এক মুঠো রোদ । পর্ব - ১০
এরপর কি হলো?
--এরপর আরকি, পুরো পুলিশ স্টেশনকে বিয়ের দাওয়াত দিলাম।
--মাঝরাত হয়ে যাওয়ায় আর বাসায় আসিনি। সামনে যেই পার্কটা আছে, ওখানেই বসে ছিলাম।
--এখন মিষ্টি কই?
--সবগুলো পাতিল খালি। ক্ষুধায় জান যায় যায় অবস্থা। তাই মিষ্টি নাস্তা বানাচ্ছে। রান্নাঘরে আছে গিয়ে দেখ।
--মেয়েটা ওপর দিয়ে এতটা ধকল গেলো। আর তুই ওকে রান্নাঘরে পাঠিয়ে এখানে পায়ের ওপর পা তুলে টিভি দেখছিস?(সানু বেগম)
--আমার কি দোষ? সে তো আমার সাথে কথাই বলছে না।
--কেনো?
--রেগে আছে বোধয়। সেই রাত থেকে একটা কথাও বলেনি।
--রাগার দরকারও আছে, থাক তুই এখানে।
মামুনকে ড্রয়িংরুমে রেখে রিয়া আর সানু বেগম রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায়।
--মিষ্টি....
--আরে মা, কোথায় ছিলেন আপনারা?
--থানায় গিয়েছিলাম।
--ওও, আমি তো চলে এসেছি।
--হ্যা মামুন সব বলেছে। বুকের ওপর থেকে পাথর নেমে গেছে মনে হচ্ছে। তুমি রুমে যাও, আমি নাস্তা বানাচ্ছি।
--না না মা, আমি পারবো।
--পারলেও এখন করা লাগবে না। রুমে গিয়ে একটু বিশ্রাম নাও।
--বিশ্রাম তো পরেও নিতে পারবো।
--যেতে বললাম না! যাও।
--আচ্ছা।
রিয়া মিষ্টিকে সাথে করে নিয়ে রুমে এসে বসে। মিষ্টিকে রুমে যেতে দেখে মামুনও পেছন পেছন রিয়ার রুমে এসে মিষ্টির সামনে দাড়ায়।
--তোর এখানে কি?(রিয়া)
--তোর ভাবির সাথে একটু কথা বলতাম।
--সে বলবে না।
--একটু রান্না ঘরে গিয়ে মাকে সাহায্য কর। আমি ওর সাথে একটু কথা বলি।
--রিয়া তুমি যাবে না। এখানেই বসে থাকো।(মিষ্টি)
--আমার অপরাধটা কি সেটা তো বলো। কেনো আমার সাথে কথা বলছো না?
--এটার ও জবাব দেবে না?
--রিয়া, ওনাকে বলো আমি ওনার সাথে কথা বলবো না।
--কিন্তু কেনো?
--যে আমার কথা শোনে না, কেনো তার সাথে কথা বলবো?
--বাবারে..... একটা ভুল নাহয় করে ফেলেছি। তাই বলে কথা বলবে না?
--না।
--ঠিক আছে, আমার সাথে কথা না বললে আমি খাবো না।
--রিয়া, ওনাকে ঢং করতে মানা করো।
--আমি ঢং করতেছি? ঠিক আছে, কাল দুপুরের পর থেকে আমি এখনো কিছু খাইনি, একটু পর জ্ঞান হারাবো, তখন যেনো আমার কাছে না আসে।
--ভাই, এবার কিন্তু ওভার এক্টিং করছিস, যা নিজের রুমে যা।(রিয়া)
--থাক তোরা, আমিও আর কারো সাথে কথা বলবো না।
মিষ্টির সাথে রাগ দেখিয়ে মামুন সোজা নিজের রুমে চলে আসে।
--আচ্ছা, ভাইয়ার সাথে কথা বলছো না কেনো?
--সে আমার কোনো কথাই শুনে না।
--কি এমন কথা? শুনি তো।
--জানো কাল রাতে কি করেছে?
--কি?
--আমি তাকে কতবার বারন করলাম আমার শতমায়ের বাড়িতে না যেতে। কিন্তু সে আমার কথা না শুনেই ওদের বাড়িতে চলে যায়। কত বড় বিপদ হয়েছে জানো তুমি?
--বিপদ? কি বিপদ?
