সূরা নাসর এর তাফসীর
ইবন আব্বাস (রাঃ) উবাইদুল্লাহ ইবন আবদুল্লাহ ইবন উবাহকে (রাঃ) জিজ্ঞেস করেনঃ সর্বশেষ কোন সূরাটি অবতীর্ণ হয়েছে তা কি তুমি জান? উত্তরে তিনি বললেন, “হ্যা, সূরা ইযাজাআ নাসরুল্লাহি ওয়াল ফাতহু (সর্বশেষ অবতীর্ণ সূরা।) ইবন আব্বাস (রাঃ) তখন বললেনঃ “তুমি সত্য বলেছ।
সহিহ মুসলিম ৩০২৪, (হা-এ) ৭৪৩৬, (ই-ফা) ৭২৬৫
যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়
وَرَأَيْتَ ٱلنَّاسَ يَدْخُلُونَ فِى دِينِ ٱللَّهِ أَفْوَاجًا
এবং আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবেন,
فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَٱسْتَغْفِرْهُۚ إِنَّهُو كَانَ تَوَّابًۢا
তখন আপনি আপনার পালনকর্তার পবিত্রতা বর্ণনা করুন এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাকারী।
আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, যখন এ সূরা নাযিল হলো তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূরাটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়লেন এবং বললেন, “মক্কা বিজয়ের পর আর কোন হিজরত নেই।“ [মুস্তাদরাকে হাকিম: ২/২৫৭]
.
সূরা নাসর রাসূলের (সাঃ) জীবনাবসানের বার্তা বহন করে
আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বয়স্ক মুজাহিদদের সাথে উমার (রাঃ) আমাকেও শামিল করে নিতেন। এ কারণে কারও কারও মনে সম্ভবতঃ অসন্তুষ্টির ভাব সৃষ্টি হয়ে থাকবে। একদা তাদের মধ্যে একজন আমার সম্পর্কে মন্তব্য করলেন, আপনি কেন এ যুবককে আমাদের মাজলিশে নিয়ে আসেন? তার সমবয়সী ছেলে আমাদেরও তো রয়েছে। তাঁর এ মন্তব্য শুনে উমার (রাঃ) তাঁকে বললেন, আপনারা তো তাকে খুব ভাল রূপেই জানেন যে, সে কোন লোকদের অন্তর্ভুক্ত l
একদিন তিনি সবাইকে ডাকলেন এবং আমাকেও ডেকে পাঠালেন। আমি বুঝতে পারলাম যে, আজ তিনি তাদেরকে কিছু দেখাতে চান। আমরা সবাই উপস্থিত হলে তিনি সকলকে জিজ্ঞেস করলেন,
.
إِذَا جَآءَ نَصْرُ ٱللَّهِ وَٱلْفَتْحُ
সূরাটি সম্পর্কে আপনাদের অভিমত কি (অর্থাৎ এ সূরাটি কিসের ইঙ্গিত বহন করছে)। কেহ কেহ বললেনঃ এ সূরায় আল্লাহ তাআলার সাহায্য এলে এবং আমাদের বিজয় সূচিত হলেই যেন আমরা এইরূপ করি। আল্লাহ তাআলার গুণগান করার জন্য এবং তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য আমাদের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কেহ কেহ আবার সম্পূর্ণ নীরব থাকলেন, কিছুই বললেননা। উমার (রাঃ) তখন আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমার মতামতও কি এদের মতই?' আমি উত্তরে বললামঃ না, বরং আমি এই বুঝেছি যে, এ সূরায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরলোক গমনের ইঙ্গিত রয়েছে। তাঁকে এটা জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, তার ইহলৌকিক জীবন শেষ হয়ে এসেছে। সুতরাং তিনি যেন তার রবের প্রশংসাসহ তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করেন ও তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এ কথা শুনে উমার (রাঃ) বললেনঃ আমিও এটাই বুঝেছি।(ফাতহুল বারী ৮/৬০৬)
.
