আগন্তুকের আসক্তি । পর্ব -০১
মাত্র ১৬ বছর বয়সী একজন মেয়েকে বিয়ে করছেন লজ্জা করছেনা আপনার?
দেশে আইন বলেও একটা কথা আছে।তাছাড়া আপনার বাবা মা কই?
বিয়ের সাক্ষি হিসেবে আমার তাদের চাই।আপনার রাস্তার দুই, চারজন বন্ধুকে দিয়ে আমি সন্তুষ্ট নই।
তেজীয়ান মেয়েটির এমন চটপটে কথায় চমকে তাকায় আশেপাশের মানুষজন।
সহসা বিকট শব্দে ঠাসস করে মেয়েটির গালে একটি চড় পড়ে।ডান গালটায় হাত
দিয়ে রক্তলাল চোখে আবার ঘুরে তাকায় মেয়েটি।মেয়েটির নাম ইতিকা।
গালের অসহ্য ব্যাথায় মনে হচ্ছে ডান গালটি নিমিষেই খসে পড়বে তার।
ইতিকার চোখের চাহনী দেখে চড় দেওয়া মহিলাটি ক্রুদ্ধ স্বরে বলে,
– ওই মাইয়া এমনে তাকাইয়া কি দেহস?বিয়া হইবো মানে,আইজকাই হইবো।
.
ইতিকা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো মহিলাটির দিকে।
হঠাৎ হাতে টান পড়ায় নিজের ভার সামলাতে না পেরে মেঝেতে ধপাস করে বসে যায়।
ক্রুদ্ধ হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকাতেই চোখে পড়ে ধপধপে সাদা পাঞ্জাবি পরা
ছেলেটিকে।একবার নিজের হাত আরেকবার ছেলেটির হাতের দিকে তাকিয়ে হাত
ঝাকরা দিতে থাকে সে।কিন্তু না ছেলেটি হাত ছাড়ছেনা।তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার
কোন হেলদোল নেই।ইতিকা আবারো রাগ দেখিয়ে উঠে যেতে নেয়, তৎক্ষণাৎ
আবারো হাতে টান লাগে।দুহাত ঝাকরা দিয়ে পাশে তাকাতেই কানে আসে গমগম
সুরে বলতে থাকা ছেলেটির কথা,
– আপনার ফুফু যে চড়’টা দিয়েছে সেই চড়টা আমি আবার আপনার বাম গালে রিপিট করবো ।
যদি নিজের হবু বরের হাতে চড় না খেতে চান তবে চুপচাপ আমার পাশে বসুন।
নিজের হবু বর ‘ইনানের’ মুখে এমনটা শুনে রাগ আরো দিগুন বেড়ে গেলো ইতিকার।
কিন্তু তা প্রকাশ করার আগেই কাজি বিয়ে পড়ানো শুরু করে।ইনান এখনো তার
হবু স্ত্রীর হাত ধরে আছে শক্ত করে যেন ছেড়ে দিলেই কিশোরী একছুটে পালিয়ে
যাবে।কাজী কবুল বলতে বলায় ঠোঁট কামড়ে কেঁদে দেয় মেয়েটি।দুপাশে মাথা নাড়িয়ে
না করতে থাকে সে বিয়েটি করবে না।কিন্তু কার কথা কে শোনে এক মিনিট অপেক্ষা
করাতেই ইতিকার ফুফু আবারো তেড়ে এসে তার চুলের মুঠি চেপে ধরে।নির্দোষ মেয়েটির
এমন অত্যাচার দেখে ইনানের বন্ধু সুফিয়া ছুটে এসে ইতিকাকে জড়িয়ে ধরে।
সেই মূহুর্তেও ইনান ইতিকার হাত ছাড়েনি।বরং শক্ত করে ধরে আছে।
সুফিয়া রাগী মুখ করে ইনানের দিকে একবার তাকায়।ইনানের তাতেও হেলদোল নেই
বরং সে কাজীকে তাড়া করে বিয়ে পড়ানোর জন্য।
সুফিয়া মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে কবুল বলার জন্য তোষামোদ করতে থাকে।
কিন্তু দৈর্য্যহীন ইনান ক্রুদ্ধ স্বরে ইতিকাকে বলে,
– এই যে আপনার সমস্যা কি?একটা কবুল বলতে ত্রিশ মিনিট পার করালেন।
আমার সময় এতটাই সস্তা নাকি?আজ এখানে এই মূহুর্তে বিয়ে হবে,
না হয় সবার গর্দান যাবে অলীদ দ্রুত রামদা নিয়ে আয়।
ইনানের কথায় কেঁপে উঠে অলীদ।দরজা দিয়ে বাইরে যাওয়ার জন্য পা
বাড়াতেই কানে আসে দীর্ঘ প্রতিক্ষার সেই শব্দ ” কবুল “
.