--কাল রাতে সে থানা থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর আমি বুঝতে পারছিলাম সে আবার আমার শত মায়ের বাড়িতেই যাবে। কারন যে মামলা করেছে আমি তার ঠিকানা দেই নি। তাই ঠিকানা নেওয়ার জন্য সে ওই বাড়িতেই যাবে। আমি অনেক চিৎকার চেঁচামেচি করে পুলিশকে বলছিলাম যেনো কেউ গিয়ে ওনাকে নিয়ে আসে। ওরা মানুষ ভালো না, ওনার ক্ষতি করে ফেলবে। কেউ আমার কথা শুনছিলো না। এভাবে ২ ঘন্টা চলার পর অতিষ্ঠ হয়ে এক পুলিশ আমার শতমায়ের বাড়িতে যেতে রাজি হয়। এর প্রায় ১ ঘন্টা পর তোমার ভাইকে পুলিশ ধরে নিয়ে আসে। জানো কি হয়েছিলো?
--কি?
--তোমার ভাইকে ওরা ওই বাড়িতে বেঁধে রেখেছিলো। যদি ওরা ওনার কোনো ক্ষতি করে ফেলতো? ভাগ্য ভালো পুলিশ গিয়ে ওনাকে ছাড়িয়ে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে আসে। এর কিছুক্ষণ পরই পুলিশ আমাকে ছেড়ে দেয়।
--আচ্ছা... তাহলে এই ব্যাপার?
--কোন ব্যাপার?
--কি চাপাবাজিটাই না করলো। দেখাচ্ছি মজা। তুমি বসো আমি আসতেছি।
--কই যাও।
--বসো তো। আমি আসতেছি।
রিয়া দৌড়ে এসে মামুনের রুমে প্রবেশ করে।
--আমার রুমে কি? তোর রুমে আমি গেছি?
--যাবিও না আর।
--তো তুইও বের হ আমার রুম থেকে।
--তুই কিভাবে এত চাপাবাজি করলি আমার আর আম্মুর সাথে?
--কিসের চাপাবাজি?
--আমাদের বললি কিভাবে হিরোর মতো গিয়ে মিষ্টিকে ছাড়িয়ে নিয়ে এলি। এখন কাহিনী তো দেখি পুরোই উল্টা।
--উল্টা? মিষ্টি কিছু বলছে?
--সব বলে দিছে।
--ধ্যাত.... মেয়েটার পেট পাতলা। কথা রাখতে জানে না।
--মিথ্যুক কোথাকার।
--বনু, আম্মুকে বলিস না প্লিজ।
--মিথ্যা কেনো বললি?
--অল্প একটু মিথ্যা বলছি শুধু। ভিডিও করার সময় বেড়াতে হেলান দিয়ে ভিডিও করছিলাম। বেড়া এতটাই পাতলা ছিলো যে ভেঙে ভেতরে পড়ে যাই। পরে ওরা আমায় ধরে বেঁধে ফেলে। তবে হ্যা, আমায় মারতে পারে নি। এর আগেই কি করে যেনো পুলিশ এসে পড়ে। পরে আমাদের সবাইকে থানায় নিয়ে আসা হয়। ভিডিওটা পুলিশকে দেখালে আমাকে আর মিষ্টিকে ছেড়ে দিয়ে পুলিশ ওদের গ্রেপ্তার করে। শুধু এতটুকুই মিথ্যা বলছি।
--কেনো মিথ্যা বললি?
--আমার একটা মানইজ্জত আছে না! আমাকে বেঁধে ফেলেছে এটা কিভাবে বলি।
--ছাগল কোথাকার, যা ভাগ।
রিয়ার ধমক খেয়ে মামুন চুপ করে বসে আছে। একটু পর রিয়া হাতে নাস্তার প্লেট নিয়ে আবার মামুনের কাছে ফিরে আসে।
--এই নে, নাস্তা খা।
--খাবো না আমি, নিয়ে যা।
--কেনো?
--ইচ্ছা নাই।
--না খেলে তোর ১২টা বাজাবো আমি।
--কি করবি?
--আম্মুকে সব বলে দিবো।
--কি বলবি?
--তুই হিরো না, জিরো। উল্টা আরো কতকিছু বানিয়ে বানিয়ে বলবো।
--তুই আমার বোন নাকি শত্রু?
