গল্প - প্রিয় তুই । পর্ব - ০১
তুই আমার দেবর তিতাস! তাছাড়া আমার চেয়ে গুনে গুনে চার বছরের ছোট। তোর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, চলে যা তুই।'
কথাটা বলে ভোর দ্রুত পায়ে প্রস্থান করল। তিতাস চায়লেও আর কিছু বলতে পারল না।
নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বিশ্রী এক পরিস্থিতিতে আঁটকে গেছে সে। কিছুতেই এই পরিস্থিতি
সামলে উঠতে পারছে না। লাজ-লজ্জা ভেঙে নিজে ভোরকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে এসেছে। যাকে বিগত তিনমাস আগে সে বড় ভাবির আসনে বসিয়ে সন্মান করে এসেছে।অথচ আজ!
আর না তাকে এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতো।
ভোরের গমন পথে একবার তাকিয়ে তিতাসও ভোরের বাসা থেকে বেরিয়ে গেল।
যা বলার ভোর তো বলেই দিয়েছে আর দাঁড়িয়ে বা কী হবে!
ভোরের বাবা-মাও কিছু বলতে পারলেন না। শুধু নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
ভোর উনাদের একমাত্র মেয়ে। উনারা সর্বদা মেয়ের সিদ্ধান্তকে আগে গুরুত্ব দেন।
যা এতকাল হয়ে এসেছে। কারণ ভোর কখনো উনারা অসন্তোষ এমন কাজ করে নি,
হয়তো করবেও না। তাছাড়া ভোর খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে।
যা করবে অবশ্যই ভেবে চিন্তে করবে।
পূর্বে যেমন উনারা ভোরকে জোরপূর্বক কিছু চাপিয়ে দেন নি, এই পরিস্থিতিতেও দিবেন না।
তিতাস বেখেয়ালিভাবে হাঁটছে ফুটপাতের রাস্তা ধরে।
চঞ্চল প্রাণবন্ত ছেলেটা এই তিনটে মাসে কেমন চুপসে গেছে।
ওর না আছে খাওয়া-দাওয়ার ঠিক-ঠিকানা আর না ঘুম।
বাসার যা পরিস্থিতি কোনোটাই ঠিকঠাক হচ্ছে না।
তাছাড়া বিয়েতে যদি ভোর মত দিতো হয়তো পরিস্থিতি কিছুটা সামলে উঠতে
পারত। কিন্তু তা তো হচ্ছে না! সত্যি বলতে, ভোরের'ই বা কী দোষ? সেও মানুষ।
তারও মন বলে কিছু আছে। ওর নেওয়া সিদ্ধান্তটা যথেষ্ট যুক্তিযুক্তি'ও।
এসব ভেবে তিতাস আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
বুকে জমায়িত অপ্রকাশিত কথাগুলোও যদি এভাবে উড়িয়ে দেওয়া যেতো তাহলে বেশ হতো।
অন্তত প্রতিটা সেকেন্ডে টেনশনের হাত থেকে রেহাই পেতো।
তিতাস ফোনে সময় দেখে একটা পার্কে গিয়ে বসল।
কেবল পাঁচটা বিশ বাজে।
আগে এই সময়েই বন্ধুদের আড্ডা নয়তো প্রিয় বাইকটা নিয়ে দিক-বেদিক ছুটতো।
পড়াশোনার অবসরে এই দু'টোই তার পছন্দের কাজ।
কতই না মধু ছিল সে দিনগুলো! হঠাৎ দমকা হাওয়ার মতো পিয়াসের সিদ্ধান্ত
