বিচ্ছেদ। পর্ব - ০৩
আমাদের প্রেমের সূচনা মূলত সেদিন থেকেই ।
আমি অবশ্য তখনো হ্যাঁ বলিনি , এক তরফা ও ই বলে যেত ।
আমি ছিলাম একজন ভালো শ্রোতা । ওপাশে ও ওর সব অনুভূতি বিনা সংকোচে প্রকাশ করে যেত আর এপাশে আমি ওর নিঃসংকোচ প্রকাশভঙ্গীমা দেখে হাসতাম কখনো ভালো লাগতো , কখনোবা লজ্জায় লাল হতাম এটা ভেবে ভালোবাসা জিনিসটা আমার জীবনেও এসেছে সত্যি?
ওর প্রতি যে আমার একটা অনুভূতি কাজ করা শুরু করে দিয়েছে সেটা আমি বুঝতে পারতাম তক্ষুনি খুব বেশী করে যখন স্কুল থেকে বেরিয়ে ওকে অপেক্ষা করতে দেখা যেত না , টিউশন ক্লাসের বাইরে ও নেই , গলির মাথায়ও দাঁড়িয়ে নেই শুধু আছে মুঠোফোনের বিপরীতে ।
মাঝেমধ্যে কান্না পেত , এই কান্নার মানে আমি জানতাম না ।
নিজেকে বকে দিয়ে বলতাম “সম্পর্ক নেই আবার কান্না কিসের?”
আমি নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করতাম ।
নিজের কষ্ট , আনন্দ যতটা প্রকাশ করার দরকার ততটা করতাম না ভালো লাগতো না কেনো জানি!
এজন্য কষ্টের রাতগুলিতে যখন মনে হতো হ্যাঁ ও হয়তো আমাকে সঙ্গ দিলে মন খারাপ ছুটে যাবে তখনও আমি যোগাযোগ করতাম না ওর সাথে ।
ও একটা মেসেজ পাঠালে শুধু সেটারই জবাব দেয়া হতো পাল্টা প্রশ্নও কখনো করিনি ।
.
দেখতে দেখতে আমার এসএসসি পরীক্ষা এসে গেলো , পড়াশোনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম ।
সব কিছুর থেকে দূরে । ও কে না বলেই ফোনটাও বন্ধ করে রেখে দিলাম ।
পরীক্ষা মোটামুটি ভালোই হচ্ছিল , প্রতিদিন পরীক্ষা দিয়ে এসে ইচ্ছে করতো ফোনটা বের করে ওকে নিউজ টা জানাই কিন্তু আবার মন বলতো ফোন বের করা মানে লক্ষ্য চ্যুত হওয়া।
এই ভেবে আর অশান্ত মন কে শান্ত করা হতো না ।
যা হোক পরীক্ষা আমার ভালোয় ভালোয় কেটে গেলো , প্রাক্টিক্যাল শুরু হবার আগে বাবা জানালেন লাস্ট প্রাক্টিক্যাল শেষে একদিন গ্যাপ দিয়ে পরদিন ই আমাকে ঢাকায় পাঠাবেন খালার বাসায় । কলেজ ওখানেই ।
জানিনা কেনো এটা শুনে আমার দারুণ খুশি লাগলো , সেও তো ঢাকাতেই থাকে ।
এটা নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তারই একটা সাইন?
দু’টো দিন উদ্দীপনায় কাটলো ।
লাস্ট প্রাক্টিক্যালের দিনে সকল বন্ধুরা মিলে প্ল্যান করলাম ঘুরতে যাবো , কে জানে আর কখনো সবাই একসাথে থাকার সুযোগ হবে কি না!
পরীক্ষা শেষে বাইরে এসে দাঁড়িয়ে অন্যদের আসার অপেক্ষা করছি হঠাৎ মনে হলো একটা পরিচিত মুখ?
উৎসুক হয়ে চারিদিকে খুঁজতে থাকলাম ভাবছিলাম সে আসবে কি করে?
এই খোঁজা খোঁজির মধ্যে হাতে টান পড়লো , কারো শক্ত হাত আমার কবজি টা মুঠো বন্দী করে আমাকে টানতে টানতে নিয়ে যেতে লাগলো ।
রাগতে রাগতে নিজেকে সামলে নিলাম মানুষটা কে দেখে ।
ইয়াসির?
.
