Breaking News

সুধারানী ও নবীন সন্ন্যাসী । পর্ব - ০৩

'আপনি আমাকে বহুৎ ধূর ভাবছেন দাদা। পুলিশ পাউডারের গন্ধ পেয়ে আমার তিনজনকে ধরেছে। আমি থানায় গিয়ে বিরভুর নাম বলতে ও সি বলল আপনি বিরজুর গার্জেন। আপনি থাকতে বিরজু নাকি ওসব করতে পারে না।' মিত্তিরদা এক মুহূর্ত ভাবলেন। তারপর বললেন, 'দারোগাবাবু বাড়িয়ে বলেছেন। ঠিক আছে, আমি বিরজুর সঙ্গে কথা বলছি।'

: তিন নম্বরের রকে ভর দুপুরেই মেয়ের মেলা। বেশীর ভাগই কুড়ির নিচে সালোয়ার পাঞ্জাবি আর মুখে পাউডার মেখে গুলতানি মারছে। এদের অনেকেই সকালে এপাড়ায় ঢুকে রাত্রে ফিরে যায়। রাতের ঘর যে মেয়ের তাকে এবং বাড়িওয়ালিকে খদ্দেরের কাছে পাওয়া টাকার অর্ধেক ভাগ করে দিতে হয় । এদের আগমন শুরু হয়েছে কিছুদিন। তিন নম্বরের খানদানীত্ব এরাই ঘুচিয়ে দিতে শুরু করেছে। ওদের দেখে মেয়েগুলো ধম ধরেছিল। কেউ একজন সতর্ক করে দিতে এমন ভাব করতে লাগল যেন দেখতেই পাচ্ছে না। মিত্তিরদা পিয়নকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়লেন।

এক তলায় এখনও বাসি গন্ধ। ছায়া আর নোংরা মাখামাখি। মাঝখানে উঠোনকে রেখে চৌকোণা বাড়ি সটান উঠে গেছে। সেই উঠোনে ছাই, সাবানের ফেনা, কলের জলে থৈ থৈ চাতাল আর গোটা কয়েক বেড়ালেৱ চিৎকার । উঠোনের চারপাশে বারান্দা। সেখানে গা এলিয়ে একটু বয়স্ক মেয়েরা বসে আছে। মিত্তিরদা পিয়নের মুখের দিকে তাকালেন। নজর ঘুরছে। ছোকরা বিয়ে করেনি। তবে কোন কোন মানুষের দর্শনেই সুখ হয়। কলেজের ছেলেরা যেমন ভর দুপুরে এপাড়ার গলিতে গলিতে স্রেফ হাঁটাহাঁটি করতে আসে।

দোতলার সিঁড়ির মুখেই কোলাপসিবল গেট, সেখানে ভেতর থেকে চাবি মারা। মিত্তিরদা তালা ধরে নাড়তেই আওয়াজ উঠল। ভেতর থেকে একটা গাঁজা খাওয়া মেয়ের গলা জানতে চাইল, 'কে?'

মিত্তিরনা পিওনকে ইশারা করতে সে কোনমতে জবাব দিতে পারল, "চিঠি আছে।'

তারপরেই একজন বৃদ্ধাকে দেখতে পেলেন মিত্তিরদা। মাথায় চুল নেই। থান পরা। কোমর বেঁকেছে। এপাশে এসে জিজ্ঞাসা করল, 'সাতজন্মে এবাড়িতে চিঠি আসে না। ঠিক দেখেছ তো ?

“হ্যাঁ । না দেখে কি আসছি ?' পিয়নটি এতক্ষণে যেন নার্ভ ফিরে পেল, 'না দেখে আসিনি।

বৃদ্ধা এবার মিত্তিরদার দিকে তাকালেন, 'একটা চিঠি নিতে দুজন এয়েছ ?

দাও।'

মিত্তিরদা কিছু বলার আগেই পিয়নটি মাথা নাড়ল, ফরেনের চিঠি।' “কি হয়েছে মোক্ষদা ? ভেতর থেকে যে কণ্ঠস্বরটি ভেসে এল তাতে কর্তৃত্বের ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু মিত্তিরদার মোটেই পরিচিত বলে মনে হল না । এই কি তাহলে সুধারানী ? মোক্ষদার গলা ততক্ষণে চড়ায় উঠেছে, 'কি বলছে দ্যাখো, কোথাকার নাকি চিঠি। সঙ্গে চা-বাবু এসেছে।'

মিত্তিরদা এবার অস্বস্তিতে পড়লেন। আড়ালে আবডালে এপাড়ার অনেকেই তাকে চা-বাবু বলে চিহ্নিত করে। তাই বলে এমন মুখোমুখি ? এবং তখনই