ঘুটঘুটে অন্ধকার গ্রামের রাস্তায় হাটু মুড়ে বসে আছে অলীদ।মাইক্রোর সিটে গা এলিয়ে বসেছে সুফিয়া; তারা নিজেদের মাঝে কথা বলায় ব্যস্ত। এমন সময় সেখানে এগিয়ে আসে ইনান।তখনি একছুটে তার দিকে এগিয়ে আসে অলীদ।
– শালা তোর মাথায় কি ঘুরছে?দিন দিন সব বুদ্ধি কি লোপ পেয়েছে নাকি?একটা বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করেছিস।এখনো ১৮ বছর হয়নি তার।
– তো?
ইনানের ঘাড় ত্যাড়া জবাবে সুফিয়া বিরক্ত হয়ে গাড়ি থেকে নেমে আসে।এবং ইনানকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– দোস্ত আমি মানলাম এটা অজপাড়াগাঁ।এখানে ১৫/১৬ বছরে আহরহ মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে কিন্তু আমাদের শহরের কথা ভাব।একবার মেয়েটাকে নিয়ে গেলে পুলিশ কেসেও ফেঁসে যেতে পারিস।তাছাড়া আঙ্কেল আন্টি কিছুতেই এই বিয়ে মানবে না।
– তো?এত চাপ নিচ্ছিস কেন?আমি যে বিয়ে করেছি বাবা মা না জানলেও মামু ঠিকি জানে।
ইনানের কথায় তেতে উঠলো অলীদ,
– আল্লাহর কসম আঙ্কেল ঠিকি বলে তোর মামু তোর মাথাটা চিবিয়ে খাচ্ছে।না হলে এই মেয়েকে বিয়ের জন্য অনুমতি তিনি কি করে দেয়?
– সেটা তোকে না জানলেও হবে।সুফু(সুফিয়া) যা গিয়ে দেখ আমার বউটার বিদায় পর্ব শেষ কিনা।আমাদের হাতে সময় নেই অলরেডি রাত একটা বেজে গেছে।
সুফিয়া সোজা হেটে ইনানের বাড়ির উদ্দেশ্য যেতে থাকে।তার মাথাটা ঘুরছে তার বন্ধু এমন বুঝদার ছেলে কিনা মাত্র ১৬ বছর বয়সী একটি মেয়েকে বিয়ে করছে ভাবতেই রাগগুলো মাথা ফেটে বেরিয়ে আসছে।
.
বিদায়ের ক্ষণে কারো চোখে জল নেই।সবাই স্বাভাবিক।ইতিকা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে পরনে তার লাল বেনারসি।শুধু তাকে জড়িয়ে ধরে কাদঁছে তার সমবয়সী ফুফাতো বোন মিহি।নিস্তব্দতা ঘুচে দিচ্ছে মেয়েটির কান্না।পরক্ষণে ইতিকার ফুফু এসে মেয়েটির মুখ চেপে ধরে কেননা নিরিবিলি স্তব্দ পরিবেশে সবার হয়তো সন্দেহ হবে আজ ইতিকার বিয়ে।গ্রামের আশেপাশের সবাই এত দল বাধানো মানুষজন দেখে সন্দেহ করলেও ইতিকার ফুফা ‘আকবর’ বলেছেন এরা শহর থেকে এসেছে তার পরিচিত লোকজন।কিন্তু বাড়ির দুই / তিনটে পরিবার ছাড়া কেউ জানেনা আজ ইতিকার বিয়ে।আর সেই দুই/তিন পরিবারের মুখ টাকা দিয়ে বন্ধ করেছে ইনান।
শেষ মূহুর্তে ইতকাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে দেয় তার ফুফি ফরিদা।কিন্তু মেয়েটির চোখে জল নেই,নেই কোন বিদায়ের ক্ষণের কষ্ট।চোখে মুখে হতাশার ছাপ।ফরিদার কান্নার শব্দ কমে আসতেই ইতিকা তার কানে ফিসফিস করে বলে,
– ওয়াসিম আসবে ফুফি দেখে নিও।ওয়াসিম তোমাদের ছাড়বেনা।ওয়াসিমের ভালোবাসা মিথ্যা নয়।
__
নিরিবিলি রাস্তা মাড়িয়ে রাত প্রায় চারটার সময় ইনানের গাড়িটি ঢুকলো বারো তলা বিশিষ্ট একটি ফ্লাট বাড়িতে।নয় তলার ফ্লাট টিতে উঠে সুফিয়া ইতিকাকে নিয়ে দরজা খুলে ঘরের ভেতরে ডুকতে নিলেই ইতিকার হাত টেনে পিছিয়ে আনে ইনান।তখনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ইনানের দিকে ইতিকা তাকালে ইনান তাকে উপেক্ষা করে সুফিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– সুফু তুই আগে ঘরে যা।তারপর বরন কর।
– এই সময় বরন ডালা কোথায় পাবো আমি?
