মন নিয়ে কাছাকাছি | পর্ব - ৩০
হাই হিল পরার অভ্যাস না থাকলেও আজ শখ করে পরেছিল। সেই শখই কাল হলো। এমনিতে মাহিমা যথেষ্ট লম্বা হলেও উঁচু জুতোতে আরও লম্বা লাগে। উঁচু জুতো পরার এটাও অবশ্য একটা কারণ। কিন্তু এই জুতো পরে বেচারির পা বাজে ভাবে ছিলে গেছে। চামড়া উঠে লাল মাংস বেরিয়ে পড়েছে।
এজন্যই তো এভাবে জ্বলছিল। হাঁটার সময় ব্যথা হচ্ছিল। কিন্তু মাহিমা খেয়াল করেনি। এখন জুতো খুলে ছিলে যাওয়া জায়গাটা দেখে রীতিমতো আঁতকে উঠতে হচ্ছে। ক্ষতটা দেখার আগে ব্যথা এতটাও অনুভব হচ্ছিল না। কিন্তু এখন ক্ষত দেখে যন্ত্রণা যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। মাহিমা নিচের ঠোঁট ফুলিয়ে কাতর গলায় বলল,
"কতটা ছিলেছে! উফ, ভীষণ জ্বালা করছে।"
মুবিন হতাশ নয়নে এই মেয়েটাকে দেখলো। কিছুটা শাসন মেশানো গলায় বলল,
"যেটা পরে কম্ফোর্ট ফিল করো না সেটা পরতে যাও কেন? কেউ নিশ্চয় জোর করেনি।"
"কিন্তু লেহেঙ্গার সাথে হিল না পরলে লেহেঙ্গা মাটিতে গড়ায়।"
মুবিন কী বলবে এই মেয়েকে? রাগ লাগলেও কঠোর ভাবে কিছু বলার অধিকার এখনও তার হয়নি।
"পরেছ, এখন হয়েছে? ভালো লাগছে?"
"না। ব্যথা লাগছে।"
মুবিন চাইলেও এখন মাহিমার জন্য নতুন একজোড়া জুতা এনে দিতে পারবে না।
আনলেও মাহিমা নিজেই হয়তো নিতে চাইবে না। উল্টো তার এরকম আচরণে সন্দেহ করবে।
ভুলও বুঝতে পারে। কিন্তু মাহিমা পুরোটা অনুষ্ঠানে এই জুতা পরে হাঁটবে কীভাবে?
মুবিন পকেট হাতড়ে টিস্যু খুঁজে পেলো।
বুদ্ধি বের করে গোড়ালির দিকে জুতোতে টিস্যু গুঁজে দিল।
মাহিমা মনোযোগ সহকারে মুবিনের প্রতিটা কাজ দেখছে। মুবিন এবার বলল,
"এবার পরো দেখি। এখনও ব্যথা পেলে পরতে হবে না।"
মাহিমা জুতো পরে উঠে দাঁড়াতে নিলে মুবিন বলল,
"হেল্প লাগবে?"
"না, ঠিক আছে।"
মাহিমা নিজে নিজেই দাঁড়াল।
নিচে পা ফেলে দেখল টিস্যু থাকায় এখন আর জুতোয় ঘষা লেগে কষ্ট হচ্ছে না। মাহিমা কৃতজ্ঞতার চোখে মুবিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
"ধন্যবাদ মুবিন ভাই। আপনাকে অনেকগুলো ধন্যবাদ দিলেও কম পড়বে।"
মুবিন হাসলো। সে ভালোবাসা চায় কিন্তু এই মেয়ে তাকে ধন্যবাদ দিয়ে কৃতজ্ঞতা জানায়।
যাক এটাই বা কম কিসে? কৃতজ্ঞতাই হয়তো একদিন ভালোবাসার রুপ নিবে।
মুবিন ততদিন অপেক্ষা করবে।
মুবিনের কাছ থেকে চলে এলেও মাহিমা এখনও মুবিনকে নিয়েই ভাবছে।
মুবিন ভাইয়ের আজকের আচরণ তার কাছে অবিশ্বাস্য হলেও খারাপ লাগেনি।
মুবিন ভাই তার জন্য কতটা ভেবেছে!