আমি একই সাথে অবাক এবং খুশি হলাম ।
খুশির যুক্তিযুক্ত কারণ জানিনা কিন্তু মনে অন্যরকম এক আনন্দ হলো আমার ।
কোনো এক গলির মুখে নিয়ে গিয়ে সে আমার হাতটা ছেড়ে দিলো আমি চোখ তুলে চাইলাম তার মুখ পানে ।
বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে গেলো আমার ।
সুন্দরমতো চেহারা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে , চোখ বসে গেছে ডার্ক সার্কেল পড়ে গেছে ।
চুল উশকোখুষকো , দাড়ি বড় হয়ে গেছে ।
দেখে মনে হচ্ছে রাস্তার পাগল দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে ।
আমি কিছু বলতে চাইলাম কিন্তু তার আগেই সে একপ্রকার চেঁচিয়ে বললো_
— আমাকে তোমার মানুষ মনে হয় না? হ্যাঁহ্ প্রায় দু’মাস হলো যোগাযোগ বন্ধ করেছো ।
জানি পড়ার চাপ কিন্তু আমাকে একটা বার বললে হতো না? হুট করে ফোন অফ করে রেখে দিয়েছো , রাইটিং শেষ এটলিস্ট শেষ এক্সামের দিন তো একটু যোগাযোগ করলে হতো?
তোমার বিরহে আমার মরণদশা এ কথা তো তুমি জানো , এত নিষ্ঠুর কেনো তুমি?
সব জেনেও নীরব?
আমি দু কদম এগিয়ে এসে বললাম_
— আমাদের কি মান অভিমানের সম্পর্ক হয়েছে? জবাবদিহিতার অধিকার আছে?
— ওহ্ আমার অনুভূতি তোমার কাছে কিছুই না তাই না? আমি তোমাকে ভালোবাসি এটা এতদিন থেকে বুঝিয়ে আসছি তুমিই তো বুঝতে চাইছো না ।
আর কি করলে বুঝবে? কি করলে প্রমাণিত হবে আমি তোমায় ভালোবাসি?
আমি মুচকি হাসলাম , কন্ঠের ধীরতা বজায় রেখে বললাম _
— কই একদিনও তো প্রেম নিবেদন করলে না প্রেমিক পুরুষের মতো । একদিনও তো জিজ্ঞেস করলে না “তুমি আমার প্রেয়সী হবে?”
.
ও অবাক হয়ে তাকালো আমার দিকে ।
নস্টালজিক হয়ে গেছে ও , তাকিয়েই আছে ।
তারপর হঠাৎ কোথাও একটা ছুটে গেলো , খানিক বাদে যখন আসলো তখন দেখি ওর হাতে কয়েকটা বেলী ফুল ।
হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে সেগুলো বাড়িয়ে দিয়ে বললো_
— হবে আমার প্রেয়সী? আমার মনের অসুখের ঔষধ? এই ছন্নছাড়া জীবনটাকে গুছিয়ে দিবে? একটু অধিকার নিয়ে বলবে? এখন আমি এসেছি আর এলোমেলো পাগলের মতো থাকা যাবেনা ।
কথা দিচ্ছি তোমার চোখে জল আসতে দেবো না ।
আমি এটা শোনা মাত্রই কেঁদে ফেললাম , ও অপ্রস্তুত হয়ে বললো_
— এই রে কাঁদিয়ে দিলাম যে?
আমিও হাঁটু গেড়ে বসে ওর গলা জড়িয়ে ধরে বললাম_
— আজকে মাফ এরপর কাঁদালে ভয়ংকর শাস্তি দিবো ।
ও মুচকি হেসে বললো_ পবিত্র ভালোবাসার কসম তোমার শাস্তি মাথা পেতে নেবো ।
আনোয়ার সাহেব বুঝতে পারলেন তো ও ওর কথাটা রাখতে পারেনি ।
আমার চোখের জলের কারণ হয়েছে , ভালোবাসার কসম কেটেছিল শাস্তি ওর প্রাপ্য ।
এতটুকু বলে থামলো রুশরা ।
আনোয়ার সাহেব ব্যাকুল হয়ে জানতে চাইলেন_
— কি এমন হলো মা যে বিচ্ছেদের কষ্ট নেমে আসলো?
— হু বলবো তো । আপনি কি আমাকে একটু পানি খাওয়াতে পারবেন?
— অবশ্যই৷ মোখলেস? মোখলেস?
দারোয়ান দৌড়ে আসলো তার সাহেবের গলা শুনে , বিনীত ভঙ্গিতে বললো_
” আজ্ঞে সাহেব?”
— ম্যাডামের জন্য পানি নিয়ে আসো?
— জ্বী সাহেব ।
হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলো দারোয়ান
দু মিনিটের মাথায় পানির গ্লাস নিয়ে হাজির ।
— রেখে যাও ।
— জ্বী ।
পানির গ্লাস রেখে চলে গেলো দারোয়ান ।
আনোয়ার সাহেব গ্লাসটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন_
— নিন মা?
