তুমি আমি । পর্ব -০১
এক সপ্তাহ পর..
আজ তাঞ্জিলার বিয়ে। বেশ ধুম ধাম করেই বিয়েটা হচ্ছে তার। তাদের বাড়ীটি খুব সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে আর হবেই বা না কেন আজ যে তাঞ্জিলার বিয়ে। সে হল তার বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে তাই ত তার বিয়েতে কোনো কমতি রাখা হয় নি।
সারাবাড়ী জুড়ে মানুষের হৈ চৈ এবং সাউন্ডবক্সে গান বাজছে।
.
বিউটি পার্লার থেকে মেয়েরা এসে তাঞ্জিলাকে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কারণ
আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বরযাত্রী চলে আসবে। এই বাড়ীতে আর অল্পক্ষণের জন্য
রয়েছে তাঞ্জিলা এরপর শুরু হবে তার নতুন একটি জীবন, নতুন সংসার।
চারিদিকে এত খুশির আমেজ লেগে থাকলেও এসবের মাঝে মন নেই তাঞ্জিলার।
তার ভিতরটি শূন্য শূন্য লাগছে মনে হচ্ছে কেউ একজন এই মূহুর্তে তার পাশে নেই।
হ্যা সে ঠিকই বুঝতে পেরেছে এই মূহুর্তে তার সব থেকে কাছের বন্ধুটি তার পাশে নেই।
হয়ত এজীবনে তাকে আর পাওয়া হবে না।
.
সেদিনের ঐ ঘটনার পর তাঞ্জিলার সাথে তামিমের আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। এমনকি কলেজেও তামিমকে সে দেখতে পায়নি এই গত এক সপ্তাহ ধরে।
হয়ত তার উপর এখনও রেগে আছে তাই বিয়েতেও এলো না।
আসলে সেদিন নিজেই বলে এসেছিল তার বিয়েতে যেন সে না আসে তাই সেই কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে।
.
তাঞ্জিলার এখন বুক ফেটে কান্না আসছে শুধুমাত্র তামিম এর জন্য।
নিজেকে দোষারোপ করছে কেন যে সেদিন রেগে এই কথাটি বলে এলাম।
কিন্তু পরক্ষণে ভাবছে সে যা বলেছে ঠিকই বলেছে, যে মানুষটির অন্যের প্রতি কোনো অনুভূতি
নেই তাকে নিয়ে ভাবারও কোনো প্রয়োজন নেই।
তবুও মন মানছে না ইচ্ছা করছে এখান থেকে ছুটে চলে যেতে তামিম এর কাছে, কিন্তু
পরিবারের মান সম্মানের কথা ভেবে এখনও চুপ করে রয়েছে।
কারণ সেও যে তামিম’কে অনেক ভালোবাসে সেই ছোটবেলা থেকে।
কিন্তু তার এই অনুভূতি কখনও তামিম বুঝতে চায়নি আর হয়ত বুঝবেও না কারণ
এখন আর সময় নেই, কিছুক্ষণ পর সে হয়ে যাবে অন্য কারও
যাকে মন থেকে কখনও আশাও করে নাই সে। তবুও বিধাতার লেখা পরিবর্তন করা যাবে না।
.
নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফোনে পাব্জি খেলছে তামিম।
এদিকে তনিমা বেগম তৈরি হয়েছেন তাঞ্জিলার বিয়েতে যাওয়ার জন্য।
তিনি তৈরি হয়ে তামিম এর ঘরে এসে দেখেন সে এখনও শুয়ে আছে।
তামিমকে তৈরি না হয়ে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন-
তনিমাঃ- কী হল তুই এখনও তৈরি হস নাই কেন? বিয়েতে যাবি না?
তামিমঃ- নাহ!
তনিমাঃ- কেন?
তামিমঃ- এমনি!
তনিমাঃ- কী হয়েছে বল আমাকে,শরীর খারাপ না কী? (এগিয়ে এসে কপালে হাত দিলেন)
তামিমঃ- নাহ আম্মু এমনি ইচ্ছা করছে না যেতে।
তনিমাঃ- কী বলছিস এসব? আজ তোর ছোটবেলার বন্ধুর বিয়ে আর তুই যাবি না এটা কোনো কথা?
তামিমঃ- আহহ আম্মু এভাবে বিরক্ত কর না আমাকে,তোমার যাওয়ার তুমি যাও আমাকে শুধু শুধু কেন ডাকছ? একটু ঘুমাতে দাও।
.
