যেদিন তুমি এসেছিলে । পর্ব -০৫
কেবিন দো’তলায় হওয়ার সুবাদে এক ফালি রোদ্দুর এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল অর্ষার চোখে-মুখে। সে বন্ধ চোখ কুঁচকে ফেলে। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। কোথায় আছে বোঝার চেষ্টা করে কিছুক্ষণ। শোয়া থেকে উঠে বসে চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারে হাসপাতালে রয়েছে। মাথার মধ্যে এখনো ঝিমঝিম করছে। হাতের ওপর লেপ্টে থাকা রোদ্দুর দেখতে গিয়ে দেখতে পায় মারের দাগগুলো। কষ্টের মাঝেও সে হেসে ফেলে।
‘তুমি উঠে গেছ?’ ভেতরে আসতে আসতে বলল আহনাফ।
.
আহনাফের উপস্থিতি অর্ষাকে বিস্মিত করে। চোখের পলকেই গতকালের দৃশ্যপট চোখের পাতায় ভেসে ওঠে। তবে সকালেও যে লোকটাকে সে এখানে পাবে সেটা আশা করেনি। অথচ অর্ষা জানলই না, লোকটা শুধু সকালেই নয় বরং সারা রাত জেগে হাসপাতালেই ছিল।
সে দৃষ্টি নত করে বলল,’হুম।’
‘শরীর কেমন এখন?’ পাশের চেয়ারে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল আহনাফ।
অর্ষা এবারও ছোটো উত্তরে বলল,’ভালো।’
‘সম্পূর্ণ ভালো নয়। শরীরে জ্বর নেই। তবে শরীর কিন্তু দুর্বল। বাড়িতে ফিরে ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করবে। সময়মতো ওষুধও খাবে।’
‘জি আচ্ছা।’
.
আহনাফ ভালোমতো খেয়াল করে দেখল, অর্ষা তার দিকে তাকাচ্ছে না। নিজের হাতের দিকে দৃষ্টি রেখে কথা বলছে। কথা বলতে অস্বস্তিবোধ করছে? নাকি মেয়েটা এমনই? তার চিন্তাচেতনা শেষ হওয়ার পূর্বেই অর্ষা জিজ্ঞেস করল,’কেয়া আপু কোথায়?’
‘সম্ভবত শো-রুমে। সকালে তোমায় দেখতে এসেছিল।’
‘কয়টা বাজে এখন?’
আহনাফ হাত ঘড়িতে সময় দেখে বলল,’৯:৪০।’
‘বাড়ি ফিরতে হবে। কলেজে যেতে হবে।’
আহনাফ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বলল,’একদিন কলেজে না গেলে কিছু হবে না। আজ যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আজকের দিনটা রেস্ট নাও। চাইলে তুমি হাসপাতালেই রেস্ট নিতে পারো। বাড়িতে তো মনে হয় না রেস্ট নেওয়ার সুযোগ হবে।’
অর্ষা উত্তর করল না। চুপ করে রইল। আহনাফ নিজেই জিজ্ঞেস করল,’থাকবে এখানে?’
‘না।’
‘ঠিকাছে। তুমি নিজের জামা-কাপড় পরে তৈরি হয়ে নাও। আমি হাসপাতালের বাকি বিল মিটিয়ে আসছি।’
অর্ষা কিছু বলল না। আহনাফও উত্তরের অপেক্ষা না করে বাইরে বেরিয়ে যায়।
.
৯:২৫ থেকে আহিল বাড়ির সামনে অপেক্ষা করছে। অর্ষার এতক্ষণে চলে আসার কথা। লেট করছে কেন? আর অপেক্ষা না করে সে নিজেই অর্ষার বাড়িতে চলে যায়। তিয়াস বারান্দায় বসে খেলছিল। আহিলকে দেখে সে দু’হাত বাড়িয়ে দেয় কোলে নেওয়ার জন্য।
আহিল হেসে ও’কে কোলে নেয়। জিজ্ঞেস করে,’কেমন আছো চাচ্চু?’
