Breaking News

ক্লাসের সেই ছেলেটি



কেমিস্ট্রি ল্যাবে হাতাহাতির এক পর্যায়ে ক্লাসের সবচেয়ে শান্ত, সবসময় কোণায় বসে থাকা ইন্ট্রোভার্ট ছেলেটি যেদিন শ্রেয়া কে প্রতিপক্ষের এসিডের আক্রমণ থেকে বাঁচানোর জন্য দৌড়ে আসে, সেদিন সবাই বিস্ময়ের উর্ধ্বে পৌঁছে গিয়েছিলো। শ্রেয়া ছিলো তাদের ব্যাচের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে, ক্যাম্পাসে আরও অনেক সুন্দরী মেয়ে থাকলেও তার মত অতিমাত্রায় সুন্দরী আর কেউ ছিলোনা। শ্রেয়া দেখতে যেমন সুন্দর ছিলো, তেমনি ছিলো অনেক দুষ্ট এবং আড্ডাপ্রিয় মেয়ে। আবার অনেকের সাথেই মারামারি, হাতাহাতি হয়ে যেত তার বিশেষ করে ছেলেদের সাথে!

পাঁচ বছর আগে শ্রেয়া এইচএসসির স্টুডেন্ট ছিলো, বিজ্ঞান বিভাগে।
ছেলে আর মেয়েদের সেকশন আলাদা হলেও সব বিষয়ের ল্যাবের কাজ সবাই মিলে একসাথে
করতো গ্রুপ নিয়ে। তাকে একটি ছেলে প্রপোজ করেছিলো, সে ছিলো বড়লোকের বখাটে ছেলে।
শ্রেয়া তাকে ফিরিয়ে দেয় বলে সেদিন এই বিষয়টি নিয়ে সেই ছেলের সাথে
হাতাহাতি হয় তার ল্যাবের মধ্যেই। প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ছেলেটি কেমিক্যাল আর এসিড
মিশ্রিত একটি দ্রবণ শ্রেয়ার দিকে ছোঁড়ার জন্য হাতে নিতেই সেই ছেলেটি এসে শ্রেয়াকে ধাক্কা
মেরে সরিয়ে দেয় আর পুরো দ্রবণ চেহারার ওপর পড়াতে সেদিন ছেলেটির চেহারার একপাশ পুড়ে গলে যায়!
এই দৃশ্য শ্রেয়া সহ্য করতে না পেরে সেখানেই অজ্ঞান হয়ে যায়, পরে সে নিজেকে তার
বিছানায় আবিষ্কার করে। এ নিয়ে অনেক কাহিনী হয়েছিলো ক্যাম্পাসে, শ্রেয়া এবং বাকি
সবাই মিলে ছেলেটি কে হাসপাতালে দেখতে গেলেও তাকে খুঁজে পায়নি,
পরে জানতে পারে ছেলেটি কলেজ ছেড়ে দিয়েছে। বড়লোক বাবার টাকার ক্ষমতায় আর
কোনও বিচার হয়নি সেই বখাটে ছেলেটির!

এসব ভাবতে ভাবতে শ্রেয়া নদীর ধারে এসে পা ডুবিয়ে বসলো। তার পরনে সাদা সালোয়ার কামিজ,
পায়ে রুপার মোটা নূপুর। সে এখন অনার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী,
চোখ বন্ধ করে পাঁচ বছর আগের স্মৃতি অবলোকন করার চেষ্টা করছে সে!
সেই ছেলেটির নাম ছিলো শাহরিয়ার, সবসময় ক্লাসে এক কোণায় বসে থাকতো, কারোও
সাথে কথা বলতো না। শ্রেয়া মাঝে মাঝে চেষ্টা করতো কথা বলার কিন্তু
শাহরিয়ার খুব কম কথা বলতো তার সাথে। সেদিনের পর থেকে ছেলেটিকে অনেক খুঁজেছিলো সে,
তাকে বাঁচানোর জন্য যে ছেলেটি নিজের চেহারা পুড়িয়েছে তার জন্য আজও শ্রেয়ার মন কাঁদে!
কত ছেলেকে রিজেক্ট করেছে সে তার জন্য, তার বাবা মা ও এ কথা জানে।
তারা শ্রেয়াকে বোঝাতো যে শাহরিয়ার আর ফিরবে না কিন্তু শ্রেয়ার বিশ্বাস ছিলো সে একদিন ফিরবে...
কি জানি কি পেয়েছিলো সে সেই ইন্ট্রোভার্ট ছেলেটির মধ্যে!

