বিরহের নাম তুমি । পর্ব -০২
সূর্যমুখী ফুল নিয়ে একটি লেকের পাশে অপেক্ষা করছে জয়।
ফোনের কল লিস্টে গিয়ে অন্বেষার নাম্বারটিতে বারংবার কল করেও ওপাশ থেকে
ফিরতি কোনও রেসপন্স পাচ্ছে না সে। তবে হালও ছাড়েনি। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
দুপুরের কাঠফাটা রোদে ঘেমে একাকার অবস্থা
জয়ের। তবুও সে অপেক্ষা করে চলেছে প্রিয় মানুষটির জন্য।
ফোন না ধরলেও অন্বেষা লেকের পাড়ে আসে। গরমে ফরসা মুখটা টুকটুকে লাল হয়ে গেছে।
অন্যরকম সুন্দর লাগছিল ওকে। তবে চেহারায় স্পষ্ট বিরক্তের ছাপ।
একগাল হেসে এগিয়ে যায় জয়। নিজেই রিকশা ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে,’
আসতে কোনও সমস্যা হয়নি তো?’
অন্বেষা প্রত্যুত্তর করল না। রোষানল দৃষ্টিতে একবার জয়ের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নিল।
অন্বেষা রাগ করেছে বুঝতে পেরে জয়ও আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি।
অল্পসল্প গাছের ছায়া আছে এমন এক জায়গায় গিয়ে দুজন বসল।
অন্বেষাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে কিছু বলতে চায় অথবা বলবে। জয় তাই সুযোগ দিচ্ছিল।
ওর ধারণাকেই সত্য প্রমাণ করে অন্বেষা ঝাঁঝাল কণ্ঠে বলল,’এইটা কি কোনও দেখা করার মতো সময়?’
জয় বোকা বনে গেল অন্বেষার কথা শুনে।
কেননা এখানে সম্পূর্ণ দোষ অন্বেষার। দেখা করার কথা ছিল ১১টায়।
জয় ঠিক সময়ের আগে এলেও অন্বেষা এসেছে ঠিক এক ঘণ্টা বিশ মিনিট পর।
প্রণয় চাইলেই কথাটা বলতে পারত। চোখে আঙুল দিয়ে বলতে পারত, ‘
আমি ঠিক সময়েই এসেছি। বরং তুমিই দেরি করে এসেছ।’ কিন্তু না, জয় এমন কিছু বলেনি।
কারণ সে চায় না কথায় কথা বাড়ুক এবং দুজনের মাঝে তর্ক লেগে যাক।
তাই নিজেরই দোষ এমন একটা ভঙ্গি করে বলল,’আচ্ছা, বাবা স্যরি।
এখন এই ফুলগুলো তো গ্রহণ করো।’
গলার স্বর বেড়ে যায় অন্বেষার।
খানিক বাদে নিজেকে সংবরণ করে দাঁতে দাঁত পিষে বলে,’
ফুল দেওয়ার মতো কোনও উপহার হলো?
আমার এসব ভাল্লাগে না জানো না?’
জয় দমে গেল। মনে মনে ভীষণ ব্যথিত হলেও সেটা অন্বেষাকে বুঝতে দিল না।
দুনিয়ায় ফুল অপছন্দ করে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বিরল।
মানুষের মাঝেও যদি ফুল পছন্দ, অপছন্দ অনুযায়ী ভাগাভাগি করা যায়
তাহলে দেখা যাবে মেয়েরাই সবচেয়ে বেশি ফুল পছন্দ করে।
কিন্তু অন্বেষা ব্যতিক্রম। ফুল তার পছন্দ নয়। তার পছন্দ দামি দামি গিফ্ট।
জয় হতাশ হয়ে বলল,’তাহলে ফুলগুলো কি ফেলে দেবো?’
‘ফেলে দাও নয়তো বাড়িতে নিয়ে যাও। তাতে আমার কোনও মাথা ব্যথা নেই।
তবে আমি ফুল বাড়িতে নিতে পারব না।’
.
বিরক্ত হয়ে বলল অন্বেষা। একটুখানি চুপ থেকে আবার বলল,’খিদে পেয়েছে।
খাওয়াবে কিছু নাকি এখানেই খালি পেটে বসিয়ে রাখবে?’