তিয়াস কিছু না বলে আহিলের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখে। তার মন খারাপ বোঝা যাচ্ছে। আহিল তিয়াসের পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,’বাবার মন খারাপ?’
তিয়াস নিরব,নির্বিকার। আহিলের কণ্ঠস্বর শুনে কুসুম ঘর থেকে বের হয়। আহিল মনে মনে প্রচণ্ড রকম ঘৃণা করে কুসুমকে। কুসুম যে বোঝে না তা নয়। আহিলের চোখের দৃষ্টিই বলে দেয় সে কুসুমকে কতটা ঘৃণা করে। শুধুমাত্র অর্ষার জন্যই সে সবসময় কুসুমের সঙ্গে ভদ্রতা দেখিয়ে নম্রভাবে কথা বলে।
আহিল জিজ্ঞেস করে,’অর্ষা কোথায় ভাবি?’
কুসুমের চোখ-মুখ অন্ধকার। সে আহিলের সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী নয়। আবার না বলেও উপায় নেই। তাই গম্ভীর হয়ে বলল,’জানি না।’
.
আহিল বোঝে, এই ‘জানি না’র পেছনেও কুসুম সব জানে। তবে সে আহিলকে কিছু বলবে না। তাই সে কুসুমকেও ঘাটায় না। তিয়াসকে কুসুমের কোলে দিয়ে বাড়ি থেকে হয়ে কেয়াকে ফোন করে। কেয়া তখন কাস্টমার সামলিয়ে ব্যস্ত। ফোন তোলারও সময় নেই। আহিল ফোনের ওপর ফোন করছে বলে কেয়া উপায় না পেয়ে ফোন রিসিভ করে।
আহিল সোজাসুজি অর্ষার প্রসঙ্গে চলে যায়। জিজ্ঞেস করে,’অর্ষা কোথায় জানো?’
কেয়া কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও থমকায়। ভাবে আহিলকে সে কী বলবে। সত্যিটা বললে ঝামেলা বাড়বে। সিদ্ধান্ত নিল মিথ্যাই বলবে। তাই সে বলল,’অর্ষা আমার সাথে আছে। আজ কলেজে যাবে না। আর শোন, আমি তোকে পরে ফোন দিচ্ছি। ব্যস্ত আছি এখন।’
.
আহিল কোনো উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দিল। কেয়ার কথাকে সে ভরসা করেনি। সোজা চলে গেছে ওর শো-রুমে। লোকজনের ভিড় তো রয়েছে ঠিক; তবে কোথাও এখানে অর্ষা নেই। আহিলকে দেখে কেয়া থতমত খেয়ে যায়। ওর সহকারি এক মেয়েকে পাঁচ মিনিটের জন্য একটু কাস্টমারদের সময় দিতে বলে সে আহিলের কাছে আসে।
আহিল চোখমুখ শক্ত করে বলে,’তুমি আমায় মিথ্যে বললে কেন? কোথায় অর্ষা?’
কেয়া বুঝে যায় এই পর্যায়ে আহিলকে মিথ্যে বলে আর লাভ নেই। সে কুসুমের অত্যাচার সম্পর্কে সবই জানে। এইটুকুই বা লুকিয়ে লাভ কী। সে সব বিস্তারিত বলে আহিলকে। রাগে আহিলের মুখ লাল হয়ে গেছে। সে পারে না শুধু কুসুমকে খু’ন করে ফেলতে। কেয়ার থেকে হাসপাতালের ঠিকানা নিয়ে সে হাসপাতালে চলে আসে।
রিসিপশনে আহনাফের সাথে তার দেখা হয়ে যায়। তবে আহিল অবাক হয় না। কেয়ার কাছে সে বিস্তারিত সবই শুনেছে। এ কথাও সত্য যে, ভাইয়ের ওপর তার চাপা রাগও রয়েছে। একটাবার কি আহিলকে তার এসব জানানো প্রয়োজন ছিল না?
আহিলকে দেখে আহনাফ অবশ্য একটু অবাক হয়। জিজ্ঞেস করে,’তুই এখানে?’
আহিল এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করল,’অর্ষা কোথায় ভাইয়া?’
