বিচ্ছেদ। পর্ব - ০১
ম্যাডাম ডিভোর্সের কারণ হিসেবে কি লিখবো?
আপনার হাজবেন্ড আপনার ওপর শারিরীক টর্চার করেন নাকি পরকীয়া প্রেম?
— কিছুই না ।
— কিছুই না? ম্যাডাম তা’হলে লিখি আপনার শ্বশুরবাড়ির লোক আপনার ওপর টর্চার করে?
— নাহ্ ।
— তা’হলে কীভাবে ডিভোর্স হবে ম্যাডাম?
— লিখুন আমরা আর সম্পর্ক এগোতে পারছিনা । তাই ডিভোর্স চাই ।
— কিন্তু ম্যাডাম এটা তো স্ট্রং কারণ না । স্ট্রং কারণ ছাড়া তো ডিভোর্স সম্ভব না ।
— আপনি লিখুন । আমার হাজবেন্ড এর ওপর তো আমি অযথা দোষারোপ করতে পারবো না । আমরা আমাদের সম্পর্ক এগোতে পারছি না , চাইছি না জন্য আলাদা হতে চাইছি ।
— ডোন্ট মাইন্ড ম্যাডাম আপনাদের কি এ্যারেঞ্জ ম্যারেজ ছিলো?
— নাহ্ লাভ ম্যারেজ ।
— লাভ ম্যারেজ?
— জ্বী । চার বছর সম্পর্কের পর আমরা বিয়ে করি এবং সাড়ে সাত বছর সংসার আমাদের ।
— ম্যাডাম এতদিন পর ডিভোর্স?
— জ্বী ।
.
আনোয়ার শেখ এবার সোজা হয়ে বসলেন ।
চশমা টা ঠিক করে মনযোগী হয়ে তাকালেন তার সামনে বসে থাকা নারীটির দিকে ।
ছিপছিপে , মাঝারি গড়নের উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের সে ।
পরণে বেগুনী রঙা একটা শাড়ি তার সাথে ঢিলেঢালা একটা বেণী , সাজগোজ খুব সাধারণ আর হাতে কালো চামড়ার একটা ঘড়ি ব্যাস!
ওহ্ একটা কালো চামড়ার ব্যাগও সে কোলের ওপর নিয়ে বসে আছে ।
সাজগোজ কিংবা মুখের নকশা দেখে মনে হচ্ছে রুচিশীল একজন মানুষ আর বেশ টাকাপয়সা ওয়ালা ।
এত মায়াবী মেয়েটার কি এমন হলো সে ডিভোর্স চাইতে আসলো?
এসব নানাকিছু ভাবনা মাথায় আসলো আনোয়ার সাহেবের ।
হালকা কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে উনি ক্লায়েন্ট কে জিজ্ঞেস করলেন_
— ম্যাডাম আপনি যদি মাইন্ড না করেন তা’হলে একটা প্রশ্ন করতে পারি কি?
— জ্বী বলুন? আর আমাকে ম্যাডাম বলার দরকার নেই আমার নাম রুশরা ।
রুশরা বলেই ডাকতে পারেন ।
— রুশরা মা আপনি আমার মেয়ের বয়সী হবেন । মা আপনি খুব মায়াবী ।
এমন মায়াবী মানুষের জীবনে দুঃখের ছায়া নামার কারণ কি জানতে পারি মা?
আপনি আমাকে আপন ভেবে বলতে পারেন ।
যদি আমি সমস্যা সমাধান করতে পারি?
.
এবারে একটু নড়েচড়ে বসলো রুশরা নামক নারীটি ।
— বুঝতে পারছি না কোথা থেকে শুরু করবো ।
— আপনি শুরু থেকেই শুরু করুন মা কোনো সমস্যা নেই ।
— তা’হলে আমার ছেলেবেলার কাহিনী থেকেই শুরু করি?
