আগন্তুকের আসক্তি । পর্ব -০৪
বিয়ের কারনটা এখনো আমাদের তুই ব্যাখ্যা করিস’নি ইনান।
এবার তুই সোজাসাপটা বলবি এই বিয়েটা করার কারন কি?
ওয়াইনের বোতলটা বেশ শব্দ করেই টেবিলের উপর রাখলো ইনান।
সুফিয়ার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার তার ইচ্ছে নেই তাই আবারো চুপচাপ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে আছ।
– প্লিজ এইভাবে চুপ থাকিস না।তুই এমন কেন করলি?
এত বেপরোয়া কেন তুই?আঙ্কেল আন্টিকে জানিয়ে হলেও বিয়েটা করতে পারতি।
ইনান প্রত্যুত্তর করলো না।বরং অলীদ সুফিয়ার পাশে বসে আফসোস ভঙ্গিতে বলে,
– আগামীতে কিছু একটা হবে।
– কী হবে?
– যুদ্ধ!এই যুদ্ধে তুই আমি দুজনেই ফেঁসে যাবো আর ওই কুত্তা ইনান তো ডাইরেক মারা পড়বে।
– মানে কি?
– ইতিকা মেয়েটি আমাদের টপ শত্রু ওয়াসিমের গার্লফ্রেন্ড।
অলীদের কথা শুনে সারা শরীরে ঝলকানি দিয়ে উঠে সুফিয়ার।
দু’হাতে মাথা চেপে ধরে গোপনে জোরে জোরে শ্বাস ছাড়তে থাকে।
– এটা কিভাবে সম্ভব।এই মেয়ে প্রেম করছে?আর মেয়েটার বয়স মাত্র ১৬।
আমার জানা মতে ক্লাস নাইনে পড়ছে।
সুফিয়ার কথায় হো হো করে হেসে উঠে ইনান।
হাতের সিগারেট ছুড়ে ফেলে আয়েশি ভঙ্গিতে বসে বলতে থাকে,
– মেয়েটা তোর থেকেও দু’গুন বেশি সেয়ানা।ওয়াসিমের কাছে আসতে পারে,
হাতে হাত রেখে চলতে পারে আর আমি বিয়ে করায় গায়ে কলঙ্ক লেপ্টে গেছে?
– বিয়ে করা আর গার্লফ্রেন্ড হওয়া দুইটা কি এক?
তোর উপর আমার বিশ্বাস নেই কখন কি করে ফেলবি।
সুফিয়ার কথায় এবার বেশ রেগে গেলো ইনান।টেবিলের উপর শব্দ করে হাত রেখে বলে,
– শেট আপ,আমার বউয়ের কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ আমি জানি।
তাই তোদের কাছ থেকে জ্ঞান নিতে আসবো না।
আরেকটা কথা ইতিকার বয়স ১৬ নয়, ১৭ বছর ১০ মাস।
আর ১৬ বছর যে জন্ম নিবন্ধনটা আছে ওটাতে বয়সের হেরফের করা আছে।
তার মায়ের মৃত্যুর কারনে পড়াশোনার বাধাগ্রস্ত হয়।
কিছু দিন পরেই ইতিকার আঠারো বছর পূর্ণ হবে এখন আশা করি এই
বিষয় নিয়ে তোদের মাথা ব্যথা নেই তোদের।
ইনান আবারো চেয়ারে বসে ওয়াইনের বোতলে চুমুক লাগায়।
মাথায় ঝিম ধরে গেছে।সুফিয়া অলীদকে শান্ত থাকতে ইশারা করে।বেশ কিছুক্ষণ
তাদের মাঝে নিরবতায় কেটে যায়।
– সবটা বুঝলাম কিন্তু এত মেয়ের মাঝে ওয়াসিমের গার্লফ্রেন্ডকে বউ বানানোর বিষটি বুঝলাম না।
– সব কথা বোঝার দরকার নেই তোদের।
.
ফ্লাটের তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই ভয়েরা আকড়ে ধরলো অলীদকে।চারিদিকে অন্ধকার আচ্ছন্ন।এই ফ্লাটে গত এক বছর যাবৎ আছে সে কোনদিন এত অন্ধকার করে রাখেনি ইনান তবে আজ ঘরের লাইটগুলো বন্ধ কেন?তাছাড়া ইতিকা কোথায়?
