Breaking News

গল্প: পরিণতি । পর্ব - ০৪

হসপিটালে এক সপ্তাহ থাকার পরে বাড়িতে আসলাম।। আমি তখন পাগল প্রায়, এতো দিনের এতো কিছু মেনে নিয়েছি। ভেবেছিলাম যাই করেছে, ভুল করে করেছে বাট পালিয়ে যাওয়ার কথা তো আমি ভুলেও কল্পনা করিনি।

মেয়ের দিকেও খেয়াল রাখতে পারছি না, দিন রাত কেদে কেদে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম!! কতো রাত যে না ঘুমিয়ে কাটাইছি তা আমি আর আমার আল্লাহ জানেন।
সারাদিন ফোন দিতাম, সবাই কে কেদে কেদে বলতাম যা করেছে আমি সব ভুলে যাবো৷ তবুও তাকে ছাড়া আমার জীবনের মূল্য নাই। তাকে এনে দাও তোমরা!! দিনের ভিতর হাজার বার তার নাম্বারে ট্রাই করতাম, নাম্ভার অফ।
না খেয়ে না ঘুমিয়ে আমি এমন হয়েছিলাম যে, তখন সবাই বলতো এই মেয়ে পাগল হয়ে যাবে। আগে পড়ে যা হয়েছে কখনো এমন ভেঙে পড়িনি, কিন্তু এইবার কি যে হয়েছে আমি নিজেও জানিনা।
প্রায় ২০দিন পর একদিন হঠাৎ তার মায়ের কাছে কল দিয়েছে, তার মা নাকি খুব গালি দিয়েছে। আমার কথা নাকি জিজ্ঞেস করেছে, শ্বাশুড়ি বলেছে মেয়েটা মরে যাবে। খায় না, ঘুমায় না, বাচ্চা ফেলে রাখে পাগল পাগল করে। সারাদিন কান্না করে, এই সব।

তখন মাগরিবের টাইম, আমার ফোনেও কল আসে!! রিসিভ করতেই তার সেই চিরচেনা ভয়েস! হঠাৎ দেখলাম বুকে কম্পন শুরু হয়েছে, প্রিয়জন হারানো কি এতোই ব্যাথা!!
বলছে প্লিজ ফোন কাটবে না! শুনলাম তুমি নাকি খাওয়া দাওয়া করছো না!! বাচ্চাকে দেখছো না, এটা কিন্তু অন্যায়। মনে রাখবে আমি যাই করি না কেনো। বাচ্চাটা কিন্তু তোমার এখন। ওর দিকে খেয়াল রেখো! তুমিও ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করো।
আমি চিৎকার করে বলি, কেনো তুই আমার সাথে এমন করলি? কি ভুল ছিলো আমার? এই বাচ্চা আমার না, এই বাচ্চার দ্বায়িত্ব তোর। তুই যখন চলে গেলি, এই বাচ্চার ও কোনো প্রয়োজন নেই আমার!!
আমি পাগলের মতো বলতে থাকলাম, যা করেছিস ফিরে আয়!! আমি আগের মতো সব ভুলে যাবো, নতুন করে সংসার করবো। অনেক দূরে চলে যাবো আমরা এভাবে অনেক ক্ষন কথা বলি, সবাই রাগ করছিলো তারপরে ও কথা বলি।
আমার মন কে তো আমি মানাতে পারছিলাম না কিছুতেই, নিজের পরিবার, বাচ্চা সব যেনো মাথা থেকে বের হয়ে গেছিলো।

গ্রামের অতি সাধারণ মেয়ে ছিলাম।জীবন টা পড়াশুনা আর ছোট ভাইকে নিয়েই কেটেছে। একটা মেয়ে বন্ধু পর্যন্ত ছিলো না আমার!! পুরুষ মানুষের মন মানষিকতা কেমন হয়, কোনো ধারনাই ছিলো না। কোনো ছেলেবন্ধু তো দূরের কথা, ক্লাসের ছেলেদের সাথেও কোনো দিন কথা বলিনি।
বিয়ের আগে ভাই, আর বাবা কে ছাড়া কোনো পুরুষ মানুষ সম্পর্কে আমার ধারনা ছিলো না।
এখন দেখেছি সেই পুরুষ, যে ডেলিভারির দিন অসুস্থ স্ত্রী কে হসপিটালে রেখে অন্য কারো বউকে নিয়ে পালিয়ে যায়। এটা ও মেনে নিতে হয়?
যা করবে ১৮/২০বছরের ছেলেমেয়েরা। তাও মেনে নিতে হয় ৩০+ এক পুরুষ মানুষের কাছ থেকে…
বড় ভাইয়া ১০দিনের ছুটি কাটিয়ে চলে যায়, বারবার আমার হাতে ধরে বুজিয়ে যায়। আমি বেচে থাকতে তোদের আর কস্ট করতে দিবো না, তোরা খুব ভালো থাকবি। ভুলে যা এই তিন টা বছর, তুই সুস্থ হলে মেয়েকে মার কাছে দিয়ে তুই আমার পড়াশোনা শুরু করবি।।
পড়াশোনা আমি অফ বন্ধ করিনি,
তবে বাচ্চার জন্য ২য় বর্ষের এক্সাম দিতে পারিনি।
কে শোনে কার কথা, তখন কেউ ভালো কথা বললেও বিষ মনে হতো।
আমার ভাই মেয়ের নাম রাখে, আফিফা তাসনিম সানিতা!! সানিতা ডাক নাম, আমাদের তিন ভাই বোনের নাম মিল রেখে। সাথীর-সা, নিবিড় (ছোট ভাই)- নি, তাকবির(বড় ভাই)-তা=সানিতা!! যে নাম রাখা নিয়ে কতো স্বপ্ন দেখেছি দুজন মিলে, সব স্বপ্ন ভেঙে যায় এক নিমিষেই।

