মন নিয়ে কাছাকাছি | পর্ব - ২৯
মীরার ওড়নায় টান পড়লে সে দাঁড়িয়ে গেল। কিসের সাথে ওড়না আটকেছে দেখার জন্য মীরা পেছন ফেরার আগেই জায়িন এসে লোকটাকে বলল,
"এক্সকিউজ মি, আঙ্কেল। আপনার পায়ের নিচে..
লোকটা নিচে তাকিয়ে লক্ষ করতেই দেখল তিনি কারো ওড়নায় পা রেখে দাঁড়িয়ে আছেন।
লোকটা জায়িনের দিকে তাকিয়ে লজ্জিত মুখে হেসে বলল,
" ওহ সরি ইয়াংম্যান। আন্তরিক সরি।"
মীরা এদিকে তাকালে দেখতে পেল জায়িন তার ওড়না হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে একটা লোকের সাথে কথা বলছে। মীরা অবাক হওয়ার সাথে সাথে কিছুটা বিরক্তও হলো।
জায়িন ভাই কোন সুখে তার ওড়না ধরে রেখেছে?
ব্যাপারটা দেখার জন্য মীরা ওদের কাছে এসে দাঁড়াল।
লোকটা মীরাকে দেখে জায়িনের দিকে তাকিয়ে উদেশ্য পূর্বক হেসে বলল,
"নতুন বিয়ে? এমনই হয়। এসময় বউয়ের আঁচল ধরেই ঘুরতে হয়।
আমিও এমনভাবেই তোমার চাচীর আঁচল ধরে ঘুরতাম।
একমুহূর্তের জন্য চোখের আড়াল হতে দিতাম না। আর এখন দেখো। বিয়ের ছাব্বিশ বছর পেরিয়েছে।
আমি কোথায় তোমার চাচী হয়তো জানেই না।
সে-ও মিসেস সালেহ নয়তো মিসেস হকের সাথে গসিপ করছে। হা হা।
এমনই হয়। শুরুতে প্রেমটা যেমন থাকে বিশ বছর পর তার কিছুই থাকে না।"
লোকটা নিজে নিজেই ওদের স্বামী স্ত্রী কল্পনা করে এতগুলো কথা বলে গেল।
জায়িন চেয়েও বাধা দিতে পারল না।
মীরা চোখ বড় বড় করে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
পাগল লোক কাকে কার বউ বলছে? দিনেদুপুরে চড়িয়ে এসেছে নাকি?
মীরা জায়িনকেও দেখল। জায়িন ভাই লোকটার ভুল শুধরে দিল না!
মীরার জায়িন ভাইয়ের উপরও রাগ হলো।
"না না না। আঙ্কেল আপনার ভীষণ বড় ভুল হচ্ছে। আমরা..
লোকটা মীরাকে থামিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বলল,
" শুরুতে সবাই এটাই বলে মা। আমাদের প্রেম আমৃত্যু থাকবে।
কিন্তু দু'জন মানুষ একসাথে থাকা শুরু করলে একে অপরের অনেক খুঁত জানতে পারে।
শুরুতে পার্টনারের যে অভ্যাসে ভালোবাসা পেত বছর কয়েক গেলে সেটাই বিরক্তিকর হয়ে উঠে।"
মীরা নাকের পাটা ফুলিয়ে আগুন চোখে জায়িনকে দেখছে।
জায়িন ভাই কিছু বলছে না কেন? আশ্চর্য!
"আঙ্কেল আপনি থামবেন? না জেনে কতকিছু বলে যাচ্ছেন!"
