই গাড়িতে উঠলে তীব্র সামনে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে পড়ে।
গাড়ি চলা শুরু করতেই চোখ বুঝে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে।
আধঘন্টা পর মনোয়ারা হাজির হয় শেখ বাড়িতে৷ আকদ হবে তাই বাইরের কাউকে বলা হয় নি।
শুধু দুই পরিবারের লোকজন আছে। তীব্ররা সবাই বসার ঘরে বসে আছে ।
একে একে হরের রকম নাস্তা নিয়ে তাদের সামনে রাখছে দুজন কাজের লোক ।
তীব্র সেদিকে মোটেও নজর দিচ্ছে না। এ বাড়ির কোনো কিছুই তার মনে টানে না।
একমাত্র মায়ের বাপের বাড়ি তাই মাঝে মধ্যে আসতে হয়। এই যা!
তবে এবার তো এলো নতুন সম্পর্কের সুতো গাঁধবে বলে, এই সম্পর্কও মনে টানবে তো!!!
বসার ঘরে ওদেরকে দেখতে পেয়েই সাকী একছুটে মাধবীর রুমে চলে যায়। গিয়েই বলে,
-আপাই, তোর বর এসেছে। তোকে বিয়ে করবে।
সাকীর কথাটা কানে গেলেও প্রতিক্রিয়া জানায় না মাধবী।
হাতে থাকা হালকা নীল রঙের কাঞ্জিভরম শাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে কেবল....
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com