--খা বলছি।
--মিষ্টি এলো না কথা বলতে।
--দরজার বাহিরেই দাড়িয়ে আছে সে। তুই খেয়ে নে। খাওয়া শেষ হলেই সে আসবে।
--ওকে একটু ভেতরে পাঠা। কথা আছে তার সাথে।
--পাঠাচ্ছি, খাওয়া শুরু কর।
--হুম।
রিয়া বাহিরে এসে মিষ্টিকে ভেতরে পাঠায়। হাতে প্লেট নিয়ে মামুন বিছানায় বসে আছে। আর মিষ্টি এসে ধীরেধীরে মামুনের পাশে বসে।
--কথা বলবে না আমার সাথে? এতটা রাগ আমার ওপর?
--আপনি কেনো আমার কথা শুনেন না?
--এখন থেকে সব শুনবো।
--যদি ওরা আপনার কোনো ক্ষতি করে ফেলতো? তখন কি হতো?
--আমি না গেলে তোমায় ছাড়াতাম কি করে?
--তাই বলে বিপদে পড়তে হবে আপনাকে?
--আচ্ছা বাবা যা হওয়ার হয়ে গেছে। আর করবো না এমন। তুমি যা বলবে তাই শুনবো।
--সত্যিতো?
--৩ সত্যি।
--আপনি আমায় খুব ভালোবাসেন তাইনা?
--ওমা, তুমি কিভাবে জানো এটা?
--ধুর, বলুন না।
--হুম বাসি, খুব।
--আমার যদি কিছু হয়ে যেতো, আপনি কষ্ট পেতেন?
--মরেই যেতাম।
--এত ভালোবাসেন?
--হুম।
--আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরি?
--বাবারে, আজ নিজে থেকেই?
মামুনকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মিষ্টি নিজে থেকেই মামুনকে জড়িয়ে ধরে।
এই প্রথম মিষ্টি জড়িয়ে ধরায় মামুন লজ্জা পাচ্ছে।
মামুনকে জড়িয়ে ধরেই মিষ্টি কান্না করা শুরু করে।
মিষ্টির মুখটা উপরের দিকে তুলে আলতো করে চোখের পানি মুছে দেয় মামুন।
--এই পাগলি, কাঁদছো কেনো?
--আমি খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম। ভেবেছিলাম আমি বুঝি আর কখনো আপনাদের কাছে ফিরে আসতে পারবো না।
--এমনটা কি হতে পারে? তুমি না ফিরলে আমরা কি করে থাকতাম হ্যা? তুমি তো এখন এই পরিবারের একটা বড় অংশ। না চাইলেও তোমায় ফিরতে হতো, শুধু আমাদের জন্য।
--সত্যিই কি আমার ভাগ্যে এত ভালোবাসা ছিলো?
--তোমায় তো কেউ এমনি এমনি ভালোবাসেনি। এই ভালোবাসা তুমি জয় করে নিয়েছো।
--একটা কথা বলি?
--হ্যা বলো না।
--ভালোবাসি।
--শুনি নি।
--ভালোবাসি।
--শুনতে পারছি না, আরো জোরে বলো।
-যাহ, বলবো না আর।
--আর একবার বলো প্লিজ।
--আপনাকে আমি খুব খুব ভালোবাসি।
--আমিও।
--বিয়েটা কেনো পেছালেন? আমার আর দেরি সহ্য হচ্ছে না।
--ওমা, এত তাড়া?
--হুম।
--বিয়ের শপিংই তো করা হলো না, কাল আবার যাবে?
--শপিংয়ে?
--হুম।
--আচ্ছা।
ভালোয় ভালোয় পুরো দিন কেটে যায়। পরদিন সকালে মামুন আর মিষ্টি আবার বিয়ের শপিংয়ের জন্য বের হয়।
রিয়ার স্কুল থাকায় মামুন আর মিষ্টিকে একাই বের হতে হয়।
বাসার বাহিরে বের হয়ে দেখে সেই লোকটা আজ আবার বাসার সামনে দাড়িয়ে আছে। যে প্রতিদিন এখানে দাড়িয়ে বারান্দার দিকে তাকিয়ে থাকতো।
মামুন আর মিষ্টিকে গেইট দিয়ে বের হতে দেখে লোকটা তাদের দিকে এগিয়ে আসে।
--কেমন আছেন ভাই?
--তুমি আজও এসেছো? কি চাই?
--না ভাই, আজ জ্বালাতে আসি নি। একটা কথা জিজ্ঞেস করতে আসলাম।
--কি কথা?