ইদানীং তার শাহরিয়ারের কথা খুব বেশী মনে পড়ছে। আজ খারাপ লাগছিলো বিধায় তাই ভর দুপুরে নদীর পাড়ে এসে বসে আছে। জায়গাটি নির্জন খুব, একটু পর নিজের পিছে ছয়জন পুরুষকে দেখে শ্রেয়ার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো!
-" কে আপনারা? "
-" ম্যাডাম আমাদের সাথে আপনার যেতে হবে এক জায়াগায়। "
এ কথা শুনে ভয়ে শ্রেয়ার হৃদপিন্ড মনে হয় এবার ভিতর থেকে বেরিয়ে মাটিতে পড়ে লাফাবে!
-" আরও আশ্চর্য তো কেনও যাবো আমি? আর কে আপনারা? আমার পিছু নিচ্ছেন কেনও? "
-" দেখুন ম্যাডাম এটা আমাদের বসের অর্ডার, আমরা চাইনা আপনাকে স্পর্শ করে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যেতে।

-" এক থাপ্পড়ে গালের মাংস খুলে আনবো বেয়াদব! টাচ করে দেখতো একবার তারপর দেখি তোর হাত তোর শরীরের সাথে থাকে নাকি! "
এই বলে শ্রেয়া নিজের ওড়না কোমরে বাঁধতে শুরু করলো।
-" প্লিজ ম্যাডাম আমাদের সাথে চলুন নাহলে বস আমাদের মেরে ফেলবে! আপনাকে কথা দিচ্ছি আপনার কোনও ক্ষতি হবেনা! "
-" এই নির্জনে একটা মেয়েকে একা পেয়ে তামাশা করছিস কি ভেবেছিস আমি কিছু বুঝিনা? তোদের বস কে? ফোন লাগা এখনই! "
-" প্লিজ ম্যাডাম চলুন নাহলে বস আমাদের মেরে ফেলবে!"
শ্রেয়া নিজের স্পীড ডায়ালে পুলিশের নাম্বার রেখে বুকে সাহস বেঁধে তাদের সাথে চললো। তার নিজেরও দেখা দরকার তাদের কে তাদের বস? তাছাড়া কোনও উপায়ও ছিলোনা, সে না গেলে হয়তো লোকগুলো তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতই! শ্রেয়াকে তারা চোখ বেঁধে ব্ল্যাক পাজেরো করে নিয়ে গেলো....
চোখ বন্ধ অবস্থায় শ্রেয়া বুঝতে পারলো তাকে কোনও এক বিছানায় বসানো হয়েছে।
-" চোখ খুলতে পারো তুমি এখন। "
গম্ভীর কোনও পুরুষালী কন্ঠে শ্রেয়া একটু চমকে গেলো, খুব পরিচিত লাগছে কন্ঠটি! শ্রেয়া চোখের বাঁধন খুলে চোখ খুলতেই একটু অবাক হলো....তার সামনে শ্যামবর্ণের একজন পুরুষ বসে আছে কিন্তু কালো কাপড় দিয়ে তার চেহারা অর্ধেক ঢাকা, বলতে গেলে শুধু বাম চোখ বাদে পুরো মুখই ঢেকে রেখেছে! শ্রেয়া তার চেহারা দেখার চেষ্টা করছে কিন্তু বার বার ব্যর্থ হচ্ছে!

-" কে আপনি? "
-" কেমন আছো শ্রেয়া? "
-" ভালো আছি কিন্তু আপনি কে? আর ডাকাতের মত নিজের চেহারা ঢেকে রেখেছেন কেনও? "
-" আমার সাথে দুষ্টুমি করার স্বভাবটা তোমার আজও গেলো না! "
কথাটি শুনেই শ্রেয়া অনেক অবাক হলো,
-" শাহরিয়ার তুমি! "
-" হ্যাঁ আমি। "
এতদিন পর কাঙ্খিত সেই মানুষটি কে দেখে শ্রেয়ার বুক ধড়ফড় করছে!
-" তুমি কোথায় ছিলে এতদিন? "
-" ছিলাম কোনও এক জায়গায়! "
-" এক থাপ্পড়ে গাল ফাটিয়ে দিবো! আমাকে এখানে ধরে এনে আবার আমার সাথেই ইগো মার্কা কথা? আর তুমি কলেজ ছেড়ে দিয়েছিলে কেনও? তোমাকে দেখার জন্য আমরা সবাই হাসপাতালে গিয়েছিলাম কিন্তু তোমাকে আমরা কেউ খুঁজে পাইনি আর। "
-" সেদিন কোনওমতে ট্রিটমেন্ট নিয়ে আমরা অন্য শহরে চলে যাই, সেখানেই আমার ট্রিটমেন্ট হয়। আব্বু আমাকে নিয়ে রিস্ক নিতে চায়নি আর। "
-" আর ওই ছেলেটার যে....."
শাহরিয়ার তাচ্ছিল্য হাসলো,