সুরবালা বাইরে বেরিয়ে এল। মিত্তিরনা দেখলেন সুরবালার কালো চুল পিঠে ছড়ানো। শরীর মেসে মজে আছে। কিন্তু সেই মেন এমন মাত্রাজ্ঞান রেখে সাজানো যে অহঙ্কার মরে যায়নি। পনের কেন তিরিশের চাপল্য উধাও কিন্তু পঞ্চাশের মন্বন্তর ঢুকতে পারেনি, ফাঁক না পাওয়ায়। 

সুরবালার কপালে তখনই হাঁসের পায়ের ছাপ। চোখ যেন চোখের শত্রু। দাঁত কামড়ানো ঠোঁটের দেওয়াল। তারপর গম্ভীর গলায় নির্দেশ এল, 'মোক্ষদা, তালা খুলে দাও' এ স্বরে দ্রুত কাজ হল। দরজা খুলে একপাশে সরে দাঁড়াল মোক্ষদা মিত্তিরদা বললেন, 'লাম'

সুরবালা মাথা নাড়ল, 'তাই তো দেখছি

কথাটায় যে খোঁচা আছে সেটা বুঝেও উপেক্ষা করলেন মিত্তিরদা। মেয়েরা কখনই ভেবেচিন্তে কথা বলে না। বলার পর তার মানে দাঁড়িয়ে যায়। বিশেষ করে সম্পর্কটা যদি অভিমানের হয়।

ভেতরে ঢোকার পর সুরবালা এগিয়ে গেল। মিত্তিরদা আবার বললেন, 'খুব অসময়ে এসেছি যি

‘তোমার সময়জ্ঞান আছে জানতাম না তো ? চমৎকার একটা ফরাস বিছানো ঘরে ঢুকে কথা বলল সুরবালা। মিত্তিরদা চকিতে পিওনটির দিকে তাকালেন। ছোকরা আবার কি ভাবছে কে জানে। আবেগের ঘোরে এখন না এলেই ভাল হত । হাত দেখিয়ে বসবার ইঙ্গিত করে সুরবালা সামান্য তফাতে তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে বসল। মিত্তিরনা আরাম করে বসে বললেন, এটি সরকারী কর্মচারী। চিঠি বিলিয়ে বেড়ানো কাজ। আমায় বলল তিন নম্বরের সুধারানী দাসীর নামে চিঠি এসেছে। কৌতূহল হল। সুধারানী কি তোমার মেয়ে?

সুরবালা বড় বড় চোখ মেলে মিত্তিরদাকে দেখল, 'কৌতূহল কেন ? মিত্তিরদা এবার হাসলেন, 'এই বাড়িতে ঢোকার পর সেই কেনটা নিজের কাছেই জানতে চাইছি।'

মাথা নাড়ল সুরবালা । তার মানেটা অস্পষ্ট। মুখে বলল, 'সুধারানী আমার মেয়ে নয়। মেয়ের মতন। আমার কোন ছেলেপুলে নেই। নেই মানে হতে দিইনি।'

'ও।' শব্দটা আচমকা বেরিয়ে এল মুখ থেকে। মন অন্যদিকে ঘোরাতে চাইলেন মিত্তিরদা। এর জন্যে তাঁর কি দায়িত্ব থাকতে পারে? সুরবালার যৌবনে হলুদ রঙ লেগেছে। ভরন্ত শরীরে যদিও এখনও মোটা বাঁক নজর কাড়ার জন্যে তৈরী, তবু ইচ্ছেটা হলেও ঈশ্বর সময় হবেন না। নিজের বয়সের সঙ্গে হিসেব মিলিয়ে মিত্তিরদা সে ব্যাপারে নিশ্চিত। ততক্ষণে দাঁড়িয়ে থাকা পিওনটির দিকে হাত বাড়িয়েছে সুরবালা, 'কই দেখি।'

পিশুনটি দিতে পেরে বেঁচে গেল যেন। সুরবালা আধা লম্বা খামটি দেখে বলল, 'ওমা, এ যে বাংলায় লেখা নয়। সুধাকে আবার ইংরেজিতে চিঠি লিখবে কে ? সুধার নাম তো ওপরে ?”

প্রশ্নটি পিওনকে। সেই ঘাড় নাড়ল, 'হ্যাঁ। সুধারানী দাসী। এসেছে প্যারিস থেকে

'কোত্থেকে?' সুরবালা বুঝতে পারেনি।

চলবে...

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com