একদিন মা মেয়েকে গোসল করায়, মেয়েটা এতো কাদে, কাদতে কাদতে মুখ নিল হয়ে যায়। শ্বাস টানতে পারেনা, মুখ থেকে ফেনা বের হয়ে যায়। কিছুক্ষন পর মেয়ে আমার চুপ হয়ে যায়।আমার মা ওকে বুকে নিয়েই চিৎকার দেয়। ছোটো ভাই ও চিৎকার শুরু করে।
আমি দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে বুকে টেনে নেই, তখন ভালোবাসার একটা টান অনুভব করি!তখন মনে হয় এই আমার বেচে থাকার সব কিছু, মেয়ে না থাকলে তো আমি আরো শেষ হয়ে যাবো।
তখন ভাবলাম না আজ থেকে আর আমার মেয়েকে কস্ট দিবোনা, ওকে আমার মতো করে তৈরী করবো!!
তারপর মেয়েকে নিয়ে একটু ভালো সময় যেতে শুরু করলো!!
তাও যেমন কস্ট তেমনি!! কস্টের ভাগ কাউকে দিতে পারছি না!!
চার মাস চলে যায়, দু:খ কস্ট নিয়ে!! এর মাজে টুকটাক ফোন দিতো ভাবিও। কথা বলতাম!!
উনি একদিন কল দিয়ে খুব কান্না করে, আর বলে সাথী আমি আবার ফিরে আসতে চাই তোমার কাছে, আমি তুমি আর আমাদের মেয়ে কে নিয়ে আবারো আমরা সংসার শুরু করবো!!
সেটা কিভাবে হয়?

এদিকে এলাকায় তার মান সন্মান একে বারে শেষ!! ভাইয়া তাকে সামনে পেলেই খুন করবে,, যদি শোনে আমি কথা বলি আমাকেও মেরে ফেলবে।
আমার ভাই খুব জেদি!! রেগে গেলে মা ছাড়া কেউ থামাতে পারেনা!!
সব কিছুই ভাবছি, কিন্তু তাকে ছাড়া যে আমি অসম্পূর্ণ! মনের কোথাও একটা ব্যাথা হয় প্রতিনিয়ত তাকে ছাড়া!! এ ব্যাথ্যা যে সেই কমাতে পারবে!!
কিছুদিন যাওয়ার পরে আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল হলাম। আমি তার কাছেই ফিরে যাবো।
২য় বিয়ে করার কল্পনা ও করতে পারিনি, পারিনি আমার মেয়েটা বাবার পরিচয় বাবার ভালোবাসা ছাড়া বড় হবে এই কথা ভাবতে।
অবশেষে আমার সিদ্ধান্তই ফাইনাল!! সে আমাকে তার গোপন নাম্বার দেয়, সিদ্ধান্ত নিয়ে তাকে জানাতে বলে!!
তার নতুন বউয়ের কথা জানতে চাওয়াতে সে বলে, তাকে ছেড়ে দিয়েছে।

বলে দিয়েছে তার সাথে সংসার করবে না।।
আমিও সব টা বিশ্বাস করে, বাঘের মুখে পা রাখার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।
আমার ছোট ভাইটার দিন শুরু হয় আমার মেয়ের মুখ দেখে, মেয়ের চিৎকার, কান্নার আওয়াজ সব মায়ের ফোনে রেকর্ড করে সেগুলো আবার শোনে (ভাইয়ের ফোন ছিলো না)
৪/৫মাসের বাচ্চাকে এমন ভাবে কোলে নিয়ে বেড়াবে মনে হয় এটা ২বছরের বাচ্চা!! আমি মেয়ে হয়ে যা না করি, ছোটো ভাই ছেলে হয়ে তার বেশি করে আমার মেয়ের জন্য। হিসু করলেও তারাতারি চেঞ্জ করে দেয় যদি ঠান্ডা লাগে!
বড় ভাইয়া তো মিনিটের পর মিনিট ফোন কানের কাছে ধরে রাখে, কখন আমার মেয়ে কান্না করবে, আহহহ, আহহ, করবে তাই শুনবে!!
সব কিছু মাথায় ঘোরপাক খাচ্ছে, কি করবো!! আমি চলে গেলে ওরা কিভাবে থাকবে? আমার উপর রেগে থাকবে এই সব ভেবে মাথা খারাপ”!
উনি কল দিয়ে যাচ্ছে, আমার ডিসিশন জানতে চাচ্ছে!! আমি ও সিওর দিলাম আমি তার কাছেই যাবো।
উনি বাসা দেখলেন, আমাকে অনেক বুঝালেন তুমি খুব আদরের! বাসা থেকে কিছুই করবে না। কিছুদিন পরে দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে!