লোকটা মীরার রাগ দেখেও হাসলো। মীরার রাগের পাত্তা না দিয়ে
জায়িনের দিকে তাকিয়ে মুখের হাসি চওড়া করে বলল,
"অনেক ভালোবাসে। তাই মানতে পারছে না। ভালো ভালো। এই ভালোবাসা থাকাটা ভালো। তবে যত ভালোবাসাই থাকুক। এটাই বাস্তব ইয়াংলেডি।"
লোকটার কথা শুনে মীরার রেগেমেগে আগুন হওয়া চেহারা দেখতে জায়িনের ভালোই লাগছে।
লোকটার কথাগুলোও শুনতে তেমন খারাপ লাগছে না।
বিবাহিত জীবনে হাঁপিয়ে ওঠা একটা লোক মীরাকে তার স্ত্রী ভেবে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছে। লোকটাকে বাধা দেওয়ার কোন অধিকার তো তার নেই। সব মানুষের বাকস্বাধীনতা আছে।
মীরা এই বুড়োর মাথা ফাটিয়ে দিবে।
তোর জীবনে সুখ নাই বুড়ো এখন তুই যারে তারে জামাই বউ বানিয়ে জ্ঞান ঝাড়বি!
জায়িন লক্ষ করল মীরা কঠিন কিছু কথা বলার জন্য তৈরি হচ্ছে।
তার আগেই সে লোকটাকে অন্যদিকে পাঠিয়ে দিল।
"আঙ্কেল আন্টি হয়তো আপনাকে খুঁজছে।"
এই অসহ্যকর লোক যাবার আগেও একটা কথা বলে মীরার গা জ্বালিয়ে দিয়ে গেল।
তিনি আসলে মীরাকে উদ্দেশ্য করে জায়িনকে বলেছে,
"জিতে গেছো ইয়াংম্যান। তোমার লাক ভালো। তোমার মতো ভাগ্য সবার হয়না।
আমার মতো অবহেলায় হারিও না। ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখো।"
লোকটা চলে গেলে মীরা জায়িনের উপর ফেটে পড়ল।
ঝাড়া মেরে জায়িনের হাত থেকে ওড়নার কোনা ছাড়িয়ে নিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বলল,
"আপনি লোকটার ফালতু কথা কেন শুনছিলেন জায়িন ভাই? উনি আমাদের...!
আপনি উনার ভুল কেন ভাঙেননি? চুপ করে শুনলেন! একটা কথাও বলেন নি! কেন?"
"বয়স্ক লোক। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ব্যক্তিগত জীবনের বেচারা সুখে নেই।"
"বুড়োর নিজের জীবনে সুখ নেই বলে যাকে তাকে..।
আপনি নিজেও ওই লোকটার মতো পাগল। দুই পাগলের পাগলামির মাঝে আমাকেও ফাঁসিয়ে দিয়েছেন।"
"আমি তো উনাকে কিছু বলিনি। উনি নিজে নিজে ভেবে নিয়েছেন। এতেও কি আমার দোষ?"
"অবশ্যই। আপনি ভুল ভাঙানোর চেষ্টা করেননি। উল্টো উনাকে এমনটা ভাবতে দিয়েছেন।"
"আচ্ছা মানলাম, কিন্তু উনার ভুল ভাঙালে কী হতো?"
"কী হতো মানে? উনি এমনটা ভাবত না।"
"এখন উনি এমনটা ভাবছেন। তাতে তোমার আমার কারো ক্ষতি হচ্ছে কি?"
"ক্ষতি না হোক। একটা মানুষ কেন না জেনে এমনটা ভাববে!"
"সেটা উনার ভাবনা মীরা। আমাদের তো কিছু না। উনার ভাবনা উনাকে ভাবতে দাও। কারো ভাবনার উপর নিশ্চয় আমাদের কন্ট্রোল নেই।"
জায়িনের কথার প্যাঁচে ফেঁসে গিয়ে মীরা আর তর্ক করার মতো কোন কথা খুঁজে পেলো না। শেষে রেগেমেগে শুধু এটুকু বলল,
"আপনি ডাক্তার না। আপনি নিজেও একটা মস্ত বড়ো পাগল।"
কথাটা বলেই মীরা গটগটিয়ে জায়িনের সামনে থেকে চলে গেল। মীরার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে জায়িন শব্দ করে হেসে ফেলল।
"পাগলি!"
