বিচ্ছেদ। পর্ব - ০৪
দু বছরের মাথায় ইয়াসিরের চাকরি হয়ে যায় এবং ফাইনালি দু পরিবারের সম্মতি তে আমাদের বিয়েটা হয়ে যায় ।
আমার জীবনে সবচাইতে খুশির দিন হয়ে যায় আমার বিয়ের দিন টা ।
আজকাল ভালোবাসে তো সবাই কিন্তু মানুষটা কে পায় কয়জন?
আমি পেয়ে নিজেকে সর্বোচ্চ সুখী দাবী করতে থাকি ।
বাবা মা চাইছিলেন আমি অন্তত আমার পড়াশোনা টা বাসা থেকেই করি কিন্তু নাহ্ আমি বাসায় থাকলাম না শ্বশুরবাড়িতে গিয়েই উঠলাম ।
নতুন নতুন সংসার , নতুন সব খুব খুব ভালো লাগছিলো ।
শ্বশুরবাড়ির সবাই কি ভালোটাই বাসে!
.
সংসারের তালে আমার আবার ওদিকে পড়াশোনা পিছিয়ে যেতে থাকলো , ওরও ছুটি শেষ হয়ে আসছিলো ।
ওর বাবা কে বলায় বাবা তো প্রায় সাথেসাথেই বললেন তোরা ঢাকায় যা , বন্ধ পেলে না’হয় আসবি ।
লেখাপড়ার ক্ষতি করার তো দরকার নেই ।
ওর বাবা এ কথা বললেও আমি একটা জিনিস লক্ষ করলাম মা ব্যাপারটা অতোটা পছন্দ করলেন না ।
যাক আমরা ঢাকায় চলে আসলাম ।
সব মোটামুটি ভালোই চলছিল , আমাদের দু’জনের ছোট্ট সংসার ।
আমার পড়াশোনা ওদিকে ওর অফিস , বন্ধ পেলেই হুট করে চলে যেতাম রংপুরে ।
সুখ স্বাচ্ছন্দ্যই কাটছিলো সময়৷
দেখতে দেখতে দু’টো বছর কেটে যায় আমাদের সংসারের ।
একদিন সকালবেলা খবর আসে বাবা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন আমাদের যেতে হবে ।
আমরা তাড়াহুড়ো করে বেরুলাম , পথেই খবর এলো বাবা আর নেই ।
বাবা চলে যাওয়ার পর শোকের ছায়া নেমে এলো সংসারে ।
মা পাগলপ্রায় ।
তাকে সামলাতে আমরা কয়েক মাস থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম ।
আমার আব্বা-আম্মা এসে বোঝাতো ওনাকে , মাঝেমধ্যে ওনার পুরানো বান্ধবীদের সাথে দেখা করাতাম ।
ওনার বান্ধবীদের সাথে দেখা করতে গিয়ে হয়তোবা বাড়ির বউ দের নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল ।
উনি সেদিন বাসায় এসে আমাদের ডেকে বললেন_
” বিয়ে তো হয়েছে মেলাদিন হইলো , এটাই আসল সময় বাচ্চা কাচ্চা নেয়ার ।
পরে বয়স বেশি হয়ে গেলে তোর বউয়ের ই কষ্ট হবে।”
.
আমি একদম ই প্রস্তুত ছিলাম না এটা শোনার জন্য ।
আমার ক্যারিয়ার গড়ার সময় এটা , আমি মোটেই বেবী চাইছিলাম না ।
এটাসেটা বুঝিয়ে সেদিনের মতো ব্যাপারটা সামাল দেয়া গেলো ।
কিন্তু ওর মাথায়ও ব্যাপারটা গেঁথে গেছিলো বুঝি!
ও আমাকে প্রায়ই ভাবতে বলতো , কীভাবে পরিস্থিতি সামলানো যাবে তার প্ল্যান করতো ।
এর ওদিকে তো মা প্রতিদিনই বলতেই থাকলো ।
আমাদের সংসারে অশান্তি মূলত এই বাচ্চা ঘটিত তর্ক বিতর্ক নিয়েই শুরু হলো ।
একসময় আমিও ভাবলাম স্বামী, শ্বাশুড়িকে নারাজ করি কেনো?
