জীবন্ত প্রতিচ্ছবি । পর্ব - ০১
পি*রি*য়ডের ঠিক দ্বিতীয় দিন পার হয়ে রাত্রে অনুরাধার মধ্যে কিছু একটা লক্ষ্য করলো অভি। এতক্ষণ ব্যালকনিতে দাড়িয়ে অনুরাধার সঙ্গে গল্প করে রুমে পানি খেতে এসে ভীষণ চমকে গেল অভি, অনুরাধাকে ব্যালকনিতে রেখে রুমে এসে দেখলো অনুরাধা গুটিসুটি মেরে বিছানায় শুয়ে আছে। এ কিকরে সম্ভব! আকাশ দৌড়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দেখলো সেখানে কেউ নেই! আবার রুমে ফিরে এসে দেখলো অনুরাধা সেভাবেই শুয়ে আছে।
অভি মাথায় হাত দিয়ে খাটে অনুরাধার পাশে বসে পড়লো। কিছুতেই হিসাব মিলছে না এসবের। এটা কীভাবে সম্ভব! নাকি মস্তিস্কের ভ্রম? কিন্তু অনু তো স্বশরীরে ব্যালকনিতে উপস্থিত ছিল।
অভি ব্যালকনিতে বসে ল্যাপটপে অফিশিয়াল কাজ করছিল, অনুরাধা প্রথমবার এসে এককাপ চা দিয়ে চলে যায়। অভির অফিসিয়াল কাজ শেষ হবার পরেই অভি অনুরাধাকে ডাকে গল্প করার জন্য, অনুরাধা আসে এবং দুজন বসে গল্প করে, তারপরই ঐ পানি খেতে এসে অভি দ্যাখে অনুরাধা গুটিসুটি মেরে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে আছে।
অভি বড়সড় একটা ধাক্কা খেলেও ভাবলো এই মুহুর্তে অনুরাধাকে কিছু বলা যাবেনা।
অভি শুতেই অনুরাধা ঘুরে অভিকে জড়িয়ে ধরে অভির বুকে মুখ গুঁজে ঘুম ঘুম কণ্ঠে বললো,– তলপেটে খুব ব্যাথা হচ্ছে অভি, আমার তলপেটে একটু হাত রাখো, তোমার ছোঁয়ায় ব্যথা দূর হয়ে যাবে দেখো। তোমার হাতটা যেমন ভরসার তেমনই ভালোবাসার, তাইতো তোমার স্পর্শে সমস্ত ক্লান্তি, হতাশা, কষ্ট দূর হয়ে যায় নিমেষেই।
অনুরাধাকে ভালোবেসে "অনু" বলেই ডাকে অভি।
অনুর কপালে একটা চুমু খেয়ে অভি বললো,– ড্রয়ারে অষুধ ছিল খাওনি?
ভাঙা গলায় অনু বললো,– নেই তো, শেষ হয়ে গেছে।
আচ্ছা তুমি চুপচাপ শোও, আমি ব্যবস্থা করছি– বলে অভি বিছানা ছাড়লো।
কোথায় যাচ্ছো?– অনু জিজ্ঞেস করলো।
তোমার ব্যথা উপশমের ব্যবস্থা করতে অনু– বলে টেবিলের ওপরে রাখা পানিভর্তি জগটা হাতে নিলো অভি।
: এতরাতে কোনকিছুর দরকার নেই অভি, তুমি আমার পাশে শুয়ে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেই আমার ব্যথা তোমার ভালোবাসার কাছে পরাজিত হয়ে উধাও হয়ে যাবে। তোমার কোনকিছু করতে হবেনা আসো তো।
: একদম না অনু, আমাদের বিয়ের আগে তোমায় কথা দিয়েছিলাম নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও তোমার ক্ষুদ্রতম কষ্টকেও দূর করার চেষ্টা করবো, সেটা তুমি ভুলে গেলেও আমি ভুলবো না, এখন তুমি আমার স্ত্রী, আমার সারাজীবনের সাথী। আমার প্রতি তোমার যেমন কর্তব্য, তোমার প্রতিও আমার তারথেকে দ্বিগুণ কর্তব্য।
: পাগল একটা!