– ভেতরে সব ব্যবস্থা করা আছে তুই গিয়ে দেখ।
অলীদ পেছন থেকে ইনানের কথায় ঠোঁট বাঁকায়।তার ধারনা ছিল না ইনান এত অল্প সময়ে এত কিছুর ব্যবস্থা করেছে।
বরন শেষে ঘরে ঢুকে সবাই।সুফিয়া এবং অলীদ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে চারিদিকে।পুরো ঘরটা আর্টিফিশিয়াল ফুল এবং ছোট-ছোট ফেইরি লাইটে সাজানো।অথচ এই বাড়ি থেকে তারা সকাল দশটার পর বেরিয়েছে তখনো এমন কিছু ছিল না।’তার মানে ইতিকাকে বিয়ে করার বিষয়টা কি ইনানের আগের প্লানিং ছিল?আর ভাবতে পারলো না অলীদ চিন্তায় তার মাথা ফেটে যাচ্ছে।
ইনান সুফিয়াকে ইশারা করে ইতিকাকে তার রুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য।সুফিয়া ইনানের রুমে ডুকতেই যেন আসমান থেকে ধপাস করে পড়ে।রুমটা ছোট ছোট ক্যান্ডেল, প্রদীপ দিয়ে সাজানো তার মাঝে কিছু ফুল।
ইতিকাকে বিছানায় বসিয়ে সুফিয়া চলে যেতে নিলেই তার হাত টেনে ধরে ইতিকা।
– আপু?
– হ্যা বলো।
– আ..আমি, আমি এখানে থাকবো না।লোকটাকে আমি চিনিনা জানিনা হুট করে জোর করে বিয়ে হয়ে গেলো আর তুলে নিয়ে আসলো।আমি মানতে পারছিনা।
– তুমি নিজেকে মানিয়ে নাও ইতিকা।ইনানের মাথায় কি ঘুরছে তা আমার বোধগম্য নয়।তার থেকে ভালো কি হচ্ছে দেখে যাও।
সুফিয়া ইতিকাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
দরজার বাইরে অলীদের সাথে তর্কে জড়িয়ে আছে ইনান।তখনি সুফিয়া এসে ইনানের পাঞ্জাবি আঁকড়ে ধরে,
– সমস্যা কি তোর ইনান?
– আমার কি সমস্যা হবে?
– মেয়েটার জন্য দেখছি বাসরো রেডি করে রেখেছিস তার মানে তোর এইসব আগে থেকে প্লানিং ছিল।অথচ আমাদের বলেছিস তুই মেয়েটাকে জাস্ট আজ দেখেছিস আর আজকেই বিয়ে করবি।কিন্তু তোর হাবভাব চাহনীতে অন্যকিছু প্রকাশ পাচ্ছে।
ইনান একটানে নিজের পাঞ্জাবি সুফিয়ার হাত থেকে ছাড়িয়ে নেয়।শান্ত সুরে নির্ভীয় ভাবে বলে,
– হ্যা একমাস ধরে আমি সবকিছু প্লানিং করেছি।সুযোগ্য সময় পেয়েছি আর বিয়ে করে এনেছি সাক্ষি হিসেবে তোরা ছিলি।
– তার মানে?
