অপরিচিতা । পর্ব - ০২
কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা আমি।
কয়েক মাস আগে আমি একদিন বান্ধবীদের সাথে পিকনিকে যাচ্ছিলাম।
হঠাৎ ই আমাদের বাস টা এক্সিডেন্ট করে।এবং নদীতে পড়ে যায়।
এর পর কি হয় আমার আর মনে নেই।যদি কিছু হয়ে থাকে তাহলে এর মধ্যেই হয়েছে।নয়তো আমার জ্ঞান থাকা অবস্থায় আমার সাথে কোন দূর্ঘটনা ঘটেনি।
আমার স্মৃতি শক্তি হারানোর পর কি হয় তার উত্তর শুধু আম্মুই দিতে পারবে।
কিন্তু আম্মু তো আমাকে ভুল বুঝে রেগে আছে।
কি করবো এখন কিছুই মাথায় আসছেনা।
বাবা মায়ের এক মাত্র সন্তান আমি।
বাবা মা কোন দিন কোন কিছুর অভাব আমাকে বুঝতে দেন নি।
দুজনেরই চোখের মণি আমি।
আব্বু প্রবাসী।বাসায় শুধু আমি আর আম্মু থাকি।আম্মু আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।আম্মু আমাকে খুব বিশ্বাস করে।
কিন্তু আজ যে কি হলো কিছুই বুঝলাম না।
আজ কেন এমন অসময়ে সে তার মেয়েকে বিশ্বাস করছেনা,সাপোর্ট দিচ্ছেনা।
রাত টা কেটে গেলো চোখের জলে বালিশ ভিজিয়ে।
ইহান একটা বারের জন্য আর ফোন দেয়নি।
এই বুঝি ভালবাসা?
একটা বার অন্তত ফোন দিয়ে সান্ত্বনা তো দিতে পারতো।
কি থেকে কি হলো আমার সাথে মিলে উদঘাটন তো করতে পারতো।
তা না করে, আমাকে একা পথে ছেড়ে দিলো।
কেউ আমাকে আর ভালবাসেনা।
আমি সবার চোখের কাটা হয়ে গেলাম।
সবার চোখে ঘৃণার পাত্রী হয়ে গেলাম।
সকাল হতেই আম্মুর কাছে গেলাম।
আম্মু রুটি বানাচ্ছে।
আমি পেছন থেকে গিয়ে আম্মুকে জড়িয়ে ধরলাম।
আম্মু আমার স্পর্শ পেয়ে নিজের চোখের জল মোছার বৃথা চেষ্টা করছে।
-তুমি আমাকে বিশ্বাস করোনা আম্মু?
আম্মু হাউমাউ করে কেঁদে দিয়ে বল্লো,
-খুব করি।
কিন্তু কথা টা কিছুতেই মানতে পারছিলাম না।
বলতো সোনা মা আমার।
কি থেকে কি হলো?
-আম্মু, ট্রাস্ট মি।আমার জ্ঞান থাকা অবস্থায় আমার সাথে এমন কোন ঘটনা ঘটেনি।
কিন্তু..
-কিন্তু কি?
-কিন্তু আমার স্মৃতিশক্তি হারানোর পর কি হয়েছে,কি ঘটেছে কিছুই মনে নেই আমার।
প্লিজ আম্মু,আমাকে সব খুলে বলোতো।
কি কি হয়েছিলো তখন আমার সাথে।
- মাস কয়েক আগে তুই তোর বান্ধবীদের সাথে পিকনিকে যাচ্ছিলি।নিষেধ করেছিলাম।তবুও সেদিন শুনিস নি আমার কথা।
-তারপর?
-তারপর আর কি,গন্তব্যের কাছাকাছি গিয়ে তোদের বাস টা এক্সিডেন্ট করে আর নদীতে পড়ে যায়।
ওই বাসের অনেকেই মারা যায়।
আর যারা আহত হয় তাদের ওখানকার হসপিটালে ভর্তি করা হয়।
কিন্তু তিন জন কে খুঁজে পাওয়া যায়না।
তাদের মধ্যে তুই একজন।
কথা গুলো বলছে আর আম্মু কাঁদছে।
অনেক খুঁজেও তোদের পাওয়া গেলোনা।
অসুস্থ রোগীরা সুস্থ হয়ে বাড়ী ফিরে আসে।
কিন্তু আমার মেয়েতো আর আসেনা।
আমি পাগলের মত হয়ে যাই।এক মাত্র সন্তান তুই আমার।
কত আল্লাহ্ আল্লাহ্ করি।
কত মানত।
অপেক্ষার প্রহর গুণি তুই একদিন আমার বুকে ফিরে আসবিই।
তোর আব্বুও অসুস্থ হয়ে পড়ে তোর এক্সিডেন্টের খবর শুনে।
আর আমাকে সান্ত্বনা দিতে দেশে চলে আসে।
আমরা দুজন প্রায়ই গিয়ে ওই এক্সিডেন্টের জায়গা টায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।
যদি তোকে পাই।
অনেকেই বলে নিখোঁজ তিন জন বোধয় মারাই গেছে।
কিন্তু আমার মন মানেনা।
আমি বিশ্বাস করি আমার মেয়ে বেঁচে আছে।আর একদিন আমার কাছে ছুটে আসবেই।
নিখোঁজ তিন জনের মধ্যে একজনের লাশ পাওয়া যায়।
আর বাকি থাকে দুজন।
অনেক দিন পর একজন বাসায় ফিরে আসে।
আমি অপেক্ষায় থাকি তুইও ফিরে আসবি।
কেটে যায় অনেক গুলো দিন।
আর একদিন আমার দোয়া কাজে লাগে।
আল্লাহ্ তায়ালা তোকে আমার বুকে ফিরিয়ে দেন।
তুই হঠাৎ একদিন চলে আসিস বাসায়।
আমি আর তোর বাবা যেন দেহে প্রাণ ফিরে পাই।
-কিন্তু মাঝের দিন গুলো আমি কই ছিলাম?