তনিমাঃ- হ্যা আমি ত যাবই কিন্তু একা যাব কীভাবে?
তোর আব্বুও যে ব্যবসার কাজে আটকে গিয়েছেন।
তিনি আরও আমাকে বললেন তোর সাথে যেতে আর তিনি কাজ শেষ করে
আমাদের সাথে বিয়েবাড়ীতে মিলবেন। এখন তুই বলছিস যাবি না তাহলে আমি যাব কার সাথে?
তামিমঃ- তুমি একা চলে যাও না আম্মু, আমাকে টানছ কেন?
তাছাড়া ওদের বাড়ী বেশি দূরে নয়, আমাদের বাড়ী থেকে মাত্র দশটি বাড়ী পরেই।
তাই এতটুকু পথ তুমি একা চলে যেতে পারবে।
তনিমাঃ- কী বলিস? আমি একা গাড়ী চালিয়ে যাব?
তামিমঃ- আম্মু এখন নাটক কর না ত,তুমি আমার থেকেও ভালো গাড়ী চালাতে পারও
ছোটবেলায় আমাকে স্কুলেও নিয়ে গিয়েছ তুমি একা গাড়ী চালিয়ে তাছাড়া
আমাদের বাড়ীতে কোনোকালেও ড্রাইভার ছিল না তাই এসব বাদ দিয়ে যেখানে যাচ্ছ যাও।
তনিমাঃ- কিন্তু একা একা যেতে আমার ভালো লাগছে না।
তামিমঃ- একা কেন হবে? ওখানে গিয়ে দেখবে সবাই তোমার পরিচিত মুখ,
সবার সাথে খুব দ্রুত মিশে গিয়েছে আর আব্বুও ত আসবেন সেখানে।
তনিমাঃ- কিন্তু তুই যাবি না কেন?
তামিমঃ- এক কথা বার বার বল কেন? আমি ত বলেই দিয়েছি যাব না তাহলে আবার জিজ্ঞাসা কর কেন?
তনিমাঃ- রেগে যাচ্ছিস কেন এভাবে বাবু? আচ্ছা তোর কী হয়েছে একটু বলবি আমাকে?
আজ কয়দিন ধরে দেখছি তুই চুপচাপ হয়ে আছিস আগের মত পাগলামি করছিস না
সব কিছু ধীরে সুস্থ্যে করছিস।
তামিমঃ- তুমিই ত বলতে পরিবর্তন হতে তাই নিজেকে পরিবর্তন করতে শিখছি এখন আর কোনো কথা বল না তুমি যাও তোমার দেরী হয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণে দেখও বিয়ে হয়ে গিয়েছে।
তনিমাঃ- আচ্ছা তুই যখন যাবি না তাহলে আমি আর কিছু বলব না। তুই এক কাজ কর বাবা উঠে এসে বাইরের দরজাটি লাগিয়ে দিয়ে যা আর ফ্রিজে খাবার রাখা আছে খুদা লাগলে খেয়ে নিস।
তামিমঃ- আচ্ছা আম্মু সাবধানে যেও।
এরপর তনিমা বেগম বেরিয়ে যান তাঞ্জিলাদের বাড়ীর উদ্দেশ্যে।
.
আম্মু চলে যাওয়ার পর তামিম বাইরের দরজা লাগিয়ে নিজের ঘরে ফিরে আসে।
ঘরে আসার পর ঘরের দরজাটিও লাগিয়ে দেয়।
কম্পিউটার টেবিলের উপর রাখা একটি ছবির ফ্রেম হাতে নেয় সেখানে তার
এবং তাঞ্জিলার একটি ছবি রয়েছে। এই ছবিটি তারা যেদিন প্রথম কলেজে যায় সেদিন তার
আব্বু তুলে দিয়েছিল স্মৃতি হিসেবে।
এখন এই ছবিটি সত্যিই স্মৃতি হয়ে থাকবে চাইলেও আর তাঞ্জিলাকে পাবে না সে।
ছবিটিতে হাত বুলিয়ে তার সামনে টেবিলের উপর রেখে দেয় এবং আস্তে করে বলে- “তোকে কাছে পাওয়ার খুব ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু উপায় নেই। তবুও মন তোকে কাছে পেতে চায় রে একেবারে নিজের করে নিতে চায়। যদি আর একবার সুযোগ পেতাম তাহলে এই সুযোগ আমি কখনও হাত ছাড়া করতাম না “
কথাটি বলছে আর চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে,আজ চোখের পানিরাও বাধা মানছে না তাই স্রোতের বেগে বেয়ে চলেছে।
এখন আর কিছু করার নেই একটু পরই তাঞ্জিলার বিয়ে হয়ে যাবে,সে চলে যাবে অন্য কারও সাথে এক নতুন ঠিকানায়।
.