– কিছু না।যা তোরা ঘুমা।অলীদ তুই তোর রুমে যা আর সুফু তোর জন্য ডানের ঘর রাখা আছে।
ইনান পাঞ্জাবি ঠিক করতে করতে রুমের দরজা খুলে তখনি কানে আসে তেজীয়ান সুফিয়ার কন্ঠ।
– খবরদার মেয়েটার সাথে কিছু করবি না।
– আমার যা ইচ্ছে আমি করবো আর সবটা কি তোকে বলে করবো?
ইনান রুমে ঢুকে যায়।ঠাসস করে দরজা বন্ধ করে ঘুরে তাকাতেই আকস্মিক তার বুকে গরম উত্তপ্ত কিছু আবিষ্কার করে।ভালোভাবে পরখ করতে বুঝতে পারে ইতিকা তার দিকে জলন্ত মোম ছুড়ে মেরেছে আর সেই গলন্ত মোম চুইয়ে চুইয়ে কিছুটা তার বুকে লেগেছে।এক চিলতে মৃদ্যু আগুন সহসা তার চামড়া ভেদ করে যেন মাংসে পতিত হচ্ছে।হঠাৎ অসহ্য যন্ত্রণায় চোখটা বন্ধ করে আবার খুলে নেয়।তৎক্ষণাৎ আরেকটি মোম ছুড়ে মারলে ইনান তা ধরে নেয় এবং অন্য হাত দিয়ে ইতিকাকে পেছন থেকে মুছড়ে ধরে।
– এই মেয়ে সমস্যা কি আপনার?হঠাৎ আমার কাছে বাঘিনী রূপে আসলেন কেন?বাঘিনীর ত্যাজ আমি দুই সেকেন্ডে মাটিতে মিশিয়ে দিতে পারি তার ধারণা আপনার নেই।
– আমার প্রয়োজন নেই চোর ছ্যাঁচড়ের সম্পর্কে জানার।
– কাকে চোর ছ্যাঁচড় বলছেন আপনি?
– আপনি ছাড়া এই ঘরে আর কেউ তো নেই!তুচ্ছ মানব।
– আটাশ জন রক্ষক নিয়ে চারটি মাইক্রবাস শান বাজিয়ে আপনার পরিবারকে একপ্রকার অবশ করে বিয়ে করে এনেছি আমাকে কি সামান্য মনে হয় আপনার?এতকিছু হয়ে গেলো অথচ না আপনার পাড়া-প্রতিবেশি সেখানে উপস্থিত আর না কেউ কিছু বলার সাহস পেয়েছে।আমাকে সহজ ভাববেন না আপনি।
ইনানের প্রত্যুত্তরে ইতিকার অবাক হয়।সত্যিত অজপাড়াগাঁ গ্রামটিতে সামান্য দু’চার জন মেহমান আসলে একঘরের লোক এসে অন্য ঘরে উঁকিঝুঁকি দেয় কিন্তু বিয়ের ভরা মজলিশে কেউ কিচ্ছুটি জানলো না।কে উনি?
ইতিকার ভাবুক মুখটা দেখে তার চিবুক তুলে ধরে ইনান।কানের সামনে মুখটা নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
– ভাগ্য বদল শুনেছো কখনো?আজকের পর তোমার ভাগ্য বদল হবে।হয় সূচনা না হয় বিষাক্ত উপসংহার।
ইনান ইতিকাকে ছেড়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়।তখনি আয়নায় সেই কিশোরীর প্রতিবিম্ব অগোচর করে ইনান।মেয়েটি হাসছে অদ্ভুত ভঙ্গিতে।ইতিকা হাসতে হাসতে ইনানকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– ঘটনা তো উল্টাও হতে পারে, যদি আপনার ভাগ্যের পরিবর্তন হয়?আমার যা চাই তা কিন্তু আমি নিয়েই ছাড়ি কিন্তু আপনি আমার পূর্ণতাতে বাঁধা দিয়েছেন তাই আপনার প্রাণ বিনাশ করে হলেও আমি আমার পূর্ণতা করে ছাড়বো।
ইতিকার কথায় খিটমিট করে হাসে ইনান।আয়নার দিকে তাকিয়ে ইতিকার চোখে চোখ রেখে কোমড়ে হাত গুজে বলে,
– তবে তাই হোক!
.
চলবে….
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com