এক মুঠো রোদ । পর্ব - ০১
বিয়ের প্রথম রাতে সে আমার কাছে একা আসেনি। সাথে আরো একজন নিয়ে এসেছিলো।
প্রথমে ভেবেছিলাম বন্ধু হবে হয়তো, তাই পরিচয় করাতে নিয়ে এসেছে।
কিন্তু সে আমায় ভুল প্রমান করে নিজে থেকেই বলে ওঠে,
"আজ তোমার সাথে আমি নয়, সে বাসর করবে, খুশি করে দাও ওকে"
কানকে একদমই বিশ্বাস করতে পারিনি। বুকের ভেতরটা ধুকধুক শুরু করেছিলো।
এক মূহুর্তের জন্য ফ্রিজ হয়ে গেছিলাম।
মনে অনেক আসা নিয়ে তার বাড়িতে পা রেখেছিলাম।
যদি এই জীবনে একটু সুখের দেখা পাই। আমার বয়স যখন ১২ বছর,
তখন মায়ের পরকিয়ার জের ধরে বাবা মায়ের থেকে আলাদা হয়ে যায়।
বাবা অনেক চেয়েছিলো আমায় তার কাছে নিয়ে যেতে।
কিন্তু মা আমায় কিছুতেই বাবার কাছে যেতে দেয়নি।
আমিও মাকে ছেড়ে যেতে চাইনি। মায়ের সাথেই রয়ে গেছিলাম।
বাবার সাথে ডিভোর্সের ২ সপ্তাহ পর মা আবার নতুন করে সংসার সাজায়।
আমার মায়ের সেই স্বামীকে আমি একটুও পছন্দ করতাম না।
ওনাকে বাবা বলে না ডাকায় মা একদিন আমায় খুব মেরেছিলো।
খুব কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন। একদিন জানতে পারি এই সেই লোক,
যার জন্য আমাদের সাজানো গোছানো সংসারটা তছনছ হয়ে গিয়েছিলো।
বাবা মাকে কোনো মিথ্যে অপবাদ দেয়নি। সত্যিই মা পরকিয়ায় জড়িয়েছিলো।
মায়ের প্রতি মনের মধ্যে প্রচুর ঘৃণা জন্মাতে থাকে।
মা সেই লোকটার জন্য এতটাই পাগল ছিলো যে লোকটা মাকে যা বলতো মা তাই করতো।
শত কষ্ট বুকে চেপে বাবার জন্য অনেক অপেক্ষা করতাম, এই বুঝি বাবা এসে আমাকে এই জাহান্নাম থেকে বের করে নিয়ে যাবে।
কিন্তু বাবা আর কখনোই ফিরে আসেনি। এখনো জানি না আমার বাবা কোথায় আছে কেমন আছে।
ওই লোকটার কথায় মা আমার পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়। নিজের মা আমার সাথে সৎমায়ের মত ব্যবহার শুরু করে। ঘরের যাবতীয় সব কাজ আমায় দিয়ে করাতো। পান থেকে চুন খসলেই খুব মারতো।
খুব অত্যাচার হতো আমার ওপর।
একদিন মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না করে বলেছিলাম
মা, কেনো তোমরা আমার সাথে এমন করছো? আমি তো তোমারই মেয়ে। কেনো আমায় এত কষ্ট দিচ্ছো? আমি যে আর পারছিনা মা।
মা আমায় একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে, আমি নাকি তার নিজের মেয়ে নই। বাবার শারীরিক সমস্যার কারনে মা গর্ভধারণ করতে পারেনি। তাই তারা আমায় দত্তক নেয়।
সত্যি বলতে আমার পুরো দুনিয়াটা এমনিতেই ওলট পালট ছিলো, মায়ের এমন কথায় আমার একটুও কষ্ট হয়নি, শুধু একটু অবাক হয়েছিলাম।
নিজের মেয়ের সাথে কি কেউ এমন করতে পারে?