টেবিলের ড্রয়ার থেকে ঘুমের ওষুধের পাতাটি বের করে কয়েকটি ওষুধ খুলে নিয়ে
এক নাগাড়ে খেয়ে নেয়। এখন তার ঘুমের প্রয়োজন কারণ সে জেগে থাকলে কষ্টরা আরও তাকে
ঘিরে ধরবে তাই এখন জেগে থাকলে চলবে না।
ঘুমের ওষুধগুলো খাওয়ার পর আস্তে আস্তে ঘুমেরা এসে তার চোখের পাতায় ভর
করেছে তাই আর বসে না থেকে টেবিলের উপর থেকে ফোনটি নিয়ে সোজা বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।
.
কী রে তাঞ্জিলা এভাবে মন খারাপ করে বসে আছিস কেন? আর কী ভাবছিস?
তনিমা বেগমের কথায় তাঞ্জিলা ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে একটু নড়েচড়ে বসল এবং মাথা তুলে তাকায়।
বড়মাকে দেখার পর তাঞ্জিলার মনে হল তামিমও এসেছে তাই এদিক সেদিক তাকিয়ে খুজতে থাকে।
তাকে এভাবে এদিক সেদিক তাকাতে দেখে তনিমা বেগম বললেন-
তনিমাঃ- কী হল তোর মা,এমন ভাবে এদিক সেদিক তাকাচ্ছিস কেন? কাউকে খুজছিস?
তাঞ্জিলাঃ- বড়মা তুমি একা এসেছ?
তনিমাঃ- হ্যা রে মা আমার একা আসতে হল,তোর বড় বাবা তার কাজে ব্যস্ত উনি বলেছেন
একবারে কাজ সেরে এখানে চলে আসবেন। আর তামিম ওর কথা বলিস না এত
করে বললাম কিন্তু এলো না তার নাকি ভালো লাগছে না।
তাঞ্জিলাঃ- ওহ।
তনিমাঃ- বাদ দে ওর কথা ও ত এমনই। তবে মা তোকে কিন্তু একেবারে পরীর মত লাগছে রে।
তাঞ্জিলাঃ- তাই নাকি বড়মা কিন্তু তোমাকেও আজ অনেক সুন্দর লাগছে।
তনিমাঃ- হা হা তাই নাকি,আচ্ছা তুই বস আমি গিয়ে ওদিকটা দেখে আসছি একটু পরেই ত বরযাত্রী চলে আসবে।
তাঞ্জিলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তনিমা বেগম চলে যান।
এদিকে তাঞ্জিলার মনটা আরও খারাপ হয়ে যায় তামিম’কে না দেখতে পেয়ে। তবে এখানে তামিম এর কোনো দোষ নেই কারণ সে নিজেই তাকে আসতে নিষেধ করেছিল।
তাছাড়া তামিম এর যে ইগো তাতে করে সে জীবনেও এখানে আসবে না।
নিজের ভূলের জন্য এখন নিজেকেই ধিক্কার জানাচ্ছে।
.
বর এসেছে…বর এসেছে…..
চারিদিকে হৈ চৈ লেগে গিয়েছে বর এসেছে এই ধ্বনিতে। সবাই দৌড়ে গিয়েছে বর দেখার জন্য আর তাঞ্জিলা ঘরে একা বসে তামিমের কথা ভাবছে।
এই একলা ঘরে এখন অঝোরে কেদে চলেছে সে যা এতক্ষণ এত মানুষের মাঝে পারছিল না।
এতদিনের সব জল্পনা কল্পনাকে মিথ্যে করে অন্য কেউ এসে নিয়ে যাবে তাকে। যাকে পাওয়ার আশায় ছিল কিন্তু সে তাকে বুঝল না,মিছে মিছে স্বপ্ন বুনেছিল এতটা বছর ধরে।
চলবে…
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com