‘কেবিন নং ২০৪।’
আহিল আর কথা না বাড়িয়ে ২০৪ নং রুমে চলে আসে।
অর্ষা রেডি হয়ে একপাশে কাৎ হয়ে শুয়ে ছিল। তার চোখের পাতা বন্ধ।
অর্ষাকে সে কতবার বলেছে তাদের বাড়িতে চলে আসতে। অর্ষা রাজি হয়নি।
প্রতিটা দিন ভাই-ভাবির অত্যাচার সহ্য করে।
এজন্য অর্ষার ওপরও তার গোপন ক্ষোভ রয়েছে।
অর্ষার শুকিয়ে যাওয়া রোগা রোগা মুখটা দেখে আহিলের রাগ গলে যায়।
রাগের স্থান দখল করে নেয় একরাশ মায়া। সে অর্ষার মাথার কাছে বসে।
মাথায় হাত রাখতেই অর্ষা চমকে তাকায়। সে ভেবেছিল আহনাফ!
আহিলকে দেখে তার ভাবনাকে সে ধিক্কার জানাল বারংবার।
শোয়া থেকে উঠে বসে অবাক হয়ে বলল,’তুই এখানে কেন?’
আহিল রাশভারী কণ্ঠে বলল,’তোরা সবাই এত স্বার্থপর কেন অর্ষা?
আমাকে কেউ তোরা কিছু বলিস না। এমনকি আমার ভাইয়াও আমায় কিছু জানায়নি।’
পেছন থেকে আহনাফ আহিলের কাঁধে হাত রেখে বলল,’আমায় ভুল বুঝিস না। আফরিনের জন্য এমনিতেই তুই ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া, ঘুম সব বাদ দিয়েছিস। তাই অত রাতে অর্ষার বিষয়টা তোকে জানিয়ে বাড়তি টেনশন দিতে চাইনি।’
ভাইয়ের ওপর থেকেও আহিলের রাগ কমে যায়।
সে ভাইকে জড়িয়ে ধরে বলল,’অর্ষাকে সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ ভাইয়া।’
আহনাফ ওর পিঠ চাপড়ে মৃদু হেসে বলল,’মেনশন নট ব্রো!’
.
অর্ষাকে বাড়িতে পৌঁছে দিলো আহিল নিজেই। বন্ধু-বান্ধব সবাই আহিলের কাছে অর্ষার অসুস্থতার খবর শুনে কলেজ ছুটির পর বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছে। যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী অর্ষার জন্য পছন্দের খাবার কিনে এনেছে। অর্ষার এই বন্ধুমহলটাকেও কুসুমের একদম পছন্দ নয়। তবে এখানে ওর কিছু বলারও নেই। ওরা সবাই ভালো ভালো পরিবারের ছেলে-মেয়ে। রুহুল আমিনও সাবধান করে দিয়েছে, সে যেন ওদের সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার না করে। তাই ওরা কখনো বাড়িতে আসলে তিয়াসকে নিয়ে কুসুম দরজা আটকে ঘরে বসে থাকে। মাঝে মাঝে তিয়াসকে আটকে রাখা যায় না। সে ওদের কাছে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করে।
আজ তিয়াস ঘুমে। তাই কুসুম দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে তিয়াসের পাশে শুয়ে পড়ে।
লামিয়া অর্ষার পাশে বসে বলে,’বোকারানী হঠাৎ করে এমন অসুস্থ হয়ে গেলি কেন?’
আশিক ও’কে ধমক দিয়ে বলল,’বোকার মতো প্রশ্ন করিস কেন? অসুস্থ কি কেউ ইচ্ছে করে হয়? আর কেন হয়েছে তুই জানিস না?’
জুঁই বলল,’খবরদার আর বৃষ্টিতে ভিজবি না। এভাবে অসুস্থ হয়ে থাকতে ভালো লাগছে? তোকে আর আহিলকে ছাড়া ক্লাসে আমাদের ভালো লাগে না জানিস না?’