‘চলো সামনের রেস্টুরেন্টে যাই।’
অন্বেষা উঠে দাঁড়াল। কথা বলতে বলতে একসাথে যাচ্ছে ওরা।
জয় কথা বলছিল আর অন্বেষা শুনছিল।
জয়ের অবচেতন মন বলে, এই সম্পর্কটাকে অন্বেষা বোঝার মতো এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
.
ভয়ে ভয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে সূচনা। জারিফ সাথে আসেনি।
বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে আড্ডা দিতে গেছে। আসার সময়ে বারবার করে বলেছে,
‘আব্বু যদি জানতে চায়, সকালে তোকে কলেজে পৌঁছে দিয়েছিলাম নাকি।
তাহলে বলবি, হ্যাঁ। মনে থাকবে?’
উত্তরে সূচনা মাথা নাড়িয়েছিল।
হেলমেট ভাঙার জন্য জারিফ তখনও পর্যন্ত রেগে ছিল।
বাড়িতে আসার পর যদি উল্টাপাল্টা কিছু বানিয়ে চাচিকে বলে তাহলে বোধ হয় না আর রক্ষা পাওয়া যাবে।
কোনও এক অজানা কারণেই তিনি সূচনাকে সহ্য করতে পারেন না।
হয়তো সে বাকপ্রতিবন্ধী বলে! দুর্বল মানুষরা অকারণেই অন্যদের অসহ্যের কারণ হয়ে থাকে।
এর জন্য বিশেষ কোনও হেতুর প্রয়োজন হয় না।
চাচি জেসিয়া মাহমুদ সোফায় বসে টিভি দেখছিলেন।
সূচনাকে একবার দেখে আবার টিভি দেখায় মনোযোগ বসালেন।
সূচনা যখন দেখল চাচি কিছু বলছে না তখন সে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়।
চাচি বার কয়েক ডাকে কিন্তু সূচনা শুনতে পায় না।
সে পুরোপুরি বোবা নয় একটু একটু কথা বলতে পারে।
তবে সেটা সম্পূর্ণই অস্পষ্ট।
যারা ছোটোবেলা থেকে সূচনার সাথে ছিল তারা ওর কথা বুঝতে না পারলেও আন্দাজ করতে পারত।
যারা সম্পূর্ণ বোবা তারা শুনতেও পায় না। অস্পষ্ট কথা বলতে পারায় সে কানেও শুনতো।
তবে দূর থেকে বলা কথা অথবা ডাক শুনতে পারে না।
এজন্য চাচির ডাকও তার কর্ণকুহর অব্দি পৌঁছায়নি।
ঘরে গিয়ে দরজা চাপিয়ে হিজাবের পিন খুলছিল।
তখন শব্দ করে দরজা খুলে চাচি রাগী কণ্ঠে বলেন,’ডাকি যে কানে শুনিস না?’
সূচনা নিরুত্তর। তিনি বিরক্ত হয়ে বলেন,’তোকে কিছু জিজ্ঞেস করাও তো বৃথা।
কথা তো বলতে পারিস না! শোন, ফ্রেশ হয়ে টেবিলে খাবার আছে খেয়ে নিবি।
তারপর কিছু এঁটো থালা-বাসন আছে সেগুলো ধুয়ে ফেলবি। বুয়া আজকে আর আসবে না।’
সূচনা মাথা নাড়ায়। ভেবেছিল কলেজ থেকে ফিরে একটু রেস্ট নিবে। কিন্তু এখন আর তা করা যাবে না।
তাহলে চাচি আবার রেগে যাবে। সে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নেয়।
টেবিল পরিস্কার করে থালা-বাসন ধুয়ে, কিচেনও পরিস্কার করে ফেলে।
রুমে যাওয়ার সময়ে চাচি বলে দিলেন,’জারিফের রুমটা গুছিয়ে দিস তো।’
.
নিজের রুমে আর গেল না সে। জারিফের রুমে গিয়ে দেখে সবকিছু এলোমেলো। বইখাতা,
কলম টেবিলের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
কাঁথা-বালিশ, মশারী সব এলোমেলোভাবে বিছানার ওপর পড়ে আছে।
টিশার্ট, প্যান্ট চেয়ারের ওপর রাখা। দেখে বোঝার উপায় নেই কোনও মানুষ এই ঘরে থাকতে পারে।
এক এক করে পুরো রুমটা সে গুছিয়ে ফেলে। কাজ করতে সূচনার খারাপ লাগে না বা
কষ্ট হয় না। কাজের বিনিময়ে হলেও সে সবার থেকে একটু ভালোবাসা চায়।
আর এই একটুখানি ভালোবাসা পাওয়াটাও তার জন্য দুষ্কর!