আচ্ছা, উনি মীরাকে পছন্দ করে বলেই কি তার এতটা খেয়াল রেখেছে?
শালিকে ইমপ্রেস করে মীরাকে পটাতে চাচ্ছে? কোন মেয়েকে পটানোর আগে প্রথম শর্তই হচ্ছে তার বান্ধবীকে পটাও। বান্ধবী পটে গেছে মানেই মেয়েটাও পটে গেছে।
মুবিন ভাইও এই পথই ধরেছে। তবুও মুবিন ভাইয়ের আজকের কেয়ারটুকু মাহিমা
কোনদিন ভুলবে না। ছেলে ফার্স্ট ক্লাস। মীরাটার কপাল আছে বলতে হবে।
"কোথায় ছিলি এতক্ষণ? খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হচ্ছি। চল ভাবীর সাথে সেল্ফি তুলে আসি।
ভাইয়া ভাবীর ছবিও তো তুলতে হবে।"
মীরা মাহিমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। মাহিমা পড়ে যেতে যেতেও সামলে নিয়ে হাঁটছে।
ভাবছে, মুবিন ভাইয়ের কথাটা মীরাকে বলবে কি-না। অবশ্যই বলবে।
বেচারা কত কষ্ট করে মীরাকে ইমপ্রেস করার জন্য তার সেবা আত্তি করেছে।
এই কথা মীরা না জানলে ইমপ্রেস হবে কীভাবে?
"তোর সাথে কথা আছে।"
"কী কথা?"
"দরকারি কথা।"
"দরকারি অদরকারি সব কথা পরে শুনব। এখন তুই আমার কয়েকটা সুন্দর সুন্দর ছবি তুলে দে। আমি পোজ দিচ্ছি দাঁড়া।"
মীরারা নতুন ভাবী নিয়ে রাতে বাড়ি ফিরলো।
এখনও সবাই ইভান ভাইয়ের ঘরে নতুন ভাবীকে ঘিরে বসে আছে।
মীরাও এতক্ষণ ওখানেই ছিল। কাপড় চেঞ্জ করতে মাত্র রুমে এসেছে।
ওয়াশরুম থেকে চেঞ্জ করে এসে বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে কানের দুল,
চুড়ি, টিকলি খোলার সময় পায়ের দিকে চোখ গেল। তার এক পায়ে নূপুর নেই।
মীরা ব্যস্ত হয়ে আশেপাশে খুঁজতে লাগল। কখন হারিয়েছে এটা? বাড়িতে আসার পর?
নাকি বিয়েতে? রুমে পড়লে পেয়ে যাবে। কিন্তু অন্য কোথাও পড়ে থাকলে?
মীরা ফ্লোরে বসে উঁকিঝুঁকি দিয়ে বেডের নিচে দেখছে। এমন সময় ছোট চাচী ঘরে এলো।
ছোট চাচী মীরাকে নিচে বসে থাকতে দেখে বলল,
"কী করছিস তুই? নিচে কী খুঁজছিস?"
মীরা মুখ তুলে চাচীর দিকে চাইল। মুখ কালো করে বলল,
"আমার নূপুর হারিয়ে... " মীরা লক্ষ করল চাচীর হাতে ফোন ধরা। সে বুঝে গেল।
আজকের এত খুশির দিনটাও ওই মহিলা নষ্ট করতে চাচ্ছে?
ওই মহিলা কি তাকে খুশি থাকতে দেখতে পারে না? মীরার চোখ মুখ কঠিন হয়ে গেল।
তীক্ষ্ণ গলায় সে বলল,
"আজও কেন বাইরের একটা মানুষের সাথে তুমি কথা বলছো ছোট চাচী?