‘তোকে যে আমার অ্যাসাইনমেন্ট করতে দিয়েছিলাম। তুই তো আজ গেলি না। স্যারকে অ্যাসাইনমেন্ট দেখাতে পারিনি বলে পুরা পঁয়তাল্লিশ মিনিট ব্যাটায় আমারে দাঁড় করিয়ে রাখছে জানিস?’ মনমরা হয়ে বলল রেশমি।
ওর কথায় সবাই হেসে ফেলে। দিদার চিৎ হয়ে বিছানায় শুয়ে বলে,’ভালো হইছে। স্যারের জায়গায় আমি হলে তো তোরে কান ধরিয়ে বেঞ্চের ওপর এক পায়ে দাঁড় করিয়ে রাখতাম।’
রেশমি কটমট করে তাকিয়ে বলে,’চুপ কর আঙ্কেলের বাচ্চা খবিশ! তোর স্যার হওয়ার যোগ্যতা আছে? তুই হবি টোকাই। রাস্তায় রাস্তায় ভাঙা বোতল, কাগজ এগুলা টোকাবি।’
‘মাইর কিন্তু মাটিতে পড়বে না চুমকির বাচ্চা!’
জুঁই দিদারের হাতে চাপড় দিয়ে নাম সংশোধন করে বলে,’রেশমি!’
দিদার জিভ কেটে বলে,’ও থুক্কু। রেশমি।’
ওদের কাণ্ডকারখানা দেখে অর্ষা হাসতে হাসতে শেষ। জুঁই আর অর্ষা শব্দ করে হাসছিল। ওরা হাসলে মনে হয় সাথে বাড়ি-ঘরও কাঁপে।
আশিক আহিলের উদ্দেশ্যে বলল,’দোস্ত দেখ তো বাইরের কুত্তাগুলা এখনো আছে নাকি ওদের হাসির শব্দে ভয়ে পালাইছে।’
অর্ষা আর জুঁই দুজনই আশিকের পিঠে কিল বসাল। আশিক পিঠ বাঁকিয়ে বলল,’শা’লার সত্যি কথা বললেও মাইর খাইতে হয়।’
আহিল বলল,’এজন্যই তো আমি নিরব দর্শক।’
দুম করে তখন আহিলের পিঠেও এক কিল পড়ল। আহিল আহত দৃষ্টিতে অর্ষার দিকে তাকিয়ে বলল,’মুখ খুলেই মনে হয় ভুল করলাম।’
‘একদম।’ বলল অর্ষা।
‘জুঁই তোরে একটু ছুঁই?’ জুঁইকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল আশিক।
জুঁই তেড়ে এসে মারমুখী হয়ে বলে,’একদম উলটা-পালটা কথা বলবি না বেয়া*দবের বেয়া*দব, আঙ্কেলের বাচ্চা!’
আশিক আহতকণ্ঠে বলল,’তুই আমাকে আঙ্কেল বললি?’
‘গাধা! তোকে আঙ্কেল বলব কেন? তোর বাবাকে বলেছি। তোর বাবা আমার আঙ্কেল না? তাহলে তুই আঙ্কেলের বাচ্চা না?’
‘হ্যাঁ, ঠিক। কারেক্ট। রেশমির থেকে এমন উলটা-পালটা কথা শিখেছিস বুঝতে পেরেছি। কিন্তু তুই আমাকে বকবি কেন?’
‘একশো বার বকব। তুই আমাকে ফাউল কথা বললি কেন?’
‘আজব! এটা একটা বাংলা নাটকের নাম। নায়ক-নায়িকা নিশো আর মেহজাবিন। বিশ্বাস না হলে ইউটিউবে সার্চ দিয়ে দেখিস। তোকে টাচ করতে চাইব, আমার রুচি এত বাজে না বুঝেছিস।’
‘তোর রুচি সম্পর্কে জানা আছে। বেশি ঘ্যানঘ্যান না করে রুচির ওষুধ খা যা।’
আহিল চুপচাপ পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে খেয়াল করে আশিক বলে,’আহিল, তোকে কেন লাগছে এত কাহিল?’
