আকাশচুম্বী স্বপ্ন | পর্ব -০৩
আমি আর বিথী রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তখন চোখ পড়ল আঁখি মঞ্জিলের দোতলায়। সেই মেয়েটি বেলকনির গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাচ্ছে। চিৎকার, টানা-হেঁচড়া কিছুই করছে না। তবে তার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। আমি তার দিকে তাকাতেই সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল৷ আমার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলো। এবার আমি নিশ্চিত হলাম, সে আমার উপর রেগে আছে। কিন্তু কেন রেগে আছে, তা জানা হলো না।
সন্ধ্যায় বাসায় ফিরছিলাম। মেয়েটি তখনও বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে৷ আমি স্থির হয়ে দাঁড়ালাম।
মনে হলো মেয়েটি আমাকে হাত দিয়ে ইশারা করে ডাকছে।
আমি একটু মনোযোগ দিয়ে তাকালাম।
সত্যিই ডাকছে। আজ সন্ধ্যের পরেই হয়তো আঁখি মঞ্জিলের গেটে তালা দেওয়া হয়েছে।
আমাকে দেয়াল টপকে ভিতরে যেতে হলো।
কাঁঠাল গাছ বেয়ে মেয়েটির একদম কাছে চলে গেলাম।
এতটা কাছাকাছি হব, ভাবিনি কখনো৷ মেয়েটি শান্ত গলায় বলল- আপনিও আমায় পাগল ভাবেন?
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। এতদিন আমার ধারণা ছিল, মেয়েটি কথা বলতে পারে না।
সে এবার বললো-
– শক্ত করে ধরুন, পড়ে যাবেন তো!
– আপনি কথা বলতে পারেন?
মেয়েটি খিলখিল করে হাসলো, সে হাসলে তার গালে টোল পড়ে, তা এতদিন খেয়াল করিনি।
ফর্সা গালের গভীর টোল একবার হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছিল। আমি বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বললাম-
– নাম কি আপনার?
– আমি নীলা, আপনি?
– তানভীর
সেদিন আমাদের কথোপকথন এতটুকুতেই থেমে গেলো।
কারণ, ততক্ষণে আঁখি মঞ্জিলের সেই ভদ্রমহিলা বাসায় ফিরে এসেছিলেন।
আমি কাঁঠাল গাছ বেয়ে নিচে নেমে দেয়াল টপকে দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেলাম।
এরপর যখন দেখা হলো, মেয়েটি বেলকনিতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে।
আমি রিকশার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আবার সেই উদাসীন ভাব।
চোখে-মুখে ভয় সে আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো।
ভদ্রমহিলা ছুটে এলেন, তাকে টেনে ভিতরে নিয়ে গেলেন।
আমি তখনও বিশ্বাস করিনি তার নাম নীলা মনে হলো, মেয়েটা মিথ্যে বলেছে।
হয়তো রসিকতা করেছিল।
একদিন সেই কালো ভদ্রলোকের দেখা পেলাম। গলির রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ফুঁকছিলেন।
আমাকে দেখে হনহন করে চলে যাচ্ছিলেন। আমি ডাকলাম।
তিনি দাঁড়ালেন না। উপায় না পেয়ে দৌড়ে গিয়ে খপ করে উনার হাত ধরে ফেললাম।
তিনি বিরক্ত নিয়ে বললেন-
– কি চাই?
– সেই মেয়েটার ব্যাপারে জানতে চাই।
– কোন মেয়ে! নীলা?
আমি তখন বুঝতে পারলাম, মেয়েটি রসিকতা করেনি। সত্যি বলেছিল।
তখন আমি ভদ্রলোককে বললাম-
– হ্যাঁ, নীলার ব্যাপারে জানতে চাই, ওঁকে কেন নির্যাতন করা হয়?
কেন বেঁধে রাখা হয়? আপনি তার কি হন ইত্যাদি।
– আমি তার বাবা!
আমি বিস্মিত চোখে চেয়ে বললাম- বাবা হয়ে নিজের মেয়েকে নির্যাতন করেন?
কেমন বাবা আপনি?
তিনি গম্ভীর ভাব নিয়ে বললেন- নির্যাতন আমি করি না তুমি? নিজের দোষ আমার উপর চাপাচ্ছো?
মনে রেখো, তুমি আজ অন্যের সাথে যা করবে,
একদিন অন্য একজন তোমার সাথে ঠিক তেমনটা করবে। (বলে হনহন করে চলে গেলেন তিনি)
আমি দাঁড়িয়ে রইলাম৷ তখন পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানুষ মনে হচ্ছিল নিজেকে।
চোখের জল টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছিল।
আমি শুধু বিড়বিড় করে বললাম- আমি নির্যাতন করি! আমি?
একদিন আঁখি মঞ্জিলে মেহমান এলো। এক গাড়ি মেহমান। সকালে এসেছে ওঁরা।
দিনটা শুক্রবার। অফিস নেই। আমি সুযোগের অপেক্ষা করছিলাম।
কখন কেউ একজন বেড়োবে। কখন আমি একটু ভাব জমিয়ে কথা আদায় করব।
কিন্তু সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো, কেউ বেরোল না। একটা কুকুর পর্যন্ত না।
শুধু রাস্তার ওপাশে নোহা গাড়িটা দাঁড় করা দেখা যাচ্ছে।
ড্রাইভার গাড়িতে বসে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছে।
বিকেল হয়ে এলো, কারোর দেখা পেলাম না। হঠাৎ আঁখি মঞ্জিলের দরজায় শব্দ হলো।
একটা মেয়ে ওখান থেকে বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়াল। আমি ছুটে গেলাম তার কাছে।
কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে বললাম- এই মেয়ে, নাম কি তোমার?
