মীরা প্রচণ্ড বেগে দৌড়াচ্ছে। সে যত জোরেই দৌড়াতে চাচ্ছে ততই যেন পিছিয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে এক জায়গায় থেমে আছে। একটুও এগোতে পারছে না।
তার পেছনে কুচকুচে কালো কয়েকটি কুকুর তাড়া করেছে। মীরা কুকুরের হাত থেকে বাঁচতেই জানপ্রাণ দিয়ে ছুটছে।
কিন্তু তাতেও কোন লাভ হচ্ছে না। পা মাটির সাথে আঠার মতো লেগে আছে। কুকুর গুলো কাছাকাছি চলে এসেছে। মীরা ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার করতে লাগল। কিন্তু গলা দিয়ে টু শব্দও বের হচ্ছে না। মীরা সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করতে চাচ্ছে।
তাতেও কাজ হচ্ছে না। কুকুর গুলো মীরাকে কাটতেই যাবে এমন সময় হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। আকাশ কাঁপিয়ে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে বাজ পড়ছে। বৃষ্টি শুরু হলে মুহূর্তেই মীরার চারপাশে পানি জমে গেল। মীরার হাঁটু পর্যন্ত পানিতে ডুবে আছে। কুকুর গুলো ভিজে চুপচুপে হয়েও তাকে কামড়াতে চাচ্ছে।
গলা দিয়ে শব্দ না বের হলেও মীরা চিৎকার করে গলা ভেঙে ফেলেছে। মীরার মনে হচ্ছে আজই তার শেষ দিন। কুকুর গুলো তাকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে। মীরার এই ভাবনার মাঝেই জায়িন ভাই এসে হাজির হলো। কুকুর তাড়ানোর জন্য জায়িন ভাইয়ের হাতে কফির মগ! জায়িন ভাই হিরোর মতো মীরার সামনে এসে বলল,
"আমি থাকতে তোমার কোন ভয় নেই, জানপাখি!"
বলেই জায়িন ভাই কুকুর গুলো দিকে হাতে থাকা মগটা ছুড়ে মারলো। কুকুর গুলো ভয় পেয়ে ঘেউঘেউ করতে করতে পালিয়ে গেল। মীরা জায়িন ভাইকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী গলায় বলল,
"তুমি এসেছ কলিজা? আমি জানতাম তুমি আসবে।"
ঠিক তখনই ঠাস করে ওদের উপর বজ্রপাত হলো। মীরা লাফিয়ে উঠে বসলো। এই শীতল আবহাওয়ায়ও ঘামছে বেচারি। আতঙ্কিত চোখে আশেপাশে দেখতে লাগল। নিজের ঘরে আছে বুঝতে পেরে ফোঁস করে দম ফেলল।
"আল্লাহ! মাবুদ, এটা কী দেখেছি আমি? কী দেখালে তুমি আমাকে?"
দরজা জানালা বন্ধ বলেই রুমে বাতাস আসছে না। বৃষ্টি থেমেছে মনে হয়। মীরা কপালে হাত দিয়ে ঘাম মুছলো। কয়টা বাজে এখন? রুম অন্ধকার থাকায় ঘড়িতে সময় দেখতে পারল না। ফোন খুঁজে বের করে সময় দেখল। মাত্র আটটা বাজে। এই সন্ধ্যা রাতে ঘুমিয়ে এরকম একটা স্বপ্ন দেখল!
"আল্লাহ। এখন থেকে আমি দিনের বেলা শোয়ার আগেও আয়াতুল কুরসি, তিনকুল পড়ে বুকে ফু দিয়ে শোব। ঠা'ডা পড়ে মরে গেছি! তাও জায়িন ভাইকে নিয়ে! নাউজুবিল্লাহ, স্বপ্নে উনাকে আমি... উনি আমার হিরো ক্যারেক্টারে ছিল? আস্তাগফিরুল্লাহ।"
সন্ধ্যাবেলা ঘুমিয়ে এরকম একটা স্বপ্ন দেখার জন্য মীরার নিজের গালেই ঠাসঠুস চড় দিতে ইচ্ছে করছে। আসলে সব দোষ জায়িন ভাইয়ের। আজকের ওই ঘটনা ধরেই এই স্বপ্নটা এসেছে।
"জায়িন ভাই আপনি আমার স্বপ্নে এসেও জ্বালাতে শুরু করে দিয়েছেন! ছাতা ছিল না, আপনি আমাকে ভিজেই চলে আসতে দিতেন। বন্ধুর কথা শুনতে গিয়ে কী ঘটালেন দেখেন তো।"
বাইরে থেকে দরজা ধাক্কিয়ে কেউ ভেঙে ফেলতে চাচ্ছে। মীরা বিরক্ত হয়ে তাকাল। এই বাড়িতে কোন প্রাইভেসি নেই? ভালো মতো স্বপ্নের শোকটাও কাটিয়ে উঠতে পারল না। তার আগেই ডাকাডাকি শুরু হয়ে গেছে। তনি আপুর কি খেয়েদেয়ে কোন কাজ নেই?