রেশমি দাঁতমুখ খিঁচে বলে,’তোর উলটা-পালটা ছন্দ শুনলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।’
‘ছন্দ নয় মূর্খ নারী। কবিতা। কবিতা বলে এগুলোকে। একেকটা লাইন জুড়ে আমি কবিতা বানাব বুঝেছিস?’
‘তোর এসব ফালতু কবিতার জন্য কী করা উচিত জানিস?’
.
‘অবশ্যই। অস্কার, নোবেল কিছু তো একটা পাবই আমি।’
‘জু*তার বারি পাবি শা’লা!’
‘মুখ সামলে কথা বলবি চুমকি! থুক্কু রেশমি।’
অর্ষা আর আহিল নিরব দর্শক হয়ে ওদের ঝগড়া দেখছিল। ওদের গ্যাং এর অদ্ভুত একটা নাম রয়েছে। ওরা দেয়নি অবশ্য। আশেপাশের মানুষেরা রেখেছে। ‘গ্যাঞ্জাম পার্টি’। এই কয়েকজন একসাথে হলে ঝগড়া লাগবেই লাগবে। সেটা ক্লাস, ছাদ, বাড়ি কিংবা ওয়াশরুম যেটাই হোক না কেন। এজন্য ওদের দেখলেই লোকে বলবে,’ঐতো গ্যাঞ্জাম পার্টি সব একসাথে হয়েছে।’
প্রথম প্রথম ওরা রেগে গেলেও এখন রাগে না। উনারা তো একদম পার্ফেক্ট নামই রেখেছে। শুধু ওরাই বুঝতে একটু দেরি করে ফেলেছে।
.
সন্ধ্যায় একসাথে আহনাফ, আহিল, আমেনা বেগম নাস্তা করতে বসেছে। আহিল খেতে খেতে আমেনা বেগমের উদ্দেশ্যে বলল,’মা একটা কথা বলব।’
‘হ্যাঁ, বল। অনুমতি নেওয়ার কী আছে?’
‘অর্ষাকে এই বাড়িতে নিয়ে আসো। এটলিস্ট পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকুক। আমি বললে শুনবে না। তোমার কথা অর্ষা রাখবে।’
আমেনা বেগম এবং আহনাফ দুজনেই বিস্ময় নিয়ে তাকায় আহিলের দিকে। আহনাফ বলে,’ও’কে এখানে রাখার কী দরকার?’
.
‘দরকার আছে ভাইয়া। কিছুদিন পর আমাদের এইচ.এস.সি পরীক্ষা। ওর ভাবি ওর ওপর অনেক অত্যাচার করে। ও’কে দিয়ে অনেক কাজ করায়। আমি যতদূর জানি, পরীক্ষার সময় সে আরো জ্বালাবে অর্ষাকে। আর অর্ষা অনেক ভালো ছাত্রী। ও ভালো রেজাল্ট ডিজার্ভ করে। ওর ভাবির জন্য ওর ক্যারিয়ার নষ্ট হোক সেটা আমি চাই না।’
‘সব বুঝলাম। কিন্তু তোকেও এটা বুঝতে হবে, বিষয়টা অন্যরা ভালোভাবে নেবে না। এমন নয় যে, অর্ষা তোর ছেলে বন্ধু। আফরিন যদি ওর বান্ধবীর জন্য এই সুপারিশ করত তাহলে না হয় মানা যেত।’
.
আহিল খাবার থেকে হাত সরিয়ে নেয়।
চোখমুখ শক্ত করে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,’কে কী বলবে তা নিয়ে আমার কোনো মাথা-ব্যথা নেই।
আমরা তো জানি, আমরা শুধুই বন্ধু। আমি আমার কথা বলে দিয়েছি।’
একটু থেমে সে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,’আমি এখন বাইরে যাচ্ছি।
রাতে বাড়িতে ফিরে যেন অর্ষাকে এখানে পাই।’
তারপর সে আর একটা কথাও না বলে বাইরে চলে যায়।
আমেনা বেগম অসহায় দৃষ্টিতে ওর চলে যাওয়া দেখে আহনাফের দিকে তাকায়।
তার দুই ছেলেই প্রচণ্ডরকম জেদি।
বড়োজন রাগ, জেদ লুকিয়ে রাখলেও ছোটো ছেলের রাগ সব প্রকাশ্যেই বেরিয়ে আসে।
সে পড়েছে এখন দোটানায়। কী করা উচিত তার?