-তা আমিও জানিনারে মা।
তোকে বার বার জিজ্ঞেস করার পরও তুই বলতে পারিস নি।
মনে করতে পারিস নি।
তাই আমরা আর জোর ও করিনি।আমরা আমাদের মেয়েকে খুঁজে পেয়েছি এটাই আমাদের কাছে অনেক।
-কিন্তু আম্মু,এখন তো মাঝ খানের মনে না থাকা দিন গুলোই আমার জীবনে এমন একটা ক্ষতি করে দিলো।
-মানে?
-মানে,ডাক্তারের রিপোর্ট যদি সত্যি হয় তাহলে আমার সাথে যা ঘটে তা ওই মনে না পড়া দিন গুলোর মাঝেই ঘটেছে।
আর তাই আমার স্মৃতি ফেরার পর আমি আর কিছুই এখন মনে করতে পারছিনা।
-তাহলে এই বাচ্চা ইহানের না?
-না আম্মু,
ওর সাথে আমার এমন কিছুই হয়নি।
-আচ্ছা যা হবার হয়ে গেছে,
তোর তো এতে কোন দোষ নেই।কারণ তোর কিছু মনে ছিলোনা তখন।
তুই স্মৃতি শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলি।
আর এখন যখন আবার আগের স্মৃতি শক্তি ফিরে পেয়েছিস,
এখন তো আবার মাঝের কথা গুলো মনে নেই।
তাই তুই নিষ্পাপ।
আর তোর এই বাচ্চার কথা ইহানকে বলা লাগবেনা।
আমরা আজই গিয়ে ডাক্তারকে বলে বাচ্চাটাকে নষ্ট করে আসবো।
তারপর ইহানের সাথে আমি খুব জলদি তোর বিয়ে দিয়ে দিবো।
যা তুই ফ্রেশ হয়ে আয়।
আমি নাস্তা দিচ্ছি।
আমি ফ্রেশ হতে চলে গেলাম।
মুখে পানির ঝাপটা দিতে দিতে ভাবতে লাগলাম।
ইহান কে তো আমি সব বলে দিয়েছি।
ইহান কি আমাকে এখন গ্রহণ করবে?
আমি আধ ধোয়া মুখেই আমার রুমে গিয়ে মোবাইল টা হাতে নিয়ে ইহানকে ফোন দিলাম।
-হ্যালো।
-আমার এই অবস্থা,আর তুমি একটা বার আমাকে ফোন দেয়ার কথা চিন্তা করলেনা?
-তোমার এই অবস্থার জন্য তো আর আমি দায়ী নই।
তুমি নিজেই দায়ী।
-ইহান প্লিজ,আমার সাথে যা হয়েছে আমার জ্ঞান থাকা অবস্থায় হয়নি।
-হা হা হা
-প্লিজ হেসোনা।
তোমার মনে আছে আমি যে এক্সিডেন্ট করে অনেক গুলো দিন নিখোঁজ ছিলাম?
-হ্যাঁ আছে।মনে থাকবে না কেন?
-যা ঘটার আমার সাথে ওই দিন গুলোর মধ্যেই ঘটেছে।
আর তাই আমার স্মৃতি শক্তি ফিরে পাবার পর আর আমার কিছুই মনে নেই।
-সবই বুঝলাম,তো এখন আমাকে কি করতে বলো তুমি?
-কি করতে বলি মানে?
তুমি আমাকে ভালবাসো না?
-হা হা ভালবাসা।ভালবাসা মানে বোঝ তুমি?
-না,আমি বুঝিনা ভালবাসা মানে কি।
এখন আমাকে বোঝাও তুমি।
-প্রয়োজন মনে করছিনা।
-তুমি এইভাবে কেন কথা বলছো আমার সাথে?
আম্মু বলেছে বাচ্চা টা নষ্ট করে ফেলতে।
আর অতি শীঘ্র আম্মু আমাদের বিয়ে দিয়ে দিতে চাচ্ছে।
-বিয়ে?
-হ্যাঁ বিয়ে।কেন তুমি আমায় ভালবাসোনা?তুমি আমায় বিয়ে করবেনা?
-যার পাপ পেটে বহন করছো তাকে গিয়ে বিয়ে করে নাও।
আর কক্ষণো আমাকে ফোন দিবেনা।
-ইহান,প্লিজ।এ কথা বলোনা।আমি তোমাকে ভালবাসি।
-আর আমি বাসতাম,এখন আর বাসিনা।
সো প্লিজ ডোন্ট ডিস্টার্ব মি।
-এই তোমার ভালবাসা?
-হ্যাঁ এই আমার ভালবাসা।
-প্লিজ ডোন্ট কল মি।
কোন দিন আমি যেন তোমাকে আমার সামনেও না দেখি।
তুমি তোমার পথ দেখো,আর আমি আমার পথ।
গুড বাই।
আমি কাঁদতে কাঁদতে ফোন টা দেয়ালে ছুড়ে মারলাম।
আম্মু দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
আর আমি ফ্লোরে বসে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলাম,
কে এই বাচ্চার বাবা?কে আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে আমার এত বড় ক্ষতি করলো মা?
বলোনা মা,কে করলো আমার এত বড় সর্বনাশ?
চলবে....
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com