Breaking News

আকাশচুম্বী স্বপ্ন | পর্ব -০৪ এবং শেষ

মেয়েদের জীবনেও কি এমন একটা অদৃশ্য শিকল থাকে? মেয়েরা কি জন্মগতভাবেই এরকম? চার দেয়ালে বন্দিদশা, এ-ও কি কম? সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা, রাত আবার ভোর। নতুন সকাল। সবটুকুই কাটে তার চার দেয়ালে। দেখতে হয় সেই একই মানুষ, একই দেয়াল, একই ছাদ। পুরুষেরা বাসা, কর্মস্থল, বন্ধু-বান্ধব, আড্ডা ইত্যাদি, ইত্যাদি। দিনশেষে যখন ঘরে ফিরে, সাথে থাকে শুধু ক্লান্তি, গ্লানি, অবসাদ। অতিরিক্ত একটা চকলেটও না।
অথচ, অতিরিক্ত একটি চকলেট নিয়ে এলে হয়তো নতুন মোড়ক দেখতে পেত।
তবুওতো তারা কিছু বলে না, হাসিমুখে সব বরণ করে নেয়।
তবু কেন এত এত কথা শুনতে হয় তাদের? কেন সব গালি মেয়েদের জন্যই বরাদ্দ?
কেন আজ মেয়েরাই আমাদের চোখে দূর্বল? সেই দূর্বল মেয়েটাই “মা”।
আর যিনি মা হবার যোগ্যতা রাখেন, তিনি কখনো দূর্বল হতে পারেন না।
কিছু পাঠকেরা আমার লেখায় নাকি রস খুঁজে পান না।
লেখায় নাকি জানার বা বুঝার কিছু থাকে না।
আমি নাকি গল্পে পাঠকদের জন্য কোনো মেসেজ রাখি না।
সেসব পাঠকদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হয়। আমি ভাই ছোট মানুষ।
ওসব আঙুল-ফাঙুল তুলার সাধ্য আমার নেই।
ছোট্ট জীবনের ক্ষুদ্র সময় থেকে কিছুটা সময় আলাদা করে রেখেছি লেখালিখির জন্য।
সেই সময়টা পাঠকদের উপহার দেই। বিনিময়ে নাহয় দু’কথা শুনলাম।
তাতে আমার আফসোস নেই। সে যাইহোক,
গল্পের ফেরা যাক, আমি আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না।
কোনো এক অজানা ভয় কাজ করতে লাগল। নীলা তখনও বেলকনিতে দাঁড়িয়ে।
আমি চুপচাপ মাথা নিচু করে বাসায় চলে এলাম।
মা আমার খুব আপন ছিলেন। যখন মন খারাপ হতো, মা’র কাছে গিয়ে বলতাম।
কিন্তু এখন তো মা নেই। মা মারা যাবার পর একটি ডায়েরি কিনেছি। এখনও একটি শব্দ লিখিনি।
তবে আজ হয়তো ডায়েরিটা কাজে আসবে। অনেক্ষণ ডায়েরি সামনে নিয়ে বসে রইলাম।
শেষমেশ কিছুই লিখতে পারলাম না।
তবে এতক্ষণে ফোঁটা ফোঁটা জল আমার ডায়েরির পাতা স্পর্শ করেছে।
ইচ্ছে করছে চিৎকার দিয়ে মা’কে ডাকি। আচ্ছা, চিৎকার দিয়ে ডাকলে মা আসবে তো?
আগের মতো আমাকে শান্তনা দেবে তো?
একদিন রাতে আঁখি মঞ্জিল থেকে চিৎকার দেওয়ার শব্দ আসছিল। আমি দৌড়ে গেলাম।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে খেয়াল করলাম, নীলা চিৎকার দিয়ে কাঁদছে।
মনে হচ্ছে কেউ ওঁকে মারধর করছে। মাঝে মাঝে কাচের জিনিসপত্র ভাঙার আওয়াজ আসছিল।
নীলার ঘরে তখন অন্ধকার। আমি ভেবে পেলাম না অন্ধকার ঘরে মেয়েটা এমন করছে কেন?
