তবু মনে রেখো । পর্ব - ০২
পুষ্পিতার গায়ে এখনও সেঁটে আছে বিয়ের জমকালো শাড়ি। সে ম্লান মুখে ডান হাতের কনুই সোফার হাতলে রেখে, করতল বদ্ধ করে থুতনিতে ঠেকিয়ে বসে আছে।
ইমাদ করিডর পেরিয়ে ইমার কামরার সামনে দিয়ে যাচ্ছিল।
দরজার কাছে আসতেই লাল পর্দা গলে ভেতরে চোখ গেল।
বিষণ্ণ মনে আলো ছড়ানো ঝলমলে পোশাকে বসে আছে পুষ্পিতা৷ এ এক নান্দনিক দৃশ্য।
কোনো এক শিল্পী যেন পরম যত্নে এঁকেছে তাকে।
বিষণ্ণতা যেন ওই মুখশ্রীর আরও বেশি জৌলুশ বাড়িয়ে দিয়েছে।
অনাবিষ্কৃত গলিতে কেমন অন্যরকম অনুভূতি হলো; যেন 'ওম ওম' উষ্ণ অনুভূতি।
তার পা দু'টো দরজা পেরিয়ে গেলেও মন থেকে গেল বিষণ্ণ বালিকারা কাছে।
ইচ্ছা করছে পুনরায় গিয়ে ভালো করে দেখতে। ওর মন কি ভীষণ খারাপ?
টেবিলে খাবার দিয়ে সবাইকে ডেকে আনে ইমা।
হায়দার সাহেব এসে পুষ্পিতার পাশের চেয়ার খালি দেখে বললেন,
- 'বাবা ইমাদ, তুমি বউমার পাশে গিয়ে বসো, যাও।
তোমার মা আজ বেঁচে থাকলে এগুলো আমার খেয়াল করতে হতো না..।'
কথা শেষ করার আগেই ইমাদ পুষ্পিতার পাশের চেয়ারে চলে গেল।
হায়দার সাহেব হৃদয়ে কিঞ্চিৎ ব্যথা পেলেন।
বলার সাথে সাথেই চলে যাবে, এতটাও বাধ্যগত সন্তান তিনি আশা করেননি।
এই প্রথম অনুভব করলেন পুত্র খুব বেশি অনুগত হলেও মুশকিল।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি চেয়ার টেনে বসলেন।
ইমা সবার সামনে প্লেট দিয়ে বললো,
- 'সকলের একসঙ্গে একটা ছবি তুলি বাবা।
হায়দার সাহেব সম্মতি দিয়ে বললেন,
.
'হ্যাঁ ছবি তুলো, বউমা প্রথম এবাড়িতে খাবার খাচ্ছেন। এটা স্মরণীয় করে রাখা দরকার।
একটা কথা মনে রাখবা, ডায়েরি আর ছবি ভবিষ্যতে হয়ে যায় ইতিহাস। হা হা হা।'
কেউ সঙ্গে হাসলো না। তবে ইমা বললো,
- 'আমাদের বাড়িতে সে আগে কয়েকবার খেয়েছে বাবা।'
- 'ও আচ্ছা, তাই না-কি।'
ইমা তার ভাইকে বললো,
- 'ভাইয়া তোমার মোবাইল দাও আমার ফোনে ছবি ভালো উঠে না।'
ইমাদ পকেট হাতড়ে বললো,
- 'রুমে গিয়ে দেখ।'
ইমা তাড়াতাড়ি গিয়ে মোবাইল নিয়ে এলো।
- 'লক খুলে দাও।'
ইমাদ লক খুলে মোবাইল এগিয়ে দেয়। ইমা সামনে গিয়ে সেল্ফি তুলে একটা।
তারপর ভাই-ভাবির দিকে তাকিয়ে বলে,
- 'দুইজনের মাঝখানে ভারত-পাকিস্তানের কাঁ'টাতার না-কি? কাছাকাছি হও।
ভাইয়া তুমি ভাবির পিঠের দিকে হাত নিয়ে কাঁধে রাখো তো।'
হায়দার সাহেব পুত্রকে মুখে বাঁধা না দিলেও অস্বস্তিতে ফেলার জন্য তাকিয়ে রইলেন।
ইমাদ আমতা-আমতা করে বললো,
- 'আরে থাক না।'
ইমা দাঁত কটমট করে তাকিয়ে নিজে এগিয়ে গিয়ে হাত ধরে বললো,
- 'তুমি ধরো তো আপু, অহ স্যরি, আপু না ভাবি হবে। তুমিই হাত নিয়ে ধরো তো ভাইয়াকে।'
তারপর সে নিজেই পুষ্পিতার হাত টেনে নিয়ে ভাইয়ের কাঁধে দিল। পুষ্পিতা লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলে।
ইমা ক্যামেরা থাক করে বললো,
- 'আরে এদিকে তাকাও না বাবা।'
পুষ্পিতা চোখ তুলে তাকায়। ইমা সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি ছবি তুলে নিল।
- 'মোবাইল নাও ভাইয়া।'
.