জারিফের রুম থেকে বেরিয়ে দেখে চাচি ড্রয়িংরুমে নেই। ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখল দরজা চাপানো।
ঘুমাচ্ছে হয়তো। সেও নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে।
বালিশের নিচ থেকে নিজের বাটন ফোন বের করে বড়ো বোন ভূমিকাকে ম্যাসেজ করে,’কেমন আছিস?’
বেশিরভাগ সময়ই ভূমিকা বাড়ির কাজে ব্যস্ত থাকে। তাই রিপ্লাইও সাথে সাথে দিতে পারে না।
সূচনা অপেক্ষা করতে থাকে। এতক্ষণ ঘুম পাচ্ছিল কিন্তু এখন আর পাচ্ছে না।
চিৎ হয়ে শুয়ে সে সিলিং ফ্যানের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ভাবতে থাকে
নিজের জীবনচক্রের কথা। বাবা-মায়ের সাথে তার কথা হয় না। কেননা সূচনা ম্যাসেজ
করতে পারলেও তারা লিখতে জানে না। অন্যদিকে সূচনা কথা বলতে পারে না।
মাঝে মাঝে তার দম আটকে আসে। একটু কথা বলার জন্য হাসফাস লাগে।
একই শহরে থাকার পরও বড়ো বোনের সঙ্গে দেখা করার ভাগ্য হয় না।
সূচনা জানে, গায়ের রং কালো হওয়ায় ভূমিকাকে শ্বশুরবাড়িতে অনেক লাঞ্চনা-বঞ্চনা
সহ্য করতে হয়। তাই আর সে গিয়ে ভূমিকার অশান্তি বাড়াতে চায় না।
বড়ো একটা ভাইও আছে ওদের। তবে সেটা না থাকারই মতোন। বউ
নিয়ে ঢাকার উত্তরায় থাকে। মাসে, বছরেও দেখা হয় না। হঠাৎ হঠাৎ ইচ্ছে হলে মা
ফোন করে খোঁজ-খবর নেয়। মায়ের মন বলে কথা!
সে যখন ভাবনার ঘোরে মত্ত ফোনে তখন ম্যাসেজের টোন বেজে ওঠে। ভূমিকা রিপ্লাই করেছে,’আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?’
‘আমিও আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। কী করিস?’
‘এইতো কাজ শেষ করে গোসল করে আসলাম। ফোন হাতে নিয়ে দেখি তুই ম্যাসেজ করেছিস।’
‘খাসনি এখনও?’
‘না, খাব। তুই খেয়েছিস?’
‘হ্যাঁ। আচ্ছা আগে খেয়ে নে।’
‘খাব। আজকে না কলেজের প্রথম দিন ছিল? কেমন কাটল?’
বোনের সাথে কথা বলতে পারায় ভালো লাগছিল সূচনার। কিন্তু কলেজের কথা মনে
করিয়ে দেওয়ায় মন খারাপ হয়ে যায়। কীভাবে বলবে, প্রথম দিনটাই যে খুব বাজে
কেটেছে! ভূমিকাকে এসব কিছুই বলল না। মিথ্যে করে বলল,’ভালো কেটেছে।’
‘চাচা-চাচি কেমন রে? আর জারিফ? কেউ কিছু বলে না তো?’
চোখের কোণে পানি এসে পড়ে সূচনার। জারিফের অপমানসূচক কথাগুলো মস্তিষ্কে
গেঁথে রয়েছে। যতবার দুজনের সাক্ষাৎ হয়, জারিফ ততবারই অপমান করে। বোনকে
বাড়তি চিন্তা দিতে চায় না বলে লিখল,’সবাই খুব ভালো আপু। রাসেল ভাইয়া কেমন আছে?’
