Breaking News

গল্প: অবিশ্বাস

"অনেক তো হলো। এবার ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেও।" কথাটা বলেই অহনা ফোন রেখে দিলো।

এখন মধ্যরাত। বাইরে চাঁদের আলোয় প্রকৃতিতে এক অদ্ভুত সৌন্দর্য বিরাজ করছে৷
হাতে একটা আধখাওয়া সিগারেট। সিগারেটের ধোঁয়া উড়ছে পুরো রুমে।
সিগারেটের ফিল্টার এশট্রেতে রেখে জানালার পাশে চেয়ার টেনে বসলাম।
চাঁদের সাথে ওয়ান টু ওয়ান কানেকশন আমার।
এমনই এক চাঁদনী রাতে অহনাকে কথা দিয়েছিলাম আর সিগারেট খাবো না।
সময়ের দূরত্বের সাথে মনের দূরত্ব বেড়েই চলেছে।
বাইরের খোলা হাওয়ায় তাকিয়ে ভাবছি ডিভোর্স লেটার কী তবে পাঠিয়েই দেবো!

অহনা আমার স্ত্রী। চার বছর প্রেম করার পরে আমাদের বিয়ে হয়৷ বিয়ের বয়স প্রায় তিন বছর।
আমাদের হাসিখুশি সংসার জীবনে বিগত দু'মাস ধরে বিষাদের ছায়া পড়েছে৷ যে জীবন বিষাদের।
আমাদের দীর্ঘ পথচলায় তিক্ততা কখনোই ছিল না।
সেই গর্ব করা সম্পর্কে আজ কেবল তিক্ততাই অবশিষ্ট।
জানালার ঠিক পাশে আমার আর অহনার একটা ছবি দেয়ালে টানানো।
এই ছবিটা আমাদের প্রেমের তিন বছর যখন সেই সময়ের তোলা।
মাদারীপুর লেকপার্কে অহনার মাথায় একগুচ্ছ ফুল গুঁজে দিয়েছিলাম।
আমাদের শাড়ি - পাঞ্জাবী পরা ছবি আর তেমন নেই।
এই বিশেষ ছবিটাতে অনেক দিন একসাথে তাকানো হয় না।
রোজ রাতে আমি আর অহনা মুগ্ধ হয়ে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম।
অহনার সাথে আমার পরিচয় অদ্ভুতভাবেই বলা চলে।
ক্যাম্পাসের একজনের প্রেমপত্র অন্যজনকে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলাম।
চেহারা চিনতাম না। শুধু জানতাম যে মেরুন কালারের একটা ড্রেস পরা থাকবে।
আমিও অগত্যা মেরুন কালারের ড্রেস পরিহিত মেয়েকেই প্রেমপত্র দিলাম।
তবে যাকে দিয়েছিলাম সে ছিল অহনা! যাকে দেয়ার কথা ছিল সে সেখানে ছিল না।
এভাবেই আমাদের পরিচয়।

শুরুটা তিক্তভাবেই বলা চলে। এরপর একটা সময় অন্যের দেয়া সেই প্রেম পত্রের বাহক আমি নিজেই অহনার প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া শুরু করলাম। এভাবেই আমাদের প্রেমের অধ্যায় শুরু হয়।
দীর্ঘ পথচলার শেষে বিয়েও করলাম। সুখ-শান্তি দু'টোই আমাদের ছিল।
রোজ অফিস থেকে এসে দু'কাপ কফি নিয়ে বসে কত শত গল্প করতাম তা কেবল আমরাই জানি।
সোনালী সময় ছিল জীবনের৷ দেখতে দেখতে বিয়ের দুই বছর পার হলো।
ঠিক এই সময় বিষাদের কালো অধ্যায় শুরু হলো।
কথায় আছে কোনো সম্পর্কে একবার সন্দেহ চলে আসলে পুরো জীবনটা অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়।
আমি সন্দেহবাতিক কোনোকালেই ছিলাম না৷
তবে একটা ঘটনার প্রেক্ষাপটে আমাদের দু'জনের গতিপথ আলাদা হয়ে গেছে।

ঘটনার শুরু আমাদের বিয়ের দুই বছর পর৷ একদিন বিকেলে অফিস টাইমে আমার ফোনে
একটা মেসেজ আসলো, 'সোহেল সাহেব কেমন আছেন?
আপনার প্রাণ প্রিয় স্ত্রী তো অন্যের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।'
আমি পাত্তা দিলাম না। অহনার সাথে দীর্ঘ পথচলায় আমি কখনোই এমন কিছু দেখিনি।
তবে মানুষের মন! কৌতূহল মেটাতে সেই নাম্বারে ফোন দিলাম। ফোন বন্ধ।
এই ঘটনা বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলাম।
প্রতিদিনের মতো একদিন অফিস থেকে ফিরে আমি আর অহনা দু'কাপ কফি হাতে নিয়ে গল্প করছি৷
একটু বাদেই অহনা ওয়াশরুমে গেল।
আমার ফোনে সেই নাম্বার থেকে আবার একটা মেসেজ আসলো,
'আপনার স্ত্রীর ফোনটা চেক করুন।'
অহনার ফোন সামনেই ছিল।
হাতে নিয়ে দেখি অন্য একটা নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে, 'অহনা লাভ ইউ বেবি।'

