জুই আর রবিনের প্রেমের গল্প
"তুমি যদি আমার বিষয়ে আর চিন্তা না করো তাহলেই আমি বেশি খুশি হবো।"
রবিনের সাথে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। তাকেও কিছুটা বিব্রত বলে মনে হচ্ছে। পরণে অদ্ভুত রকমের পোশাক। এই লোকটাকে খুঁজে বের করতে রবিনকে প্রায় ৪ ঘন্টা ব্যয় করতে হয়েছে।
জুঁই আবার বলে উঠল,
রবিন বলল,
"দেখো, আমার ধারণা উনি তোমার সাহায্য করতে পারে। অনেক খোঁজাখুঁজি করে উনাকে নিয়ে এসেছি। তোমাদের উপরে যে কালাজাদু করা হয়েছে বললে সেটা দূর করতে উনি সাহায্য করবেন।"
"তুমি প্লিজ যাও। আমার আম্মু দেখলে সমস্যা হবে।"
"আশ্চর্য! সমস্যা কেন হবে? তোমার আম্মু তো আমাকে চেনে আর পছন্দও করে।"
জুঁই বুঝলো রবিনের সাথে তর্ক করে লাভ নেই। সে আর কথা বাড়ালো না।
মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিলো।
"মেয়েটা কে, বাবা?"
হাঁটতে হাঁটতে লোকটা প্রশ্ন করল।
রবিন ধ্যান অন্য কোথাও ছিল। লোকটাকে আবার প্রশ্ন একই করতে হলো।
এবারে রবিন একটু করুণ হাসলো। বলল,
"আমি ওকে ভালোবাসি।"
"আর মেয়েটা?"
"ওর সাথে আমার একতরফা রিলেশনশিপ আছে। আমার ভুল টা কী জানেন চাচা?
ওর কোনো সমস্যার কথা শুনলে আমি সেটা সমাধানের চেষ্টা করি।
ও যখন বলল ওর কোনো এক আত্মীয় ওদের ক্ষতির জন্য জাদুটোনা করেছে তাই আপনাকে নিয়ে এসেছি।
আর আপনাকেও এভাবে অপমানিত হতে হলো।"
"সেটা কোনো ব্যপার না।"
লোকটা কথাটার মানে বুঝল না। তিনি জানেন রিলেশনশিপ দুই তরফা ব্যপারস্যাপার।
আজকে সকাল বেলায় এই ছেলেটি এসেছে তার বাসায়।
কালোজাদু কিংবা অন্য সব প্যারানরমাল বিষয় নিয়ে লোকটি কাজ করে।
এই ছেলেটি তাকে প্রায় পাঁজাকোলা করে এখানে নিয়ে এসেছে।
কিন্তু এখানে আসার পর পাওয়া ব্যবহারে তার ভীষণ অপমানিত বোধ হচ্ছে।
"তোমাকে আর আসতে হবে না। আমি চলে যেতে পারব।"
"আচ্ছা, চাচা। আপনার ফি টা..."
"লাগবে না।"
রবিন দোকানের একটা চেয়ারে বসে পড়ল।
জুঁইয়ের নাম্বারে একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিলো " Sorry.
আমার ভুল হলো আমি তোমার সমস্যা জানার পর সেটা সমাধান করতে চাই।
" এখন পর্যন্ত অকারণে এই Sorry শব্দটা অনেকবার রবিনকে ব্যবহার করতে হয়েছে।
ভবিষ্যতেও হয়ত হবে।
"মামা, চা দিমু এক কাপ?"
রবিন মুখ তুলে তাকিয়ে থেকে বলল,
"না মামা। বিষ থাকলে এক কাপ দেন।"
দোকানদার কিছুক্ষণ বোকার মত থাকিয়ে থেকে বলল,
"বিষ তো এই দোকানে নাই। অন্যখানে খুঁজে দেখেন।"
রবিন অপলক তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তার মনে হচ্ছে এই দোকানে বিষ পাওয়া গেলে দোকানকার নিশ্চিত তাকে এক কাপ বিষ ধরিয়ে দিতো।
একজনের দুঃখ আরেকজনকে স্পর্শ করে না কেন!