ভূমিকার বুকভেদ করে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে চাপা দীর্ঘশ্বাস। সকালের পর
আর কল করেনি রাসেল। ভূমিকা ফোন দিলেও রাসেল কেটে দিয়েছে। শ্বাশুরী কী
কী বলেছে কে জানে! ছোটো বোনের কাছে তো আর শ্বশুরবাড়ির বদনাম করা
যায় না। সে ছোটো করে লিখল,’ভালো আছে। কালকে
কলেজ থেকে ফেরার সময় আমার বাসায় আসিস।’
‘দেখি চাচাকে আগে বলতে হবে।’
‘আচ্ছা বলিস। তুই একটু ঘুমিয়ে নে। আমি খেয়ে আসি।’
‘আচ্ছা।’
ফোনটা আবার বালিশের নিচে রেখে চোখ বন্ধ করে সূচনা।
ঘুম ঘুম ভাব যখন চলে এসেছিল তখন দরজায় নক করে জারিফ। ঘুমে ঢুলুঢুলু
চোখজোড়া খু্লে রাখতেই কষ্ট হচ্ছিল সূচনার।
উঠে গিয়ে দরজা খোলার পর জারিফ বলল,’খাবারগুলো গরম করে টেবিলে রাখ।
আমি গোসল করে আসছি।’
উত্তরের অপেক্ষা না করে জারিফ ঘরে চলে যায়।
সূচনা যায় রান্নাঘরে। সব খাবার গরম করে টেবিলে সাজিয়ে রাখে।
ফোনে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসে জারিফ। থ্রি কোয়াটার কালো
প্যান্টের সাথে হাফ স্লিভের সাদা টিশার্ট পরেছে সে। ভেজা চুলগুলো জড়োসড়ো হয়ে রয়েছে।
ফোনে কথা বলার সময়ে হাসছিল। সূচনা কখনও জারিফকে এভাবে হাসতে দেখে না।
অন্তত সূচনার সামনে তো হাসেই না। সবসময় রাগ দেখিয়ে কথা বলে। সূচনা মাঝে মাঝে ভাবে,
সে মানুষ তো? একটা গৃহপালিত প্রাণীর সাথেও তো কেউ এমন আচরণ করে না।
এজন্য সে ভাবে, হয়তো পশুর চেয়েও নিচু সে।
সূচনা ঘরে চলে যাচ্ছিল জারিফ ফোনটা একটু দূরে সরিয়ে বলে,’এই বুবি, তুই কোথায় যাস?
এখানে বোস। খাবার কে এগিয়ে দেবে?’
সূচনা একটা চেয়ার টেনে বসল। জারিফ হেসে হেসে ফোনে কথা বলছে আর কী লাগবে
সেটা হাতের ইশারায় ফরমায়েশ করছে। জারিফের কথোপকথন শুনে বুঝতে পারে ফোনের ঐ
পাশের ব্যক্তিটি একটা মেয়ে। হতে পারে জারিফের গার্লফ্রেন্ড।
খাওয়া শেষ করে জারিফ ঘরে চলে যায়। সূচনা টেবিল গোছাচ্ছিল তখন আবার আসে জারিফ।
টেবিলের ওপর টাকা রেখে বলে,’সাড়ে তিনটায় দোকানে যাবি।
গলির মোড়ে দেখবি একটা দোকান আছে। এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আসবি।
আমি ঘুম থেকে উঠে যেন বিছানার পাশে সিগারেট পাই।’
সূচনার আর ঘুমানো হলো না। টেবিল গুছিয়ে ঘরে গিয়ে বসে থাকে। তার রুমের সাথে
ছোটো একটা বারান্দাও আছে। বিকেল হলে বারান্দায় যাওয়া নিষেধ। কারণ ঐ সময়ে
ছেলেরা মাঠে খেলতে আসে। বারান্দা থেকে মাঠ স্পষ্ট দেখা যায়।
বিকেল হতে এখনও অনেক সময়। তাই সে বারান্দায় গিয়ে বসে থাকে। আশেপাশের বাড়ি-ঘর দেখে।
সবার ঘরের বারান্দায় সুন্দর সুন্দর ফুলের গাছ।
.