পরিস্থিতিটাই বদলে দিলো। ধূলিসাৎ করল তাদের রঙিন স্বপ্ন।
পিয়াসের সঙ্গে ভোরের বিয়েটা দুই পরিবারের সিদ্ধান্তে হয়েছিল।
তাছাড়া ভোর আর পিয়াস সেইম বেচের। দু'জন ডাক্তারী পাশ করে নিজ নিজ কর্মে নিয়োজিত।
তবে তাদের মধ্যে প্রণয় ঘটিত সম্পর্ক ছিল না।
কাছের এক আত্মীয়ের মাধ্যমে এই বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল।
তবে ভোর আর তিতাস ছিল পূর্ব পরিচিত। ওদের সম্পর্ক ভীষণ মধুর ও
খুনসুটিময়। মূলত, ওদের পরিচয় হয়েছিল হাস্যকর ঘটনার মাধ্যমে।
যা এখনো তাদের মস্তিষ্কে গেঁথে রয়েছে। তিতাসও মেডিকেলের ছাত্র।
মেধাবী একজন স্টুডেন্ট। তার ইন্টার্নশীপ বর্তমানে চলমান।
দেখতে ভদ্র হলেও সে বেশ চঞ্চল প্রকৃতির। এবং চঞ্চলতার দিক থেকে বেশ জনপ্রিয়ও বটে।
একদিন বন্ধুদের উস্কানিতে ডেয়ার নিয়ে ভোরের কাছের বান্ধবীকে প্রেমপত্র পাঠিয়েছিল।
বয়সে ছোট হয়েও বড় আপুকে চিঠি দেওয়াতে ভোররা বেশ মজা নিয়েছিল।
এরপর ভোরের বান্ধবীরা ওকে দেখলেই ' ওগো, কলিজা শুনছো' বলে চেঁচিয়ে উঠত।
তখন ওদেরকে দেখে তিতাস মুখ কুঁচকে এড়িয়ে যেতো। যেখানে দেখা হতো,
সেখানেই তিতাসকে পচাঁতে থাকত তারা।পিয়াস এ ঘটনাটা শুনে হেসে বলত, 'ভাই,
ওই দেখ তোর কলিজার দল আসছে।'
একথা শুনে তিতাস বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে পালিয়েও যেতো।
অবশেষে, ভোরের বান্ধবীদের হাত থেকে রক্ষা পেতে তিতাস ভোরকে ডেয়ারের ব্যাপারটা জানায়।
তারপর তিতাস ওদের থেকে রেহাই পায়। তখন থেকে সে ভোরকে চিনে।
তবে ওকে একা দেখলে ভোর খোঁচা মারতে ভুল করত না।
প্রত্যুত্তরে তিতাস শুধু হাসত। মূলত এভাবেই ওদের পরিচয় হয়েছিল।
এছাড়াও ভোর দেখতে নজরকাড়া এবং বেশ ভদ্র।
পিয়াসের সঙ্গে ভোরের বিয়ের কথা শুনে সেও মত দিয়েছিল।
সবকিছু ঠিক-ঠাক হওয়াতে ওদের বিয়েও সম্পূর্ণ হয়েছিল।
তিতাস কতো হাসি-ঠাট্টাও করেছিলো এইসব নিয়ে।
তারপর বিয়ের কার্য শেষে ভোরকে ওদের বাসায় নিয়ে যাওয়ার পরপরই পিয়াস আত্মহত্যা করে।
ভোর তখনো একরাশ রঙিন স্বপ্ন নিয়ে ড্রয়িংরুমে আত্মীয়দের মধ্যে বসে ছিলো।
সবাই তখন নতুন বউ দেখতে ব্যস্ত। হৈচৈ- চেঁচামেচির আমেজে পরিপূর্ণ ছিল চারিপাশ।
হঠাৎ পিয়াসের বন্ধুদের চিৎকার শুনে সবাই সেদিকে ছুটে যায়।
এবং গিয়ে দেখে পিয়াস আর নেই। তার দেহখানা প্রাণ ত্যাগ করেছে কিছুক্ষণ আগে।
সমস্যা থাকলে তার সমাধান রয়েছে তাই বলে আত্মহত্যা! তাও বিয়ে করে!
