Breaking News

ডাক্তার সাহেব । পর্ব - ৪৪

খুব দ্রূত বেগেই গড়িয়ে পড়ি নীচে। মিহুর জোরে চিৎকারের শব্দ কানে আসলো।

আর এদিকে আমার পেটে ভীষণ ভাবে আঘাত পেয়েছি মনে হলো।

মিহুর চিৎকারে বাসার সবাই বের হয়ে আসলো। আমি সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে নীচে পড়ে কাঁতরাতে লাগলাম।

পেটে ব্যথা হচ্ছে ভীষণ। অসহ্য যন্ত্রণা আমাকে গ্রাস করছে। মনে মনে শুধু দোয়া করতে থাকলাম,

আল্লাহ আমাকে নিয়ে নিও আমার সন্তানকে বাঁচিয়ে দিও। পেটের ব্যথায় মুচরাতে লাগলাম।

চেঁচিয়ে কাঁদতে লাগলাম। মুহুর্তেই যেন সব অন্ধকার হতে লাগল।

মা এসে ও... আল্লাহ! বলে চিল্লায়ে উঠে বাবাকে বললেন


- নিরার আব্বা সিঁথিকে ধরো। আর নীলকে কল দাও। হাসপাতালে নিতে হবে।
নিরা আমার বড় ননাশের নাম। বড় মেয়ের নাম নিয়েই মা,বাবাকে বেশিরভাগ সময় ডাকে।
এদিকে আমার হাত পা মুচড়ে যেতে লাগল। মনে হচ্ছে শরীরের প্রতিটা অংশে ব্যথা করছে।
কষ্ট হচ্ছে অনেক। এজমার সমস্যা থাকায় দম নিতেও যেন কষ্ট হচ্ছে।
জিহ্বায় বেশ জড়তা আসতে লাগল।
কাঁপতে লাগলাম আমি। মিহু পাশে বসেই চিল্লায়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল
- আমি একটু সাবধান হলেই আজকে এরকমটা হত না। দোষটা আমার।
দায়িত্ব আমার ছিল আমি পালন করতে পারিনি।
তামান্না মিহুকে সান্ত্বনা দিতে লাগল।
- ভাবি সিঁথি ভাবির যা হয়েছে এটা তার কপালে লেখা ছিল। আপনি নিজেকে দোষারূপ করবেন না।
সব ঠিক হয়ে যাবে। বাবা তো দেখতেছে।
একটু শান্ত হোন। সবাই ভেঙে পড়লে তো সমস্যার সমাধান হবে না।
তামান্নার কথায় মিহু তেমন থামলো না।
বরং আমার এ অবস্থার জন্য সে নিজেকেই দোষারূপ করতে লাগল বারংবার ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই নীল চলে আসলো সাথে একজন মহিলাকে নিয়ে।
আমি শুধু ঝাঁপসা চোখে মহিলাটার দিকে তাকালাম। মহিলার বয়স ৩৫-৪০ হবে হয়তো।
প্রতি সপ্তাহে একদিন এ মফস্বলে রোগী দেখতে আসেন তিনি।
যতদূর বুঝতে পারলাম উনি একজন দক্ষ গাইনোকলোজিস্ট।
আমার হাত টা ধরল। পেটে হালকা চেপে ধরে বলল

- অনীল সাহেব আপনার স্ত্রীকে ঢাকায় নিয়ে যান দ্রূত। বাচ্চাকে বাঁচাতে হলে আর স্ত্রী কে বাঁচাতে হলে একদম দেরি করবেন না। আপনি নিজেও বুঝতেছেন আমি কেন এ কথাটা বলছি।
নীল ভাঙা গলায় জবাব দিল
- আমি এখনই ব্যবস্থা করতেছি।
আমাকে দ্রূত এম্বুলেন্সে উঠিয়ে রওনা দেওয়া হলো ঢাকার উদ্দেশ্য। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে আমি কাঁতরাতে লাগলাম। শরীরটা যেন আর ব্যথা সইবার মতো অবস্থায় নাই। নীলের হাতটা ধরে বেশ জোর খাটিয়ে বললাম
- কখনও যদি আমার আর বাবুর মাঝে কাউকে বেছে নিতে বলে তুমি আমার বাবুটাকে বেছে নিও প্লিজ। ওকে দুনিয়ার আলো দেখিও। আমার মনে হচ্ছে আমি বাঁচব না। আমি মরে গেলে আমায় ক্ষমা করে দিও। তুমি আরেকটা বিয়ে করে নিও তবে সে মেয়েকে শর্ত দিও যেন আমার বাবুর যত্নের গাফলতি না হয়।
নীল হাউমাউ করে কেঁদে দিল। কান্নাটা গাঢ় হতে লাগল। নীলকে এভাবে কাঁদতে কখনও দেখিনি। কাঁদতে কাঁদতে বলল