বাবা আমায় খুব ভালোবাসতো, তাই বাবার কাছে আমায় দেয়নি। বাবার সুখ নাকি মায়ের পছন্দ না, তাই বাবার থেকে আমায় কেড়ে নেয়।
খুব একা হয়ে গিয়েছিলাম।
আমার বয়স যখন ১৬, শারীরিক দিক দিকে তখন আমাকে অনেকটা বড় লাগতো।
এমনি একরাতে রান্নাঘরেই ঘুমাচ্ছিলাম, মাঝরাতে কারো হাতের ছোয়ায় ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলে দেখি ওই লোকটার হাতে আমার ওড়না, আর লোকটা আমার দিকে কুকুরের মতো করে তাকিয়ে লালা ফেলছে।
ভয়ে রান্নাঘরের এক কোনায় চলে যাই।
সেও ধীরেধীরে আমার কাছে এসে বসে।
তার মতলব বুঝতে পেরে জোরে চিৎকার দিয়ে উঠি।
কোথায় থেকে যেনো মা দৌড়ে আসে।
আমাদের এমন অবস্থায় দেখে মা ভীষণ রেগে যায়।
মাকে দেখে লোকটা আমার ওড়না আমার মুখের ওপর ছুড়ে মেরে চলে যায়।
সেই রাতে মা আমায় খুব মারে।
মা ওই লোকটাকে ভীষণ ভালোবাসতো, তাই হয়তো তার রাগ আমার ওপর দিয়ে ওঠায়।
মায়ের মার খেয়ে ২দিন ভীষণ জ্বর ছিলো, হাটতে পারছিলাম না। তবুও ঘরে প্রতিটা কাজ আমায় করতে হয়েছে।
মায়ের ওই স্বামীর ভয়ে মা আমাকে বাড়ি থেকে তাড়ানোর উপায় খুজতে থাকে। আমার বিয়ে ঠিক করা হয়।
যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করা হয় তাকে আমি বিয়ের আগ পর্যন্ত দেখিনি, চিনিও না।
শুনেছিলাম আমার বর মায়ের ওই স্বামীর সাথে কিসের যেনো ব্যবসা করে। সেই সুত্রে মা তাকে চিনে।
ওই জাহান্নাম থেকে বের হয়ে নিজের স্বামীর বাড়ি এসে একটা সস্থির নিশ্বাস ফেলি।
এবার যদি জীবনে একটু সুখের দেখা পাই।
স্বামীর বাড়ি এসে জানতে পারি ওনার পরিবারে কেউ নেই। উনি একাই এই বাড়িতে থাকেন।
মনে মনে খুব লোভ হয়েছিলো, ওনার শুন্য মনে শুধু আমারই জায়গা হবে। ওনার সব ভালোবাসা জুড়ে শুধু আমিই থাকবো।
খুব আসা ভরসা নিয়ে বাসর ঘরে বউ সেজে ওনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এই বুঝি উনি এসে আমার ঘোমটা তুলবেন, আর আমি লজ্জায় লাল হয়ে যাবো। তখন উনি আমার লজ্জা ভাঙাবেন।
আমার সব স্বপ্ন মাটি করে উনি বাসর ঘরে অন্য লোক নিয়ে এসে তার সাথেই আমায় রাত কাটাতে বলেন।
খুবই ভয় পেয়ে যাই। এক জাহান্নাম থেকে বের হয়ে বুঝি আরেক জাহান্নামে প্রবেশ করলাম।
উনি আমাকে কিছু কাপড় হাতে ধরিয়ে দিয়ে তৈরী হতে বলে রুমের বাহিরে চলে যান।
ধরেই নিয়েছিলাম আমার জীবনটা শেষ।
স্বামী হয়ে কি করে নিজের বিয়ে করা বউকে অন্যের হাতে তুলে দিতে পারে? কি করে আমার সব স্বপ্ন এভাবে চুরমার করে দিতে পারে?
সেও বুঝি মায়ের সেই স্বামীর মতো?
চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছিলো।
চিৎকার করে বাবাকে ডাকতে ইচ্ছে করছিলো। বাবার সাথে থাকলে হয়তো আজ আমার এমন অবস্থা হতো না।
কিছুক্ষণ আগেও যেই ঘরটাকে আমার দিন বদলে যাওয়ার কারন হবে ভেবেছিলাম, এখন মনে হচ্ছে সত্যিই সেই ঘরটা আমার দিন বদলে যাওয়ার কারন হবে। তবে নতুন করে নয়, পুরোনো কষ্টে ঘি ঢালার মতো করে।
বুকটা চিরে কান্না করতে থাকি।
হঠ্যাৎই আমার স্বামীর সাথে আসা লোকটা আবার রুমে প্রবেশ করে।
রুমে ঢুকে লোকটা আমায় ধমক দেয়, কেনো আমি এখনো বিয়ের কাপড় চেইন্জ করিনি।
ঝাপিয়ে পড়ে ওনার পা দুটো ধরে কান্না করতে থাকি।
কিন্তু লোকটা আমার চুলের মুঠি ধরে আমায় দাড় করায়।
নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে নেয়।
এত সুন্দর কেনোরে তুই? শুনলাম তুই নাকি এখনো ভার্জিন, একদম কচি মা..... আহ, কত মজা হবে আজ রাতে। তোর জীবটা রঙিন করে দেবো আমি। কাপড় খোল।
মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছিলো না আমার, শুধু ওনার দিকে হাত জোড় করে কেঁদেই যাচ্ছিলাম। কিন্তু ওই লোকটার একটুও মন গলেনি।
আমায় ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিয়ে আচল টেনে কাপড় খোলার চেষ্টা করে।
মনে মনে ভেবেই নিয়েছি, এই জীবনটা আর রাখবো না।
লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে টেবিল থেকে ফল কাটার ছুরিটা হাতে নেই।
নিজের গলায় ছুরি ধরে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার হুমকি দিতে থাকি।
লোকটাও বেশ ভয় পেয়ে যায়।
লোকটা নরম গলায় কথা বলতে বলতে ধীরেধীরে আমার কাছে এসে দাড়ায়।
তার উদ্দেশ্য ছিলো এক ঝাটকায় আমার হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে নিবে।
আমার কিছুটা সামনে এসে লোকটা এক লাফ দিয়ে ছুরিটা ধরার চেষ্টা করে।
ছুরিটা ওনার দিকে তাক করে ধরি, লাফ দেওয়ার ফলে লোকটা এসে সোজা ছুরির ওপর পড়ে।
মুখে হাত দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়ে সে।
ভালো করে খেয়াল করে দেখি ছুরিটা ওনার বাম চোখে ঢুকে গেছে।
চোখ দিয়ে ওঝোরে রক্ত বের হতে থাকে।
মূহুর্তেই লোকটা জ্ঞান হারায়।
ভীষণ ভয় পেয়ে যাই। দরজার বাহির থেকে আমার স্বামী নামক লোকটা জোরে জোরে বলতে থাকে।
জলদি কর, এখনো আমিও ছুয়ে দেখিনি। তাড়াতাড়ি আয়।
এই মানুষ নামক নরপশুর হাত থেকে বাচার জন্য জানালার থাই গ্লাস খুলে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ি। জানালায় কোনো গ্রিল না থাকায় বের হতে আমার কোনো সমস্যা হয়নি।
রুম থেকে বের হয়ে দৌড়াতে থাকি। অন্ধকারে চোখ বন্ধ করেই দৌড়াতে থাকি। জানি না কতক্ষণ দৌড়াই, একটা সময় জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাই।
যখন জ্ঞান ফিরে, তখন নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করি।
পাশেই একটা বয়স্ক মহিলা বসে আছে।
--কি হয়েছে মা তোমার? কোথায় থেকে এসেছো?
--আমি এখানে কি করে এলাম?
--সকালে নামাজের ওজু করতে বের হয়ে দেখি তুমি আমার কলপাড়ে পড়ে আছো। তাই তোমায় তুলে এখানে নিয়ে এলাম। কে তুমি মা?