"কিরে সাড়াশব্দ দিচ্ছিস না কেন? মরে টরে গেলি নাকি? মীরা! এই খবিশ, দরজা খোল।"
মীরা বিছানা ছেড়ে দরজা খুলে দিলে তনি মীরাকে ঠেলে ভেতরে চলে এলো। পুরো ঘর অন্ধকার দেখে বলল,
"দরজা জানালা লাগিয়ে ঘর অন্ধকার করে ধ্যান করছিলি নাকি? কার আত্মাকে ডাকছিলি?"
"নিজের আত্মাই দেহ ত্যাগ করতে করতে বেঁচেছে, অন্যের আত্মা ডেকে এনে নুন মরিচ দিয়ে আচার দেব?"
"দিলে দিতেও পারিস। তোর সাথে তো কোন ভরসা নেই। হাতমুখ ধুয়ে খেতে আয়। খিচুড়ি আর ইলিশ ভাজা হয়েছে।"
খিচুড়ি, ইলিশ ভাজার কথা শুনেই মীরার জিভে পানি এসে গেল।
মুবিন ভাইয়ের উপর মীরা ভীষণ রাগ করেছে। আজকের পর থেকে সে আর মুবিন ভাইকে সাহায্য করবে না। একা একাই এবার মাহিমার মন জয় করুক। দেখুক কত ধানে কত চাল। নানির বাড়ি যাওয়ার আগে তাকে জানিয়ে যেতে পারলো না? তাহলে তো মীরা ঝড়তুফান মাথায় নিয়ে কষ্ট করে এতদূর যায় না। মুবিন ভাইয়ের মেসেজ দেখেও মীরা দেখছে না।
"আপনি গুরুতর একটা অপরাধের কাজ করেছেন মুবিন ভাই। জিরাফ ভাইটাকে বাড়িতে রেখে নিজে চলে গেছেন। উনাকেও কেন সাথে নিয়ে গেলেন না!"
অনেকগুলো মেসেজ জমা হলেও মীরা সিন করছে না। সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে এখন ঘুমও আসছে না। সময় কাটাতে মীরা ইভার কাছে চলে গেল। প্রতিদিন রাতেই ওরা লুডু খেলে। মীরা ইভান ভাইয়ের ঘরের সামনে এসেও ভাবল, এখন এগারোটা বাজে। এসময় কাউকে বিরক্ত করা কি ঠিক? মীরা আবার নিজের ঘরে ফিরে গেল। মুবিন ভাই কি কানা? দেখতে পারছে না কয়টা বাজে এখন। এসময় মেসেজ দিচ্ছে। মীরা রিপ্লাই করল,
"মুবিন ভাই প্রথমত আপনার সাথে আমার কোন কথা নেই। দ্বিতীয়ত, কয়টা বাজে দেখেছেন?"
"সরি মীরা। এত রাতে মেসেজ দেওয়ার জন্য দুঃখিত। কিন্তু তুমি আমার সাথে কথা বলবে না কেন?"
"কারণ কাজটাই আপনি এমন করেছেন। আপনার জন্য আমার ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব স্বপ্ন আসছে। ঘুমোতে যেতে ভয় করছে।"
"মানে! আমি কী করেছি মীরা?"
"আমি সব করেছি মানে কী? খুলে বলবে একটু?"
মীরা কিছুই মুবিন ভাইকে খুলে বলতে পারল না। পায়ে গরম চা পড়েছিল। সে জায়গা এখন ফোস্কা পড়ে গেছে। পায়ের ছোট আঙুলটা সোফায় ঠুসা খেয়েছিল। সেটাও ব্যথা করছে। মাথায় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে সর্দি লেগেছে। টিস্যু হাতে নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে। হাঁচি শুরু হলে একসাথে দশ বারোটা। ভয়ঙ্কর স্বপ্নের কথা নতুন করে না-ই বললো। এসব কার জন্য হয়েছে? মুবিন ভাই বাড়িতে নেই এই কথাটা তাকে জানালে এসব কিছুই হতো না।
"আমি ঠিক করেছি, আমি আর আপনাকে সাহায্য করব না। এতদিনে যতটুকু করেছি ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা থাকলে সেটাও ফিরিয়ে নিতাম।"
জায়িন তার মা'র সাথে ফোনে কথা বলছে। সুমনা ছেলেকে একা বাড়ি রেখে গিয়ে থাকতে চাচ্ছিল না। তবুও চাচা চাচীর জোড়াজুড়িতে থাকতে হলো। সুমনারা দুই বোন। কোন ভাই নেই। বাবা মা-ও বেঁচে নেই। এখন বাপের বাড়ি বলতে এক চাচা আছে তাকে দেখতেই মাঝে মাঝে আসে। চাচা তাদের নিজের মেয়ের থেকে কম দেখে না। আজ অনেকদিন পর দুই বোন এলে যেতে দিলো না।
জায়িন যদি এখন মা'কে বলে সে রাতে খায়নি তাহলেই মা'র প্রেসার বেড়ে যাবে। মিথ্যা না বলে সে কোনরকমে কথা কাটিয়ে নিতে চাইল,
"আজ বিকেল থেকে প্রচুর ঝড়তুফান হয়েছে। রাস্তাঘাটে পানি জমে গেছে। রাতে না ফিরে ভালোই করেছ।"
"সেটা তো বুঝলাম। কিন্তু তুই আমার কথা কাটাচ্ছিয় কেন? খাসনি কিছু?"