দেয়াল টপকে ভিতরে গেলাম। ভয়ে ভয়ে ডোরবেল বাজালাম।
সেই ভদ্রমহিলা দরজা খুলে দিলেন। কিছু বললেন না। কৌতূহলী ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
খেয়াল করলাম, নীলা তার শোবার ঘর থেকে উঁকি দিয়ে আমাকে দেখছে। তার মুখ দেখে মনে হলো,
সে কিছুটা লজ্জা পেয়েছে।
তখন ভদ্রলোক দ্রুত পায়ে এসে আমাকে ধাক্কা দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলেন। আমি ছিটকে পড়লাম। দেয়ালে ধাক্কা লেগে কপালের কিছুটা অংশ কেটে গেল। কপালে হাত লাগাতেই টলটলে লাল রক্তে ভিজে গেল হাত। বাসায় ফিরে আসলাম। ঘুমাতে পারছি না মেয়েটার মায়াবী চেহারা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে
একদিন রাতে বিছানায় বসে ডায়েরিতে কিছু একটা লিখার চেষ্টা করছিলাম। তখন ধীর পায়ে বাবা রুমে এলেন। চেয়ার টেনে আমার সামনে বসলেন। আমার হাত ধরে বললেন- তোর সাথে বড় অন্যায় করে ফেলেছি রে বাবা বড় অন্যায় করে ফেলেছি।
আমি কৌতূহলী ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলাম- কী হয়েছে বাবা?
তিনি শান্তনা দেবার ছলে বললেন- বিথীকে তুই ভুলে যা বাবা।
– কেন বাবা, কী হয়েছে?
বাবা আসামির মতো মাথা নিচু করে বললেন- বিথী তার প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়েছে। রোহিত ফোন দিয়েছিল। খুব কান্নাকাটি করছে। তোর কাছে ক্ষমাও চেয়েছে। আমাকে তুই মাফ করে দিস বাবা। না বুঝে মেয়েটার সঙ্গে তোর বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়াটা মোটেও উচিত হয়নি।
আমি মৃদু হেসে বললাম- কি বলছো বাবা! এতে তোমার কী দোষ! যা হবার, তা তো হবেই বাদ দাও।
বাবা আমার হাত আরো শক্ত করে ধরে কাঁপা গলায় বললেন- আরো একটা পাপ করেছি বাবা…
– কি সেটা?
বাবা তড়িঘড়ি করে চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। বুক পকেট থেকে লাইটার বের করলেন।
একটা সিগারেট জ্বালালেন।
বাবা এখনও শক্ত মানুষ। এক নিঃশ্বাসে অনেকটা পথ দৌড়ে পাড়ি দিতে পারেন।
যতটা আমিও পারি না। তবে আজ তাকে দূর্বল দেখাচ্ছে। একটু বেশিই দূর্বল।
হাত কাঁপছে। তিনি বাঁ হাতে এস্ট্রে নিয়ে চেয়ারে বসলেন।
কিছুক্ষণ একটানা সিগারেটের ধোঁয়া ফুঁকলেন।
উচ্ছিষ্ট অংশ এস্ট্রেতে রেখে আরো একটি সিগারেট জ্বালালেন।
একের পর এক কয়েক টান দিয়ে বললেন-
– একটা মেয়ে তোকে ভীষণ ভালোবাসতো। তুই যখন বাসা থেকে বেরিয়ে যেতিস, মেয়েটি তোর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত। আবার রাতে তোর ফিরে আসার অপেক্ষায় রাস্তার দিকে চেয়ে থাকতো অপলক নয়নে। সে ছিল আমার দু’চোখের বিষ। আমি কখনোই তাকে তোর পাশে চাইতাম না। কারণ আমি আগে থেকেই তোর সাথে আমার বন্ধু খলিলের মেয়ে নবনীর বিয়ে ঠিক করে রেখেছিলাম।
আমি কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে প্রশ্ন করে বসলাম।
– আমি কি মেয়েটাকে চিনতাম বাবা?
বাবা আরো একটি সিগারেট জ্বালালেন। এত ঘনঘন সিগারেট খাওয়া তার অভ্যাস না। দিন-রাতে বড়জোর চার-পাঁচটা সিগারেট খান তিনি। অথচ গত দশ মিনিটে তিনটি সিগারেট শেষ করতে চলেছেন। কথা বলছেন ধোঁয়া ফুঁকতে ফুঁকতে। বাবা উদাসীন ভাবে বললেন-
– তুই খেয়াল করিসনি কখনো। মেয়েটা প্রতিদিন তোকে দেখত, প্রতিদিন তোর জন্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতো। এমনও হয়েছে, তুই রাস্তার এক পাশ দিয়ে হেঁটেছিস, মেয়েটা রাস্তার অন্য পাশ দিয়ে তোর সাথে তাল মিলিয়ে হেঁটেছে। হয়তো খেয়াল করিসনি। একদিন মেয়েটাকে সামনাসামনি পেয়ে গেলাম। পেয়েছি বললে ভুল হবে। তার সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যেই বেরিয়েছিলাম। কারণ আমি জানতাম, তখন সে ভার্সিটিতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরোবে। যেই না গেট দিয়ে বেরোল, আমি তার পথ আটকালাম। গম্ভীর গলায় বললাম- এই মেয়ে, কী চাই তোমার?