সূচনারও ইচ্ছে করে বারান্দায় গাছ লাগাতে। বেলী ফুল, সূর্যমুখী, কামিনী আর
গোলাপ গাছ লাগানোর ইচ্ছে আছে। কিন্তু আপাতত হাতে টাকা নেই।
সে ঠিক করেছে একটু একটু করে টাকা জমিয়ে তারপর গাছ কিনবে।
ঘড়ির কাটায় যখন ঠিক তিনটে বেজে ত্রিশ মিনিট তখন বাড়ি থেকে বের হয় সূচনা।
ফুটপাত দিয়ে যাওয়ার সময়ে গাছের নার্সারি দেখা যায়। হরেক রকমের গাছ সেখানে।
ফুলগাছগুলো যেন সূচনাকে আহ্বান করছিল। ঈষৎ হাসে সে ফুলের দিকে তাকিয়ে।
গলির মোড়ের দোকানটায় গিয়ে দেখতে পায় একটা ছেলে বসে আছে বেঞ্চে। সূচনার
ইতস্তত লাগছিল সিগারেট কিনতে যাওয়ার জন্য। কিন্তু না কিনে উপায়-ও তো নেই।
দোকানের কাছাকাছি যাওয়ার পর সূচনার মনে হলো সে ছেলেটিকে চিনে। কয়েক সেকেণ্ড পর
মনে পড়ে এই ছেলেটিই বাসে ওকে প্রটেক্ট করেছিল। দোকানে যাওয়ার পর দুজনের
একবার চোখাচোখি হয়ে যায়। দুজনই সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। সিগারেটের দিকে
তাকিয়ে রয়েছে সূচনা। জারিফ কোনও সিগারেটের নাম বলেনি। আন্দাজে এখন সে
কোন সিগারেট নিয়ে যাবে? চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দোকানদার জিজ্ঞেস করে,’কী নিবা?’
.
সূচনা ফ্যালফ্যাল করে কিছু্ক্ষণ তাকিয়ে থাকে। পরক্ষণে ভাবে জারিফ যখন স্পেসিফিকভাবে
কোনও সিগারেটের নাম বলেনি তার মানে সে সব সিগারেটই খায়।
সূচনা আঙুল তাক করে সিগারেটের প্যাকেট দেখায়। তার উদ্দেশ্য দোকানদার যেই সিগারেটের ওপর
হাত রেখে জিজ্ঞেস করবে,’এটা?’ সে তখন ঐটাই নেবে।
দোকানদার নেভি সিগারেটের প্যাকেটের ওপর হাত রেখে জিজ্ঞেস করল,’এই সিগারেট?’
সূচনা উপর-নিচ মাথা ঝাঁকায়। দোকানদার একটু বাঁকা চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,’কয়টা নিবা?’
সূচনার অস্বস্তি লাগছিল। এখন কী করে বোঝাবে পুরো প্যাকেটটাই যে নেবে?
সে তো সূচনার ইশারা করা কথাও বুঝতে পারবে না। উপায়ন্তর না পেয়ে সূচনা হাত
পেতে প্যাকেটটি দিতে বলে। দোকানদার সিগারেটের প্যাকেট হাতে দিলে সূচনা
পাঁচশো টাকার একটা নোট এগিয়ে দেয়। এবার দোকানদার এবং জয় দুজনই
কৌতুহলী হয়ে তাকায়। কথা কেন বলছে না এটাই তারা ভেবে পাচ্ছে না।
দোকানদার না পেরে জিজ্ঞেস করল,’তোমার গলায় কি কিছু হইছে?’
সূচনা দু’দিকে মাথা নাড়াল। হাত দিয়ে ইশারা করে বলল,’আমি কথা বলতে পারি না।’
দোকানদার কিছু বলার পূর্বে জয় জিজ্ঞেস করল,’আপনি কথা বলতে পারেন না?’
সূচনা এবার দু’দিকে মাথা নাড়াল। দোকানদার টাকা ফিরিয়ে দিয়ে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল
সূচনার যাওয়ার পথে। জয়ের উদ্দেশ্যে বলল,’আল্লাহ্ মানুষরে কোনো না
কোনো দিক দিয়া একটা কমতি রাখেই। দেহো, মাইয়াডা কী সুন্দের চান্দের লাহান!
কিন্তু কথা কইতে পারে না।’
তার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জয় দৌঁড়ে যায়। এক রিকশার সাথে ধাক্কা লেগে
সূচনা রাস্তায় পড়ে গেছে। পাশেই ড্রেন। একটুর জন্য ড্রেনে পড়েনি। রিকশাওয়ালা
বিরক্ত হয়ে বলল,’কতবার কইরা হরেণ বাজাইলাম, হুনেই না।’
‘তো আপনি দেখে ব্রেক করবেন না? এখন যদি বড়ো কোনও এক্সিডেন্ট হয়ে যেত?’