ওই ভদ্র মহিলাকে সব কিছু খুলে বলি।
উনি একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে আমার দিকে করুণাময় দৃষ্টিতে তাকান।
--ওই পশুটার ভাগ্যে বুঝি তুমিই পড়লে? জানো সে কে?
--কে?
--এই এলাকার নাম করা পতিতা ব্যবসায়ী। আর তুমি কিনা তাকেই বিয়ে করলে?
--বিয়ের আগে আমি কিছুই জানতাম না।
--এখন সে যদি জানতে পারে যে তুমি এখনো এই এলাকায় আছো, তোমায় সে খুজে বের করবেই।
--এখন আমি কি করবো দাদু?
--আজ সারাদিন তুমি এখানেই লুকিয়ে থাকো। রাতের আধারে এই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাবে।
--কোথায় যাবো আমি? আমার যে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।
--বাঁচতে চাইলে তোমাকে যেতেই হবে। তুমি অন্য কোনো শহরে চলে যাও।
--দাদু, পৃথিবীটা বড়ই নিষ্ঠুর। তার চেয়েও নিষ্ঠুর এই পৃথিবীর মানুষগুলো। ওরা আমায় বাঁচতে দেবে না।
--দেখো মেয়ে, তুমি এখনো ছোট। জীবনের মানেটা তুমি এখনো জানো না। তোমাকে বাঁচতে হবে।
--ঠিক আছে, আজ রাতেই আমি অন্য কোথাও চলে যাবো।
.
রাতের আধারেই বেরিয়ে পড়ি এক অচেনা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
ওই ভদ্র মহিলা আমায় একটা বোরকা দেয়, এবং সাথে কিছু টাকাও দেয়।
যেনো খুদা লাগলে কিছু খেতে পারি।
অন্ধকারে হাটতে হাটতে স্টেশন পর্যন্ত চলে আসি।
কিন্তু তখনো আমি জানতাম না আমি কোথায় যাবো। দূরপাল্লার কোনো একটা বাসে উঠে যাবো। যা হওয়ার হবে...
টিকেট নেওয়ার জন্য কাউন্টারে গিয়ে দেখি আমার স্বামী নামক সেই মানুষটা ভেতরে একটা লোকের সাথে কথা বলছে।
ওনাকে দেখেই কাউন্টার থেকে বের হয়ে বড় রাস্তা ধরে দৌড় দেই।
উনিও আমার পেছন পেছন দৌড়াতে থাকে।
তখনই মনে পড়ে আমার মুখটা বোরকা দিয়ে ঢাকা ছিলো। উনি আমাকে চিনতে পারতেন না।
ইসস, কেনো আমি বোকার মতো দৌড় দিলাম।
মনে ভয় নিয়ে এলোপাথাড়ি দৌড়াতে থাকি।
নিজের জীবনের প্রতি মায়াটাই উঠে গিয়েছিলো।
কি নিয়ে বাঁচবো? কাকে নিয়ে বাঁচবো? কার ভরসায় বাঁচবো? আমার বেঁচে থাকার কোনো কারনই খুজে পেলাম না।
রাস্তার পাশ ছেড়ে রাস্তার মাঝ দিয়ে দৌড়ানো শুরু করি।
তার হাতে ধরা পড়লে হয়তো বেঁচে থেকেও আমাকে মরে যেতে হবে।
এরচেয়ে ভালো সহজ মৃত্যুটাই হোক।
একটা গাড়ি এসে স্বজোরে আমায় আঘাত করে। ছিটকে গিয়ে রাস্তার সাইটে পড়ি।
জ্ঞান হারানোর আগে দেখতে পাই আমার স্বামী নামক লোকটাও আমার পাশে পড়ে আছে।
আমার পিছু নিতে গিয়ে সেও আমার সাথে এক্সিডেন্ট করে। পুরো রাস্তা রক্তে সেঁতসেঁতে হয়ে যায়।
চলবে...
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com