মেয়েটা আমার দিকে তাকালো ষোলো-সতেরো বছর হবে বয়স। গোলগাল চেহারা।
চোখে-মুখে চঞ্চলতা। সে আমার দিকে এমনভাবে তাকাল,
মনে হচ্ছিল সে আমাকে অনেক আগে থেকে চেনে।
হাসি হাসি মুখে বললো- আমি নওরিন, তুমি?
– তানভীর!
– তানভীর তুমি কীসে পড়?
– পড়াশোনা তো শেষ।
নওরিন চিন্তিত ভাব নিয়ে বলল- তাহলে তো তুমি অনেক বড়!
আমি একটু হাসলাম। বললাম- এখানে কার বাসায় এসেছো?
– খালা মনির বাসায়।
তারপর অনেক কথা হলো। কথা বলতে বলতে আমি অনেকগুলো চকলেট দিলাম তার হাতে।
যখন ভাব হয়ে গেল, তখনই জিজ্ঞেস করলাম…
– নীলা তোমার কী হয়?
– নীলা আপু আমার আপু হয়।
– ওঁর এই অবস্থা কি ছোটোবেলা থেকেই? মানে শিকল বন্দি!
মেয়েটার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে করুণ গলায় বললো-
– না, না। আপু খুব লক্ষী একটা মেয়ে। খুব বুদ্ধীমতী। দেখতেও সুন্দর।
পড়াশোনায় টপার ছিল। গত এক বছরে আপু এমন হয়ে গেছে।
আমি আর কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম- কেন হয়েছে এমনটা?
– আপু একটা ছেলেকে ভালোবাসতো। ভীষণ ভালোবাসতো।
শুনেছি ছেলেটাকে এক নজর দেখার জন্য আপু ঘন্টার পর ঘন্টা বেলকনিতে,
রাস্তায় রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতো। বৃষ্টিতে ভিজত,
একদিন ছেলেটাকে দেখতে না পেলে সে খাবার খেত না কিন্তু ছেলেটা…
বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নওরিন। মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
আমি বুঝতে পারলাম নীলাকে কোনো এক ছেলে আঘাত দিয়েছে।
যার ক্ষত এখনও শুকায়নি। হয়তো শুকাবেও না।
আমি তখন নওরিনকে ছেলেটার সম্পর্ক জিজ্ঞেস করলাম-
– ছেলেটা কে জানো তুমি? দেখেছো তাকে কখনো?
– চিনি না, দেখিনি কখনো তবে নাম শুনেছি
– কী নাম তার?
– তানভীর (বলেই হনহন করে চলে গেল সে)
আমি আরো একবার ধাক্কা খেলাম। জানি না কী ঘটছে আমার সাথে।
তবে যা-ই ঘটছে, খুব বাজে ঘটছে এর পরিণাম হয়তো খুব একটা ভালো হবে না।
সেদিন রাতেও আমার ঘুম হয়নি। সারারাত এপাশ-ওপাশ করে কাটিয়েছি।
আর ভেবেছি, সবার আঙুল ঘুরে ফিরে আমার দিকেই আসে কেন?
কেনই বা আঁখি মঞ্জিলের লোকগুলো আমাকে এতটা ঘৃণা করে?
কেন নীলা মেয়েটাকে আমার এত আপন
মনে হয়? কেন বাবা নীলার কথা শুনে রেগে গেলেন?
কেন নওরিন নীলাকে আঘাত দেওয়া ছেলেটার নাম বলতে গিয়ে আমার নাম বলল?
এরকম অসংখ্য প্রশ্ন ঘুরছিল আমার মাথায়। ঘুমে চোখ লেগে এলো।
ভোর বেলা তখন মসজিদ থেকে ফজরের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। বাবা দরজায় টুকা দিলেন।
– তানভীর এই তানভীর ওঠ, আজান দিচ্ছে নামাজ পড়বি না?
ঘুম থেকে উঠে বাবার সাথে নামাজ পড়তে যাই। সেদিনের পর আর নীলার দেখা পাইনি।
দিনের পর দিন কেটে যায় তারপর সপ্তাহ, মনে হলো এই বুঝি দম আটকে গেল।
তবু বেঁচে রইলাম। তৃষ্ণা রয়ে গেল। তৃষ্ণার্ত চোখ নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা
করতাম আঁখি মঞ্জিলের সামনে।
দেখতে দেখতে দু’সপ্তাহ তারপর তিন এতো দিনে মেয়েটাকে একটি বার দেখিনি
তার গলার আওয়াজ শুনতে পাইনি সাড়া-শব্দ কিছুই না।
এক মাসের মাথায় হঠাৎ একদিন দেখলাম সে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
আমি যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। ততদিনে মেয়েটা আরো শুকিয়ে গেছে।
কপালের হাড় পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। চোখের নিচে এতটাই কালো হয়েছে,
মনে হচ্ছিল কেউ কালি লেপ্টে দিয়েছে তার চোখের নিচে। চোখগুলো যেন হাড়ের ভিতর চলে গেছে।
তবে তার শুকনো হাসিটা আগের মতোই, আমার দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসল সে।
আমার এতদিনের অপেক্ষা, এতদিনের দুশ্চিন্তা,
ভয়-ভীতি সবকিছুর অবসান হয়ে গেল এক মুহূর্তে। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলাম।
তখন চোখে পড়ল শিকলে বাঁধা হাত। মনে মনে ভাবলাম,
সব মেয়ের জীবনেই কি এমন! একটা অদৃশ্য শিকল থাকে?
সেটা কি লোহার, তামার, না রূপার? মেয়েরা কি জন্মগতভাবেই এরকম?
.
চলবে…
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com