-" ওহ হাহাহা হ্যাঁ ওর চেহারাও আমি গলিয়ে দিয়েছি এসিড দিয়ে। "
-" মানে ক্লাসে এক কোণায় বসে থাকতে তুমি চুপ করে আর সেই তুমি এত ডেঞ্জারাস! "
-" যা করেছে সেটারই শাস্তি পেয়েছে ও। "
-" তোমার সাথে তো ওর শত্রুতা ছিলোনা তাহলে তুমি কেনও এমন করতে গেলে? তোমার নিজের লাইফ নষ্ট করলে আমাকে বাঁচাতে গিয়ে! "
-" ওর সাহস কি করে হলো তোমার ক্ষতি করার! "
-" তা তুমি কি ডাকাতে জয়েন করেছো? মুখ পুড়েছে ভালো কথা ডাকাত সেজে থাকবে নাকি সবসময়? "
শাহরিয়ার দাঁড়িয়ে গেলো,
-" তুমি কি আর ভালো হবেনা জান? "
-" এক্সকিউজ মি? জান কে? বাহ ভালোই তো লম্বা হয়েছো দেখি...বডি বানিয়েছো...আর এই কাপড় সরাও তোমার মুখ দেখব আমি। "
-" না তুমি ভয় পাবে। "
-" তোমার মুখ দেখাও বলছি! "
শ্রেয়ার জোরাজুরি তে শাহরিয়ার কাপড় সরিয়ে তার চেহারা দেখাতেই শ্রেয়া ভয়ে চিৎকার করে দুইহাত দিয়ে নিজের চোখ-মুখ ঢেকে ফেললো,
-" বলেছিলাম না ভয় পাবে! "
শ্রেয়া আবারও চোখ খুলে শাহরিয়ারের দিকে তাকালো...শুধু ডান চোখ আর ঠোঁটটা বাদে পুরো ডান পাশটা পোড়া তার, ততটা বীভৎস না হলেও শাহরিয়ার কে প্রথম দেখায় যে কেউই ভয়ে চিৎকার করবে এই কুৎসিত অবস্থা দেখে! কষ্টে তার ভিতরটা জ্বলে যাচ্ছে....তার জন্য শ্যামবর্ণের এত সুন্দর ছেলেটির আজ কি অবস্থা! শ্রেয়া নিজেকে শান্ত করে বললো,
-" যাক মোটামুটি ভালোই আছো তুমি! ভালো লাগলো তোমার সাথে দেখা হয়ে এখন আমার যেতে হবে। "
বলে শ্রেয়া চলে যেতে নিলেই শাহরিয়ার তার হাত খুব শক্ত করে ধরে নিজের কাছে আনলো,
-" কি হচ্ছে কি এসব? "
-" তুমি কি কিছুই বোঝোনা? এত কিছু হলো তুমি কি কিছুই বুঝলেনা? "
-" ওহ এতদিন কোথায় ছিলো এসব? না বলে চলে গিয়ে এখন আবার হুট করে এসে আদিক্ষেতা দেখানো হচ্ছে? "