ইমাম আহমাদ (রহঃ) ইবন আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে,
যখন إِذَا جَآءَ نَصْرُ ٱللَّهِ وَٱلْفَتْحُ
এ সূরাটি নাযিল হয় তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ আমাকে আমার মৃত্যুর খবর জানিয়ে দেয়া হয়েছে। আর ঐ বছরই তিনি মৃত্যু বরণ করেন। (আহমাদ ১/২১৭) ইমাম আহমাদ (রহঃ) একাই এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন l
সহীহ বুখারীতে আয়িশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর রুকু ও সাজদায় নিম্নলিখিত তাসবীহ অধিক পরিমাণে পাঠ করতেনঃ
سبحانك اللهم ربنا وبحمدك اللهم اغفر لي.
‘হে আল্লাহ! আপনি মহাপবিত্র এবং আপনার জন্যই সমস্ত প্রশংসা। হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করুন l
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআনুল হাকীমের
فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَٱسْتَغْفِرْهُۚ إِنَّهُو كَانَ تَوَّابًۢا
এ আয়াতের উপর অধিক পরিমাণে আমল করতেন। তিরমিযী ছাড়া অন্য তিনটি সুনান গ্রন্থেও ইহা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। (ফাতহুল বারী ৮/৬০৫, মুসলিম ১/৩৫০, আবু দাউদ ১/৫৪৬, নাসাঈ ৬/৫২৫, ইবন মাজাহ ১/২৮৭, সহিহ বুখারী (তাও) ৮১৭, ৭৯৪, (ইফা) ৭৫৮, ৭৮০
.
ইমাম আহমাদ (রহঃ) মাশরূক (রহঃ) হতে বর্ণনা করেন, আয়িশা (রাঃ) বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর শেষ জীবনে নিম্নলিখিত কালেমাগুলি অধিক পরিমাণে পাঠ করতেন ।
سبحان الله وبحمده أستغفر الله وأتوب إليه
‘আল্লাহ মহাপবিত্র, তার জন্যই সমস্ত প্রশংসা, আমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তাঁর নিকট তাওবাহ করছি।
তিনি আরো বলতেন ? নিশ্চয়ই আমার রাব্ব আমাকে জানিয়েছেন যে, আমার উম্মতের ভিতর আমি একটি নিদর্শন দেখতে পাব এবং তিনি আমাকে আদেশ করেছেন যে, যখন আমি তা দেখতে পাব তখন যেন আমি আল্লাহর বেশী বেশী প্রশংসা করি এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি। কারণ
তিনিই একমাত্র তাওবাহ কবুলকারী। এখন আমি সেই নিদর্শন দেখতে পাচ্ছি তোমরাও দেখতে পাচ্ছ যে, এখন দলে দলে লোক আল্লাহর দীনে প্রবেশ করছে।
সুতরাং তোমরাও তোমাদের রবের গুণগান কর এবং তার
কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই তিনি তাওবাহ কবূলকারী এবং ক্ষমা প্রদানকারী। (আহমাদ ৬/৩৫) ইমাম মুসলিমও (রহঃ) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। (১/৩৫১)
.
তাফসীর ইবন জারীরে উম্মে সালমা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, শেষ বয়সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উঠতে বসতে চলতে ফিরতে এবং আসতে যেতে নিম্নের তাসবীহ পড়তে থাকতেন
سبحان الله وبحمده
অর্থাৎ আল্লাহ মহাপবিত্র এবং তার জন্যেই সমস্ত প্রশংসা।
উম্মে সালমা (রাঃ) বলেনঃ আমি একবার এর কারণ জিজ্ঞেস করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূরা নাসর তিলাওয়াত করেন এবং বলেন, আল্লাহ তাআলা আমাকে এ রকমই আদেশ দিয়েছেন।
মুসনাদ আহমাদে বর্ণিত আছে যে, এ সূরা অবতীর্ণ হওয়ার পর
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সালাতে প্রায়ই এ সূরা তিলাওয়াত করতেন এবং রুকূতে তিনবার নিম্নের দু'আ পড়তেন ও
سبحانك اللهم ربنا وبحمدك اللهم اغفر لي, انك انت التواب
الرحيم
‘হে আল্লাহ! আপনি মহা পবিত্র। হে আমাদের রাব্ব! আপনারই জন্য সমস্ত প্রশংসা। হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করুন। নিশ্চয়ই আপনি তাওবাহ কবুলকারী, দয়ালু।
.