মেয়েটি ভয়ার্ত গলায় বলল- কিছু চাই না।
তখন আমি হুংকার দিলাম। বললাম- কিছু না চাইলে আমার ছেলের পিছু নিয়েছো কেন? কী চাও তুমি?
তখন মেয়েটা চোখের জল ছেড়ে কাঁদতে লাগল। আমি চেঁচালাম। আশেপাশে লোকজন জড়ো হলো। মেয়েটি তখনও কাঁদছিল। একসময় তার মা এলেন। আমার কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইলেন। আমি ইচ্ছেমতো অপমান করলাম। যা খুশি গালাগাল করলাম। মেয়েটির মা কিছুই বলল না। আসামির মতো দাঁড়িয়ে রইল।
আমি বাবাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম- তুমি এসব করেছো বাবা?
বাবা ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- বড় অন্যায় করে ফেলেছি রে বাপ। আমি জানতাম না, মেয়েটা তোকে এতটা ভালোবাসে। শুনেছি মেয়েটা নাকি পাগল হয়ে গেছে! তবে মাঝে মাঝে ভালো হয়ে যায়।
– মেয়েটার নাম কি বাবা?
বাবা আর্তনাদের স্বরে বললেন- নীলা!
নীলা নাম শুনতেই আমার বুক কেঁপে উঠল। আমি আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকলাম না। দৌড়ে ছুটে গেলাম আঁখি মঞ্জিলে। দোতলায় গিয়ে ডোরবেল বাজালাম। ভদ্রমহিলা দরজা খুললেন। তখন আমি বললাম-
– নীলার সাথে কথা বলতে চাই। প্লিজ দরজা বন্ধ করবেন না।
– আমার ভালো মেয়েটাকে আধপাগল বানিয়ে রেখেছো এবার কি পুরোপুরি পাগল বানাতে চাও?
– একবার শুধু যেতে দিন। এটুকু দয়া করুন। শুধু একবার ওঁর সাথে কথা বলব। (আমি হাত জোড় করলাম বললাম)
ভদ্রমহিলার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে শুরু করল। তিনি কান্না কণ্ঠে বললেন- আমার একটাই মেয়ে খুব লক্ষী শুধু তোমার জন্য আজ আমার মেয়েটার এ অবস্থা। ভালো মেয়েটাকে শিকল বন্দি করে রাখতে হয়। ওঁর হাত পায়ের কাটা দাগগুলো দেখেছো? সে নিজে নিজে পাগলামো করে। এমন তো সে ছিল না। কেন সে এমন করবে?
বলে তিনি ভিতরে চলে গেলেন। আমি গেলাম তার পিছু পিছু। নীলার শোবার ঘরে গিয়ে দেখলাম, সে বিছানায় কাঁচুমাচু হয়ে শুয়ে আছে। আমি তার পাশে বসতেই তার ঘুম ভেঙে গেল। সে ঘুমঘুম চোখে তাকালো আমার দিকে, চোখ কচলে আবার তাকাল। আমাকে বারবার ছুঁয়ে দেখল। ভদ্রমহিলা চাবি এনে দিলেন। আমি লোহার শিকল খুলে দিলাম। নীলাকে ছাদে নিয়ে গেলাম। অবাক করার মতো বিষয়, গত ক’দিনে তার বয়স আরো কমে গেছে। দেখতে অনেকটা বাচ্চা বাচ্চা মনে হচ্ছে। ছাদে গিয়েও সে আমাকে কয়েকবার ছুঁয়ে দেখল। আমি তার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে বললাম-
– তুমি কি আমার শেষ বয়সের সঙ্গী হবে?
নীলা আরো একবার আমাকে ছুঁয়ে দেখল। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল…
– আমার আকাশচুম্বী স্বপ্ন আজ সামনে দাঁড়িয়ে আমায় চাইছে। এটা কি আদৌ বাস্তব না কি সেই আগেকার স্বপ্ন?
– বাস্তব, বিশ্বাস না হয় ছুঁয়ে দেখ।
– যদি কখনো হারিয়ে যাও?
– হারাবো না, একবার শুধু হাতটা ধরো। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আগলে রাখবো।
– আর যদি আমি হারিয়ে যাই?
– খুঁজে নেবো, যেখানেই যাবে ছায়া হয়ে থাকবো পাশে।
এভাবেই পূর্নতা পেলো আরো একটি ভালোবাসা! ভালো থাকুক সব ভালোবাসার মানুষগুলো, ভালো থাকুক তাদের প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে।
<>সমাপ্ত<>

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com