বাচ্চা তো দূর্বলতা না হয়ে শক্তি হতে পারে?
আমি রাজি হয়ে গেলাম ।
আমার ক্লাস মিস যাচ্ছিলো বললাম ঢাকায় ফেরত যেতে ।
ও ওর মা, ভাই বোনকে একা ছাড়তে পারছিলো না আমি বললাম আমাদের সাথে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হোক?
কিন্তু নাহ্ আমার শ্বাশুড়ি কিছুতেই যাবেন না ঢাকায় ।
.
ওনার সাজানো সংসার ছেড়ে নাকি ইট পাথরের শহরে এসে ওনার একদমই ভালো লাগবে না ।
অনেক বোঝালাম আমরা কিন্তু আম্মা রাজি না ।
শেষে চাচা শ্বশুর বললেন তারা দেখবেন কোনো সমস্যা নেই ।
প্রয়োজনে তাদের ছেলে আর ছেলের বউ এ বাড়িতে উঠবে ।
এখানে একটা কথা চাচা শ্বশুরের ছেলের সাথে আমার একদিনও দেখা হয়না এর মাঝে কারণ ছেলেটা ময়মনসিংহে জব করতো ও নাকি বদলি নিয়ে রংপুরে শিফট করতে চায় এখন ।
কথা ওটাই হলো ওরাই আমাদের বাড়িতে থেকে সার্বিক টা দেখাশোনা করবেন ।
আমরা খুশিই হলাম ।
আরো একটা বছর গেলো এভাবে ই ।
আমি বিসিএস এর প্রিপারেশন নিচ্ছিলাম ওদিকে বেবী প্ল্যানও করছিলাম কিন্তু চেষ্টা করেও কনসিভ করতে পারছিলাম না ।
মায়ের প্রেশার বেড়ে গেলো কিন্তু ও আমার পাশে ছিলো ।
ডাক্তার দেখানো হলো , ডাক্তার কিছু টেস্ট দিলো ।
নানারকম বাজে চিন্তা আসছিলো আমার মাথায় ।
একরকম উত্তেজনার বসে আমিই পরদিন হসপিটালে গিয়ে খবর নিলাম একা একা ।
ডাক্তার আমার হাতে রিপোর্ট দিয়ে বললো “ইউ আর আ্যাবসোলিউটলি ফাইন ,
ইউ ক্যান বি আর মাদার বাট মেইন প্রবলেম তোমার হাজবেন্ড এর মধ্যে । ও কখনো বাবা হতে পারবে না ।”
আমি থমকে গেছিলাম এটা শুনে ।
.
কাতর হয়ে জানতে চাইলাম কোনো চিকিৎসা করানো পসিবল কি না?
কিন্তু ডাক্তার বলে দিলো চিকিৎসা ফলপ্রসূ হবে না ।
আমি সারা রাস্তা ভাবতে ভাবতে আসছিলাম কি করা যায়?
ব্যাপারটা জানলে ও খুব খুব কষ্ট পাবে ।
ঠিক করলাম এখন জানাবো না , কিন্তু ও তো রিপোর্ট চাইবে?
কিছু তো দরকার , জানিনা কেনো আমি রিপোর্ট চেইঞ্জ করানোর সিদ্ধান্ত নিলাম ।
ভাবলাম ওকে বলবো চিকিৎসা করালেই আমি সুস্থ হয়ে যাবো আর আমার একটা কনফিডেন্স ছিলো আমি ও এই সংবাদ শুনলেও আমার হাত ছাড়বে না ।
আমি ওটাই করলাম । রিপোর্ট বদলে দিলাম ।
ও রিপোর্ট হাতে পেয়ে নির্বাক হয়ে বসে ছিলো কতক্ষণ ।
তারপর আমাকে বললো সমস্যা নেই আল্লাহ চাইলে হবে ।
মা ব্যাপারটা জানার পর খুব নারাজ হয়ে গেলেন ।
আমি আবার আমার পড়াশোনার দিকে নজর দিলাম ।
ও পূর্বের তুলনায় একটু চুপচাপ হয়ে গেছিলো , মা কল দিলে ওকে আলাদা হয়ে কথা বলতে বলতো ।
আমার খারাপ লাগতো কিন্তু প্রকাশ করতাম না কারণ আমার ওর ওপর আস্থা ছিলো ।
যেই পড়াশোনার পেছনে এত কষ্ট করছিলাম আমি সেটার ফল পেলাম ফাইনালি ।
বিসিএসএ আ্যাডমিন ক্যাডারে হয়ে গেলো ।
পোস্টিং হলো রংপুরে ই ।
.