আহনাফ কফি শেষ করে টিস্যু দিয়ে মুখ মোছে। অত্যন্ত শান্তকণ্ঠে বলে,’আমার কথা বাদ দাও।
আহিল যা চাচ্ছে তাই করো। এছাড়া আমি বিডিতে থাকিই বা কতদিন?
আহিল সবসময় তোমাদের সাথে থাকে। ওর চাওয়াকেই প্রায়োরিটি দেওয়া উচিত।’
.
এরপর সেও চলে যায় তার রুমে। আমেনা বেগম কিছুক্ষণ বসে থেকে হতাশ দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করেন।
নিজের রুমে গিয়ে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ে অর্ষার বাসায় যাওয়ার জন্য।
বাড়িতে গিয়ে রুহুল আমিনকে পাওয়া গেল।
এই প্রস্তাব অর্ষা নাকচ করলেও রুহুল আমিন মেনে নিল।
সে আমেনা বেগমের সামনেই অর্ষার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলল,’
আন্টির কথা তুই ফেলে দিতি পারবি বনু? সে না মায়ের মতো?
পরীক্ষার কয়টা দিনই তো! মায়ের কাছে থেকে পরীক্ষা ভালোমতো দে।’
অর্ষা বোঝে না ভাইয়ের এই নাটকের মানে কী। সে আসলে কী চায়?
টাকার জন্য এমন করে? নাকি বাকি সবার মতো সেও ভাবে আহিলের সাথে
ভালোবাসার কোনো সম্পর্ক রয়েছে। আর তাই হয়তো চায়, আহিলের দিকে তাকে ঠেলতে।
বিয়ে হলে তাদেরই তো লাভ! অথচ ভাই যদি সত্যিই এই আশায়
দিনাতিপাত করে থাকে তাহলে সেটা নেহাৎ-ই হবে বোকার স্বর্গে বসবাস।
রুহুলের সিদ্ধান্ত কুসুমেরও পছন্দ হয়নি। অর্ষা চলে গেলে বাড়ির সমস্ত কাজ এখন কে করবে?
আবার তার এই অবচেতন মনই চায় অর্ষাকে বাড়ি থেকে দূর করতে।
মানুষের মন বোঝা বড্ড কঠিন। ক্ষণে ক্ষণে যে মন বদলায় তাকে বোঝার সাধ্যি কার?
.
সে রাতেই আমেনা বেগমের সঙ্গে এই বাড়িতে আসে অর্ষা।
আফরিনের রুমে ও’কে থাকতে দিয়ে আমেনা বেগম বলেন,’এখন থেকে তুমি এই ঘরেই থাকবে।
আমার মেয়ের মতো।’
অর্ষা মলিন হাসে।
আমেনা বেগম ও’কে বিশ্রাম করতে বলে চলে যাচ্ছিলেন তখন অর্ষা পিছু ডেকে বলে,
‘আমি কি আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারি?’
আমেনা বেগম নিজেই এগিয়ে গিয়ে অর্ষাকে জড়িয়ে ধরেন।
মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,’পাগলি মেয়ে। আমার ছোটো ছেলেটাও পাগল আর তার বন্ধু-বান্ধবও!’
অর্ষা এবারও প্রত্যুত্তরে হাসল।
.
সোফায় বসে ফোন চাপছিল আহনাফ। ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজাচ্ছেন আমেনা বেগম। ব্যস্ত দেখাচ্ছে তাকে। প্রায় অনেকক্ষণ আগেই তিনি কাজের মেয়ে রেণুকে অর্ষার ওষুধ, দুধ আর সেদ্ধ ডিম দিয়ে আসতে বলেছেন। রেণুর হাতের কাজই শেষ হয়নি এখনো। আমেনা বেগম পূণরায় বিরক্তকণ্ঠে বললেন,’কিরে রেণু? যাসনি এখনো?’