ইতিকার কথা মাথায় আসতেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় অলীদ।
– ভাবী কই?আর ঘর এত অন্ধকার কেন?
– রুমে আছে।
– কিন্তু তুই মেইন সুইচ বন্ধ করে গেলি কেন?এত বিতিকিচ্ছি তুই কি করে করিস বলতে পারবি?
ইনান জবাব দিলো না।হঠাৎ করেই ঘর জুড়ে সব লাইট আগের মতো জ্বলে উঠলো।
বেশ রাত হয়ে গেছে এতক্ষণে হয়তো ইতিকা ঘুমিয়ে গেছে।কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ইনান বেড রুমের দরজা খুলে প্রবেশ করতেই থমকে যায়।ভেজা কাপড়ে জুবুথুবু হয়ে বসে আছে মেয়েটি।দু’গাল রক্তিমভাব ছড়িয়ে আছে।আরক্তনয়নে একপলক তাকায় ইনানের দিকে।
তার দৃষ্টির ভাবগাম্ভীর্য বুঝতে পেরে গলা খেকিয়ে উঠে ইনান।
– এত নাটকের মানে কি?আপনি জামা কাপড় চেঞ্জ করেন’নি কেন?মানলাম আমি বকেছি তাই বলে ভেজা শরীরে…
ইনান এগিয়ে এসে ইতিকাকে ছুঁয়ে দেয়।সারা শরীর প্রচন্ড ঠান্ডা হয়ে আছে।
– ইতিবউ দ্রুত চেঞ্জ করে আসুন।
– আজব কথা বলছেন না কেন?
–
– আমি উঠতে বলেছি আপনাকে।
ইতিকা কথা শুনলো না বরং রাগ দেখিয়ে বসে রইলো।ইনান একটা সময় বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়।ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভালো ভাবে পরখ করে।মেয়েটার উপর বার বার রেগে যাচ্ছে সে, কি করে সামলাবে এই রাগ।লেখনীতে পলি আনান।এদিকে নেশাটা যেন ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে,মাথা ভারী ভারী অনুভব হচ্ছে।
– লাস্ট বার বলছি আপনি ওয়াশরুমে যাবেন এবং ড্রেস চেঞ্জ করবেন।
ইতিকা গেলো না।বরং ঠায় বসে রইলো আগের মতো।রাগের মাত্রাটা যোগ হয়েছে এবার বেশামাল ভাবে।ড্রেসিং টেবিলের আয়নার দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হেসে উঠলো সে।
তৎক্ষনাৎ রুম জুড়ে ছড়িয়ে যায় বিকট শব্দ।শব্দের তোড়ে অলীদ বিছানা থেকে এক লাফে উঠে বসে।
ইতিকা নিরবতা ঘুচে শব্দ করে কেঁদে উঠে।মেঝেতে আয়নার টুকরো গুলো ছড়িয়ে আছে।গলগল করে রক্ত ঝরছে ইনানের ডান হাত থেকে।
– আপনি এখনো যাবেন না ইতিবউ?
ইতিকার জামকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।অপরদিকে অলীদ জোরে জোরে দরজায় করাঘাত করছে। রক্তাক্ত হাতটা চোখের সামনে এনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ইনান।আফসোস সুরে ফিসফিস করে বলে,
– আমায় কি একটু শান্তি দেবেন না ইতিবউ!
.
– এই রাগ,জেদ বেহায়াপনা তোর কি কোন দিন কমবে না?বিয়ে হয়েছে এবার একটু শান্ত থাক মানুষের মত ব্যবহার কর তোর আচরণ আমার কাছে রাস্তার কু*ত্তার থেকেও খারাপ লাগে।হাতের কি জঘন্য অবস্থা করেছিস তুই।কাল সকালে ডাক্তারের কাছে যাবি।
অলীদ রাগ ঝারতে ঝারতে ইনানের হাতে ব্যান্ডেজ করছে।ইতিকা চুপসে দরজার কোনায় দাঁড়িয়ে আছে।রুমের একপাশে কাঁচের ছড়াছড়ি।এই মূহুর্তে তার কি করা উচিত বুঝে উঠতে পারছে না সে।লোকটাকে তার আগে থেকেই রাগী কপট মনে হতো কিন্তু এখন একটা পাগলা,উম্মাদ মনে হচ্ছে।রাগ দেখিয়ে কেউ কাঁচে ঘুষি দেয়?এইভাবে হাতের বিশ্রী অবস্থা করে?আর প্রত্যেক বার রাগ দেখিয়েই কি মানুষটার গায়ে এত কাটা-সেলাইয়ের দাগ!মানুষটা আসলেই অদ্ভুত। কিন্তু এই অদ্ভুত মানুষটা কেন তার জীবনে ইতিকা নামক সরল সোজা মেয়েটার জীবন জুড়ে নিয়েছে?
