মন নিয়ে কাছাকাছি | পর্ব - ৩৩
ভাগ্য জায়িনের সহায় হলো। মীরার সামনে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যাওয়ার আগেই জায়িনের ফোন বেজে উঠল। ফোনের ওইটুকু আলো দিয়েই জায়িন ড্রয়িংরুমটা দেখে নিল। মীরাকে নিয়েই এগিয়ে গিয়ে ফোন হাতে নিল। আবির বোনের চিন্তায় অস্থির করে জায়িনের কল করছে। জায়িন কল তুললো। আবিরের উত্তেজিত কন্ঠ শোনা যাচ্ছে।
"জায়িন মীরা তোদের ওখানেই তো? ওকে বৃষ্টিতে একা বেরুতে দিছসনি তো?"
জায়িন শান্ত গলায় জবাব দিল,
"মীরা আমার কাছেই আছে। ওর কিছু হয়নি।"
"থ্যাংক গড! বাহিরে যে পরিমাণ ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। আমরা এটা ভেবে ভয় পাচ্ছিলাম মীরা হয়তো রাস্তায় কোথাও আটকা পড়েছে। রাত হলেও ওকে আসতে দিস না। ঝড় কমলে আমি এসে নিয়ে যাব। ওকে একটু দেখিস ভাই। বাজ পড়লে মীরা ভীষণ ভয় পেয়ে যায়।"
"হুম।"
আবির কল কেটে দেওয়ার পরও মীরা জায়িনকে ছাড়ছে না। সে আগের মতোই আষ্ঠেপৃষ্ঠে জায়িনকে ধরে রেখেছে। মীরার দ্রুত চলা একেকটা শ্বাস-প্রশ্বাস জায়িনের বুকে বাড়ি খাচ্ছে। মাথাটা একটু নিচু করতেই মীরার চুল থেকে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ নাকে এসে লাগলো। নিশ্চয় শ্যাম্পুর ঘ্রাণ। বুকের বাঁ পাশে ঠিক যেখানটায় হৃদয়ের অবস্থান, জায়িনের শার্টের ওই অংশ মীরার হাতের মুঠোর ভেতর দলা পাকানো। মেয়েটা কি তার ভেতরের উথালপাতাল অনুভূতির আন্দোলন টের পাচ্ছে? জায়িনের হাসফাস লাগছে। বাইরে তীব্র বাতাস গাছগাছালি উড়িয়ে নিয়ে গেলেও জায়িন এই ঘরের ভেতর পর্যাপ্ত বাতাস পাচ্ছে না। জায়িন চোখ বন্ধ করে নিয়ে গভীর ভাবে দম টানলো। বাইরের ঝড়ের সাথে তার নিজের ভেতরও একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এই ঝড় প্রকৃতির ঝড়ের থেকেও ভয়ংকর রুপ ধারণ করার আগে কিছু করতে হবে। জায়িন নরম গলায় মীরাকে ডাকল।
"মীরা! মীরা, একবার চোখ খুলে দেখো। ভয়ের কিছু নেই। মীরা!"
না। মীরা নিজেও ঘোরের মধ্যে আছে। এভাবে কাজ হবে না ভেবে জায়িন শক্ত হাতে মীরাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ওর দুই বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে হুঁশে আনতে চাইল।
"মীরা, আলো এসেছে। এখন আর ভয় পেতে হবে না। মীরা!"
জায়িনের কঠিন গলায় ধমক খেয়ে মীরার হুঁশ ফিরেছে। সে নিজের করা কাণ্ডের কথা মনে করে ভয়, লজ্জা, অস্বস্তিতে জায়িনের দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারল না। লজ্জায় কুঁকড়ে গেছে বেচারি। জায়িন ওর বাহু ছেড়ে দিল। এবং মীরাকে কিছুই না বলে কোথাও চলে গেল। জায়িন যেতেই মীরা ধপ করে সোফায় বসে পড়ল। এটা কী করেছে সে? তাকে দিয়ে এটা কী হয়ে গেল! জায়িন ভাই তাকে কী ভাবছে? মীরা কেন বুঝলো না। নিশ্চয় জায়িন ভাই তাকে বাজে ভাবছে। লজ্জায়, নিজের উপর ঘৃণায় মীরার চোখে পানি এসে গেছে। সে দু'হাতে মুখ ঢেকে হুহু করে কেঁদে ফেলল। সে তো জানে, ইচ্ছে করে এটা করেনি সে। ভুল করে হয়ে গেছে। কিন্তু জায়িন ভাই কি বুঝবে?
