Breaking News

গল্পঃ আমি ফুলি


ছোটবেলায় থেকেই আমার খুব শখ ছিলো জ্বিন দেখার। ছোট বেলা দাদুর কাছে অনেক জ্বিন ভূতের গল্প শুনেছি তবে আমি কখনো এদের বাস্তব অস্তিত্ব দেখতে পাইনি।

তাই কৌতুহল বশত জ্বীন, ভূত দেখার জন্য আমার এবারের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে যাওয়া।
২০০৬ সাল। আমি সবেমাত্র এইচ এস সি পরীক্ষা দিয়েছি। দীর্ঘ দিন ছুটি কাটাতে আমি দাদু বাড়িতে যাওয়ার উদ্দেশ্য রওনা হলাম।
আমার দাদুুর বাড়িটা হচ্ছে বেগমগঞ্জ উপজেলার একটা ছোট্ট গ্রামে।
সবুজ শ্যামলে গাছপালা বেষ্টিত আমাদের গ্রাম। গ্রামের মানুষ গুলোও বেশ সহজ সরল। কৃষিকাজ করেই তারা জীবিকা নির্বাহ করে। রাস্তাঘাট এখনো কাঁচা।
আমার দাদুর বাড়ি ছিলো দোতলা পাকা দালান। এমন বাড়ি পুরো গ্রামে একটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
গ্রামে রয়েছে বেশ কিছু জমিদার বাড়ি।
কিছু অভিশপ্ত জঙ্গল। একটা নদী ও বেশ কিছু অলৌকিক দিঘী।
আমার ছোট বেলার বন্ধু ছিলো কালু শেখ।
এখন বেশ বড় হয়ে গেছে সে। বাড়ি পৌঁছে ফ্রেস হয়ে লম্বা একটা ঘুম দিলাম। বিকালে কালুর সাথে ঘুরতে বের হলাম। কালুর সাথে ছোটবেলার গল্পে মেতে উঠলাম আমি।
আমি কালুকে আমার জ্বিন, ভূত দেখার ইচ্ছেটা জানালাম। সে বিষয়টা হেসে উড়িয়ে দিলো। কালু এ যুগে এসে এসবে বিশ্বাসী নয়।
তার কথায় আমিও সাঁই দিলাম।
কালু আমাদের গ্রামের কিছু ভৌতিক জায়গায় নিয়ে গেলো আমায়। প্রথম গেলাম ইচ্ছে দিঘীর পাড়ে। এই দিঘীর নাম ইচ্ছে দিঘী রাখা হলো কেনো? এ প্রসঙ্গে কালুকে জিজ্ঞেস করলে সে বলে;
এই দিঘিটা ৪০০ বছর আগে কোনো এক জমিদার খনন করেন। এই দিঘীটার বিশেষত্ব হচ্ছে, কেউ যদি সৎ উদ্দেশ্য মন থেকে সাহায্য চাই তাহলে এই দিঘী তার সে ইচ্ছেটা পূরণ করে। কারো কোনো জিনিস প্রয়োজন হলে এখানে এসে দিঘীর কাছে চাইলে সেটা পরেরদিন পাওয়া যেতো এবং প্রয়োজন শেষে সেটা ফেরৎ দিতে হতো। কেউ যদি সেটা চুরি কিংবা ফেরৎ না দেই তাহলে সে ধ্বংস হয়ে যায়। এই দিঘী সবার ইচ্ছে পূরণ করতো। তাই এই দিঘীর নাম দেওয়া ইচ্ছে দিঘী।
একদিন একটা যুবক এই দিঘীতে মাছ চুরি করতে আসে। পরেরদিন ঐ যুবককে দিঘীর পানিতে মৃত অবস্থায় ভেসে থাকতে দেখা যায়। তারপর থেকে এই দিঘী কারো ইচ্ছে পূরণ করে না। কালের বিবর্তনে মানুষের ব্যবহারের ফলে এই দিঘীর অলৌকিক ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়।
কালুর কথা শুনে আমার একটু মন খারাপ হলো। তারপর আমরা গেলাম একটা পুরাতন জমিদার বাড়িতে। তখন প্রায় সন্ধ্যা হতে লাগল। একটা সময় এই জমিদার বাড়িটা বেশ জাঁকজমক ছিলো। কিন্তু আজ আর কিছুই নেই এখানে। এই বাড়িটা নাকি অভিশপ্ত। তাই এখানে কেউ থাকে না। কেনো থাকে না কালুকে জিজ্ঞেস করলে বলে:
