মাধবীলতা । পর্ব - ০২
এরপর যা বুঝতে পারলাম আমার হাত পা ভয়ে কাঁপতে লাগলো।
শীতের ভেতরেই ঘেমে শরীর একাকার হয়ে যাচ্ছে।ধরফর করে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলাম।
নিজের নিশ্বাস দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে লাগলো।আতংকে গলা শুকিয়ে কাঠ
কেউ বাসা বেঁধেছে আমার গর্ভের ভেতরে,তার স্পন্দন অনুভব করতে পারছি আমি।কিন্তু এই সময়ে সেটা কিকরে সম্ভব?নিজের পেটে হাত দিয়ে আঁতকে উঠলাম,
এই স্পর্শ ঠিক সেইদিনের ভদ্রমহিলার গর্ভে যখন প্রথম হাত রেখেছিলাম তার অনুরূপ!!
আবারো ফোনটা বেঁজে উঠলো।আমি কাঁপা হাতে রিসিভ করলাম।
---কি হলো ফোন রিসিভ করছো না কেন?
(অনুরোধ)
---তুমি এখন কোথায় আছো অনুরোধ?
---আমি অফিসে,কেন?
---একটু আসতে পারবে আমার এখানে...?
---আচ্ছা কি হয়েছে তোমার বলো তো,সব ঠিক আছে তো?
---না সব ঠিক নেই,একদম ঠিক নেই সব।
---ঠিক নেই মানে!কি হয়েছে মাধবী?
---এতো কথা ফোনে বলা সম্ভব না।তুমি আমার বাসায় আসো,তারপরে সব খুলে বলছি।
---আচ্ছা ঠিক আছে।কিন্তু কি হয়েছে বলবে তো?
---অনুরোধ মনে হয় আমি প্রেগনেন্ট!!আমি বুঝতে পারছি না কিকরে হলো এসব।
---হোয়াট!কি বলছো তুমি এগুলো??মাথা ঠিক আছে তো আমার।
---হ্যাঁ, আমার মাথা ঠিকই আছে।তুমি একটু তাড়াতাড়ি এসো।প্লিজ অনুরোধ,তোমার অনুরোধ করছি যতো দ্রুত সম্ভব এসো।
---তুমি একদম চাপ নিও না,আমি আসি আগে।তারপরে দুজনে মিলে আলোচনা করবো এই বিষয়ে।
---ওকে।থ্যাংকস অনুরোধ।মেনি মেনি থ্যাংকস।
এরপরে ফোনটা কেটে দিলাম।এটা ভেবে আরো বেশী অবাক হচ্ছি অনুরোধ এতো বড়ো
একটা কথা শুনে কোনোরকম রিয়েক্ট করলো না।এমনকি আমায় দুশ্চিন্তা না করার জন্য বললো।
সত্যি ওর মত শুভাকাঙ্ক্ষী আমার জীবনে আর কেউ নেই।
ও আমার পাশে না থাকলে আজকে এই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব ছিলো আমার কাছে।
জীবনের একটা কালো অধ্যায় পার করে এসেছি সেই ছোটবেলায়।
যার কারণে নিজের পরিবার,নিজের বাবা মা স্বজনদের ছাড়তে বাধ্য হয়েছি আমি।
এমনকি তাদের কারোর চেহারা স্পষ্ট স্মরণ নেই আমার।
তার কয়েক বছর পরেই অনুরোধের সাথে পরিচয় আমার।ওর সাহায্যে মেডিকেলে
পড়াশুনা করে আজ আমি একজন প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার।
অনুরোধের ঋণ আমার শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে,যা চাইলেও
কখনো শোধ করতে পারবো না আমি।
এবার সর্বপ্রথম যে কাজটা করতে হবে সেটা হলো আমার প্রেগনেন্সি টেস্ট।
রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত শতভাগ নিশ্চিত হয়ে কিছুই বলা সম্ভব নয়।
হয়তো সত্যিই কোনো প্রানের অস্তিত্ব আছে আমার গর্ভে নয়তো অন্য কিছু।
পরের দিন সকালে খুব তাড়াতাড়ি ডিউটি আওয়ারের আগেই হাসপাতালে গেলাম।
প্রথমেই নিজের প্রয়োজনীয় টেস্টগুলো করিয়ে নিলাম।
এরপর নিজের কাজে মনোযোগ দেই।একটু পরে একজন নার্স এসে ঢুকলো আমার কেবিনে।
---ম্যাম,সেই পেসেন্টের কথা মনে আছে?
---কোন পেসেন্ট?
---আরে দুই তিন মাসে যার টিউমার অপারেশন করিছেলেন আপনি।পরে পেটের বাচ্চাটাও মারা যায়।
(নার্সের মুখ থেকে হঠাৎ কথাটা শোনার পরে বুকটা আবারো ধরফর করে উঠলো আমার!)
---হ্যাঁ,কেন কি হয়েছে?
---উনি তো গতকালকেই মারা গেছেন!!
---কিইই!মারা গেলো কিকরে,তার সেটা তুমিই বা জানলে কি করে?
---শুনেছি বাচ্চাটা মারা যাবার পরেই মানসিকভাবে বেশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।
খাওয়া দাওয়া এক প্রকার বন্ধই হয়েই গিয়েছিলো তার।
---তারপরে....?
---শুনলাম গতকাল উনি সুইসাইড করেছেন।
তার পরিবারের দাবি বাচ্চার শোকেই নাকি সে নিজেকে শেষ করে দিয়েছে।
যদিও এর সত্যটা কতোটুকু আমি জানি না।
---কি বলছো তুমি এগুলো নার্স,ভদ্রমহিলা সুইসাইড করেছেন।
আচ্ছা তুমি জানলে কিকরে বললে না তো?