: হুম পাগল তো, তোমার পাগল, এমন পাগল আজীবন থাকতে চাই।
: এটা তো আমার সৌভাগ্য অভি তোমার মতো একজন জীবন সঙ্গী হিসেবে পাওয়া, আচ্ছা যা-ই করো জলদি করো।
: ওকে তুমি একটু সময় অপেক্ষা করো, আমি আসছি।
কথা শেষে অভি জগ হাতে কিচেনে এসে কিচেনের লাইট জ্বালাতেই আবার ভীষণ চমকে গেল। গ্যাস স্টোভের ওপর রাখা পানিভর্তি পাতিল, এবং পাতিলের পানি যেভাবে দুলছে তাতে মনে হচ্ছে এইমাত্র কেউ রেখে গেছে। আগেই ভৌতিক কিছু না ভেবে অভি ভাবলো হয়তো পাতিলে পানি ভরে অনু রেখেছিল, এবং হঠাৎ মৃদু ভুমিকম্পে হয়তো পাতিলের পানি দুলছে!
আরও নিশ্চিত হবার জন্য অভি রুমে ফিরে এসে অনুকে বললো,– স্টোভের ওপর পাতিলে পানি রেখেছিলে অনু?
চোখ খুলে ঘুম ঘুম জড়িয়ে আসা কণ্ঠে অনু বললো,– কেন তুমি কি আমায় রাখতে বলেছিলে নাকি যে রাখবো! রাখিনি তো।
আচ্ছা তুমি ঘুমানোর ট্রাই করো– বলে অভি আবার কিচেনে চলে আসলো।
এসব যাকিছু ঘটছে তা কি আসলেই রহস্যময় কিছু? নাকি ভুল ভ্রম এবং মনের অহেতুক সন্দেহ বিষয়গুলোকে রহস্যময় করে তুলছে!
যা-ই হোক, স্টোভে আগুন জ্বেলে কিচেনের কাচের সচ্ছ জানালা ভেদ করে রাতের আকাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো অভি, চাঁদের জোছনায় মুখরিত পৃথিবী। অভি ভাবছে অনুর পিরিয়ডের সমস্যা না থাকলে অনুকে নিয়ে বাইরে গিয়ে চাঁদের স্নিগ্ধ আলো মেখে আসতো গায়ে।
জানালা থেকে চোখ ফিরিয়ে পেছনে তাকাতেই ভয়ে লাফিয়ে উঠলো অভি। অনুরাধা দাঁড়িয়ে আছে হাসিমুখে।
অভিকে ভড়কে যেতে দেখে অনু হেসেফেলে বললো,– বউকে দেখে এমন ভাবে ভয়ে লাফিয়ে উঠলে যেন ভূত দেখেছো! এই শোনো তোমার বউ দেখতে এতটাও কুৎসিত নয় যে দেখে ভয়ে লাফিয়ে উঠতে হবে।
আমতা আমতা করে অভি বললো,– না ইয়ে মানে!
হাসতে হাসতে অনু বললো,– ইয়ে মানে কি আবার? ভীতু একটা, হা হা হা।
তোমার চোখে তো ঘুম ছিল, তারপর পেটে ব্যথা, কষ্ট করে আসার কি দরকার ছিল বলো– অভি বললো।
মুখ ভেঙচি দিয়ে অনু বললো,– তুমি আমার জন্য এতরাতে একাকী এতসব করছো, আর আমি এসে তোমার একাকীত্ব দূর করবোনা তা কি হয়?
অভি বললো,– এইটুকু সময়ের ব্যাপার তো মাত্র।
হুম, তুমি ছাড়া এক মিনিটও আমার কাছে একাকীত্বের সমান মিস্টার জামাই, তাই চলে এলাম– অনু বললো।
পাতিলের পানি কতটুকু গরম হলো দেখতে ঘুরে দাড়িয়ে পাতিলের পানিতে আঙুল ডোবালো অভি, হ্যা ঠিক আছে একদম, কুসুম গরম। এবার তো বোতল দরকার।
আচ্ছা এক লিটারের খালি বোতল আছে বাসায় অনু– বলে ঘুরে দাড়াতেই অভি আবারও চমকে গেল, অনু নেই!
দ্রুত পায়ে রুমে এসে দেখলো অনুরাধা বিছানায় ঘুমিয়ে আছে।
দাড়িয়ে এক মনে অভি ভাবছে, অনু ইচ্ছে করে দুষ্টুমি করছে না তো? তাই হবে হয়তো, তাছাড়া আর কি!
সারা বাসা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও একটা বোতল পেলোনা অভি, এ যে মহা বিপদ!
আবার কিচেনে এসে খুঁজতে লাগলো।
পেছন থেকে অনুরাধা বললো,– কি খুজছো অভি?
লাফিয়ে উঠে ঘুরে দাড়িয়ে অভি বললো,– পেটে ব্যথা নিয়েও এত দুষ্টুমি করলে হয় অনু?! গরম পানি ভরার জন্য একটা বোতল খুঁজছি। কিন্তু পাচ্ছিনা কোথাও, সব বোতল ফেলে দাও নাকি? এই যে আরসি সেভেন-আপ এর এত বোতল আনি সেসব দুই একটা রাখলে কি হয় বলোতো!
