আজকাল বড্ড বেশি চুল পড়ছে তোমার
ঢুলু ঢুলু চোখে সাব্বির চোখ মেলে তাকালো। তার সামনে মুনিয়া দাঁড়িয়ে আছে। সাব্বির বালিশ থেকে মাথাটা তুলল। তাকে যেমন ভাবে ধাক্কা দিয়ে ডাকা হচ্ছিল সাব্বির ভেবেছিল বাসায় হয়ত ডাকাত পড়েছে।
সাব্বির আবার বালিশে মাথা রাখল। চোখ বন্ধ রেখে বলল,
"তুমি এটা বলার জন্য আমার এত সুন্দর ঘুমটা ভাঙালে! চুল তো পড়ারই জিনিস। মাথায় যে থাকে সেটাই তো বিস্ময়ের।"
মুনিয়ার হাতে সাব্বিরের ঝরে পড়া চুলগুলো। সেগুলোই মাত্রই বালিশ থেকে কুড়িয়েছে। সাব্বিরের মাথাভর্তি এক ঝাক রেশমি চুল মুনিয়ার ভীষণ রকমের পছন্দের ছিল।
মুনিয়া আর কিছু বলল না। চুলগুলো ফ্লোরে ফেলে চলে গেল।
সাব্বির অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। মুনিয়া পিছনে দাঁড়িয়ে আয়নার দিকে আছে। চুল আচরাতে আচরাতে সাব্বির বলল,
"কী ব্যপার তাকিয়ে আছ যে? নতুন করে প্রেমে পড়ছো নাকি?"
মুনিয়ার মুখে একটা বিরক্তির ছাপ পড়ল। সে বলল,
"তোমার মাথায় যে টাক পড়তে শুরু করেছে দেখেছ? চুলের একটু যত্ন নিতেও তো পারো।"
"আমার বাবার মাথায় একটা বিশাল বড় টাক ছিল। বাবার ছেলে হিসেবে কিছু গুণাগুণ তো পাবোই। তাই আমার মাথাতেও পড়ছে, বুঝলে। কথায় বলে না বাপকা ব্যাটা সিপাহিকা ঘোড়া। কুছ নেহি তো থোরা থোরা।"
এই বলে হাসতে হাসতে সাব্বির চুল আচরে চিরুনিটা ড্রেসিন টেবিলে রাখল। এরপর ঘুরে দাঁড়াল। মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
"নাস্তা কি হলো?"
"হ্যাঁ হয়েছে। খেতেই ডাকছিলাম।"
একটা পরোটা শেষ করে আরেকটা পরোটা নেয়ার সময় মুনিয়া বাঁধা দিয়ে বলল,
"একটাই নাও। ওজন যে বাড়ছে সে খেয়াল আছে? কলেজে থাকা কালীন কত সুন্দর বডি ছিল তোমার। আর এখন কী এক ডেস্কে বসে কাজ করো, ভুড়ি শুধু বাড়ছেই।"
সাব্বির তার পেটে হাত দিয়ে ভাবল,
"নাহ, পেট টা আসলেই বাড়ছে।"
খিদে থাকা সত্ত্বেও সে আরেকটা পরোটা না নিয়ে উঠে গেল।
সীমা তার মোবাইলে তার হবুবরের ছবি দেখাচ্ছিল। অনেক বছর পর দুইজনের দেখা হয়েছে। বিয়ের দাওয়াত দিতেই আসা। গল্পগুজব, হাসি ঠাট্টার এক পর্যায়ে সে বলল,
"ক্লাসের সব মেয়েদের হার্টথ্রব সাব্বির ভাইকে তো বিয়ে করে ফেললি। আমি যে কী কষ্ট পেয়েছিলাম শুনে, কী বলব!"
মুনিয়া তখন মজার সুরে বলল,
"তো ক্ষতি কী? এখন তোর হবু বরকে ছেড়ে আমার বরকে বিয়ে করে নে।"
সীমা কিছুটা অবাকই হলো। সাব্বিরকে নিয়ে এই ধরণের মজা আগে করলে মুনিয়া ঝগড়া বাধিয়ে দিতো। আর আজকে সেও কিনা মজা করছে!
প্রসঙ্গ পাল্টে সে বলল,
"সেসব বাদ দে। এখন তো সাব্বিরের সাথে কোনো ফটো আপলোড দিস না। বিয়ের সময় তো তোর ফটো দিয়ে আমার পুরো নিউজফিড ভরে গেছিল। দেখি এখনকার রিসেন্ট ফটো দেখা।"
মুনিয়া গ্যালারি থেকে সাব্বির আর ওর একটা রিসেন্ট ফটো বের করল। এরপর বাড়িয়ে দিলো সীমার দিকে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, মুনিয়া আর সাব্বির একসাথে দাঁড়িয়ে। মুনিয়ার মাথায় লম্বা এক গুচ্ছ চুল শোভা পেলেও সাব্বিরের মাথায় কিছুটা টাক পড়ে গেছে, আর পেটে ভুড়ি উঁকি মারছে।
হাসবে না ভেবেও সীমা হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল,
"কলেজের সেই হ্যান্ডসাম বালকের এই অবস্থা কী করে হলো রে? যত্ন টত্ন নেস না নাকি?"