রেণু রান্নাঘর থেকে উত্তর দিলো,’হইয়া গেছে খালাম্মা। আইতাছি দুই মিনিট।’
আমেনা বেগম বিরক্ত হোন। দুই মিনিট শেষ হবে দশ মিনিটে গিয়ে। জহির চৌধুরীর আসার সময় হয়ে গেছে। রাতের খাবার সবসময় একসাথে যথাসময়ে খাওয়া চাই সকলের। সে কোনদিক সামলাবে? আহিলেরও কোনো খোঁজ নেই। মেয়েটাকে আনার জন্য পাগল হয়ে গেছে। এখন সেবাযত্ন না করে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে জিদ্দে আল্লাহ্ মালুম।
তিনি উপায়ন্তরহীন হয়ে আহনাফকেই বললেন,’বাবু একটু যাবি?’
বাড়িতে আসার পর এই পর্যন্ত সে অর্ষার মুখোমুখি হয়নি। মায়ের কথা শুনে ফোন থেকে চোখ তুলে তাকাল।সেই দৃষ্টিতে কিছু ছিল। তাই তিনি বললেন,’থাক আমিই দিয়ে আসছি।’
আহনাফ সোফা ছেড়ে উঠল। ফোন প্যান্টের পকেটে রেখে বলল,’কী দিয়ে আসতে হবে দাও।’
আমেনা বেগম খুশি হলেন। ট্রে হাতে দিয়ে বললেন,’এই ওষুধটাও খেয়ে নিতে বলবি। অর্ষা কিন্তু আফরিনের রুমে।’
‘আচ্ছা’ বলে আহনাফ আফরিনের রুমের দিকে যায়।
আহনাফ যাওয়ার পর রেণু আসে। ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে বলে,’দেন খালাম্মা দিয়া আসি।’
আমেনা বেগম চোখ রাঙিয়ে বললেন,’থাক এখন আর দরকার নেই। তুই গিয়ে তোর জরুরী রান্না কর।’
‘রাগ করলেন খালাম্মা? রাগ কইরেন না। ছোটো ভাইজান ফোন দিয়া কইছে অর্ষা আপার জন্য যেন গুড়ের পায়েস রান্দি। আপার নাকি অনেক পছন্দ। আর জানেনই তো ভাইজানের কী রাগ। আইসা যদি দেখছে রান্দন হয় নাই তাইলে তো আমারে বকব।’
.
আমেনা বেগম অবাক হলেও মুচকি হাসলেন। বললেন,’রাগ করিনি। আহনাফ নিয়ে গেছে খাবার।’
রেণুর যেন কথাটা ঠিক হজম হলো না। সন্ধ্যার নাস্তর টেবিলে দুই ভাইয়ের বাকবিতণ্ডার সময়ে সে পাশেই ছিল। অর্ষার এই বাড়িতে আসা নিয়ে যার এত মতবিরোধ ছিল সে-ই খাবার নিয়ে গেল?
রেণু চোখ দুটো গোল গোল করে বলল,’কামডা হইল কী খালাম্মা?’
‘কীসের কথা বলছিস?’
‘বড়ো ভাইজান না প্রথমে চাইলই না অর্ষা আপা এ বাসায় আসুক। এহন আবার হেয়-ই আপার খেয়াল রাখতাছে। বাবাগো!’
তিনি মুচকি হেসে বলেন,’তোরা সবাই শুধু আমার বড়ো ছেলের গম্ভীরতাই দেখিস। ভেতরের নরম মনটা কেউ দেখিস না।’
রেণু দাঁত দিয়ে জিভ কেটে বলল,’ছি, ছি খালাম্মা কী যে বলেন! দুই ভাইজান-ই অনেক ভালো মানুষ আমি জানি।’
.
দরজায় দু’বার নক করে আহনাফ বলল,’আসব?’