---ওনার বাবার বাড়ি আমার নতুন শ্বশুর বাড়ির খানিকটা কাছেই।
ভদ্রমহিলার পরিবার জাস্ট কয়েকবছর আগে নতুন বাসা নিয়েছেন ঐ এলাকায়।
ইনফ্যাক্ট আমি নিজেও জানতাম না এতোদিন।
কাল সুইসাইড এর ঘটনা শুনে যখন দেখতে গেলাম।তারপরে সবটা পরিস্কার হলো।
---আচ্ছা,ওর স্বামী কোথায়,তার বিষয়ে জানো কিছু?
---যতোদূর শুনেছি স্বামী নাকি আগেই ছেড়ে দিয়েছে তাকে।এরপরে থেকে বাবার বাড়িতেই থাকতো সে।হয়তো পাগলামি সহ্য করতে না পেরেই ছেড়ে দিয়েছে।
নিজের হাতে কতোবড়ো ভুল আর অন্যায় হয়ে গেছে আমার এখন বুঝতে পারছি।
আমার লোভের কারণে একজন মা তার সন্তান হারালো, এখন কিনা নিজের প্রানটাও হারালো।
হয়তো সবাই ভদ্রমহিলার মৃত্যুর পেছনে তার সন্তান বা তার পাগলামিকেই দায়ি মনে করবে।
কিন্তু তার পেছনেও যে একজনের হাত রয়েছে আর সেটা হলাম আমি।
এতো বড়ো একটা গর্হিত সত্য থেকে কিকরে পালিয়ে বাঁচবো আমি।
এই চিন্তাই ভাবিয়ে তুলছে আমায়।হয়তো সারাটা জীবন এই অনুশোচনার
আগুনে জ্বলে পুড়ে মরতে হবে আমায়।এই পাপ থেকে পালানোর আর কোনো রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি না আমি।
নার্স চলে যেতে উদ্যত হতেই তাকে প্রশ্ন করি।
---আচ্ছা আমাকে ঐ ভদ্রমহিলার বাড়িতে নিয়ে যাবে তুমি, আমি যেতে চাই ওখানে।
নার্স আমার কথা শুনে একটু অবাক হলো।
---আপনি সেখানে গিয়ে কি করবেন ম্যাম?
---এমনি যাবো,গুরুতর কোনো কারণ নয়।
এরপর আমি নার্সকে বুঝিয়ে রাজি করালাম।হাসপাতালের ডিউটি শেষ হতেই সন্ধ্যার পরে
তার সাথে ভদ্রমহিলার বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই।তার বাসা হাসপাতাল থেকে বেশ দূরে।
যেতে যেতে প্রায় দুই ঘণ্টা লাগলো।বেচারি নার্সকে আমার জন্য এতোটা পথ জার্নি করে
আসতে হলো।তাকে সাথে নিয়েই বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম আমি।
আমি নিজেও ভাবতে পারি নি এই বাড়িতে আজ কি অপেক্ষা করছে আমার জন্য।
আমাদের ড্রয়িং রুমে বসতে দেয়া হলো।আমি চারদিকটায় চোখ বোলাতে লাগলাম।
হঠাৎ আমার দৃষ্টি দেয়ালের ওপরে টানানো ফ্যামিলি ফটোর দিকে যায়।
ছবিটা দেখে আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যেতে শুরু করলো।
এতো আমার ছোটবেলার ফ্যামিলি ফটো!যার ভেতরে আমি নিজেকে দেখতে পাচ্ছি।
আমার বাবা মা,ছোট ভাই বড়ো বোন সবাই আছে।তার মানে কি এটা আমার নিজের বাড়ি...??
সৃষ্টিকর্তা এ কোন খেলা খেলছেন আমার সাথে আমি জানি না!!
একটা অজানা ভয় আর আতংক আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো আমায়।
একটু পরে ভেতর থেকে বাড়ির একজন কাজের লোক আমাদের জন্য নাশতা নিয়ে আসে।
আমি তাকে প্রশ্ন করি :
---আচ্ছা বাড়ির লোকজন কোথায়??
--তারা সবাই একটু বেরিয়েছেন, একটু পরেই ফিরে আসবেন।
---ওহহ,শুনুন। ফ্যামিলি ফটোটা কি এই পরিবারের??
আমার কথা শুনে লোকটা হেসে দিলো!
---কি যে বলেন ম্যাম।এই পরিবারে আর কাদের ফ্যামিলি ফটো থাকবে।
---ওহহ,এরা সবাই কি থাকে এখানে!?
---হ্যাঁ,সবাই থাকে।শুধু একজন বাদে!
--একজন বাদে?কেন সে কি এখানে থাকে না?(নার্স বলে উঠলো)
---আসলে আমি তো অতটা জানি না।তবে বাড়ির ছোট মেয়ের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই।
সে নাকি কোন ছোটবেলায় বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।
তাদের দুভার্গ্য দেখেন একমাত্র যে বড়ো মেয়ে ছিলো সেও চলে গেলো!!!
বেচারী নিজের সন্তান হারানোর শোক সহ্য করলে পারলো না।
লোকটার কথা শুনে আমি আর স্থির রাখতে পারলাম না নিজেকে।
সারা শরীর একটা অদ্ভুত কম্পন দিয়ে উঠলো।এ কি করলাম আমি....!!
নিজের হাতে নিজের বড়ো বোনের এতো বড়ো একটা সর্বনাশ কিকরে করলাম আমি...???
এই কারণেই তখন ঐ ভদ্রমহিলাকে দেখে এতো পরিচিত মনে হয়েছে আমার...
বার বার মনে হচ্ছিলো তার সাথে আমার যেন কোনো সম্পর্ক আছে...
চলবে.....
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com