ধমক দিয়ে বলল জয়।
‘হ, হরেণ বাজামু না হুনলে দোষ নাই। আর এক্সিডেন্ট হইলে তহন আমগোর দোষ।’
বিড়বিড় করতে করতে রিকশাওয়ালা চলে গেল। কথা বলতে বলতেই জয় সূচনাকে
ধরে দাঁড় করিয়েছে। হাতের, জামার ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে সূচনা তাকিয়ে রয়েছে ড্রেনের দিকে।
কারণ টাকাগুলো সব ড্রেনে পড়ে গেছে।
‘আপনি ঠিক আছেন?’ জিজ্ঞেস করল জয়। সূচনা ব্যথাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল।
জয় কোমল কণ্ঠে বলল,’একটু দেখেশুনে হাঁটবেন না? আর একটু হলেই তো এক্সিডেন্ট হয়ে যেত।’
.
এ কথার কোনও প্রত্যুত্তর করল না সূচনা। জয় জানতে চাইল,’আপনি কোন বাসায় থাকেন?
সূচনা হাত দিয়ে বাড়ি দেখাল। হঠাৎ করে তখন এক বিড়ালের বাচ্চা
দৌঁড়ে এসে সূচনার পায়ের সাথে লেগে দাঁড়ায়। প্রথমে ভয়ে ভড়কে যায় সে।
জয় বিড়ালের বাচ্চাটিকে তাড়াতে চাইলে সূচনা ইশারায় বারণ করল।
বিড়ালের বাচ্চার মাথায় হাত বুলিয়ে রাস্তার এক সাইডে রেখে দিল।
ফিরে যাওয়ার সময়ে বাচ্চাটি ম্যাও ম্যাও করতে করতে আবার দৌঁড়ে আসে।
সূচনা দাঁড়িয়ে পড়লে বিড়ালের বাচ্চাটিও দাঁড়িয়ে পড়ে। এই কাণ্ড দেখে জয় হেসে ফেলে।
হাসতে হাসতে বলে,’আপনাকে খুব পছন্দ হয়েছে ওর। সাথে করে বাড়িতে নিয়ে যান।’
অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সূচনা। টাকা ড্রেনে পড়ে গেছে এজন্য না জানি কত কথা শুনতে হয়।
এখন যদি এই বাচ্চাটিকে বাড়িতে নিয়ে যায় তাহলে হয়তো সূচনাকেই বাড়ি থেকে বের করে দেবে।
এদিকে বিড়ালের বাচ্চাটিকেও ভীষণ আদুরে লাগছিল এবং বাচ্চাটিও সূচনাকে ছাড়ছিল না।
যেন এক নিরব প্রাণী আরেক নিরব প্রাণীর দেখা পেয়েছে।
তাই সে ঠিক করল বাচ্চাটিকে লুকিয়ে বাড়িতে নিয়ে যাবে।
‘রাস্তাঘাটে দেখেশুনে যাবেন।’ বলে জয় চলে যায়।
সূচনাও বিড়ালের বাচ্চাটি ওড়নার তলায় লুকিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসে।
বাড়ির সবার কাছেই এক্সট্রা চাবি আছে। তাই কলিংবেল না বাজিয়েই বাড়িতে
ঢুকে নিজের রুমে নিয়ে যায় বিড়ালটিকে। টেবিলের ওপর বসিয়ে মাথায় হাত বুলায়।
বিড়ালটি তাকিয়ে আছে সূচনার দিকে। সূচনা নিজের ভাষায় কথা বলে,’খবরদার দুষ্টুমি করবি না।
ঘরেই থাকবি। আর বাইরে যাবি না কিন্তু।’
বিড়ালটি কী বুঝল কে জানে মাথা ঝাঁকিয়ে টেবিলের ওপর শুয়ে পড়ল। সূচনা হেসে ফেলে।
বিড়ালের মাথা চুলকে দিয়ে বলে,’তুই তো দেখি অনেক লক্ষী।
আচ্ছা তোর নাম কী দেওয়া যায় বল তো? তোর গায়ের রং তো গোল্ড।
মিষ্টিও এরকম রঙের হয়। আচ্ছা শোন, আজ থেকে তোর নাম মিঠাই।’
বিড়াল চোখ পিটপিট করল। সূচনা আবার সাবধান করে দিয়ে
দরজা চাপিয়ে জারিফের রুমে যায় সিগারেট রাখতে। দরজা খোলাই ছিল।
জারিফ রুমে নেই। টেবিলের ওপর সিগারেট রেখে আসার সময়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয় জারিফ।
সূচনাকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করে,’সিগারেট এনেছিস?’