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল প্রায় দেড় ঘন্টা হতে চলল সে নিচে বসে আছে।
এই বাড়ির দোতলায় একটা পার্টি আছে। তবে পার্টিতে রবিন ইনভাইটেড নয়।
জুঁইয়ের কোনো এক বান্ধবীর জন্মদিন।
রবিনের বন্ধুরা জুঁই সম্পর্কে জানলেও, জুঁইয়ের কোনো বন্ধুবান্ধব রবিনকে চেনে না।
এমনকি একবারের জন্য ডাকেওনি।
সে কি এতটাই অযোগ্য? এসব ভাবনার মাঝেই জুঁইয়ের মেসেজ।
"আমাকে দুই হাজার টাকা দিতে পারবে?"
"হ্যাঁ, আমি আসছি।"
"তোমাকে আসতে হবে না। আমি নিচে নামছি।"
টাকাটা বাড়িয়ে দিতে দিতে রবিন বলল,
"আমাকে একটাবার ডাকলে পারতে।"
"আসলে আমি ভেবেছিলাম তুমি চলে গেছ।"
রবিন মুচকি হাসলো। এরপর বলল,
"আমি চলে গেছি এটা ভাবলে টাকাটা চাওয়ার জন্য কল দিতে না। আমি আসি।"
জুঁইকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রবিন চলে আসলো।
"তুই কোনো মেয়েকে দেখেছিস তার অন্য ছেলে ফ্রেন্ডের সাথে এতটা ক্লোজ হয়ে ছবি তুলতে?"
জুঁইয়ের সাথে অন্য একটা ছেলের ছবি দেখিয়ে রবিনকে উদ্দেশ্য করে হাসিব কথাটা বলল।
ছবিতে অন্য একটা ছেলের সাথে জুঁইকে খুব কাছাকাছি বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে।
এটা গতদিনের পার্টির ছবি। হাসিব ছবিটা কোত্থেকে পেয়েছে সেটা অজানা।
"শোন, ওরা শুধু বন্ধু। এর বাইরে ওদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই।"
কথাটা রবিন মুখে বললেও তার নিজেরই বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।
হাসিব রবিনের কাধে হাত রেখে বলল,
"কথাটা তুই নিজে বিশ্বাস করিস?"
রবিন থতমত খেয়ে বলল,
"বি..শ্বা.স ক..কর না কেন? অবশ্যই করি।"
হাসিব কাধ থেকে নাম নামিয়ে মোবাইলটা পকেটে রাখল। এরপর বলল,
"তোকে আমি অনেকবার অনেক প্রমাণ দিয়েছি, রবিন।
মেয়েটা তোর জন্য ঠিক না। তুই ছাড়া ওর অন্য অনেক ছেলেদের সাথে সম্পর্ক আছে।
কিন্তু তুই সেটা বিশ্বাস করছিস না। হয়ত করছিস, কিন্তু ইচ্ছে করে চোখ বন্ধ করে রেখেছিস।
যাই হোক, তোর লাইফ তুই জানিস, আসি।"
অনেকটা হতাশ ভঙ্গিতেই হাসিব চলে গেল। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে আবার ঘুরে তাকালো।
রবিনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
"তোর উচিত ভবিষ্যতে কষ্ট পাওয়ার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকা।
তাহলে কিছুটা হলেও কষ্টটা কম পাবি।"
দো'আ পড়ে শরীরে ফু দিয়ে দিলেন মুনতাহিনা বেগম। এরপর বললেন,
"কোথায় যাচ্ছিস?"