তখনকার সেই শোকাহত মুহূর্তে সবাই যখন পিয়াসকে নিয়ে ব্যস্ত,
তখন কয়েকজন মহিলা ভোরকে সাদা শাড়ি পরিধান করিয়ে দেন।
ওটাই নাকি ভোরের উপযুক্ত পোশাক। ভোরও তখন কিছু বলে নি শুধু নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।
মূলত কিছু বলার মতো অবস্থাতে সে ছিল না।
এরই মধ্যে কেউ বা কারা তাকে তুলল অপরাধীর কাঠগড়ায়।
ওর শরীরে লেপ্টে দিলো অলক্ষী এবং অপয়া তকমা।
সেই মুহূর্তে থেকে ভোর যেন পাথরে পরিণত হয়েছে। কোনো অনুভূতি কাজ করে না ওর মধ্যে।
এই অবধি ঠিক ছিল কিন্তু তিতাসের মা ভোরের এই অবস্থা মানতে পারেন নি।
ছেলের শোক এবং ভোরের কথা ভেবে ব্রেণ স্টোক করেন।
বর্তমানে উনি শয্যাশায়ী। প্রায় ছয়মাস যাবৎ হসপিটালে দিন কাটছে উনার।
দিনকে-দিন অবস্থাও বেগতিক হচ্ছে।
তবে এ অবস্থা হওয়ার আগে উনি ভোরকে সঙ্গে তিতাসের বিয়ের প্রস্তাবও পাঠিয়েছিলেন।
কারণ পিয়াসের ভুল সিদ্ধান্তের জন্য একটা মেয়ের জীবন নষ্ট হয়ে গেছেন।
এই অনুতাপে সর্বদা অস্থির থাকতেন।
খোঁজ নিয়ে জেনেওছিলেন, কেউ বা কারা অপয়া লক্ষী বলাতে ভোর আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল।
ভাগ্যেক্রমে তার ছোট ভাই জানালা দিয়ে দেখে ফেলাতে সে বেঁচে যায়।
এভাবে তো আর কারো জীবন চলে না।
এই সমাজের কিছু নিকৃষ্ট মানুষ তাকে ভালো থাকতে দিবে না।
তাকে বারংবার মনে করছি দিবে এবং দিচ্ছে সে অপয়া, লক্ষী।
এজন্য বিয়ে করে ঘন্টা খানিক পেরোতে না পেরোতেই বরকে খেলো।
না হলে এমন হবে কেন? এসব ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন উনি তিতাসের সঙ্গেই ভোরের বিয়ে দিবেন। উনাদের এক ছেলের জন্য ভোরের জীবন অগোছালো হয়েছে৷
আরেক ছেলেকে দিয়ে সব ঠিক-ঠাক করবেন।
তিতাসকে তখন নিশ্চুপ দেখে সম্মতি আছে ধরে নিয়েছেন।
কিন্তু উনাদের পরিকল্পনা বৃর্থা করে ভোর নিজেই প্রস্তাবে নাকচ করে দেয়।
এভাবে এতদিন অতিবাহিত হয়েছে।
কিন্তু গতকালরাত থেকে মায়ের অবস্থা আরো খারাপ হওয়াতে তিতাস নিজে ছুটে এসেছে,
ভোরের কাছে। একে তো ভোর সম্পর্কে ওর ভাবি তার উপরে বয়সে বড়।
তবুও সে পরিবকরের কথা ভেবে মেনে নিয়েছে। কিন্তু ভোর! সে তো নিজের সিদ্ধান্তেই অটল।
তবে তিতাসও হার মানার পাত্র নয়।
যেখানে ওর প্রাণপ্রিয় মায়ের কড়া আদেশ অবধারিত সেখানে আর কোনো কথায় থাকতেই পারে না।
থাকলেও সে তোয়াক্কা করবে না।
এসব ভেবে তিতাস পার্ক থেকে বেরিয়ে ভোরের চেম্বারে চলে গেল।
কিছুক্ষণ আগেই ভোর এখানে এসেছে। এখন রোগী দেখতে ব্যস্ত।
একে একে সব রোগী দেখা হলে তিতাস এবার
চেম্বারে ঢুকে ভোরের মুখোমুখি বসল। সামনে থাকা স্বচ্ছ কাঁচের গ্লাস থেকে পানি পান করল।
হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখ মুছে এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিলো। যেন চেম্বারটা তার।
তখন ভোর স্বাভাবিকভাবে বলল,
-'' কিছু বলবি?"
-''পড়া ফেলে এখানে নিশ্চয়ই খেজুরেআলাপ করতে আসি নি।"
-'' তাও ঠিক।"
-''পুনরায় বলছি, আম্মুর প্রস্তাব মেনে নাও।"
-'' পুনরায় জানিয়ে দিচ্ছি, না, না, এবং না।''
-"কেন?"
-" উফ, আর কতবার বলব তিতাস। তোকে সেভাবে ভাবতেই পারব না আমি।
তাছাড়া বয়সেও ছোট তুই।"
-" বয়ঃসন্ধির পর কোনো ছেলেই আর ছোট থাকে না।
আর আমি তো বয়ঃসন্ধি পেরিয়ে টগবগ যুবক, তাহলে?"
তিতাসের কথা শুনে ভোরের মুখটা থমথমে হয়ে গেল।
ভোর রেগে কিছু বলতে উদ্যত হলে তিতাস ইশারায় ওকে থামিয়ে দিলো।
তারপর সঙ্গে করে আনা রিপোর্টগুলো দেখিয়ে অতি শান্ত কন্ঠে বলল,
-''বায় চান্স, আম্মুর কিছু হলে আমিও তোমাকে ছেড়ে কথা বলব না, ভোর চৌধুরী। "
চলবে.....!!
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com