দারুণ খুশি হয়েছিলাম যে যাক এখন শ্বশুরবাড়িতেই থাকতে পারবো কোনো সমস্যা হবে না ।
ওর জব ঢাকায় থাকার কারণে ও থেকে গেলো আমিই রংপুরে চলে গেলাম ।
আমার শ্বাশুড়ি আমাকে আগের মতো পছন্দ করতো না ঠিক ।
আমার সাথে তেমন কথাবার্তা বলতো না , আমি চেষ্টা করছিলাম সম্পর্ক সহজ করার কিন্তু ওদিক থেকে সাঁড়া নেই ।
একটা ইন্টারেস্টিং কথা শুনবেন?
আমার চাচা শ্বশুরের ছেলে কে ছিলো জানেন?
আমার সেই স্কুল জীবনের বেস্ট ফ্রেন্ডের বয়ফ্রেন্ড টা ।
এতবছর পর ওকে দেখে আমি অবাক হয়ে গেছিলাম ।
ওর বউ আমার বান্ধবী নয় অন্য মেয়ে ।
আমাকে দেখে ছেলেটা বললো_
কি ভাবী চমকে গেলেন আমাকে দেখে?
আগের কথা মনে রাখবেন না ।
বয়স কম ছিলো ভুল করে ফেলেছি কিন্তু এখন আমারও সংসার হয়েছে!
আমি পূর্বের কাজের জন্য অনুতপ্ত ।
ছেলেটা বললেও আমি কেনো যেন বিশ্বাস করতে পারলাম না ,
একদিকে ভাবছিলাম নাহ্ হয়তো আসলেই ভালো হয়েছে
বউ-বাচ্চা আছে চরিত্র ভালোও হতে পারে ।
আমার সিক্সথ সেন্স বলছিল ও আমার জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে ।
.
এর মাঝে আবার ইয়াসির অসুস্থ হয়ে গেলো ।
গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ওকে হসপিটালে এডমিট করা হলো ।
জানা গেলো ওর কিডনিতে প্রবলেম , রিপ্লেস করতে হবে ।
আম্মা আমাকে দোষারোপ করলেন ।
কেঁদে কেঁদে বললেন এই অলক্ষীটা আমার সংসার খেতে ই এসেছে ।
না সন্তান দিতে পারে আর না সংসারী ।
আমি স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম আম্মার কথা শুনে ।
ভালো খারাপ সময় সব সংসারে ই আসে
তা’হলে এটা নিয়ে আম্মা আমাকে কীভাবে দোষারোপ করতে পারেন?
সব ঝামেলা আমাকেই পোহাতে হচ্ছিলো
ইয়াসিরের কিডনি রিপ্লেসের জন্য ডোনার খুঁজছিলাম অন্যদিকে মায়ের খারাপ কথা ।
সহ্য করার মতো না তবুও দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যাচ্ছিলাম ।
আল্লাহ্ কে ডাকছিলাম খুব করে ।
আল্লাহ্ সহায় হলেন এবং ডোনার পাওয়া গেলো ।
এ যাত্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসলো ইয়াসির ।
কিন্তু ওর ভেতর আমূল পরিবর্তন আসলো যেন!
বাসায় সবসময় আম্মা আমাকে নিয়ে অভিযোগ করতে থাকলেন ।
ওর মন মস্তিষ্ক বিষিয়ে তোলার ছোট্ট প্রয়াস ।
বুঝতে পারছিলাম ওদের পরিকল্পনা ছেলেকে আরেকটা বিয়ে করানোর ।
আমি চুপচাপ ছিলাম । আমাদের ভালোবাসা পরীক্ষা করার সময় ।
.
চলবে…
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com