ওই নোংরা স্বার্থপর জঘন্য মহিলার কথা কেন শোনো।"
মীরার কথা মানুষটা শুনতে পারছে ভেবে ছোট চাচী ফোনের স্পিকার চেপে ধরলো।
তাতেও অবশ্য শেষ রক্ষা হলো না। মীরা আরও চেঁচিয়ে বলতে লাগল,
"একটা বাইরের মানুষের সাথে আমি জীবনেও কথা বলবো না।
আমার জন্য উনার এতই দরদ থাকলে উনাকে বলো আমাকে যেন শান্তিতে বাঁচতে দেয়।
আমি উনার ছায়াটাও আমার জীবনে চাই না।"
ছোট চাচী অসহায় মুখে মীরার দিকে তাকিয়ে বলল,
"তোর মা হয় মীরা। মা কি সন্তানের সাথে... "
"কে সন্তান ছোট চাচী? কাকে মা বলছো তুমি? উনি মা হলে সন্তানকে ছেড়ে চলে যেত?
তুমি মাহাকে ফেলে চলে যেতে পারবে?
উনি আমাকে তখন ছেড়ে গেছেন যখন আমার শুধু উনাকেই লাগত।
এখন তো আমার উনাকে লাগবে না। উনাকে ছাড়াই তো এতগুলো বছর থেকেছি।
বাকি জীবনও থাকতে পারব।"
কথাগুলো বলে মীরা কাঁদতে লাগল। এই মহিলা যখনই কল দেয় মীরার কষ্ট হয়।
সবকিছু ভুলে থাকতে চাইলেও পারে না। মনে হয় সে কতটা দুর্ভাগা। তার মা তাকে ছেড়ে চলে গেছে।
সে কি এতটাই খারাপ ছিল? ছেড়েই চলে যাবে তাহলে দুনিয়ায় এনেছিল কেন?
ছোটবেলা যখন বুঝতো না, সব জায়গায় মা'কে খুঁজত। মা কেন আসে না?
কেন তাকে আদর করে না এই কথাই জিজ্ঞেস করতো। স্কুলে সব বাচ্চাদের বাবা মা যেত।
শুধু তার মা-ই যেত না। কোন বাচ্চারা তার সাথে খেলতো না। মীরা অনেক কাঁদত।
সেই সময় গুলো মীরা কখনও ভুলতে পারবে না। আর না ওই মানুষটাকে ক্ষমা করতে পারবে।
তিক্ত অতীত মনে পড়ায় মীরার কষ্ট হচ্ছে। সে হাতপা ছেড়ে মেঝেতে বসে কাঁদতে লাগল।
ছোট চাচীও তার কান্না থামাতে পারল না।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বাকি সবাই নতুন বউকে ছেড়ে মীরার ঘরে হাজির হয়েছে।
মীরাকে কাঁদতে দেখে অস্থির হচ্ছে। তার কান্নার কারণ বারবার জিজ্ঞেস করছে।
বড় ফুপু মীরার মাথা, মুখে হাত বুলিয়ে বলছে,
"কী হয়েছে আমার মা'টার? কেন কাঁদছে? ও মা বল না। আমাদেরকে কেন টেনশন দিচ্ছিস?"
আবির সবসময় মীরাকে ক্ষেপায়। মজা করে। কিন্তু মীরার একটু মন খারাপ হলেই তার দুনিয়া ভার লাগে।
"ও মীরাবাঈ, কী হয়েছে চাঁদ? কেন কাঁদছিস তুই? কেউ কিছু বলেছে?"
মীরা কারো কোন কথার জবাব দিচ্ছে না। ছোট চাচী আসল কারণ বলার জন্য মুখ খোলার আগেই মীরা বলল,
"আমার নূপুর হারিয়ে গেছে। কোথাও পাচ্ছি না।"
মীরা কেন কাঁদছে এটা জানতে পারলে সবাই ছোট চাচীকে বকবে। ফুপু তো ভীষণ রাগ করবে। তাই মীরা নূপুর হারানোর বাহানা দিয়েছে।
মীরার কান্নার এই সামান্য কারণ শুনে সকলে হতাশ। কিন্তু মেয়েটা এরকম ভাবে কাঁদছে তাই কেউ কিছু বলতে পারল না। ইভান মীরাকে ধরে বিছানায় বসিয়ে আশ্বস্ত করল,
"তোর কতগুলো নূপুর লাগবে? আমাকে বল। আমি তোকে এনে দেব। তবুও এভাবে কাঁদিস না লক্ষী। তুই না ভালো মেয়ে। এভাবে কেঁদেকেটে কেন আমাদের কষ্ট দিচ্ছিস? তুই কাঁদলে আমাদেরও তো কান্না পায়।"
মীরা হেঁচকি তুলতে তুলতে চোখ মুছছে। যতবার চোখ মুছছে ততবারই আবার জল গড়িয়ে পড়ছে। ইভান মীরার চোখ মুছে দিল। মাথার চুল ঠিক করে দিতে দিতে বলল,
"তোর দুইটা ভাই থাকতে তুই কেন একটা নূপুরের জন্য কাঁদছিস পাগলি!"