অভির কথা শেষ হতে না হতেই কিচেনের মাথার উপরের সামসিড থেকে একটা পুরনো আরসির বোতল গড়িয়ে অভির সামনে পড়লো।
অভি ঝুকে পড়ে বোতলটা হাতে নিয়ে উঠে সোজা হয়ে বললো,– আরে বাহ! খুজতে খুজতে হয়রান, আর এখন বোতল নিজে এসে ধরা দিচ্ছে, কীসব অদ্ভুত কান্ড।
বোতলটা ধুয়ে বোতলে পাতিলের কুসুম গরম পানি ঢেলে মুখ বন্ধ করে ঘুরে দাড়িয়ে অভি বললো,– চলো জলদি রুমে চলো।
অনু মিষ্টি হেসে বললো,– তুমি যাও আমি গ্যাস বন্ধ করে আসছি।
অভি বোতল হাতে রুমে এসে আবার যেন আকাশ থেকে পড়লো, অনু তো বিছানায় ঘুমন্ত তাহলে রান্নাঘরে কাকে রেখে আসলো! অভি দৌড়ে আবার কিচেনে এসে দেখলো কিচেনের বাতি ঠিকই অফ কিন্তু কেউ নেই এখানে।
অভির মাথায় হাত। মাঝেমধ্যে গোপনে দুই একটা বিড়ি ছাড়া অন্যকোনো নেশাপানি ছোঁয়ও না অভি, সজ্ঞানে তো আজ নেশাপানি কিছুই খায়নি অভি তাহলে এরকম হচ্ছে কেন! নাকি অজ্ঞানে– ধুর অজ্ঞানে কি কোনকিছু সম্ভব নাকি!
নিজের মাথা নিজেই ওয়ালের সাথে টাক মেরে ফাটাতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু তা-ও করা যাবেনা, তাহলে অনুর সেবা করবে কে?
আবার রুমে এসে টিউবলাইট বন্ধ করে ডিমলাইট জ্বেলে খাটে উঠে শুয়ে অনুকে টেনে বুকে এনে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়ে বললো,– এখন কেমন লাগছে অনু?
ঘুম ভেঙে গেল অনুর, ঘুম জড়িত কণ্ঠে অনু বললো,– ব্যথাটা তেমনই আছে অভি, কমছে না।
আচ্ছা চিৎ হয়ে শোও অনু!
অনুরাধা চিৎ হয়ে শুলো।
পাতলা কম্বল টেনে দুজনের গায়ে জড়িয়ে কম্বলের ভেতর দিয়ে অনুর তলপেটে গরম পানির বোতলটা রেখে সেঁকা দিতে লাগলো অভি। এতে ব্যথা উপশম হয়।
অনুরাধারও ভালো লাগছে, ঘুম ঘুম চোখে ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়ে অনুরাধা বললো,– সত্যি তোমায় মতো কেয়ারিং একজন স্বামী যে মেয়ের কপালে জোটে সে সত্যি ভাগ্যবতী। এমন স্বামী যেন প্রতিটি মেয়ের ভাগ্যে জোটে। আই লাভ ইউ অভি!
হঠাৎ অভি বোতল ফেলে হুড়মুড় করে অনুকে ভীষণ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,– লাভিউ লাভিউ অনেক ভালোবাসি অঅঅঅঅঅনু!
অনুরাধা অনুরাধা অবাক হয়ে বললো,– আরে হঠাৎ করে এত ভালোবাসার প্রেশার আমার ওপর ছাড়লে চাপে ভর্তা হয়ে যাবো তো! কি হলো তোমার?
অনুরাধাকে জড়িয়ে ধরে কাঁপছে অভি।
অনুরাধা আবার বললো,– এমন কাপছো কেন অভি?
অভি কাঁপতে কাঁপতে বললো,– ও কিছু নয় অনু, ভালোবাসার হাইপ্রেশারে শরীরে ভাইব্রেশন মুড চালু হয়ে গেছে।
আসলে অভি ভীষণ ভয় পেয়ে ওরকম করছে, অভি যখন অনুর তলপেটে সেঁক দিচ্ছিল তখন হঠাৎ রুম থেকে ড্রইং রুমে যাবার দরজায় ঠিক অনুরাধার প্রতিচ্ছবি হাসতে দেখে ভয়টা পেয়েছিল, অনুরাধা তো পাশেই শুয়ে আছে তাহলে ও কে?
আসলে কী হচ্ছে এসব? কি কারণেই বা এ বাড়িতে এসেছে এই জীবন্ত প্রতিচ্ছবি?...
চলবে...
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com