ইমাদ মোবাইল রাখলো তার প্লেটের পাশে। পুষ্পিতার প্লেটে ভাত দিল ইমা।
ঠিক তখনই বিদুৎ চলে গিয়ে চারপাশে ঘন আঁধার নেমে এলো।
হায়দার সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন,
- 'কিযে হলো, এত বিদ্যুৎ নিচ্ছে কেন আজকাল।'
ইমাদ মোবাইলের বাতি জ্বালিয়ে বললো,
- 'সরকারের বিদ্যুৎ সাশ্রয় কর্মসূচী চলছে বাবা।'
- 'সেটা আবার কি?'
.
- 'করোনা আর ইউক্রেন রাশিয়ার যু'দ্ধের কারণে না-কি অর্থনৈথিক সমস্যা দেখা দিছে দেশে।'
- 'চু'র বা'টপাররা দেশটারে লু'টে-পু'টে খেয়ে এখন যু'দ্ধ আর করোনার দো'ষ দিচ্ছে।
দেশটা রসাতলে গেল। সবকিছুর দাম বেড়ে আ'গুন।
এবার ইদে কাপড়ও বেশি বেচা-কেনা হলো না।
মানুষ খেতে পারছে না, কিনবে কি।'
- 'বাবা কর্মচারী বাদ দিলে হয় না। এখন থেকে আমি ফুল টাইম থাকলাম।'
- 'দু'দিক একা সামলানো মুশকিল হবে।'
ইমা গিয়ে চার্জার বাতি নিয়ে এসেছে। হায়দার সাহেব বললেন,
- 'বউমার দিকে রাখো বাতি।'
.
ইমা বাতি রেখে খেতে বসলো। খাবার পর্ব শেষ হওয়ার পর হায়দার সাহেব রুমে চলে গেলেন।
পুষ্পিতা কি করবে বুঝতে পারছে না৷ অন্ধকারে কি ইমার ঘরে গিয়ে বসে থাকবে?
