গল্পঃ আমি ফুলি । পর্ব - ০৩ এবং শেষ
সন্ধ্যার পর থেকেই আকাশটা মেঘলা হয়ে আছে। রাতে মনে হয় বৃষ্টি নামবে।
একটু পর অনেক ঝড় উঠল। হঠাৎ পরিবেশ শান্ত হয়ে গেলো।
মাঝরাতে কারো ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেলো আমার। কণ্ঠটা বেশ পরিচিত মনে হচ্ছে।
ঘুমের ঘোরে দরজা খুলে দেখি,
আমার সামনে হঠাৎ কালুকে দেখে আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম।
আমি কি ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছি ,
চোখ কচলে তাকালাম না তো ঠিকই দেখছি, এটা তো সত্ত্যিই কালু।
আমি কিঞ্চিত ভয়ার্ত কণ্ঠে বললাম, কালু তুই এখানে আসলি কেমনে?
কালু বলল: তুই না বলছিলি, তুই জ্বিন দেখতে যাবি।
চল আমার সাথে জমিদার বাড়িতে আজকে দুজন মিলে জ্বিন দেখবো।
আমি কালুর কথা শুনে বুঝতে পারলাম,
এটা কালু না, কালুর রূপ ধরা সেই ঘৌল জ্বিন। কালু তো গত রাতেই মারা গেছে।
আজ আমার জমিদার বাড়িতে যাওয়ার কথা।
আমি যায় নি তাই হয়তো কালুর রূপ ধরে আমাকে ডাকতে এসেছে।
কিন্তু এখন আমি কি করি। এখন কি কালুর
সাথে আমার জমিদার বাড়িতে যাওয়া উচিৎ হবে।
যদি এই খারাপ জ্বিনটা আমার কোনো ক্ষতি করে বসে।
আবার মনে হলো, সে যদি আমার ক্ষতি করার ইচ্ছে থাকতো তাহলে তো
গতকাল রাতেই আমার ক্ষতি করতে পারতো। যাবো কি যাবো না দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে গেলাম।
এরই মধ্যে কালুর ডাক, কিরে যাবি না। রাত তো প্রায় শেষ হয়ে আসলো।
আমি কালক্ষেপণ না করে চললাম কালুর সাথে।
যা হবার হবে, সাথে করে নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে ইমাম সাহেবের দেওয়া রক্ষা
কবজটা নিলাম। আর একটা টর্চ লাইট।
উদ্দেশ্য জমিদার বাড়িতে গিয়ে ফুলির আসল রহস্য বের করা।
আমি কালুর সাথে স্বাভাবিক মানুষের মতো আচরণ করলাম।
সে যদি বুঝতে পারে, আমি তাকে ভয় পাচ্ছি তাহলে বিপদ আমারই হবে।
ঝড়ের কারণে রাস্তা ঘাট হালকা ভিজে গেছে।
গাছ থেকে ঝরে পাতা পড়ে আছে সব জায়গায়।
জমিদার বাড়িটা আমাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে মানে ইচ্ছে দিঘীর পরেই।
ঘুটঘুটে অন্ধকার। কালুর সাথে টুকটাক কথা হচ্ছে।
গতকাল রাতের কথা বলতেই কালু কেমন যেন চুপসে গেলো।
চোখ গুলো কেমন গোলাটে থেকে হালকা নীল বর্ণ ধারণ করেছে।
আমি আর কথা বাড়ালাম না।
চুপচাপ হাঁটতে লাগলাম। দিঘীর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় লক্ষ্য করলাম,
দিঘীর উপর একটা যুবক ছেলের লাশ ভাসছে। হালকা চাঁদের আলোতে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি
দিঘীর উপর কি যেন ভাসছে। ভয়ে আমি রীতিমত কাঁপতে শুরু করছি।
কালুর দিকে তাকাতেই দেখি সে আমার দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
একটু আগে দেখলাম তার চোখ গুলো নীল আর এখন টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করেছে।
মনে হচ্ছে এই মূহুর্তে সে আমাকে গিলে ফেলবে। ভাগ্যিস আমার সাথে রক্ষা কবজ টা ছিলো।
কালু আমার থেকে যথেষ্ঠ দূরে দূরে অবস্থান করছে।
আমি পুকুরের দিকে টর্চ মারতেই দেখি সেখানে কেউ নেই।
হঠাৎ লাশটা কোথায় গায়েব হয়ে গেলো সেটাই ভাবছি আমি।
.