প্রশ্নগুলো ঘুরে ফিরে ইতিকার মস্তিষ্কে বার বার হানা দিচ্ছে কিন্তু সঠিক উত্তর পাওয়া এখনো হলো না।
অলীদ ব্যান্ডেজ শেষে পূর্ণ দৃষ্টি রাখে ইতিকার উপর।
ভাবী শুনছেন? ‘ভাবী’ শব্দটা শুনেই অপ্রতিভ অবস্থায় পড়ে যায় ইতিকা।
ফ্যাল ফ্যাল করে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে অলীদের দিকে।
অলীদ গলা ঝেরে আবারো দৃষ্টি রাখে ইতিকার দিকে,
ভাবী আপনাকেই বলছি, শুনছেন আপনি?
– জ..জী বলুন।
.
– আপনি আজ পাশের রুমে ঘুমান।গতকাল সুফু যেখানে ঘুমিয়েছে।ইনানকে বরং আজ একা থাকতে দিন।
অলীদের কথা শেষ হতেই ইনান দুজনের উদ্দেশ্য গম্ভীর স্বরে বলে,
– অলীদ এখন রুম থেকে যা।অন্য কেউ যেন ভুলেও এই রুম থেকে যাওয়ার দুঃসাহস না করে, হিতাহিত ফল ভালো হবে না।
অলীদ উঠে দাঁড়ায় ইতিকাকে থাকতে ইশারা করে নিজে বেরিয়ে যায় রুম থেকে।
.
গভীর রাতে ইনান বারান্দায় বসে আছে।হিমেল হাওয়া শরীরে অন্যরকম শিহরণ জাগিয়ে তুলছে।হাতের টনটন ব্যথা তীব্র ভাবে বৃদ্ধ পেলেও সে একদম স্থির ভাবে সিগারেট ফুঁকছে।এমন কত শত জখম যে সে পেয়েছে তার ইয়াত্তা নেই।তার তুলনায় এই জখমটি তুচ্ছতম।
সিগারেটের শেষ টান দিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয় বাইরে।ঘুটঘুটে অন্ধকার রুমটায় প্রবেশ করে বিছানার পাশে টেবিলে রাখা ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দেয়।বেশ খানিকটা আলো আছড়ে পড়ছে ঘুমন্ত ইতিকার মুখে।সেদিকে তাকিয়ে স্মিত হাসতে থাকে ইনান।
– ইতিবউ আগে তুমি ছিলে আমার টোপ,এরপর অদ্ভুত ভাবে সব পালটে গেলো।এখন সব কিছুর উর্ধে তুমি আমার ভালোবাসা।আর ভালোবাসার যত্ন করতে হয়, না হলে হারিয়ে যায়।আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টায় তোমায় আগলে রাখবো।
.
সকাল সকাল ফ্লাটে সুফিয়ার আগমন মোটেও সুবিধা লাগেনি অলীদের কাছে।তার দিকে তাকিয়ে বেশ সন্দেহের দৃষ্টিতে প্রশ্ন ছুড়লো অলীদ,
– তুই এত সকাল এখানে কি করস?
– ইনান আমায় আসতে বলেছে।
– কিন্তু কেন?
– তা জানি না।
দুজনের মাঝে আবার নিরবতা।কিছুক্ষন পরেই ইনান এসে তাদের সামনে বসে এবং সুফিয়াকে ইশারা করে বলে,
– ইতিকার দায়িত্ব অর্ধেক তোর উপর ছেড়ে দিলাম।
– আমার উপর?মানে কি?