বিজয় অর্থে এখানে মাক্কা বিজয়কে বুঝানো হয়েছে। এ ব্যাপারে কোন মতানৈক্য নেই। আরবের সাধারণ গোত্রগুলির মধ্যে এ ব্যাপারে কোন মতানৈক্য হয়নি। আরবের সাধারণ গোত্রগুলি অপেক্ষা করছিল যে, যদি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বজাতির উপর জয়যুক্ত হন এবং মক্কা তাঁর পদানত হয় তাহলে তিনি যে সত্য নাবী এ ব্যাপারে কোন প্রকার সন্দেহ থাকবেনা। আল্লাহ তা'আলা যখন তাঁর প্রিয় নাবী সাল্লাল্লাহু
‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মহাবিজয় দান করলেন তখন এরা সবাই দলে আল্লাহ তা'আলা যখন তাঁর প্রিয় নাবী সাল্লাল্লাহু
.
‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মহাবিজয় দান করলেন তখন এরা সবাই দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করল। এরপর মক্কা বিজয়ের দু’বছর অতিক্রম হতে না হতেই সমগ্র আরাব ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করল। অতঃপর এমন কোন গোত্র অবশিষ্ট থাকলনা যারা ইসলামের উপর তাদের আনুগত্য প্রদর্শন করলনা। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই প্রাপ্য।
সহীহ বুখারীতেও আমর ইবন সালমার (রাঃ) এ উক্তি বিদ্যমান রয়েছে যে, মক্কা বিজয়ের সাথে সকল গোত্র ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হল।
ইমাম বুখারী (রহঃ) তার সহীহ গ্রন্থে আমর ইবন সালামাহ (রহঃ) হতে বর্ণনা করেছেন, যখন মক্কা বিজিত হয় তখন দলে দলে লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার জন্য চলে আসতে থাকে। এর পূর্বে বিভিন্ন এলাকার লোক ইসলাম কবুল করতা বিলম্ব করছিল এ উদ্দেশ্যে যে, দেখা যাক মুসলিম বাহিনী মক্কার উপর প্রভাব বিস্তার লাভ করতে সম্মত হয় কি না। ঐ সব লোকেরা বলত
তাঁকে এবং তাঁর অনুসারীদেরকে ছেড়ে দাও, তিনি যদি বিজয় লাভ করেন তাহলে আমরা জেনে যাব যে, তিনি সত্য নাবী। (ফাতহুল বারী ৭/৬১৬)
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ রাব্বল আলামীনের প্রাপ্য।
.
মুসনাদ আহমাদে বর্ণিত আছে যে, যাবির ইবন আবদুল্লাহ (রাঃ) এক প্রতিবেশী সফর থেকে ফিরে আসার পর যাবির (রাঃ) তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে যান। সেই প্রতিবেশী মুসলিমদের মধ্যে ভেদাভেদ, দ্বন্দ্ব-কলহ এবং নতুন নতুন বিদআতের কথা ব্যক্ত করলে জাবিরের (রাঃ) চক্ষুদ্বয় অশ্রু সজল হয়ে উঠল। তিনি কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বললেনঃ আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, লোকেরা দলে দলে আল্লাহর দীনে প্রবেশ করছে বটে, কিন্তু শীঘ্রই তারা দলে দলে এই দীন থেকে বেরিয়ে যাবে।' (আহমাদ ৩/৩৪৩)
সূরা নাসূর -এর তাফসীর সমাপ্ত
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com