প্রায় অনেক বছর আগের ঘটনা। তখন এই গ্রামে জমিদার শাসন চলতো। জমিদার বাড়িতে কাজ করতো এই গ্রামের ই একটা মেয়ে নাম ফুলি। ফুলি দেখতে যেমন সুন্দরী তেমনি অপরূপা। তার এই সৌন্দর্যের মোহে পড়ে যায় জমিদারের একমাত্র ছেলে প্রদীপ।
ফুলিকে প্রেমের প্রস্তাব দেই প্রদীপ। ফুলি রাজি হয় না। কারণ সে জানে, রাজার সাথে প্রজার প্রেম ভালোবাসা মানাই না। তাছাড়া প্রদীপ ছেলেটার চরিত্রও অতোটা ভালো না।
সাধারণ গ্রাম্য একটা মেয়ে ফুলি। ভালো মন্দ অতো কিছু বুঝতো না।
অভাবের কারণে জমিদার বাড়িতে কাজ করতো সে। কিন্তু জমিদারের দুশ্চরিতের ছেলেটি একদিন রাতে তার বন্ধুদের নিয়ে ফুলিকে রাতভর ধর্ষণ করে মেরে ফেলে।
পরে সেটা আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়।
তারপরেই এই বাড়িটা অভিশপ্ত হয়ে যায়।
পরে ফুলির মৃত আত্মা এই বাড়িতে আসে এবং জমিদার বাড়ির সকলকে নির্মম ভাবে হত্যা করে তার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়। এই বাড়িতে নাকি তার আত্না এখনো ঘুরাঘুরি করে। অনেক মানুষ নাকি মাঝে মাঝে তাকে এই বাড়ির ছাদে নাচতে দেখে। আবার কেউ যদি মাঝরাতে এই বাড়ির আশেপাশে দিয়ে যায়,
তাহলে তারা একটা মেয়েলী কণ্ঠের গান শুনতে পাই। হয়তো এইটা ফুলির অতৃপ্ত আত্মা যা মানুষকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে।
তবে এসবে আমি বিশ্বাসী নয়। এসব ঘটনা আমার দাদু থেকে শোনা। তিনিও নাকি তার দাদু থেকে এসব শুনেছেন। কালের বিবর্তনে এসব মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে যায়।
আর সবশেষে আমরা গেলাম একটা বাগানে। অবশ্য বাগান না বলে জঙ্গল বললেও ভুল হবে না। চারপাশে ঘন গাছপালা বেষ্টিত। এই জঙ্গলটা নিয়েও নাকি অনেক ঘটনা ঘটেছে এই গ্রামে। তখন প্রায় রাত হয়ে গেছে। আমি আর কালু জঙ্গলের পথ ধরে হাঁটছি।
জঙ্গলটা ঠিক জমিদার বাড়ির পিছন থেকে নদী পর্যন্ত বিস্তৃত। কালু বলল: এই জঙ্গলটার দিকে মানুষ সচরাচর আসে না।
তবে আমি মাঝে মাঝেই আসি। এই জঙ্গলটা নাকি ভালো না। এখানে যদি কেউ দিনের বেলায় গৃহপালিত পশু গরু, ছাগল এসব বেঁধে রেখে যেতো সেগুলা আর খুঁজে পাওয়া যেতো না। পেলেও মৃত অবস্থায় পাওয়া যেতো।
একবারের ঘটনা, তখন গ্রামে অতো রাস্তাঘাট ছিলো না। নদী পথে মানুষ চলাচল করতো। আর জঙ্গলের পথ দিয়েই মানুষকে নদীর ধারে যেতে হতো। সেদিন এক নবদম্পতি বিয়ে করে রাত্রি বেলা এই পথ ধরে বাড়ি যাচ্ছিল। রাত্রি তখন অনেক গভীর। এই জঙ্গলটা পার হয়ে যখন বর ও বর যাত্রী নৌকা দিয়ে উপারে যাচ্ছিলো তখন নৌকাটা নদীর মাঝে খানে ডুবে যায়।