রবিন জবাবে মিথ্যে বলতে পারলো না। বলল,
"জুঁইয়ের সাথে দেখা করতে।"
"তুই আরেকবার ভেবে দেখ, বাবা। মেয়েটা হিন্দু।
ও যদি ওর ধর্ম পাল্টে ফেলে তাহলে আমাদের কারোর কোনো আপত্তি নেই।
আমি তোকে কষ্ট পেতে দেখতে চাই না। তাই মেনে নিচ্ছি। তুই ওকে একবার বলে দেখ।
এসব রিলেশনে আর না থেকে হালাল ভাবে বিয়েটা করে নে।"
রবিন ঘাড় নাড়ল। মা চলে গেলেন। উঠে গিয়ে টেবিলের উপরে রাখা চকলেট আনতে গেল।
চকলেটগুলো জুঁইয়ের জন্য কেনা। কিন্তু সেখানে এখন সেটা নেই।
পুরো ঘর খুঁজেও যখন পেলো না ঠিক করল যাওয়ার সময় আবার কিছু কিনে নিয়ে যাবে।
বাইরে বের হতেই দেখল সেই চকলেটটা তার ভাগ্নের হাতে শোভা পাচ্ছে।
"আমি তোমার জন্য আমার ধর্ম পরিবর্তন করতে পারব না, রবিন।
তোমার ইচ্ছে হলে তোমার ধর্ম পরিবর্তন করো।"
রবিন অনেক কষ্টে নিজের রাগ দমন করল। এরপর বলল,
"তুমি আরেকবার ভেবে দেখো।
আমার পরিবার থেকে তোমাকে নিয়ে আর কোনো সমস্যা নেই।
আর থাকলেও আমি তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে রাজি আছি।
কিন্তু আমার বাসায় পুরো ইসলামিক আবহাওয়া। সেখানে তোমাকে...."
"তাহলে আমাকে ছেড়ে দাও। ধরে রেখেছ কেন?"
কত অবলিলায় জুঁই কথাটা বলে ফেলল ভেবে অবাক হলো রবিন।
"কিন্তু..."
"আমি আর এ ব্যপারে কথা বলতে চাই না। আমার সাথে আর যোগাযোগ করো না।"
জুঁইকে আটকানো গেল না। এরপরে বহুবার কল করেও জুঁইকে পাওয়া গেল না। প্রথমে ব্যস্ত বললেও পরবর্তীতে শোনা গেল রবিনের ডায়ালকৃত নাম্বারটি শুইচ অফ।
অনেকটা পাগলের মত পায়চারী করতে লাগল রবিন।
এত রাতে ছুটে জুঁইয়ের বাড়ি চলে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এখন সেটা সম্ভব না।
বারবার মনে হচ্ছে জুঁইকে এবার সে সত্যিই হারিয়ে ফেলতে চলেছে। জুঁই হয়ত তাকে ঠিকঠাক ভাবে ভালোবাসেনি, কিন্তু সে তো বেসেছে। সেই ভালোবাসার জন্য কি থেকে যাওয়া যেত না?
"কিরে তুই কি গাজা খেতে শুরু করেছিস নাকি, রবিন?"
মুনতাহিনা বেগম রবিনের চোখগুলো দেখে কথাটা বললেন। রবিন অবাক হয়ে বলল,
"কী যে বলো! আমি এসব খাই না তুমি জানো সেটা।"
"হ্যাঁ জানি। তোর চোখ এমন লাল হয়ে আছে কেন? তুই রাত জেগেছিলি নাকি কান্না করেছিলি? সত্যি করে বল তো।"
কথাটা শুনে রবিনের আবার কান্না উপচে পড়তে চাইল। কিন্তু সেটা যেভাবেই হোক আটকে রাখতে হবে। উঠে যেতে যেতে সে বলল,
"আমি আর খাবো না, মা। বের হচ্ছি।"
মুনতাহিনা বেগম মনে মনে বলছেন না জানি কোন জাদুটোনা করেছে ছেলের উপর। দিনদিন স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে। কী থেকে কী হয়ে যাচ্ছে শুধুমাত্র ওই মেয়েটার জন্য!