সূচনা হাত দিয়ে সিগারেট দেখায়। সিগারেট দেখে জারিফ বলল,’নেভি এনেছিস কেন?
আমি তো নেভি খাই না। গোল্ডলিফ খাই।’
.
সূচনা এদিক-ওদিক তাকিয়ে টেবিল থেকে কলম তুলে নিল।
হাতের তালুতে লিখল,’আপনি তো তখন নাম বলে দেননি।’
জারিফ অন্যমনস্ক হয়ে বলল,’ওহ। আচ্ছা বাকি টাকা কোথায়?’
এবার একটু কাচুমুচু হয়ে দাঁড়ায় সূচনা। জারিফ আবার জিজ্ঞেস করে।
উত্তর না পেয়ে জিজ্ঞেস করে,’টাকা ফেরত আনিসনি?’
আর তখনই ম্যাও ম্যাও করতে করতে ঘরে আসে মিঠাই।
ভয়ে আঁৎকে ওঠে সূচনা। জারিফ বিরক্তের সাথে বলে,’এইটা আবার বাড়িতে ঢুকল কীভাবে?’
এই বলে সে বিড়ালটিকে বাম হাতে তুলে বাইরে রাখতে যায় তখন হাত চেপে ধরে সূচনা।
অনুনয়ের ভঙ্গিতে তাকিয়ে দু’দিকে মাথা নাড়ে।
যাতে বিড়ালটিকে বাইরে না রাখে। চাচি তখন ঘরের সামনে এসে বলে,’কী হয়েছে?’
সূচনা হাত ছেড়ে দেয়। বিড়াল দেখে রেগে যান জেসিয়া মাহামুদ।
চিৎকার করে বলেন,’বাড়িতে বিড়াল কে এনেছে?’
সূচনাকে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন,
‘তোকে যে দয়া করে বাড়িতে থাকতে দিয়েছি এতে তোর হয় না?
তুই আবার আরেক আপদকে ঘরে তুলে এনেছিস!’
তিনি বিড়ালটির গলা চেপে ধরে বাড়ির বাইরে রেখে আসেন।
বারবার চিৎকার করে বিড়ালটি ম্যাও ম্যাও করছিল। কষ্টে চোখে পানি চলে আসে সূচনার।
.
রান্নাঘরে বসে তরকারী কাটছিল ভূমিকা।
রেশমা বেগম ঘুম থেকে উঠে হাই তুলতে তুলতে বললেন,’রান্না শেষ হলে হালিম বানাইও তো।
রিদি আইব।’
রিদি রাসেলের ছোটো বোন। তিন বাড়ির পরের বাড়িতেই হাজবেন্ডের সাথে থাকে।
তিনি এখন মেয়ের বাড়িতেই যাচ্ছেন। শ্বাশুরী চলে যাওয়ার পর
দরজা লাগিয়ে দিয়ে সে ভাত বসিয়ে দেয় চুলায়। অন্যমনস্ক হয়ে তরকারী
কাটছিল আর রাসেলের কথা ভাবছিল।
একটা ছোটো বিষয় নিয়ে এত রাগ দেখানোর কোনও মানে হয়?
দরজায় এলোপাথাড়ি ধাক্কার শব্দ পেয়ে ভূমিকা দরজা খুলে দেয়।
এক বয়স্ক ভিক্ষুক অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। পরনে ছেঁড়া পাঞ্জাবি।
লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে মলিনস্বরে বলে,’মাগো সারাদিন কিছু খাই নাই। কয়ডা ভাত খাইতে দিবা?’
ভূমিকার মায়া লাগে। নিজের বাবার প্রতিচ্ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
এই বয়সেও ভিক্ষা করে খেতে হচ্ছে। উনাদের ছেলে-মেয়েরা কি কোনও খোঁজ-খবর নেয় না?