অনেক খুঁজাখুজি করেও তাদের লাশটাও খুঁজে পাওয়া যায় নি। তাছাড়া যারা ব্যবসা বাণিজ্য করতো তারাও মাঝ রাতে গঞ্জে থেকে এই জঙ্গলের পথ দিয়েই বাড়ি ফিরতো। আমার দাদু একবার রাত্র বেলা জঙ্গলের পথ দিয়ে ফিরছিলেন। এক হাতে ছিলো বেশ কিছু মাছ এবং অন্য হাতে ছিলো লণ্ঠন বা কুপিবাতি। কিন্তু আমার দাদুর এতো দিনের পরিচয় হওয়া সত্বেও মাঝপথে এসে তিনি জঙ্গলের পথটা হারিয়ে ফেললেন।
পেছন থেকে কেউ যেনো উনাকে ডাকছেন।
কিন্তু তিনি পেছন ফিরে না তাকিয়ে সোজা পথে হাঁটতে লাগলেন। হঠাৎ উনার সামনে এসে দাঁড়ায় একটা ভয়ংকর ও অদ্ভুত আকৃতির পেত্নী। যার শরীরে কোনো মাথা নেই। কাটা স্থান থেকে টকবগিয়ে রক্ত পড়ছে।
আমার দাদু ছিলেন যথেষ্ঠ সাহসী লোক।
তার কাছে মাছ চেয়েছিলো তিনি দিতে অস্বীকৃতি জানাই। এবং ঐ ভয়ংকর পেত্নীটার সাথে দাদুর ধস্তাধস্তি চলে অনেকক্ষণ। এক পর্যায়ে দাদু বাধ্য হয়ে মাছ দিয়ে দেই। পরেরদিন সকালে দাদুকে নদীর ঘাটে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া যায়।
জানি না কিভাবে তিনি বেঁচে গেলেন আজও সে রহস্য অজানা। তবে আমার দাদু ছিলেন একজন ঈমাণদার ও সৎ লোক। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করতেন।
এজন্য হয়তো পেত্নী টা দাদার কোনো ক্ষতি করতে পারে নি।
কালুর সাথে কথা বলতে বলতে আমরা প্রায়
মাঝ জঙ্গলে চলে এসেছি। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বেশ ঠান্ডাও পড়ছে। সোয়েটার টা নিয়ে আসলে বোধহয় ভালো হতো। পায়ের নিছে শুকনো পাতার মচমচ শব্দ আর ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না।
জায়গা আসলেই ভৌতিক। গাঁ ছমছম করার মতো পরিবেশ।
হঠাৎ কালু বলল,
তার নাকি চাপ পেয়েছে। তাই সে একটা গাছের আড়ালে গিয়ে কাজ সারছে। আমি দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। অনেকক্ষণ হওয়ার পরেও যখন কালু আসছে না তখন আমি তাকে ডাকতে লাগলাম। কালু কালু বলে বেশ কয়েকবার ডাকলাম। কোনো সাড়া শব্দ নেই। তাই বাধ্য হয়ে আমিই এগিয়ে গেলাম। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সেখানে কালুকে খুঁজে পাচ্ছি না।
সামনে তাকাতেই দেখি দূরে একটা মেয়ে খিলখিল করে হাসছে। দূর থেকে বুঝা যায় মেয়েটা যথেষ্ঠ সুন্দরী। কিন্তু এই জঙ্গলে এতো রাতে মেয়ে আসলো কৈত্থেকে। ভয়ে আমার হৃদপিন্ড কেঁপে উঠল।
হঠাৎ কাঁদের উপর একটা শীতল হাতের স্পর্শ পেলাম। মূহুর্তেই আমার শরীরে শিহরণ বয়ে গেলো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি কেউ নেই।
চিৎকার দিয়ে বললাম কে আপনি?
অপর প্রান্ত থেকে একটা সুরেলা কণ্ঠে আওয়াজ আসলো- আমি ফুলি!
চলবে....

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com