ইমাদ রান্নাঘরে মোবাইলের বাতি জ্বালিয়ে রেখে এসে বোনের সাহায্যের জন্য টেবিল থেকে
প্লেটগুলো নিয়ে যায়। পুষ্পিতা খানিকটা অবাকই হলো।
পুরুষ মানুষকে সচরাচর এগুলো করতে সে কখনও দেখেনি।
ইমা এসে টেবিল মুছতে শুরু করলো। ইমাদ তার মোবাইল নিয়ে চলে গেল রুমে।
- 'কি হলো ভাবিজান, চেয়ার-টেবিলের সঙ্গেই রাত কাটাবে না-কি।'
কথাটি বলে ফিক করে হাসলো ইমা। পুষ্পিতা বিব্রতবোধ করছে।
কি বলবে বুঝতে পারছে না৷
- 'ভাইয়া তো চলে গেছে, তুমি যাও।'
পুষ্পিতা অকারণ আঙুল ফোটানোর চেষ্টা করে বললো,
- 'তোমার সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ থাকি।'
- 'আচ্ছা ঠিক আছে।'
ইমা টেবিল মুছে বাতি হাতে নিয়ে বললো,
- 'চলে আসো।'
পুষ্পিতা ওর সঙ্গে বিছানায় গিয়ে বসলো। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় প্রচণ্ড গরম লাগছে।
আমতা-আমতা করে বললো,
- 'কাপড় খুলে ফেলি? অনেক গরম লাগছে।'
ইমা মুচকি হেঁসে ওর কানে ঠোঁট নিয়ে কিছু একটা বলতেই পুষ্পিতার মুখ লাল হয়ে উঠলো।
- 'দুষ্টামি করো না ইমা, আমি কাপড় চেঞ্জ করতে বলেছি।'
- 'সেটাও ভাইয়ার রুমে। বাসর ঘরে বিয়ের সাজেই তো স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতে হয়,
তাই না? না-কি সাজগোজ করে সেন্টারে যায় অতিথিদের দেখাতে আর ছবি তুলতে।'
পুষ্পিতা হেঁসে ফেললো।
- 'তুমি এতো পাকা পাকা কথা তো আগে বলতে না ইমা।'
- 'আগে কি ভাবি ছিলে?'
- 'আচ্ছা এখন বলো এই গরমে এগুলো পরে থাকবো?'
- 'আমি কি জানি? আমি বড়োজোর পাখা দিয়ে বাতাস করতে পারি।'
কথাটা বলে ইমা পাখা নিয়ে এলো।
পুষ্পিতা বাঁধা দিলেও সে উপেক্ষা করে বাতাস করতে করতে বললো,
- 'চিন্তা করো ভাবি, কারেন্টের লোকেরা কেমন বেরসিকের দল।
মানুষের বাসর রাতেও বিদ্যুৎ নিয়ে বসে থাকে। এরা কি মানুষ!'
পুষ্পিতার ভীষণ হাসি পেল।
সে হাসির শব্দ আঁটকে রাখার জন্য করপুটে মুখ ঢেকে বিছানায় হেলে পড়লো।
হাসির তোড়ে ওর শরীর এখন নড়ছে।
করিডরে হায়দার সাহেবের কথা শুনে পুষ্পিতা সঙ্গে সঙ্গে মাথায় কাপড় তুলে স্বাভাবিকভাবে বসলো।
- 'আরে বউমা এখানে কেন? ইমা, যাও মা, তাকে ইমাদের রুমে দিয়ে আসো।'
ইমা পাখা নাড়তে নাড়তে বললো,
- 'থাকুক বাবা আরও কিছুক্ষণ।'
- 'আহা, নারে মা। সবকিছুর একটা নিয়ম-নীতি বলে কথা আছে। এগুলো মানতে হয়।
যাও, নিয়ে যাও।'
ইমাদ রুমে এসে ইয়ারফোন কানে গুঁজে লতা মঙ্গেশকরের 'লাগ যা গালে'
গান শুনছে আর পুষ্পিতাকে নিয়ে ভাবছে। তার বাবা যেরকম বলেছেন,
সেসব পুরোপুরি মানতে সে নারাজ। আবার উনার কথা পুরোপুরি ফেলতেও সে পারবে না।
আচ্ছা পুষ্পিতা কি তাকে পছন্দ করে? না-কি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর বাধ্য হয়েই বিয়ে বসেছে?
নিশ্চয় সেও প্রস্তুত নয় তার সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর মতো জীবন যাপনের জন্য।
বাতির আলো দেখে দরজার দিকে তাকায় সে। পুষ্পিতাকে নিয়ে এসেছে ইমা।
আস্তে করে বিছানা থেকে উঠলো। মনে মনে ঠিক করেছে সন্ধ্যার মতো আর রূঢ় আচরণ করবে না সে৷
আবার পুরোপুরি মিশবেও না। মধ্যমপন্থা জীবনের বহু জটিল সমস্যার একমাত্র সমাধান।
ইমা চলে গেল। পুষ্পিতা ধীরপদে বিছানার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আমতা-আমতা করে বললো,
- 'আসলে আমি আসতে চাইনি, ওরা..।'
.