হকচকিয়ে গেলাম। কখনো ভাবতেও পারিনি এমন কিছু হতে পারে।
অহনাকে এই বিষয়ে কিছুই বললাম না।
কিছুদিন পর পর মেসেজ আসতেই থাকলো।
কয়েকদিন বাদে দুপুরে আবার আমার ফোনে মেসেজ আসলো,
'আপনার স্ত্রী এখন আপনার অফিস থেকে বাম পাশের তিন নাম্বার হোটেলে আছে।'
আমি অফিস থেকে বের হয়ে অনেকটা ঝড়ের গতিতে হোটেলে গিয়ে দেখে
রিসিপশনে অহনা দাঁড়িয়ে আছে!
প্রায় চিৎকার করে বললাম, 'তুমি এখানে কেন?'
অহনাও প্রায় সাথে সাথে ভূত দেখার মতো চমকে বলে উঠলো 'তুমি এখানে কেন?'
এরপর থেকে আমাদের দূরত্ব শুরু। অহনা ওর বাবার বাড়িতে।
সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে সেই নাম্বার থেকে বিগত দু'মাস ধরে কোনো মেসেজ আসেনি।
অনেকবার চেষ্টা করেও জানতে সক্ষম হইনি কে ছিল সেই ব্যক্তি।
রাত প্রায় শেষ হতে চললো। গোটা কয়েক সিগারেট খাওয়া শেষ।
অহনা আমাকে ঠকিয়েছে এটা আমি ভাবতেই পারছি না।
মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েই দেবো।
ভাবছি একবার অহনার সাথে দেখা করে জিজ্ঞেস করি এরকম কেন করলো।
দুই দিন পরে অহনাকে ফোন দিয়ে বললাম দেখা করতে চাই।
অহনা প্রথমে রাজি না হলেও পরে দেখা করতে রাজি হলো।

অহনার প্রিয় মেরুন কালারের পাঞ্জাবী পরে বের হলাম। গন্তব্য লেক পার্ক।
এখানেই দু'জনে কত বিকেল কাটিয়েছি সব আজ শুধুই স্মৃতি।
বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর অহনা আসলো।
কাকতালীয়ভাবে অহনার গায়েও মেরুন কালারের শাড়ি। অথচ দু'জনের গতিপথ প্রায় আলাদা।
অহনা আর আমি পাশাপাশি বসে আছি।
নীরবতা ভেঙে আমিই বলা শুরু করলাম, 'কেমন আছো?'
অহনা নিরুত্তর। কিছুক্ষণ পরে আবার বললাম, 'আমার সাথে কেন এমন করলে?'
এবার অহনা আমার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো। রাগে গজগজ করতে বললো,
'আমি কী করেছি? যা করার তুমি করেছো৷ তুমি আমাকে ঠকিয়েছো।'

ওর কথা শুনে আমি আসমান থেকে পরলাম।
চোখেমুখে এক আকাশ সমান কৌতুহল নিয়ে বললাম, 'মানে? কী বলছো তুমি?'
অহনা আরো রেগে গিয়ে প্রায় চিৎকার করে বললো, 'নাটক করো? ঘরে বউ রেখে অফিস কলিগের সাথে হোটেলে যাও। আবার এমন একটা ভাব করো যে কিছুই জানো না।'
অহনার কথা শুনে তাজ্জব বনে গেলাম। নিজেকে সামলিয়ে বললাম, 'কী বলছো এসব?
তুমিই তো অন্য কারো সাথে প্রেমে মশগুল আছো। হোটেলে সেইদিন কেন গিয়েছিলে?'
আমার কথা শেষ হতে না হতেই অহনা আমার গালে থাপ্পড় দিলো।
'লজ্জা করে না নিজের বউকে নিয়ে এসব বলতে?'
নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। এসেছিলাম অহনার কাছে জবাব চাইতে।
আর এখন নিজেরই জবাবদিহিতা করতে হচ্ছে।
এবার আর মুখে কিছু বললাম না। ফোন বের করে অহনাকে মেসেজ দেখালাম।
অহনা অবাক দৃষ্টিতে মেসেজগুলো দেখে নিজের ফোন বের করলো।
আমার হাতে ফোন দিয়ে বললো, 'নেও তুমিও দেখো।'

এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। একটা নাম্বার থেকে অহনার ফোনে অনবরত মেসেজ।
সব আমার বিষয়ে। আমার সহকর্মীর সাথে আমার প্রেম!
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে, যেদিন আমার ফোনে মেসেজ এসেছিল অহনা হোটেলে,
ঠিক সেদিন সেই সময়েই অহনার ফোনেও মেসেজ এসেছিল আমি হোটেলে!
আমাদের দু'জনের ফোনে আসা মেসেজের নাম্বার একই সিরিয়ালের।
শুধু শেষের তিনটা ডিজিট আলাদা।
দু'জনেই নিশ্চুপ। পিনপতন নীরবতা। এবার অহনা নীরবতা ভাঙলো।
'সোহেল, তুমি আমাকে বলতে পারতে।'
'তুমিও তো কিছু বলোনি অহনা।'
'তুমি এমন করতে পারো আমার কল্পনাতেও আসেনি। তাই ভেবেছিলাম দেখি আসলে সত্যি কিনা। হোটেলে গিয়ে দেখি আসলেই তুমি সেখানে!'
'আমিও ভাবতে পারিনি তুমি এমন করতে পারো।'

আমি অহনার হাতে হাত রাখলাম। অহনার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।
'সোহেল তুমি আমাকে ডিভোর্স দেয়ার কথা অব্দি ভেবে ফেলেছিলে।'
আমি নিশ্চুপ। ছেলে মানুষের কাঁদতে নেই। অহনা এবার আমার কাঁধে হাত দিয়ে বললো, 'তোমাকে অনেক বলেছিলাম অভিমান পুষে রাখতে নেই। দেখলে তো অভিমান আমাদের কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে?'
আমি বললাম, 'আমাদের ফোনে এই মেসেজ কে দিয়েছিলো জানো তুমি?'
'না। অনেক চেষ্টা করেছি বের করতে পারিনি। কেউ হয়তো আমাদের বিচ্ছেদ চেয়েছিল।'
বাদ দেও। এই খারাপ সময় না আসলে হয়তো আমাদের নিজেদের প্রতি বিশ্বাস আরও নড়বড়ে হতো একসময়।
প্রায় রাত হতে চলল। অহনাকে বললাম, 'বাসায় চলো।'
অহনা বললো, 'না। বাবার বাড়িতে যাবো। তুমি এসে নিয়ে যাবে।
আমি কাউকে কিছু বলিনি। সবাই জানে বেড়াতে এসেছি।'
আমি এই মেয়ের বুদ্ধি দেখে অবাক হলাম বরাবরের মতো।
চাকরি নিয়ে আমার ব্যস্ততার কথা সবাই জানে। তাই অহনা কিছু না বললে কারো সন্দেহ হবে না।
অহনা আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে অভিমানের স্বরে বলে উঠলো,
'তুমি কিন্তু কথা দিয়েছিলে আর কখনো সিগারেট খাবে না।'

আমি আড়চোখে একবার ওর দিকে তাকালাম।
এই মেয়ে নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝে গেছে সিগারেটের ব্যাপারটা।
মেয়ে মানুষের এই অদ্ভুত এক ক্ষমতা আছে বটে।
চোখমুখ দেখেই অনেক কিছু পড়ে নিতে পারে।
আর সেই মানুষটা যদি হয় প্রিয় কেউ তাহলে তো কোনো কথাই নেই।
আমি ওর শেষ কথার কোনো জবাব না দিয়ে উঠে গেলাম পাশের দোকানের দিকে।
সেখান থেকে একগুচ্ছ গোলাপ কিনে অহনার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বললাম,
'আমাকে কি আরেকবার সিগারেট খাওয়ার অনুমতি দেয়া যায় না বউ?'
অহনা মুচকি হেসে বললো, 'জ্বী না। তাহলে ডিভোর্সের অনুমতি হয়ে যাবে কিন্তু।'
আমার হাতের উপর অহনার হাত। দু'জনে হাঁটছি। মনযোগ দিয়ে অহনার বকবকানি শুনছি।
অনেকদিন এই বকবক শুনি না।
হয়তো অবিশ্বাস নামক ব্যধির কারণে বকবকানি শোনা আজীবনের জন্য বন্ধ হয়ে যেত।
সেই সাথে এটাও অনুভব করলাম জীবনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু ঘটনা ব্যতীত জীবনটা আসলে সুন্দর।
মারাত্মক রকমের সুন্দর। শুধু প্রয়োজন সম্পর্কগুলোর ঠিকঠাক পরিচর্যা করা। .

<>সমাপ্ত<>

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com