সামনে একটা বাঁশ বাগান। এর পরেই জমিদার বাড়ি। বিশাল বাঁশ ঝাড়।
অনেকদিন বোধহয় এখান থেকে কেউ বাঁশ কাটে না।
বাঁশ ঝাড়ের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় বাঁশ গুলো একটার সাথে
আরেকটা সজোরে আঘাত করছে।
আর জঙ্গল থেকে জোর গলায় হুতুম পেঁচার ডাক শোনা যাচ্ছে।
দাদুর কাছে শুনেছি, রাতের বেলায় নাকি পেঁচার ডাক শোনা ভালো না।
না জানি ভাগ্যে কি ঘটে তা ভেবেই আমার নাজেহাল অবস্থা।
জমিদার বাড়িতে ডুকতেই কিছু বাদুর মাথার উপর দিয়ে উড়ে চলে গেলো।
আমি ভিতরে প্রবেশ করলাম। পুরনো জমিদার বাড়ি। দেয়াল গুলো খসে পড়েছে।
চারিদিকে মাকড়শারজাল। না জানি কতো বছর মানুষ এই বাড়িতে আসে না।
ফুলির রহস্য জানতে যখন এতোটুকু এসেছি, তখন ভাবলাম পুরো জমিদার বাড়িটা একটু ঘুরে দেখি।
.
দোতালা সিস্টেমের বিশাল দালান। রুম গুলো বেশ বড় বড়।
হাঁটতে হাঁটতে আমি বাড়ির ভিতরে চলে গেলাম। কিন্তু পেছনে তাকাতেই দেখি কালু নেই।
দূর্ঘটনায় যদি মানুষের একটা হাত, পা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়,
তখন মানুষ যতটা ভয়ে পেয়ে কাঁপতে থাকে, আমিও ঠিক ততটাই ভয় পেয়ে কাঁপতে লাগলাম।
টর্চ জ্বালাতে যাবো এমন সময় দেখি টর্চ জ্বলছে না।
হঠাৎ দোতালা থেকে একটা সুলেরা কণ্ঠে মেয়ের গান শোনা যাচ্ছে।
এই গানের সুর আমাকে তার দিকে চম্বুকের ন্যায় আকর্ষণ করছে।
দোতালায় চলে গেলাম আমি। একটি রুমে আলো জ্বলছে।
আর সেই রুম থেকে গানের সুর শোনা যাচ্ছে।
সাথে মেয়েটি নাচ্ছেও। তার নূপুরের ঝঙ্কার আমার মনের
ভিতর একটা উত্তাল মহাপ্রলয় সৃষ্টি করছে। আমি তার রুমে উঁকি দিতেই সে
আমাকে দেখে একটা মুচকি হাসি দিলো।
ঠিক গতকাল রাতের মতোই মেয়েটির হাসি দেখে আমার সকল ভয়ভীতি দূর হয়ে গেলো।
এটাতো গতকাল রাতের সেই ফুলি মেয়েটা। সে আমাকে ডাক দিয়ে বলল:
ভয় পেও না। ভিতরে এসে বসো। আমি তোমার কোনো ক্ষতি করবো না।
শুধু তোমার কাছে আমি একটু সাহায্য চাই বন্ধু।
ফুলির আচরনে আমি বেশ পুলকিত হলাম।
তার উপর আবার বন্ধু বলে ডাকছে।
নাকি এসব তার ছলচাতুরী। আমাকে মেরে ফেলার ফাঁদ।
আমি ভিতরে গিয়ে বসে বললাম: বলো কি সাহায্য লাগবে তোমার?