উনাকে ভেতরে বসতে দিয়ে ভূমিকা খাবার আনতে যায়।
দুপুরে খাওয়ার পর অল্পকিছু ভাত আর তরকারী ছিল।
সেগুলোই একটা প্লেটে নিয়ে সাথে এক গ্লাস পানি দেয়।
তিনি তৃপ্তিসহকারে প্লেটের ভাতগুলো খেতে থাকেন।
বার বার করে তিনি ভূমিকার জন্য দোয়া করছেন আর বলছেন,
‘সারাজীবন সুখী হও মা। তুমি অনেক ভালা।’
‘আগে খান চাচা। পরে কথা বইলেন।’
খাওয়া প্রায় শেষের দিকে যখন তখন ভূমিকা জিজ্ঞেস করল,’আপনার ছেলে-মেয়ে কেউ নেই চাচা?’
অশ্রুসজল হয়ে পড়ে তার দৃষ্টি। নোংরা পাঞ্জাবির হাতায় চোখ মুছে বলেন,
‘দুক্ষের কথা কী কমু মাগো! তিনডা পোলা আমার। সবাই সবার বউ নিয়া আলাদা থাহে।
একটা মাইয়া আছিল। বিয়া দিছি। শ্বশুরবাড়ির লোকজন যোগাযোগ রাখতে দেয় না।
তাই আমিও আর যাই না। মাইয়া সুখী হইলেই আমগো বুড়া-বুড়ির সুখ।’
কষ্টে হচ্ছে ভূমিকার। নিজেদের বাড়ি আর অল্পকিছু জমি-জমা থাকায় নিজের বাবা-মায়ের দিন চলে যাচ্ছে।
এইটুকু যদি না থাকত তবে? আর ভাবতে পারছে না সে।
দুনিয়ার মানুষগুলো ভীষণ স্বার্থপর।
এদের স্বার্থ ফুরিয়ে গেলে তখন বাবা-মাকেও আবর্জনার মতো ছুঁড়ে ফেলে দিতে দু’বার ভাবে না।
হায়রে মানুষ!
ফোন বাজার শব্দ পেয়ে ভূমিকা দৌঁড়ে ঘরে যায়। রাসেল ফোন দিয়েছে ইমোতে।
ফোন ধরেই ভূমিকা অভিমানী কণ্ঠে বলে,’এতক্ষণে রাগ কমেছে তাহলে?’
‘তোমার ওপর রাগ করে থাকতে পারি?’
‘তা তো দেখতেই পেলাম। এখন বলো খেয়েছিলে দুপুরে?’
‘ভূমিকা! ভূমিকা।’
বাইরে থেকে শ্বাশুরীর দারাজ কণ্ঠে ডাক শুনে হকচকিয়ে যায় ভূমিকা।
ফোন না কেটেই দৌঁড়ে আসে ড্রয়িংরুমে। হিংস্র বাঘিনীর মতো তাকিয়ে রয়েছে রেশমা বেগম।
তিনি কর্কশকণ্ঠে বললেন,’এই লোক কে?’
‘মা আসলে, উনি সারাদিন কিছু খাননি তাই…’
‘আর তাই তুমি ঘরে আইনা গাণ্ডেপিণ্ডে গিলাইবা? এদের স্বভাব জানো তুমি?
কখন ঘর থেকে কী চুরি কইরা নিয়া যাইব টেরও পাইবা না।’
অপমানে বুড়ো লোকটি কেঁদে ফেলেন। হাত জড়ো করে বলেন,’মাইয়াডারে বইকো না।
দোষ আমারই!’
শ্বাশুরী ব্যঙ্গ করে বললেন,’বাপের বাড়ি থেইকা চাল আইনা রাখো তাই না?
একজন একজন কইরা আইব আর খাওয়াইবা।’
লোকটি চোখের পানি মুছতে মুছতে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান।
ফোন হাতের মুঠোয় চেপে ধরে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে অশ্রু ত্যাগ করে ভূমিকা।
শ্বাশুরী এখনও নানানরকম কথা শুনিয়ে যাচ্ছেন। ফোনের অপর প্রান্তে তখনও রাসেল লাইনে ছিল।
.
চলবে…
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com