- এমন কথা বলো না প্লিজ। তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না। আমাদের বাচ্চা আর তোমার কারও কিছু হবে না। একটু শান্ত হও তুমি। কিসব বলছো তুমি। তোমার এ শক্ত কথা তো আমার ভালো লাগছে না। আমাকে একা রেখে কেন চলে যাবে? আমি তোমায় ভীষণ ভালোবাসি। সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ ।
সারা রাস্তায় আমি ব্যথায় কাঁতরিয়েছি। শরীরও ক্লান্ত। ব্যথা সইবার মতো ক্ষমতা যেন শরীরের আর অবশিষ্ট নেই। হাসপাতালে নেওয়া হলো দ্রূত। সিজার করা লাগবে জানানো হলো। নাহয় বাবুর আর আমার দুজনের ক্ষতি হতে পারে। আমার বাচ্চাটার হয়তো পেটে থাকতে থাকতে আর ভালো লাগছিল না তাই দ্রূত চলে আসতে চাচ্ছে। মনে মনে শুধু বাচ্চাটার জন্য দোয়া করতে লাগলাম। বলতে লাগলাম হে আল্লাহ আমার যা হওয়ার হোক আমার বাচ্চাটাকে আপনি বাঁচিয়ে দিয়েন। এ মুহুর্তে আমার মায়ের মুখটা আমার চোখে ভেসে আসছে প্রবল ভাবে। মা কতই না কষ্ট করে আমাকে জন্ম দিয়েছেন। অথচ মাকে খুশি রাখার চেষ্টা কখনও করিনি। মাকে জড়িয়ে ধরতে পারলে হয়তো একটু শান্তি পেতাম।
কিছুকক্ষণের মধ্যেই আমাকে অটিতে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত করা হলো। সর্বশেষ মুহুর্তে নীলের হাতটা ধরেছিলাম। বেশ আস্তে গলায় বলেছিলাম অনেক জ্বালিয়েছি মরে গেলে মাফ করে দিও। নীল শুধু হাউমাউ করে কেঁদেছিল।

এ সময়টায় গত বছর এস এস সি পরীক্ষার ছুটি কাটিয়েছিলাম। কলেজে ভর্তি হই রেজাল্ট দেওয়ার পর পরই। জুনের ১ তারিখ থেকে ক্লাস শুরু হয়। জুন মাসের ১৫ তারিখে বাজি ধরি নীলকে নিয়ে। আর সেখান থেকেই নীলের সাথে আমার পরিচয়। কথা বলা থেকে প্রণয় হয় আগস্টের দিকে। তখন বেশ ভালোই গরম ছিল। খুব লম্বা সময় প্রেম আমাদের হয়নি। বাবু পেটে এসে পড়ে বিয়ের পর পরই। বিয়ের একমাস পরেই বাবু পেটে চলে আসে আর ২ মাস পরে নিশ্চিত হই৷ এরপর কত কাহিনির সমাবেশ নিয়ে সময়টা পার করি।
প্রেগন্যান্সির সবচেয়ে উপভোগ্য সময় ছিল শীতের সময়টায়। সে সময় আমার তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। কনকনে শীতটায় বেশ ভালোই উপভোগ করেছিলাম বাবুকে নিয়ে। যদিও সেটার বিস্তর বর্ণণা করা হয়নি। কারণ সবকিছু সুন্দর হয়ে সামনে এগিয়েছিল। পড়াশোনাতেও মোটামুটি মা আর নীলের অনুপ্রেরণায় তখন মনোযোগ দিতে পেরেছিলাম। এই তো এপ্রিলের প্রথম দিকে কলেজের পরীক্ষাও দিয়েছি। আর এখন এপ্রিল মাসের একদম শেষের দিক। হিসাব অনুযায়ী আমার বাবুর বয়স সাত মাসের বেশি। যতদূর জানি বাচ্চা পরিপক্ব হতে নয়মাস সময় লাগে। সেখানে আমার বাবু সাতমাসে চলে আসতেছে বিষয়টা যেন আমকে বেশ ভাবিয়ে তুলল।

যদিও শীত পড়েনি তবুও মনে হচ্ছে বাইরে হয়তো অনেক শীত পড়েছে। কুয়াশায় হয়তো সব তলিয়ে নিচ্ছে। হালকা চোখে তাকালাম। শীতে কাঁপতে লাগলাম। কেউ একজন আমার অবস্থা টের পেয়ে ফ্যানটা বন্ধ করল। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখলাম নার্স। পেটে হাত দিয়ে দেখলাম আমার সিজার হয়ে গেছে। বেশ অবাক হলাম। ভাবতে লাগলাম কখন বাবু হয়ে গেল আমার! একটু আগেও চিন্তা করছিলাম সাত মাসে বাবু হলে সে বাবু সুস্থ হয়ে জন্ম নিবে কি'না। এখন লক্ষ্য করে দেখলাম আমার বাবু ডেলিভার করা হয়ে গিয়েছি। আমি কিছুটা তড়িঘড়ি করে নার্সকে বললাম
- আমার সিজার কখন হলো? আমার বাবু কোথায় আর নীল কোথায় মানে আমার হাসবেন্ড।
নার্স মেয়েটা হালকা গলায় বলল
- ধৈর্য ধরুন সব জানতে পারবেন। এত অস্থির হবেন না।
নার্সের কথা শুনে আমার বুকটা কেঁপে উঠল। মনে প্রশ্ন ঝেঁকে বসলো আমার বাবু বেঁচে আছে তো? প্রশ্নটা আসতেই ক্রমেই আমি অস্থির হয়ে গেলাম।

চলবে.....

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com