– ইতিকাকে স্কুলে ভর্তি করাবি।এই শহরে চলতে হলে,আমার সঙ্গে থাকতে হলে ঠিক যা যা অভিজ্ঞতা প্রয়োজন সব তোর দায়িত্ব।ওর জন্য আলাদা ম্যাডাম ঠিক করবি পড়ানোর জন্য।
ইনানের কথা শেষ হওয়ার আগেই চটপট উত্তর দিলো অলীদ।
– দোস্ত তোর সাথে থাকতে হলে মেয়েটাকে আগে যুদ্ধক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে।দুই, চারটা লাশ তার সামনে পড়লে যেন অজ্ঞান না হয় তাই কলিজা শক্ত রাখতে হবে।কিন্তু মেয়েটার কাল তোর হাত কাঁটা দেখে যে অবস্থা হয়েছে মনে তো হয়না তোর সাথে যেকোন পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে সে টিকে থাকবে।
– সেট আপ!
ইনান বেশ জোরেই ধমক দেয় অলীদকে সঙ্গে সঙ্গে চুপসে যায় সে।
.
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ব্রাশ করছে ইনান।তাদের বিবাহিত জীবনের অষ্টম দিন আজ।এই কয়েকদিন বেশ ঝড়ঝাপটা বয়ে গেছে তার উপর।ইতিকাকে স্কুল ভর্তি নিয়ে ছিল বেশ তোষামোদ।
গতকাল থেকেই নতুন স্কুলে পড়াশোনা শুরু হবে তার।
গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে আয়নার দিকে তাকায় ইনান।সেখানে ভেসে উঠে ভেজা চোখ দুটি নিয়ে তাকিয়ে থাকা কিশোরীর দিকে।
– ইতিকা কাদঁছো কেন তুমি?
– এই কয়েকদিনে আমি বুঝতে পেরেছি আমার ভালোর জন্য সব ব্যবস্থা আপনি করছেন কিন্তু আপনি কি এটা ভেবে দেখছেন না,সব কিছু ভালোর জন্য করলেও আপনি আমার ভালো থাকাটাই কেড়ে নিলেন।
ইতিকার কথায় ইনানের কপালে সুক্ষ্ম ভাজ পড়ে।
– কি সমস্যা তোমার?
– আপনি ওয়াসিমকে কি করে চেনেন?
– সেটা তোমাকে বলতে বাধ্য নই আমি।
– ওয়াসিম আমার হবু বর!
– মুখে লাগাম দিয়ে কথা বলো ইতিবউ।সে তোমার প্রাক্তন।ভুলেও স্বামি বানাতে যেওনা।
– আপনার আগে সে আমার জীবনে এসেছে আর আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল।কিন্তু আপনি মাঝে ডুকে সব ভেস্তে দিয়েছেন।
– ওহ আচ্ছা তাই নাকি?এতই টান বুঝি প্রেমিকের জন্য?তা বিয়ের সাপ্তাহ পার হয়ে গেলো তোমার প্রেমিক কোথায়?
– সে দেশের বাইরে আছে।ফ্যামিলি বিজনেসে।
– ওহ তাই নাকি? নাকি বিয়ে করে সংসার করছে?
– মানে?
.
ইতিকা চমকে তাকায় ইনানের দিকে।ইনান হাসতে হাসতে নিজের ফোন হাতে তুলে ইতিকার সামনে তাক করে।ইতিকা মোবাইলের দিকে তাকিয়ে ভড়কে যায়।ওয়াসিম একটি মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হাসছে।ছবিটি দেখে দোটানায় পড়ে যায় ইতিকা মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই ইনান ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
– কার জন্য আমাকে অপমান,অবহেলা করছো?ওয়াসিম বাগদত্তা।বিদেশে সে ফ্যামিলি বিজনেসে যায়নি বরং বিয়ে করতে গেছে।আর তুমি তো ছিলে তার ভো…. থাক আর কিছু বলবো না।মন দিয়ে পড়াশোনা করো।
ইনান শার্টের কলার ঠিক করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ঠিক সেই মূহুর্তে মুখে হাত ঘুঁজে কেঁদে দেয় ইতিকা
।ইনানের কানে ইতিকার কান্নার শব্দ আসতেই আবারো দৌড়ে রুমে ফিরে আসে,
– অন্য কোন উপপতির জন্য কাদঁতে হলে রাস্তায় যাও।আমার বাসায় এইসব আমি সহ্য করবো না।মাইন্ড ইট।
ইনানের কথায় কোন হেলদোল নেই ইতিকার বরং আরো জোরে শব্দ করে কেঁদে উঠে সে।
.
চলবে…
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com