ফুলি বলতে লাগল: আগে তোমাকে পুরো ঘটনা বলি। ভয় পেও না। আমি ফুলি নয়।
ফুলিকে তো অনেক আগেই জমিদার ও তার বন্ধুরা ধর্ষণ করে মেরে ফেলেছে।
আমি ফুলির একমাত্র গোলাম। আমি একটা মানুষ রূপী জ্বিন।
আমার নাম ইসফাত। মালিকের হুকুম পালন করাই আমার কাজ।
ফুলি আমাকে তার মন্ত্র জালে আটকে বশ করে রেখেছে।
মৃত্যুর আগে সে আমাকে হুকুম দিয়ে গেছে, জমিদারের বংশকে
ধ্বংস করে দিতে। কিন্তু জমিদারের বংশের সবাইকে তো আমি মেরে ফেলেছি তবুও কেনো আমার মুক্তি হচ্ছে না। তুমি আমাকে এই বন্দী দশা থেকে মুক্ত করো বন্ধু।
দাদুর মুখে শুনেছি জ্বিনদের কখনো বিশ্বাস করতে নেই। তবে তার কথা শুনে মনে হচ্ছে সে খুব বিপদে আছে। তার কথা আমার বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হলো।
আমি বললাম: ফুলি তোমাকে কিভাবে বশ করলো আর আমি তোমাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?
ইসফাত জ্বীন জবাব দিলো: ফুলির বাবা তন্ত্র, মন্ত্র সাধনা করতো। মানুষদের জ্বীন বা খারাপ কিছু গ্রাস করলে তিনি কবিরাজি চিকিৎসা করাতেন।সেখান থেকে ফুলি এসব শিখেছে।
আর জমিদারের ছেলে যখন তাকে ধর্ষন করে বিধ্বস্ত অবস্থায় ফেলে বাহিরে যায় ফুলি সে
সময়ে নিজের হাত কেটে রক্ত দিয়ে মন্ত্র পড়ে আমাকে ডাকে।
নিজের বশে এনে আমাকে জমিদারের বংশের সকলকে মেরে তার ওপর
করা অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে হুকুম দিয়ে যায়।
পরেরদিন জমিদারের ছেলে প্রদীপ ফুলিকে মেরে ঐ জঙ্গলে পুঁতে ফেলে।
সে থেকে ঐ জঙ্গলে কেউ একা একা গেলে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
দ্বিতীয়ত হচ্ছে, জমিদারের বংশের কেউ না কেউ এখনো বেঁচে আছে।
তোমার কাজ হচ্ছে তাদের খুঁজে বের করা। তাদের মেরেই আমার চির মুক্তি।
আমি বললাম: কিন্তু আমি তাদের খুঁজে পাবো কোথায়?
জবাবে সে বলল: তুমি যে করেই হোক তাদের খুঁজে বের করবে।
না হলে তুমি সহ গ্রামের সকলের অনেক বড় ক্ষতি করে ফেলবো।
আমি তার কথায় রাজি হলাম। এছাড়া আমার কোনো উপায় নেই।
তাকে প্রশ্ন করলাম: আচ্ছা গতকাল রাতে আমার বন্ধু কালুকে হত্যা করলো কে?
জবাবে সে বলল: কালু আমার হাতেই মারা গেছে।
আমি : কিন্তু কেনো তাকে মারলে?
সে: আমি এমনি এমনি কাউকে মারি না। কালু ছেলেটার চরিত্র ভালো না।
আমি প্রায় রাতেই নদীর ঘাটে ঘুরতে যায়। কালকেও গেলাম।
হঠাৎ কালু নামের ছেলেটাকে দেখলাম আমার দিকে এগিয়ে আসতে।
আমার রূপ সৌন্দর্য দেখে কালু নিজেকে ঠিক রাখতে পারে নি।
তার মনে কামনার ঝড় বয়ে গেলো। সে আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ে।
আর কালুর এই দুশ্চরিত্রের কারনেই তার মৃত্যু হয়।
আমি: তাই বলে এতো নির্মম ভাবে!
প্রত্যুত্তরে সে চুপ করে রইলো।
আমি তোমার আসল রূপ দেখতে চাই।
সে: আমার আসল রূপ দেখলে তুমি ভয় পাবে?