মীরা নাক টেনে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,
"ওইটাও তুমিই এনে দিয়েছিলে।"
"তাতে কি? আবার এনে দেব। পৃথিবীতে নূপুর আবিস্কারই হয়েছে আমার বোনের সুন্দর সুন্দর দুইটা পায়ের জন্য।"
মীরা দু-হাত ভরে মেহেদি পরেছে। ইভা আপু, উঁহু ভাবী। এতো সুন্দর করে মেহেদি দিতে পারে মীরার জানা ছিল না। ইভা আপু ইভান ভাইয়ের বউ হয়ে আসার পর থেকে এই বাড়িটা যেন আগের থেকেও সুখী সুখী হয়ে গেছে। তার ভাবী সবকিছু পারে। মীরা ইভার এত গুণ দেখে মুগ্ধ হয়। একটা মানুষ এতটা পারফেক্ট কীভাবে হতে পারে? যেমন রূপবতী তেমনই গুণবতীও। তার হাতের মেহেদি দেখানোর জন্য মীরা সিঁড়ি দিয়ে উড়ে উড়ে নামছে। নিচে নেমেই সে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। কারণ জায়িন ভাই সহ পুরো পরিবার এসেছে। আজ ভাবীর বাড়ির মানুষ আসবে মীরা জানতো । সে অপ্রস্তুত হয়ে হেসে সবাইকে সালাম দিল। সুমনা মীরার হাত দেখে বলল,
"মেহেদি দিয়েছিস?"
"হ্যাঁ ইভা আপু, এই আপু বলার অভ্যাসটা এখনও ছাড়তে পারছে না। ভাবী ডাকতে গিয়েও মুখ দিয়ে আপু চলে আসে।
" ভাবী দিয়ে দিয়েছে।"
ইভার বিয়ের পর জায়িন অনেকদিন বাড়িতে আসেনি। গতকাল রাতে ফিরেছে। আজকে শুনলো সবাই এখানে আসছে। তার মানে আজ পড়া বন্ধ। তার প্রেয়সীকে দেখতে হলে কাল বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। জায়িন এই দীর্ঘ অপেক্ষা করতে পারল না। যাকে দেখার জন্য এসেছে তাকে যতক্ষণ না দেখবে ততক্ষণ অস্থিরতা কমবে না। তাই মা, খালামনি কয়েকবার বলার পরেই এখানে আসতে রাজি হয়ে গেছে। এখানে এসে কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখতে পেয়ে তৃষ্ণার্ত হৃদয় শান্ত হয়েছে।
মীরা ইভাকে ডাকতে চলেই যাচ্ছিল। এর মাঝে আরেকটা কাণ্ড ঘটলো। ফ্লোরে মাহার রাবারের খেলনা হাঁসটা পড়ে ছিল। মীরা ওটার উপর পাড়া দিয়ে স্লিপ খেয়ে সোজা হুমড়ি খেয়ে পড়ল। পড়লো তো পড়লো, সেটাও অন্য কারো উপর না। তার দু'হাতের মেহেদির ছাপ জায়িনের সাদা শার্টে ফোটে আছে। মীরা চোখ তুলে জায়িনকে দেখে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলে আরেকটা অঘটন ঘটালো। সরি বলতে বলতে শার্ট থেকে মেহেদি মুছতে গিয়ে আরও লেপটে দিল। সে ভুলেই গিয়েছিল এটা মেহেদি। যত ধরবে ততই লাগবে।
চলবে...
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com