অবশেষে সব ঠিকঠাক হলো কিভাবে যাবো, কোথায় থাকবো ইত্যাদি ইত্যাদি!!
সে আমাদের জেলা শহরে আসবে, আর আমি ওই পর্যন্ত একাই যাবো!
সেদিন ছিলো নভেম্বর মাসের ৫ তারিখ!! ২০১২সাল
মেয়ের কিছু প্রয়োজনিও জিনিস নিয়ে রেডি হলাম। আমার প্রয়োজনীয় কিছুই নিলাম না। মেয়েকে নিয়ে, ব্যাগ বেশি হলে সমস্যা!! সে ও বার বার নিষেধ করেছে ব্যাগ যেনো বেশি না হয়।
সকাল বেলা, কিছুটা অন্ধকার!! মা ভাইয়ের চোখ ফাকি দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম গন্তব্য স্থলে!! ২০মিনিট যেতে না যেতেই মায়ের ফোন, বড় ভাইয়ের ফোন!!
সবাই কল দিয়েই কান্নাকাটি, তুই কোথায় সানি কে নিয়ে??
মায়ের ফোন রিসিভ করে, বললাম সানির দাদা বাড়ি যাচ্ছি। সবার কথা খুব মনে পড়ছে, বলতে বলতে কেদে দিলাম!! মা বলে যেখানে আছিস সেখানে দাড়া আমি নিবির কে পাঠাচ্ছি। ওরে সাথে নিয়ে যা!!
এখন পর্যন্ত একা কোথাও যাইনি, আর যেহেতু কখনো ভাইয়েদের সাথে মায়ের সাথে মিথ্যা বলিনি তাই মা ও বিশ্বাস করলো।

মা কে বুজিয়ে বললাম, আমি একটু পরেই ফিরে আসবো। আপনি ভাইয়া কে বুজিয়ে বলেন, আমি ভাইয়ার ফোন রিসিভ করতে পারবো না ভয় করছে!!
সানিতার বাবা কে কল দিলাম, সে বলে ফোন অফ করে দাও। শহরে এসে আমাকে কল দিও আমি এখানেই আছি!!
বড় ভাইয়া বার বার কল দিচ্ছে, সে হয়তো কিছু আন্দাজ করেছে। রিসিভ না করে ফোন অফ করে দিলাম!!
মা ছোট ভাইকে আমার শ্বশুর বাড়ি পাঠালো!!
আমি ডাইরেক্ট সিএনজি নিয়ে চলে গেলাম শহরে!! মেয়েটা খুব কাদছিলো সেদিন। কি জানি ও হয়তো বুজতে পেরেছিলো কিছু!!
শহরে গিয়ে ফোন খুলে কল দিলাম তাকে, সেও সাথে সাথে চলে আসলো!! দূর থেকে মুখটা দেখেই আমি কাদছি, হাত পা কাপছে!! এই সেই আমার চিরোচেনা পুরুষ টা, যে কথা দিয়েছিলো কখনো ভুলে যাবে না…
সামনে এসে সেও চোখ মুছছে!! এসেই আমাকে ডান হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে!! মেয়েকে কোলে নিয়ে খুব আদর করে!! অনোর্গল তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, কতো মানুষ, সবাই তাকাচ্ছে!! তাতে যেনো তার কিছুই মনে হচ্ছিলো না।

বাবা মেয়ের এই ভালোবাসাই আমি দেখতে চেয়েছিলাম!! এই জন্যই তো সব কিছু ফেলে চলে আসলাম তার কাছে।
গাড়িতে উঠলাম, চলে যাচ্ছি তার সাথে অচেনা অজানা গন্তব্যে!!
এদিকে বাড়ির কোনো খবর জানিনা! ফোন অফ, যোগাযোগ বন্ধ!!
রাত ৩টার দিকে ঢাকায় পৌছাই তার রাখা বাসায়। এর মাজে তার ফোনে প্রচুর ফোন আসতে থাকে, রিসিভ করে না।। নাম্বার দেখেই সাইলেন্স করে দেয়!!
বাসায় পৌছে, আমার পায়ের উপর ঝাপিয়ে পড়ে!! বার বার ক্ষমা চায়, খুব কান্না করে পা ধরে!!! এটা সে ভালোই পারতো........
চলবে....

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com