"দুই মগ কফি খাওয়ার পর আর খিদে হয়নি।"
"তুই খিদে হয়নি বললেই আমি বিশ্বাস করে নিব! সকালে রান্না করে ফ্রিজে রেখে এসেছি। এক্ষুনি ফ্রিজ থেকে ভাত তরকারি বের করে গরম করে খাবি। ওসব খেতে না পারলে আমি লাইনে থাকতে থাকতেই তুই রান্না করে খাবি।"
"মা এক রাত না খেলে কিছু হবে না। তুমি তো কাল চলেই আসবে।"
"কিছু হবে না কিছু হবে না বলেই তো শরীরের এই হাল করেছিস। নিজে রান্না করতে পারলি না। বাইরে থেকে কিছু আনিয়ে খেয়ে নিতি।"
"ওদিকে আবহাওয়া ভালো দেখে বুঝতে পারছ না এদিকে কী পরিমাণ বৃষ্টি হয়ে গেছে। খাবারের অর্ডার দিলেও মনে হয় না ডেলিভারি ম্যান আজ খাবার পৌঁছে দিয়ে যেতে পারতো।"
মা হুট করে সম্পূর্ণ অন্য একটা প্রসঙ্গে চলে গেল। জায়িন সন্ধ্যা থেকে মীরাকে নিয়েই ভেবে কাটিয়েছে। এই মেয়ের ভাবনা তার মস্তিষ্কে জোঁকের মতো এঁটে বসেছে। আজকাল অনুভূতি গুলো বড্ড অবাধ্য হচ্ছে। মন লাগামছাড়া হতে চাচ্ছে। এখন আর অনেকদিন পর এক পলকের একটু দেখায় মন ভরছে না। এখন পুরোটা সময় মীরাকে দেখতে ইচ্ছে করে। যখন তখন নানান আজুহাতে ওর কপালে পড়া অবাধ্য চুলগুলো ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে। মীরার সাথে মনের সব অব্যক্ত কথা বলে ফেলতে ইচ্ছে করে। তার এত এত অনুচিত ইচ্ছে, এদিকে জায়িন জানেই না মীরা তার জন্য কী ফিল করে। মীরার মনেও তাকে নিয়ে আদোও কোন অনুভূতি আছে কি-না। জায়িন কল কেটে অলস ভঙ্গিতে সোফায় বসে পড়লো। এইতো আরও চার/পাঁচ ঘন্টা আগে মীরা ঠিক এই জায়গাটায় বসে ছিল।
জায়িন মীরার পায়ে মলম লাগিয়ে দেওয়ার পর দু'জনেরই আর কোন কাজ ছিল না।
গুমোট বাঁধা অদৃশ্য এক অস্বস্তিতে নিজেরাও কথা বলতে পারছিল না। ওদিকে বৃষ্টি থামার নাম নেই।
আবির ভাই তাকে কখন নিতে আসবে? মীরা নখ কামড়াতে কামড়াতে সোফায় বসে আবিরের আসার অপেক্ষা করে করে এক একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিল।
জায়িন কিছুটা দূরে বসে মীরাকে সোফায় হেলান দিয়ে বসে ঘুমাতে দেখছিল।
সেই ঘুমন্ত মুখটার মায়া জায়িন এখনও কাটিয়ে উঠতে পারছে না। কত স্নিগ্ধ! কত পবিত্র সেই মুখখানা।
বাজ পড়ার শব্দ হলে ঘুমের মধ্যেই মীরা ভয় পাচ্ছিল।
জায়িন লক্ষ করেছে মীরা যতবার বজ্রপাতের শব্দে ঘুমের মধ্যে ভয় পেয়েছে
ততবারই ওর ঠোঁট জোড়া তিরতির করে কেঁপেছে। জায়িন নিজের মনের সাথেই লড়াই করে পেরে উঠছে না। অনিশ্চয়তা, সংকোচ, দ্বিধা তাকে মীরার কাছে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতেও দিচ্ছে না।
"অজান্তে তোমাকে আমি চেয়েছি। যখন বুঝেছি, তখন আর ফিরে আসার উপায় ছিল না। দেখলাম, ততদিনে সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে। আমি তোমার মায়ার পুরোপুরি আটকা পড়েছি।"
চলবে....
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com