.
রুশরা পানির গ্লাস হাতে নিয়ে তিন চুমুকে পানিটা শেষ করলো ।
তারপর গ্লাস রেখে ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে আলতো করে মুখটা মুছে নিলো ।
আনোয়ার সাহেব চুপচাপ তার কাজকর্ম দেখছিলেন ।
সবকিছুতেই মায়াবী মায়াবী ভাব , নস্টালজিক হয়ে যাচ্ছেন উনি নিজেই ।
টিস্যুটা আবার ব্যাগে রেখে রুশরা একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বললো_
— আচ্ছা যা বলছিলাম ,
সেদিন আমার আর বন্ধুদের সাথে ঘোরা হয় না ।
তার সাথেই সময় কাটাই ।
জানাই ঢাকা যাবো , সে বড় খুশি হয় ।
বলে সে আরো দু’দিন এখানে থাকবে তারপর ঢাকায় যাবে ।
মেনে নিই সেটাই ।
সেদিন রাতেই ঢাকায় চলে যাই আমি ।
এরপর আবার আমাদের প্রেম শুরু হয় মুঠোফোনের মাধ্যমে ।
কতটা সময় দেখতে দেখতেই কেটে যায় , আমার মধ্যে ম্যাচিওরিটি আসতে শুরু করে ।
সম্পর্কের ভীত মজবুত হতে শুরু করে ।
কিন্তু এর মাঝেই আমার খালাত ভাই আমাকে প্রপোজ করে বসে , আমি রাজি হই না ।
সে সময় নিতে বলে , কিন্তু আমি তো কমিটেড ।
ইয়াসির কে জানালে সে একটু মন খারাপই করে ।
খালা বাসা থেকে অন্য কোথাও যাওয়ারও উপায় নেই কারণ ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষে উঠে গেছি আমি ।
মুখ বুঁজে থাকতে হয় , অনেক সমস্যা ফেস করতে হয় ।
ভাইয়ার পাগলামি সহ্য করতে হয় কিন্তু সব কিছুর উর্ধ্বে, সব অশান্তির ঔষধ ইয়াসির ।
ও সাহস যোগায় আমাকে
.
আমি ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারিনা আমার খালাত ভাই আমার ওপর নজর রাখতে শুরু করে ।
ও জেনে যায় সবটা , আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করে বাসায় জানানোর ।
মানসিক টর্চার করতে থাকে , বলে ওর সাথে রিলেশন না করলে আমার সম্পর্কের কথা বাসায় জানিয়ে দিবে ।
ভেঙে পড়ি আমি , ইয়াসিরের সাথে যোগাযোগ করতে হয় লুকিয়ে ।
তারপর একদিন মনে হয় নাহ্ আর লুকোবো না , যা হবার হবে!
এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েই আমি বাসায় সব জানিয়ে দিই ।
সবাই তো অবাক , সবার একটা বিষয়ই পছন্দ হয়না ছেলের বয়স ।
ওকে সবাই ভালো ছেলে হিসেবে চেনে কিন্তু আমার চাইতে বয়সে এতবড় ছেলেকে কি করে মানবে?
বাবা চাচা রা রাজি থাকেনা একদমই , দুই পরিবারের কথা হয় ।
বাবা আমার কান্নায় দূর্বল হয়ে শর্ত জুড়ে দেন ওকে ভালো পজিশনে যেতে হবে তা হলেই আমাকে পাবে নয়তো না , ততদিন আমাদের যোগাযোগ বন্ধ থাকবে ।
মেনে নিই আমরা , কিন্তু আমি থাকতেই পারছিলাম না যোগাযোগ না করে ।
যোগাযোগের উপায় হিসেবে বের করি চিঠি লেখা ।
পুরাতন যুগের মতো আমাদেরও পত্র আদান প্রদানের মাধ্যমে প্রেম শুরু হয় ।
প্রতি শুক্রবার করে ওর চিঠি আসতো , আমি ৬ টা দিন অধির আগ্রহে অপেক্ষা করতাম ওর চিঠির জন্য ।
চিঠি পাওয়ার পর ওর দু’টো ভালোবাসা মেশানো কথা শুনেই আমার অন্তর জুড়িয়ে যেত ।
মনে হতো ভালোবাসা মধুর , আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন ও আর ওর ভালোবাসা ।
অবর্ণনীয় সুখে আমাদের দিনগুলো অতিবাহিত হতে শুরু করলো ।
মাঝেমধ্যে মনে হতো এই ভালোবাসা সবার জীবনে আসুক ।
এই পবিত্র ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার জীবনে সবারই আছে , সবারই..
.
চলবে,
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com