ইমাদ থামিয়ে দিল,
- 'ঠিক আছে, ঠিক আছে। তুমি বিছানায় ঘুমাও আমি ফ্লোরে থাকবো।'
কথাটি বলে সে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল।
পুষ্পিতা ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে না এই মুহুূর্ত তার করণীয় কি?
পায়ে হাত দিয়ে সালাম করবে? কিন্তু যদি ধমক দেয়? অপমান করে।
বিভ্রান্তিতে খানিকক্ষণ কেটে গেল পুষ্পিতার। ইমাদ বালিশ আর বিছানা চাদর হাতে নিয়ে বললো,
- 'কি হলো দাঁড়িয়ে আছো কেন?'
সে ইতস্তত করে বললো,
- 'আমি কি সালাম করবো?'
ইমাদ মেঝেতে বালিশ ফেলে বললো,
- 'আশ্চর্য, সেটা কি আমার বলে দিতে হবে?'
- 'না, মানে সালাম করতে পারি কি-না জিজ্ঞেস করছি।'
ইমাদ এগিয়ে গিয়ে বললো,
- 'সালাম করে শান্তি পাইলে করো। তোমার শান্তির জন্যই তো আমার আজ এই অবস্থা।
দোষ করছে একজন, শাস্তি পাচ্ছে আরেকজন।'
পুষ্পিতা লজ্জায় মাথা নীচু করে ফেললো।
- 'কি হলো সালাম করলে করো। আমার মাথা ধরেছে, এখনই ঘুমাতে হবে।'
সে আস্তে আস্তে নীচু হয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করে বললো,
- 'আমি নিচে ঘুমাই, তুমি বিছানায় থাকো।'
ইমাদ রূঢ় গলায় বললো,
- 'শোনো পুষ্পিতা, আমি যেটা বলবো এর বাইরে অতিরিক্ত কথা কখনও বলবে না।
তোমাকে আজ বলেছি বিছানায় ঘুমাতে, প্রতিদিন এই নিয়মেই চলবে।'
কথাটা বলে সে মোবাইল হাতে নিয়ে মেঝেতে শুয়ে গেল। প্রচণ্ড গরম।
বিদ্যুৎ দেয়ার নাম নেই। ইমাদ হাঁসফাঁস করছে। হঠাৎ মনে হলো তার পরনে থ্রি কোয়ার্টার আর গেঞ্জি।
তবুও এতো গরম লাগলে, ওর পরনে তো শাড়ি। নিশ্চয় গরম লাগছে।
বিছানা থেকে উঠে গিয়ে ইমার দরজায় নক করলো সে৷ ইমা দরজা খুলে দিল।
- 'কি হয়েছে ভাইয়া?'
- 'কিরে ওর কি কাপড় আনে নাই?'
- 'এনেছে তো, ব্যাগ তোমাদের রুমে না?'
- 'না তো।'
- 'তাহলে সামনের রুমে আছে, দাঁড়াও আনি গিয়ে।'
ইমা ব্যাগ নিয়ে এসে ইমাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
- 'এই নাও।'
- 'আমি এখানে আছি তুই যা নিয়ে। কাপড় চেঞ্জ করিয়ে আয়।'
'আমি কেন চেঞ্জ করাবো' বলে ভেংচি কেটে ইমা ব্যাগ নিয়ে গেল।
ইমাদ ওর রুমে বসে আবার ইয়ারফোন কানে গুঁজে দিল।
খানিক পরেই এলো বৃষ্টি। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ ক্রমশই তীব্র হতে শুরু করেছে।
চলবে....
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com