জায়িনের কাঁধে কারো হাত পড়তে জায়িন চমকে তাকালো। আবির অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে সামনের দিকে চোখ রেখেই বলল,
"পাগলিটা কে রে? ওই মেয়েটা? এখানে এসেছে!"
মীরা ততক্ষণে পুরোপুরি চোখের আড়ালে চলে গেছে বুঝতে পেরে জায়িন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
যাক আবিরের চোখে পড়েনি। আবিরটার টাইমিংও মাশাল্লাহ।
যখনতখন যেখানে সেখানে টপকে পড়ে। জায়িন কিছু বলছে না দেখে আবির ওর পেটে খোঁচা মারল।
"পাগলিটা কে বল। আমি কিন্তু স্পষ্ট শুনে ফেলেছি। আর লুকাস না। বলে ফেল।
ভাবী এখানে উপস্থিত আছে?"
জায়িনের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে।
স্বর্ণে বাঁধানো কপাল তার। একবার তনি এসে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফেলে।
একবার আবির এসে কথা শুনে ফেলে। এই দুইটার কি আর কোন কাজ নেই?
গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড দুইটা নিজেদের ফেলে তার পেছনে গোয়েন্দা খাটছে।
এরা থাকতে তার প্রেম তো এই জীবনে হবে না।
এখন দেখা যাচ্ছে এদের যন্ত্রণায় দুনিয়ায়ও থাকা যাবে না।
গাট্টিগুট্টি বেঁধে সে কি এখন মঙ্গল গ্রহে চলে যাবে? আবির জায়িনের কাঁধে চেপে ধরলো।
তনিকে ভুলভাল বোঝানো গেলেও আবিরকে উল্টাপাল্টা বোঝ দেওয়া সহজ হবে না।
"তনিকে মনে হয় এতদিন আমি ভালো করে দেখিনি। নইলে ওকে শুধু বন্ধুর নজরেই দেখেছি। তনিও যে একটা মেয়ে এটা মিস করে গিয়েছিলাম।"
আবির সানগ্লাসের উপর দিয়ে বড়ো বড়ো চোখে জায়িনকে দেখল। এই শালা বলে কি! আবির সানগ্লাস খুলে ফেলে আতঙ্কিত গলায় বলল,
"তুই আমার না হওয়া সংসার শুরু হওয়ার আগেই ভাঙতে চাচ্ছিস! বন্ধুর সম্পদের উপর কুদৃষ্টি দিচ্ছিস?"
"কী করব? তুই ঠিকঠাক মতো বন্ধুর দায়িত্ব পালন করলে এই দিন আসতো না।"
"কীভাবে দায়িত্ব পালন করব শালা। তুই তো কিছু বলিসই না। পছন্দের মেয়ে থাকলে বল।
না থাকলে সেটাও বল। তোকে কি আমি সিঙ্গেল মরতে দিতাম? বল কেমন মেয়ে পছন্দ।
আশেপাশে না পেলে সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে হলেও তেমন মেয়ে খুঁজে আনবো।"
"প্রজাপতির মতো একটা মেয়ে।"
"কিহ! এইটা আবার কোন প্রজাতি?"