-" তখন সিচুয়েশনটাই অন্যরকম ছিলো...."
-" তাই বলে পাঁচ বছর? আর এখন কি সিচুয়েশন খুব গর্জিয়াস? খুব রিচ এন্ড পাওয়ারফুল? "
-" এক্সাক্টলি! "
-" বুকের ওত পাটা থাকলে পারলে নিজের ফ্যামিলি কে নিয়ে এসো! এসব কিডন্যাপিং ফিডন্যাপিং এ কিছুই হবেনা! "
শাহরিয়ার ঝামটা মেরে শ্রেয়ার হাত সরিয়ে দিয়ে তার পায়ের দিকে তাকিয়ে তাকে আবারও বসিয়ে দিলো,
-" কি হলো? "
-" বসো। "
শাহরিয়া কোথায় গিয়ে এক বোতল আলতা নিয়ে এলো!
-" দেখি পা টা দাও। "
-" আরেএএএ....."
-" একদম চুপ! "
শাহরিয়া ছোট একটি টুলে বসে শ্রেয়ার ডান পা নিজের হাঁটুতে নিয়ে চুমু খেলে শ্রেয়ার
কেমন অস্বস্তি হতে লাগলো। এক পুরুষ তাকে স্পর্শ করাতে যত না অস্বস্তি লাগছে
তার চেয়ে বেশি অস্বস্তি হচ্ছে তার এই ভেবে যে ক্লাসের সেই ইন্ট্রোভার্ট ছেলেটি তাকে চুমু খাচ্ছে!
শ্রেয়া পা সরিয়ে নিলো,
-" কি হলো কি? "
-" তুমি আমার পায়ে কিস দিলে কেনও? "
-" তাহলে কে দিবে শুনি? "
-" তুমি কি সত্যিই শাহরিয়ার? নাকি ওর রূপ ধরা কোনও জ্বীন? "
-" হোয়াট! "
-" হ্যাঁ কারণ তুমি কারো দিকেই তাকাতে না আর সেখানে তুমি আমার পায়ে কিস দিয়েছো! "
শ্রেয়ার কথা শুনে শাহরিয়ার নিঃশব্দে হাসলো, তারপর তার পায়ে আলতা পড়ানো শুরু করলো। বেশ সময় নিয়ে সে শ্রেয়ার পায়ে আলতা লাগিয়ে দিলো,
-" ওয়াও ভালোই তো লাগিয়েছো! কিভাবে শিখলে তুমি? "
-" আব্বুকে দেখতাম আম্মু কে লাগিয়ে দিতো অলওয়েজ ইভেন এখনও লাগিয়ে দেয়। "
-" কি ভালোবাসা! যাইহোক আমি বাসায় যাব এখন। "
শাহরিয়ার বিরক্ত হয়ে বললো,
-" এত তাড়া কিসের শুনি? "
-" কোনও কিডন্যাপারের সাথে আমার থাকার ইচ্ছে নেই!"
-" উফফফফ এত অস্থির মেয়েটা! "
শাহরিয়ার শ্রেয়াকে নিজের লোকদের দিয়ে তাকে তার বাসায় পৌঁছে দিলো.....

আজ শাহরিয়া আর শ্রেয়ার বাসর রাত। এ বিয়েতে কেউ কোনও সমস্যা করেনি কারণ
শ্রেয়ার বাবা-মা বুঝেছিলেন যে পুরুষ তাদের মেয়ের সৌন্দর্য রক্ষার্থে নিজের চেহারা
এসিডে পুড়িয়ে ফেলতে পারে সেই পুরুষের কাছে তাদের মেয়ে সারাজীবন ভালো থাকবে!
আর শাহরিয়ার বাবা-মা ও অনেক খুশী এই বিয়েতে....
তাদের ছেলে শেষ পর্যন্ত কাউকে পেয়েছে নিজের জীবনে!
শাহরিয়ার রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেখলো শ্রেয়া নিজের শরীর থেকে গহনা খুলছে।
সে শ্রেয়ার কাঁধে হাত দিতেই সে তার হাত সরিয়ে দিলো,
-" ডোন্ট টাচ মি! "
-" মানে? "
-" নিজের চেহারা দেখো আয়নায় আর আমার চেহারাটাও দেখো একটু?
তোমার সাথে আমার যায়? "
শ্রেয়ার কথা শুনে শাহরিয়ারের খুব কষ্ট লাগছে....
তাহলে কি তার প্রেয়সী তাকে ভালোবাসেনা?
তার এতবড় বিসর্জন সব বৃথা গেলো তাহলে?
-" আমার থেকে দূরে থাকবে সবসময়। "
শ্রেয়ার এই কথা শুনে শাহরিয়ার এর প্রচন্ড রাগ হলো।
সে শ্রেয়াকে নিজের সাথে মিশিয়ে দুইগাল চেপে রাগান্বিত কন্ঠে বললো,

-" আমাকে তোমার ভালোবাসতেই হবে! "
শাহরিয়ার এর কথা শুনে শ্রেয়া হাসলো,
-" ক্লাসের এক কোণায় বসে থাকা সেই শান্ত, চুপচাপ, ইন্ট্রোভার্ট ছেলেটি যদি
প্রতিদিন এভাবে আমার গাল চেপে ধরে ভালোবাসা চায় তাহলে আমি তাকে ভালোবাসবো! "
শ্রেয়ার কথা শুনে শাহরিয়ার হেসে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো,
আর শ্রেয়া ও চোখ বন্ধ করে তার ভালোবাসার মানুষটির হৃদকম্পন শুনতে লাগলো........

<>সমাপ্ত<>

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com