আমেনা বেগম যাওয়ার আগে দরজা চাপিয়ে দিয়ে গেছিলেন। অর্ষা শুয়ে ছিল। আহনাফের গলা শুনে তার পিলে চমকে যায়। অকারণেই সে মানুষটাকে ভয় পায়। অথচ সে কত্ত ভালো! তড়িঘড়ি করে শোয়া থেকে উঠে বসে। গলা উঁচু করে বলল,’আসুন।’
আহনাফ খাবার নিয়ে ভেতরে ঢোকে। টি-টেবিলের ওপর রেখে বলে,’মা পাঠিয়েছে। খেয়ে নাও।’
‘পরে খাব।’
‘পরে নয়। এখনই। একটু পরই আবার ডিনার করতে ডাকবে। এইগুলো খেয়ে ওষুধ খাও।’
আহনাফের সামনে খেতে লজ্জা লাগছিল অর্ষার। মুখ ফুটে বলতেও পারছিল না কিছু। আর বলবেই বা কী? যার বাড়ি তাকেই মুখের ওপর বলবে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে? এটা তো সম্ভবই নয়!
আহনাফ ফের গম্ভীর হয়ে বলল,’কী হলো?’
.
অর্ষা ভয়ে দুধের গ্লাসটা হাতে নেয়। একটু একটু করে চুমুক দেয়। আহনাফ তাকিয়ে থাকে। অসহ্য! লোকটা এভাবে তাকিয়ে থাকে কেন? একটা মেয়ের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকলে যে লজ্জা লাগে সেটা কি সে জানে না?
অর্ষার এই মনোভাবগুলোও যেন লজ্জার সাথে সাথে মুখে ভেসে উঠছিল। সে গম্ভীরমুখে বলল,’লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। আমি তোমাকে দেখছি না। তোমার তালবাহানা দেখছি। এভাবে খেলে বছর কেটে যাবে; তবুও তোমার খাওয়া শেষ হবে না।’
‘আসলে দুধ, ডিম আমার পছন্দ না।’ ভয়ে ভয়ে কণ্ঠস্বর নিচু করে বলল অর্ষা।
‘এজন্যই তো শরীরের এই হাল। বাই দ্য ওয়ে, তোমার হাতের কালসিটে দাগ পড়ে গেছে মারের। মলম লাগিয়েছ?’
‘না।’
.
‘লাগিয়ে নিও।’
‘আচ্ছা।’ বলে অর্ষার দৃষ্টি গেল আহনাফের হাতের দিকে। যেখানে তার নখের আঁচড় রয়েছে। সে আহত দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল,’আপনার হাতের দাগটি এখনো যায়নি!’
আহনাফও এবার হাতে দাগটার দিকে একবার তাকিয়ে অর্ষার দিকে তাকাল। বলল,’এত তাড়াতাড়ি? সময় লাগবে। মা এই দাগ দেখে কী বলেছে জানো?’
অর্ষা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। আহনাফ বাঁকা হেসে বলে,’আমায় জিজ্ঞেস করেছে আমি প্রেম করছি কিনা। অর্থাৎ ইনডিরেক্টলি সে আমায় জিজ্ঞেস করেছে, প্রেমিকার নখের আঁচড় নাকি! শুধু জিজ্ঞেস নয়, রীতিমতো সে আমাকে ফোর্স করা শুরু করেছে। অথচ মা তো জানেই না তার ছোটো ছেলের আবদার পূরণ করতে গিয়ে আমার না হওয়া অ’প্রেমিকাকেই আদর-যত্ন করে বাড়িতে তুলে এনেছে।’
.
আহনাফের কথা শুনে বিষম খায় অর্ষা। আমেনা বেগম সেসময়ে রুমে এসে দেখেন অর্ষা কাশছে। সে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে অর্ষার মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে দেন। আহনাফকে নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখে রেগে বলেন,’দেখছিস মেয়েটা বিষম খেয়েছে, তাও এমন করে কীভাবে বসে আছিস বাবু?’
আহনাফ হতাশ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মেয়েটার সামনেও ধেড়ে ছেলেকে বাবু সম্বোধন করে ডাকতে হলো? অর্ষাও একটু যেন হাসল। না, মেয়েটা সম্পূর্ণ সহজ-সরল নয়। মনে হচ্ছে একটু দুষ্টুও আছে। নয়তো কাশতে কাশতেও কেন হাসবে?
.
চলবে…
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com