--ভাবিকে জিজ্ঞেস করতাম।
মিষ্টি লোকটাকে এই প্রথম দেখলো।
মামুনকে উদ্দেশ্য করে মিষ্টি বলে ওঠে।
--কে উনি?
--জানি না। শুনো কি বলে।
--হ্যা বলুন কি বলবেন।
মিষ্টির অনুমতি পেয়ে লোকটা মিষ্টির সামনে এসে দাড়ায়।
--আপনি আমাকে কখনো দেখেন নি?(লোকটা)
--নাতো।
--আমি প্রতিদিন এখান থেকে আপনাকে দেখতাম।
--ওই মিয়া, কি বলতে আসছো সেটা বলো।(মামুন)
--আচ্ছা উনি কি আপনার স্বামী?
লোকটার এমন প্রশ্নে মিষ্টি একটু অবাকই হয়। কে এই লোক, হঠ্যাৎ কেনই বা এমন প্রশ্ন করছে।
মামুন মিষ্টির উত্তরটা শোনার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে মিষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে। মিষ্টিও ঘুরে মামুনের দিকে তাকায়। একটুখানি ভেবে লোকটাকে জবাব দেয়।
--জ্বি, উনি আমার স্বামী। কেনো?
--উনি বলেছিলেন তখন আমার বিশ্বাস হয়নি। তাই আবার এলাম জিজ্ঞেস করতে।
--এই যে ভাই, এবার তো বিশ্বাস হয়েছে? এবার যান।(মামুন)
লোকটা আর কোনো কথা না বলে উল্টোদিক ঘুরে সোজা হাটা দেয়।
--কে এই লোকটা?
--কি জানি, তোমাকে পছন্দ করে।
--আমাকে? কিভাবে? আমি তো চিনিই না।
--যখন বারান্দায় আসতে, সে এখান থেকে উকি দিতো।
--ধুর, চলুন তো।
--চলো।
শপিংমলে প্রবেশ করে মিষ্টি নিজে পছন্দ করে করে কাপড় দেখছে। পুরো দিন শেষ করে মামুনের জন্য, নিজের জন্য, মায়ের জন্য, রিয়ার জন্য, সবার জন্যই মিষ্টি পছন্দ করে কাপড় নেয়।
বাসায় ফিরে সানু বেগমের সামনে সব কাপড় রেখে দেয় মিষ্টি। সানু বেগম আর রিয়া মিষ্টির পছন্দ দেখে খুব খুশি হয়।
ধীরেধীরে বিয়ের দিনক্ষণ এগিয়ে আসে।
বিয়ের আগে থেকেই মিষ্টি পুরো সংসারের দায়িত্ব নিয়ে নেয়। শুধু মামুনের সাথে একরুমে থাকা হয় না।
তখন রাতের প্রায় ১১টা.. মিষ্টি ছাদে গিয়ে বসে আছে। সারা বাড়ি খুজে মিষ্টিকে না পেয়ে মামুনও ছাদে চলে আসে।
--তুমি এখানে, আর আমি তোমাকে পুরো বাড়ি খুজতে খুজতে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম।
--ওমা, কেনো?
--ভাবলাম বিয়ের আগে বুঝি পালিয়ে গেলে।
--ধুর, কি বলেন এসব। এদিকে আসুন।
মামুন এগিয়ে গিয়ে মিষ্টির পাশে বসে। সুযোগ বুজেই মিষ্টির কোলে মাথা রেখে শুইয়েও পড়ে।
--কি করছেন? মা এসে পড়লে?
--মা ঘুমিয়ে গেছে।
--রিয়া এসে পড়বে।
--আসবে না।
--তবুও
--এত ভয় পাও কেনো হ্যা? আজতো এভাবে এখানেই ঘুমিয়ে যাবো।
--তো আমাকে এভাবে বসে থাকতে হবে?
--হুম।
--ইসসসস, শখ কত।
--পারবে না বুঝি?
--পারবো। আচ্ছা একটা কথা বলি?
--বলো।
--বিয়ের পর আমরা এভাবে ছাদে এসে গল্প করতে পারবো?
--ভালো লাগে বুঝি?
--খুব, দেখুন না চাঁদের আলোয় চারদিকটা কত সুন্দর লাগছে।
--লাগবেই তো। চাঁদ যে আজ দুইটা উঠছে।
--দুইটা কই পেলেন?
--একটা ওই যে ওপরে।
--আরেকটা কই গেলো?
--যায়নি তো, আমি তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি।
--ইসসসসসস.
চলবে....
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com