পায়ে ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ পেতে মীরা ভয় পেয়ে ছিটকে সরে যেতে নিল। কিন্তু ততক্ষণে সে বাধা পেলো। মীরা বিস্ফোরিত চোখে জায়িনকে দেখতে লাগল। জায়িন একহাতে তার পা ধরে আরেক হাতে বরফ ঘষে দিচ্ছে। মীরা ভুলেই গিয়েছিল তার পায়ে গরম চা পড়েছে। ব্যথাটাও এতক্ষণ ছিল না। কিন্তু জায়িন ভাই ভুলেননি! তিনি মীরার পায়ে বরফ লাগিয়ে দিচ্ছে। অস্বস্তিতে মীরা ছটফট করতে লাগলে জায়িন কঠিন চোখে মীরার দিকে তাকিয়ে ধমক দেওয়া গলায় বলল,
"সমস্যা কি? চিংড়ি মাছের মতো এরকম ছিট পারছো কেন?"
মীরা গলা দিয়ে কোন শব্দই বের করতে পারল না। অনেক চেষ্টার পর চিউচিউ করে বলল,
"আপনি আমার পা ধরছেন...
ওকে কথার মাঝে থামিয়ে দিয়ে জায়িন রাগী চোখে দেখল। ব্যস। মীরা এতেই আবারও কথা হারিয়ে ফেলল। বরফ লাগানো শেষ হলে জায়িন মীরাকে বসিয়ে রেখে রুম থেকে মলম নিয়ে এলো। এবার মীরার পায়ে লাগাতে নিলে মীরা পা সরিয়ে নিয়ে অসহায় মুখে বলল,
" আপনি আমার পা ধরছেন। আমার পাপ হবে। আপনি দিন। আমি নিজে লাগিয়ে নিতে পারব।"
জায়িন মীরার কথায় কানই দিলো না। উল্টো নিজেই মলম লাগিয়ে দিতে দিতে প্রশ্ন করল,
"পাপ হবে কেন?"
"আপনি আমার বড় না!"
"পাপ হবে না। আর হলেও, তুমিও আমার পা ধরে পাপ কাটাকাটি করে নিও।"
জায়িন ভাইকে সে সবসময় বদমেজাজি, গোমড়ামুখো বলে আসত। কিন্তু এই গোমড়ামুখো লোকটার ভেতরেই যে আরেকটা কত ভালো মানুষ লুকিয়ে আছে তা এতদিন দেখতে পারেনি। আজকের জন্য মীরা সত্যিই জায়িন ভাইয়ের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। সে অন্য দিকে তাকিয়ে হালকা গলায় বলল,
"ধন্যবাদ।"
"কেন?"
"বরফ ও মলম লাগিয়ে দেওয়ার জন্য।"
"শুধু একটা ধন্যবাদে কাজ হবে?"
মীরা এতক্ষণ অন্য দিকে তাকিয়ে থাকলেও এই কথা শুনে চকিতে লোকটার দিকে তাকাল। জায়িন মীরার দিকেই তাকিয়ে ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসি রেখে বলল,
"আরও তো অনেককিছু করেছি। চা বানিয়ে খাইয়েছি। অন্ধকারে ভয় পাওয়া থেকে বাঁচিয়েছি। ওসবের জন্য ধন্যবাদ দিবে না?"
এই লোকের কথা শুনে মীরা হতভম্ব, বাকরুদ্ধ। সুযোগের ব্যবহার করে তাকে এভাবে খোঁচা মারছে! এমনিতেই তো সে নিজের কাজে লজ্জিত। এখন কি তা মনে করিয়ে দিয়ে আরও লজ্জা দিয়ে মেরে ফেলতে চাচ্ছে? আচ্ছা অধিক লজ্জায় কি মানুষ মারা যেতে পারে? তাহলে নির্ঘাত পৃথিবীতে আজই তার শেষ দিন। এত লজ্জা নিয়ে কিছুতেই সে বাঁচতে পারবে না।
মীরা অর্ধভেজা শরীরে আবিরের পেছনে বাড়ি ঢুকতেই বড়মার ক্রোধের সামনে পড়তে হলো। মীরা জানে এটা বড়মার রাগ না। তার জন্য বড়মার অস্থিরতা, চিন্তা। বাইরে এখনও সমান তালে বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। জায়িন ভাইদের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গেট পর্যন্ত আসতে আসতেই ভিজে গেছে। গাড়িতে বসে পুরো পথ আবির ভাই বকাঝকা করেছে। এখন বাড়ি ফিরে বড়মা!
"কাকে জিজ্ঞেস করে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলি তুই? কার অনুমতি নিয়ে গিয়েছিলি?"