— আচ্ছা ।
একটু দম নিয়ে বলতে শুরু করলো সে_
আমার বাবা’র বাড়ি রংপুরে । রংপুরের স্থানীয় মানুষ আমরা।
আমার ছোট চাচা রাজনীতি করতেন এবং সেই সুবাদে আমাদের খুব নামডাক এলাকায় ।
আমাদের যৌথ পরিবার , সেই সুবাদে ভাইবোন সংখ্যা মোটামুটি অনেক ।
ফুপিরাও আমাদের সাথেই থাকতেন ।
তো সব ভাই বোনের মধ্যে আমি সবচাইতে ছোট এবং আমার বাবা’র একমাত্র মেয়ে ।
বাবা মা অনেক কষ্টের পর আমাকে পেয়েছেন ।
এক মেয়ে এবং সবার ছোট হিসেবে আমি ছিলাম সবার চোখের মনি ।
আমি মুখ দিয়ে বলার আগেই সবকিছু হাজির হয়ে যেত আমার সামনে ।
এতো এতো আদর থাকা সত্বেও আমার মধ্যে উড়নচণ্ডী স্বভাব টা আসলো না ।
এই ব্যাপারটায় সবাই অবাক আবার গর্ববোধ করতে থাকলো ।
আমি পড়াশোনায় অনেক ভালো ছিলাম , স্কুলে সবসময় প্লেসের মধ্যেই থাকতাম ।
ভালো স্টুডেন্ট , সাহসীকতা এবং ভদ্রতার কারণে আমার নামডাক ছিলো পাড়ায় ।
বন্ধু বান্ধবের মায়েরা আমাকে দিয়ে সবসময় তুলনা করতো এ নিয়ে বন্ধু মহলে অনেকেই আমাকে পছন্দ করতো না ।
আমি ওসব আমলে নিতাম না ।
.
আমার একটা বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো এবং সে ছিলো আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ।
কারো কথা আমলে না নিলেও ও যদি একবার আমার সাথে অভিমান করতো তা’হলে আমার পৃথিবী থমকে যেত!
আমি অশান্ত হয়ে উঠতাম , বুঝতে পারতাম না আমার এখন কি করা উচিৎ?
ও অবশ্য বেশি রেগে থাকতো না তবে ওর যখন রাগ ভাঙতো তখন আমি ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতাম ।
ও খুব হাসতো হেসে বলতো _ ” এখন যে খুব কাঁদছিস , যখন আমার বয়ফ্রেন্ড হবে বা তোর বয়ফ্রেন্ড হবে তখন তো ভুলেই যাবি । এরকম পাগলামি করতে পারবি না ।”
আমি আরো কেঁদে ফেলতাম , বলতাম_” ওরকম দিন কখনোই আসবে না । “
কিন্তু ওরকম দিন আসলে আসলো জীবনে ।
ক্লাস নাইনে ওর একটা বয়ফ্রেন্ড হয়ে গেলো ওর বয়ফ্রেন্ড হওয়ার পর থেকে ওর সাথে আমার যেই বন্ডিং টা আগের মতো থাকলো না ।
আমি ওকে বলতাম তুই বদলে যাচ্ছিস কিন্তু ও বলতো নাহ্ আমি আগের মতোই আছি ।
আমি আর কিছু বলতাম না ।
ওর বয়ফ্রেন্ড আমার সাথে পরিচিত হওয়ার পর আমাকে নক দিতো মাঝেমধ্যে ।
আমি তেমন রিপ্লাই করতাম না ।
একদিন ওর বয়ফ্রেন্ড সহ ও ঘুরতে যাচ্ছিলো তো সেদিন আমাকেও নেয় ।
আমরা দু’জনেই শাড়ি পরেছিলাম ।
.
আমরা যখন রাস্তায় ঘুরছি , ভীড়ের মাঝে এক ফাঁকে ছেলেটা আমার শরীরে বাজে ভাবে হাত দেয় ।
আমি তৎক্ষনাৎ আমার বান্ধবী কে বলে দিই , বান্ধবী ক্ষেপে যায় ।
ছোটখাট ঝগড়া করে চলে আসি ।
অন্যদিনের মতো ও আর আমাকে মানাতে আসেনা ।
আমার খুব খুব কষ্ট হয় ।
আমি নিজেই থাকতে পারছিলাম না তাই পরে আমিই যোগাযোগ করি ।
সব ঠিক হয় মোটামুটি কিন্তু আমাদের দূরত্ব কমে না ।
এর মাঝে ছেলেটা আবার আমাকে উত্যক্ত করতে শুরু করে ।
আমি বান্ধবী কে বলায় ও ভায়োলেন্ট হয়ে যায়!
আমি ওকে প্রুফ দিতে চাই কিন্তু ও কিছু দেখতেই রাজি না ।
ঐ ছেলের প্রতি ওর ভালোবাসা এতটাই গভীর যে ও আমাদের বন্ধুত্ব ভুলে যায় ।
আমাদের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাই ।
খুব খুব কষ্ট পাই আমি ।
ঐ ঘটনার পর থেকে আমার ভালোবাসার ওপর একটা ঘৃণা চলে আসে ।
যে ভালোবাসা মানুষকে অন্য সম্পর্ক থেকে দূরে নিয়ে যায় তা অভিশপ্ত , এটাই মনে হতে থাকে আমার ।
আমি হয়ে যাই অনুভূতিহীন পাথর স্বরুপ ।
.
চলবে….
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com