আমি: না ভয় পাবে না, ভয় পেলে কি আমি এতো রাতে এখানে আসতাম না।
সে: তাহলে তোমার শরীরে ঐ তাবিজটা খুলে ফেলো।
না হলে আমি তোমার সামনে আসতে পারবো না।
তার কথা মতো আমি তাবিজ খুলে বাহিরে ফেলে দিলাম।
আর মূহুর্তের মধ্যেই ফুলি নিজের রূপ চেঞ্জ করে আসল রূপে রূপান্তরিত হলো।
তার চেহেরা দেখে আমি ভয়ে আঁতকে উঠি।
স্বাভাবিক মানুষ থেকে বেশ লম্বা। সুঠাম দেহ ও কুৎসিত চেহেরা। চোখ দুটো টকটকে লাল বর্ণের।
হাতের নখ গুলো প্রসস্থ। মুখে সরু সুচালো দুটি দাঁত।
চুল গুলো সাদা। সবকিছু প্রায় মানুষের মতো। তবে আকৃতি একটু ভিন্ন।
জ্বীনটা বেশ ফুলে ফেঁসে ফোস ফোস করতে করতে একটা গর্জন ছাড়ল।
ধীরে ধীরে সে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো।
পরেরদিন সকালে আমাকে জমিদার বাড়ির সামনে থেকে মূমুর্ষ অবস্থায় উদ্ধার করা হলো।
শরীরে প্রচন্ড জ্বর আসলো।
পুরো শরীরে অসংখ্য আঁচরের দাগ। প্রায় এক সপ্তাহ আমি অসুস্থ ছিলাম।
পরবর্তীতে ইমাম সাহেবকে ডেকে আমাকে আরেকটা তাবিজ দেওয়া হয়।
ভয়ের কারণে আমার জবান বন্ধ হয়ে যায়।
পরে ইমাম সাহেব ঝাঁড় ফুক করে স্বাভাবিক ও সুস্থ করে তোলে।
সবাই আমাকে অনেক বকাবকি করলো;
আমি কেনো রাত্রের বেলা জমিদার বাড়িতে গেলাম। ঐ বাড়িটা তো ভালো না।
সেদিন রাতে কি হয়েছিলো সব আমি ইমাম সাহেব কে খুলে বললাম।
শেষে ফজরের আযান পড়ার কারণে জ্বিনটা আমাকে মারতে পারে নি।
কিন্তু যাওয়ার সময় আমাকে দোতালা থেকে নিছে ফেলে দেয়।
যার ফলে আমার কোমরের হাড়ে ভীষণ আঘাত প্রাপ্ত হয়।
এতোদিন সবাই জমিদার বাড়ির বিষয়টা কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিতো।
কিন্তু এর পর থেকে ঐ দুষ্ঠু জ্বীনের উৎপাত গ্রামে অনেক বেড়ে যায়।
গ্রামের মানুষ ভয় দেখানো সহ অনেক ক্ষতি করতে শুরু করে।
কিন্তু অনেক খোঁজ করেও জমিদারের বংশের কেউ বেঁচে আছে কিনা তা জানা যায় নি।
শতবছর আগের ইতিহাস তো কারো মনে থাকার কথা না।
পরিশিষ্ট : এই দুষ্টু জ্বীনটা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে, বিভিন্ন রূপ ধরে
ছলচাতুরী করে মানুষকে তাঁর ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করে।
যে তার ফাঁদে না বুঝে পা দিতো সে তার হাতে মারা পড়তো। তাই গ্রামের সকল মানুষ মিলে ঐ জমিদার বাড়িতে যায়। এবং ইমাম সাহেব ঐ দুষ্টু জ্বীনটাকে বোতলে বন্দী করে মেরে ফেলে।
মৃত্যুর সময় জ্বীনটা অনেক কান্না ও আকুতি মিনতি করছিলো তাকে বাঁচানোর জন্য।
যেটা কেবল আমি আর ইমাম সাহেব ছাড়া কেউ দেখে নি।
আর এখনে শেষ হলো ফুলির মৃত্যুর রহস্য।
অবশেষ জ্বিন দেখার এক অবিভূত অভিজ্ঞতা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম আমি।
.
<>সমাপ্ত<>
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com