মুনিয়া ভীষণ রেগে গেল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
"তুই এখন আয়, সীমা। আমার কিছু কাজ আছে। বাইরে বের হবো।"
সীমা বুঝতে পারল তার হয়ত এভাবে বলা ঠিক হয়নি। তার বিয়ের কার্ডটা রাখতে রাখতে বলল,
"বিয়েতে তুই আর ভাইয়া চলে আসিস। আসছি।"
মুনিয়ার রাগ কিছুতেই কমছে না। বারবার মাথায় পানি ঢালা সত্ত্বেও তার মনে হচ্ছে মাথা থেকে হয়ত ধোয়া উড়ছে। সেই সময়ে সাব্বিরের কল
মেজাজ কিছুটা ঠান্ডা করে মুনিয়া বলল,
"হ্যাঁ বলো।"
"আচ্ছা শোনো, ডাক্তার বলল আমার ওই দাঁতের অবস্থা খুবই খারাপ। ফেলে দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। হয়ত নকল দাঁত লাগাতে হতে পারে।"
এবার মুনিয়ার রাগ কান্নায় পরিণত হলো। সে মোবাইলটা আঁছড়ে ফেলে কাঁদতে লাগল। সাব্বিরকে নিয়ে কোথাও যেতে এখন তার ইচ্ছে হয় না। যেই সাব্বির আগে উড়ন্ত পাখির মত ছিল, সে এখন নয়টা পাঁচটা ডিউটির খাঁচায় আটকা পড়েছে। তাকে দেখে এখন আর আগের মত অনুভূতি কাজ করে না মুনিয়ার।
হুট করেই কি একজনের প্রতি অনুভূতি শূন্যের কোঠায় চলে আসে? তার কেন এমন হচ্ছে? দিনে দিনে তার সৌন্দর্য বাড়ছে আর অন্যদিকে সাব্বির....
নাহ সে আর এসব ভাবতে চাইছে না। সাব্বিরকে সে আবার নতুন করে ভালোবাসবে। কিন্তু জোর করে কি ভালোবাসা যায়?
"আমাকে দেখলে আর আগের মত তোমার প্রেম প্রেম অনুভূতি জাগে না, তাইনা মুনিয়া?"
নাস্তার টেবিলে সাব্বিরের প্রশ্নটায় কিছুটা থতমত খেয়ে খাবার নাকে মুখে উঠে গেল মুনিয়ার। সাব্বির দ্রুত ভঙ্গিতে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো মুনিয়ার দিকে।
মুনিয়া এক ঢোকে পুরো পানিটা খেয়ে নিলো। এরপর বলল,
"তোমার বুঝতে ভুল হচ্ছে। আমি তোমাকে এখনো আগের মতই..."
"ভালোবাসা বুঝা যায়, মুনিয়া। আর আমি এখন সেটা বুঝতে পারছি না। কারণ আমার প্রতি তোমার আগের মত ভালোবাসা নেই।"
"আসলে..."
মুনিয়ার মুখে অপরাধীর ছাপ স্পষ্ট।
সাব্বির মৃদু হাসলো।
"আমাকে ভালোবাসতে পারছো না এটা তোমার অপরাধ না, মুনিয়া। It's all right."
জুতার ফিতা বাধছিল সাব্বির। মুনিয়া বলল,
"তুমি কী জগিং এ যাচ্ছো?"
সাব্বির মুখ তুলে চাইল।
"হ্যাঁ, ভুড়িটা তো বাড়ছে। দেখি সেটা কমাতে পারি কিনা।"
মুনিয়াকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে গেল সাব্বির। কয়েকদিন ধরেই সাব্বিরের মধ্যে বিশাল পরিবর্তণ লক্ষ করে মুনিয়া। বিয়ের এক বছরের মাথায় সাব্বির নিজের যত্ন নেয়া প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। সে আবার নিজের যত্ন নিতে শুরু করেছে। এমনকি চুলের ট্রিটমেন্টও করিয়ে ফেলল।
শপিং ব্যাগ থেকে এখন শুধু মুনিয়ার কসমেটিক এর জিনিসই বের হয় না বরং তার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোও থাকে।
কয়েক মাসের মধ্যেই সাব্বিরের চেহারায় আমূল পরিবর্তন চলে এলো। এ যেন ঠিক আগের সাব্বির। যাকে দেখে প্রেমে পড়েছিল মুনিয়া।
"আজকে কোথাও ঘুরতে যাবে, সাব্বির?" মোবাইল থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলো মুনিয়ার দিকে সাব্বির। এরপর মোবাইলটা পাশে রেখে অবাক হয়ে বলল,
"হঠাৎ?"
মুনিয়া হেসে বলল,
"হঠাৎ কোথায়? অনেকদিন যাওয়া হয়নি। তাই বলছিলাম।"
"কিন্তু আমাকে সাথে নিয়ে কোথাও যেতে তো তোমার লজ্জা করে।"
মুনিয়া লজ্জায় মাথা নত করে ফেলল। এই কথাটা সে সীমাকে ফোনে বলছিল। তবে কি সাব্বির কোনোভাবে কথাটা শুনে ফেলেছে?
সাব্বির উঠে দাঁড়ালো। মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
"তুমি আমার প্রেমে পড়েছিলে, মুনিয়া। কখনো ভালোবাসতে পারোনি। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি যে রূপেই আমার কাছে আসো না কেন, তোমার প্রতি ভালোবাসা আমার কখনো কমবে না।"
কিছুক্ষণ থেমে সে আবার বলল,
"আচ্ছা, বাদ দাও সেসব। তুমি রেডি হয়ে নাও। আমরা ঘুরতে বের হবো।"
এই বলে সাব্বির ফ্রেশ হতে চলে গেল। মুনিয়া সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। তার পা যেন ফ্লোরের সাথে আটকে আছে। এখান থেকে নড়ার সাধ্য যেন তার নেই।
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com