"প্রজাপতি দেখেছিস কখনও? প্রজাপতির সব বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে থাকবে।
তার পৃথিবী প্রজাপতির ডানার মতোই রঙিন হবে। প্রজাপতির মতো ছটফটে চঞ্চল।"
"ওরে ভাই, প্রজাপতি যেমন এক ফুলে বেশিক্ষণ বসে না ওই মেয়ের মনও তোর উপর
বেশিদিন টিকবে না। তখন দেবদাস হয়ে আমার কাছেই তো আসবি। তার থেকে ভালো কচ্ছপ
প্রজাতির মেয়ে খুঁজে দিই? কচ্ছপের মতো ওই মেয়ের মন তোর উপর থেকে নড়বে না।"
মাহিমা বাম হাতে কানের পেছনে চুল আটকে রেখে ঝুঁকে নিচে তার কানের দুলটা খুঁজছে।
একটু আগে চুল ঠিক করতে গিয়ে আবিষ্কার করল তার বাঁ কানের দুল হারিয়ে গেছে।
এখানেই হয়তো কোথাও পড়েছে। আবার অন্য জায়গায়ও পড়তে পারে।
বিয়ে উপলক্ষে নতুন একজোড়া দুল কিনেছিল। তার থেকে বড় কথা দুলটা না পেলে
এখন এক কান খালি নিয়ে কীভাবে ঘুরবে? মাহিমা মানুষের ভীরের মধ্যেই এর ওর পায়ের
ফাঁকে দুলটা খুঁজে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে এক-দুজনের সাথে ধাক্কা খেয়ে সরিও বলছে।
মাহিমা কুঁজো হয়ে ঝুঁকে ছিল ওর সামনে এসে একজোড়া পা থেমে গেলে
মাহিমা মাথা তুলে মুবিনকে দেখলো।
মুবিন মাহিমার দিকে মুঠো করা হাত বাড়িয়ে দিয়ে মুঠো খুলে বলল,
"এটা খুঁজছিলে?"
মাহিমা দেখল তার হারিয়ে যাওয়া কানের দুলটা মুবিন ভাইয়ের হাতে।
মনে মনে দুলটা পাওয়ার আশা ছেড়েই দিয়েছিল।
অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে দুলটা পেয়ে গিয়ে মাহিমা খুশি হয়ে গেল।
সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মুবিনের দিকে তাকিয়ে মুখে হাসি নিয়ে বলল,
"হ্যাঁ। হারিয়ে গিয়েছিল। আপনি এটা কোথাও পেয়েছেন মুবিন ভাই?"
দুলটা মাহিমার কান থেকে খুলে পড়ে যাওয়ার সময়ই মুবিন দেখেছিল।
সাথে সাথেই সে দুলটা তুলে নেয়। মাহিমা মুবিনের হাত থেকে দুলটা নিয়ে কানে পরতে লাগল।
মুবিন মুগ্ধ হয়ে এই দৃশ্য দেখছে। মাহিমা দুল পরা শেষে বলল,
"ধন্যবাদ মুবিন ভাই। আপনি জানেন না দুলটা আমার কত পছন্দের ছিল।
একটা হারিয়ে গেলে অন্যটাও পরতে পারতাম না।"
মাহিমা চলে যাওয়ার সময় মুবিন লক্ষ করল মাহিমার হাঁটতে যেন একটু কষ্ট হচ্ছে।
হয়তো জুতার জন্য অসুবিধা হচ্ছে। মুবিন সাহস করে পেছন থেকে মাহিমাকে ডাকল।
মাহিমা ফিরে তাকিয়ে বলল,
"কিছু বলবেন?"
মুবিন মাহিমার কাছে এগিয়ে এলো। পাশ থেকে একটা চেয়ার টেনে এনে মাহিমাকে বসতে ইশারা করলে মাহিমা বুঝতে পারল না।
"বসো।"
মাহিমা অবাক হলো। বসবে কেন সে? এটা কেমন আবদার!
"তোমার মনে হয় হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে। হয়তো সমস্যাটা জুতোর জন্য হচ্ছে।"
মাহিমা বিস্মিত হলেও তর্ক না করেই চেয়ারে বসল। মুবিন একহাঁটুতে মেঝেতে ভর দিয়ে মাহিমার সামনে বসলো। মাহিমা মুবিনের আচরণে যথেষ্ট চমকাচ্ছে।
মুবিন নিজে মাহিমার জুতো খুলতে নিলে মাহিমা আঁতকে উঠে পা সরিয়ে নিয়ে বলল,
"কী করছেন মুবিন ভাই!"
চলবে...
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com