নিজেকে সামলাতে অনেকটাই কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে রবিনকে। তার ব্যবসায় মনোযোগ দিয়েছে।
একটা মুহুর্তে গিয়ে তার মনে হয়েছে, "নাহ, এবার নিজেকেও একটু ভালোবাসা উচিত।"
নাম্বারটা মোবাইল থেকে ডিলিট করে ফেললেও মস্তিষ্কে সেটা গেথে আছে তার।
দুই বছর পরে চিরচেনা সেই নাম্বার থেকে কল আসতে দেখে একবারের জন্য হার্টবিট বেড়ে গেল রবিনের। এতদিন পর জুঁই কেন কল করবে!
"হ্যালো, কে বলছেন?"
অপরপাশ থেকে ধীর কণ্ঠে জুঁই বলে উঠল,
"তুমি কি সত্যিই আমাকে চিনতে পারোনি? নাকি না চেনার ভান করছ?"
"আবার কেন কল করেছেন?"
"আমি আবার তোমার জীবনে আসতে চাই রবিন। প্লিজ আমাকে ফিরিয়ে দিও না।"
"কেন? তোমার সেই বয়ফ্রেন্ডগুলো তোমাকে মেনে নেয়নি?"
জুঁই চুপ করে রইল।
"আমি তোমার সাথে যোগাযোগ না করলেও তোমার সম্পর্কে সব খবরই আমি রেখেছি।
এখন কি আমাকে তাদের মধ্যে বেস্ট অপশন বলে মনে হচ্ছে দেখে ফিরে আসতে চাইছ?"
"যা হয়েছে ভুলে যাও, প্লিজ।"
"হ্যাঁ, ভুলেই আছি। সব ভুলতে আমাকে এতগুলো দিন নিজের সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছে।
আমি আর নতুন করে কিছু মনে করতে চাই না।"
"আমি সবকিছুর জন্য তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি।"
"আচ্ছা, ক্ষমা করলাম।"
জুঁইয়ের মনে হলো এবার হয়ত সত্যিই সব ঠিক হয়ে যাবে। জুঁইয়ের মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল,
"আমাকে তুমি এখনো ভালোবাসো?"
"তোমাকে আমি যতটা ভালোবাসি ঠিক ততটাই ঘৃণা করি।"
"কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব? কেউ যাকে ভালোবাসা যায় তাকে আবার ঘৃণাও করতে পারে!"
"হ্যাঁ যায়। এইযে আমি পারছি। তুমি আর আমাকে কল দিও না, জুঁই।
অতীতের ভুলগুলো আবার নতুন করে করতে চাই না।"
জুঁইয়ের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। রবিন কল কেটে দিয়েছে। জুঁই আবার কল ব্যাক করল।
একবার রিং হওয়ার পর এবার কলটা ব্যস্ত বলল। আবার কল দেয়ার পর রিসিভ হলো।
একটা মেয়েলি কণ্ঠ বলে উঠল,
"আমি যাকে কল করেছেন তিনি এই মুহূর্তে আপনার যোগ্যতার বাহিরে আছে।
অনুগ্রহ করে তাকে আর কল করে বিরক্ত করবেন না। ধন্যবাদ।"
কথাটা বলে লামিয়া কল কেটে দিলো। লামিয়া, রবিনের স্ত্রী।
রবিনের মনে হয় সে জীবনসঙ্গীর সাথে সাথে একটা ভালো বন্ধুও পেয়েছে।
যাকে নির্ভয়ে সবকিছু বলা যায়।
"তোমার কখনো ওর উপর রাগ হয় না, লামিয়া?"
রবিন জিজ্ঞেস করল।
"নাহ, রাগ হবে কেন? ও তোমাকে ধোকা দিয়েছিল বলেই তো আমি তোমাকে পেয়েছি।
এখন এসব বাদ দাও তো।"
রবিন কথার মোড় ঘুরানোর জন্য বলল,
"তুমি কিন্তু চাইলে কল সেন্টারে কাজ করতে পারো।"
"কেন? তুমি কি আমার কণ্ঠ শুনে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছো যে কল সেন্টারে জব করতে পাঠাচ্ছো?"
রবিন থতমত খেয়ে বলল,
"আমি সেটা কখন বললাম!"
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com