মীরা মুখ ভোতা করে দাঁড়িয়ে রইল। বড়মা উত্তর না পেয়ে আরও রেগে যাচ্ছে।
"আজকে পড়া দেখাচ্ছিলি? সারাবছর যে মেয়েকে ঠেলে ধাক্কিয়ে প্রাইভেটে পাঠানো যায় না সে মেয়ে আজ ঝড়তুফান মাথায় নিয়ে পড়তে চলে গেল!"
ছোট চাচীও আজ মীরার বিপক্ষে বলছে।
"কেন গিয়েছে জানেন না ভাবী? বাড়িতে থাকলে কি বৃষ্টি হলে ভিজতে দিতাম? ইচ্ছে করে এমন দিন দেখেও প্রাইভেটে গেছে যেন রাস্তায় বৃষ্টি শুরু হলে ভিজে আসতে পারে।"
ভেজা কাপড়ে মীরার শীত লাগছে। সে কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই ধমক খেলো। মীরা ঠোঁট উলটে আবিরের দিকে দেখলো। যতই হোক আবিরকে তো বোনকে বাঁচানোর জন্য কিছু বলতেই হবে।
"মামী ওর বিচার তো এখনও কিছুই হয়নি। সব বিচার বাকি আছে। আগে ওকে রুমে গিয়ে কাপড় পালটে আসতে দাও। তারপর লম্বা সময় নিয়ে বিচার বসবে।"
দু'জনই দেখল সত্যিই মীরা ভেজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটা দেখে আরও ধমক দিল।
"এখন ভেজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? জ্বর বাধাতে? জ্বর এলেও তো আমাদেরকেই ভোগাবি। রুমে গেলি না এখনও!"
মীরা চ্যাল চ্যালিয়ে রুমে চলে গেল। যাক বাবা, আবির ভাই এযাত্রায় বাঁচিয়ে দিয়েছে। মীরা চেঞ্জ করে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। এতক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেলেও প্রকৃতিতে এখনও রেশ লেগে আছে।
ঠান্ডা হাওয়াও দিচ্ছে ভীষণ। মীরা অন্যমনস্ক হয়ে মাথা মুছতে মুছতে দূরের দিকে তাকিয়ে আছে। অন্ধকারে কিছু দেখা না গেলেও এমনিই তাকিয়ে থাকা। মাথা মুছতে মুছতে মীরা মনে করছে আজ কী কী হয়ে গেল।
জায়িন ভাইও তাকে মাথা মোছার জন্য এরকম একটা তোয়ালে দিয়েছিল।
বিকেলের পর থেকে যা যা ঘটে গেছে তা মীরার কল্পনার বাইরে ছিল।
সে যদি জানত মুবিন ভাই বাড়িতে নেই তাহলে কি জীবনে ওখানে যেত?
আর গিয়েছিল ঠিক আছে। জায়িন ভাইদের একটা ছাতা থাকলে কি এসব কিছু হতো?
না সে ওখানে থাকত, না ওই ঘটনা গুলো ঘটতো।
ছাতা ছাড়া চলে এলেও বাড়িতে এসে বকাও খেতে হতো না।
"সব দোষ আপনার জায়িন ভাই। আপনি আবির ভাইয়ার কথা শুনে আমাকে জোর করে আটকে রেখেছেন।"
কনকনে ঠান্ডা বাতাসে মীরার শীত লেগে যাচ্ছে। সে ব্যালকনি থেকে রুমে ফিরে এলো।
এখনও ইলেক্ট্রিসিটি আসেনি। কোথায় কোন তার টার ছিড়ে গেল না তো?
বিদ্যুতের খুঁটি পড়ে গেলে আজ রাতে আর কারেন্ট আসবে বলে মনে হয় না।
ঘরের জানালা খোলা ছিল। পর্দাগুলো বাসাতে উড়ছে।
মীরা সব জানালা বন্ধ করে দিল। বৃষ্টির কয়েক ফোঁটা মাথায় পড়েছিল বলেই মনে হচ্ছে সর্দি লেগে গেছে। অলরেডি কয়েকবার হাঁচিও দিয়ে ফেলেছে।
আজকের ঠান্ডা আবহাওয়া দেখেই মীরা কম্বল নামিয়েছে। এখন তার কিছু করার নেই।
নিচে গেলেই বকা খাবে। তাই মীরা বিছানা উঠে পড়ল,
"চল ভাই মীরা, খিচুড়ি খাওয়ার ওয়েদারে তোর কপালে আছে বকা।
তাই বকা খাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে খাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়।"
গায়ে কম্বল টেনে দিয়ে মীরা শুয়ে পড়ল।
কয়েকবার এপাশ ওপাশ করে কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমঘুম ভাব এসে গেল।
পুরোপুরি ঘুম চলে আসার আগেই আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
চলবে..
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com