আগন্তুকের আসক্তি । পর্ব -০৫
ফোলা চোখ মুখ নিয়ে সুফিয়ার দিকে বিরক্তিকর ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে ইতিকা।আজ তাকে স্কুলে যাওয়ার জন্য বেশ জোর তোষামোদ শুরু করে দিয়েছে সবাই।কিন্তু এই মূহুর্তে স্কুল,পড়াশোনা কিছুই মাথায় নেই তার বর্তমানে ওয়াসিমের সাথে একটি বার যোগাযোগ করার জন্য আকুল হয়ে পড়েছে সে।
– আমি আজ স্কুলে যাবো না আপু।
কথাটি ইনানের শ্রবণ হতেই পাউরুটিতে কামড় বসানোর আগেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় ইতিকার দিকে,
– স্কুল যাবেন না মানে কি?
– আমার ভালো লাগছে না।
– আমি আপনাকে সেদিন বলেছিলাম অন্য কারো জন্য কাদঁতে হলে রাস্তায় যান আমার বাসায় এইসব আমি মেনে নেবো না।তারপরেও আপনি গত তিনদিন আমাকে জ্বালিয়ে মারছেন।কাদঁতে কাঁদতে চোখে মুখের কি বাজে অবস্থা করেছেন ধারনা আছে আপনার?
ইনান কথাটি বলেই পাউরুটিতে কামড় বসায়।
ইতিকা না চাইতেও আবারো ঠোঁট কামড়ে কেঁদে দেয়।না চাইতেও ইনানের কথা তার বার বার মনে পড়ছে।
.
দীর্ঘ লম্বা ঢেউ খেলানো চুলগুলোতে বেণি বাধিঁয়ে নিজেকে তৈরি করে নেয় ইতিকা।ইনান বেশ কিছুক্ষণ আগেই বাসা থেকে বেরিয়েছে।বর্তমানে সুফিয়া আর ইতিকাও বের হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
স্কুল ব্যাগ হাতে তুলে নিয়ে প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র চেক করে নিচে চলে যায় দুজনে।
– একটা কথা বলবো আপু?
প্রশ্নটি করেই জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো ইতিকা।
– বলো।
– প্রায় পনেরো দিন হলো আমি তোমাদের সাথে আছি কিন্তু কাউকেই চিনি না।সবচেয়ে বড় কথা যার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে তাকেই এখনো ভালোভাবে চিনতে পারছি না আমি শুধু তার ডাক নামটাই যানি।
ইতিকার প্রশ্নে স্মিথ হাসে সুফিয়া।রাস্তার পাশ থেকে রিক্সা ডেকে ইতিকাকে চড়ে বসার জন্য ইশারা করে।
– ইনানের পুরো নাম “ইফতিহার ইনান”। পড়াশোনা অর্নাস ২য় বর্ষ।বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে।তার বাবা বর্তমানে ব্যবসা করছেন।
– কিন্তু তিনি তার বাবা মায়ের সঙ্গে কেন থাকেন না?আর সেদিন তার সাথে এত বাজে ভাবে কেন কথা বলেছে?
– ইনানের বাবার সঙ্গে তার বনিবনা নেই এর বিশেষ কারন তার মামার জন্য।ইনান তার মামু ভক্ত।বিষয়টি মোটেও পছন্দ করেন না আঙ্কেল। গত একবছর থেকে পরিবার বিচ্ছিন্ন ইনান।
– কিন্তু আমাকে বিয়ে করার কারনটা বুঝতে পারছিনা।
– সেটা আমিও জানি না ইতিকা।
ইতিকা আর প্রশ্ন করলো না।দীর্ঘ জ্যাম লেগে থাকা রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে নিজের জীবনের হিসাব কষতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
.
স্কুল শেষে ভিড়ের মাঝে কোন দিকে যাবে দিশেহারা হয়ে পড়ছে ইতিকা।স্কুলের বেশ কয়েকজন মেয়ের সাথে তার আজ পরিচয় বিনিময় হয়েছে।কিন্তু সবার কাছে নিজেকে অবিবাহিত দাবি করেছে।
ভিড়ের মাঝে সুফিয়াকে খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ হাতে বেশ জোরেই টান অনুভব করে সে।ঘাবড়ে গিয়ে হাত ছাড়ানোর জন্য ঝাকরা দিতেই আরো জোরে টান লাগে তৎক্ষনাৎ ছিটকে প্রশস্ত কারো বুকে আছড়ে পড়ে ইতিকা।নিজেকে ধাতস্ত করে দ্রুত মাথা তুলে তাকাতেই ইনানকে দেখে অস্থিরতা লুপ্ত হয়।
– আপনি?আপু কোথায়?
– আপু আসবে না এখন আমার সাথেই বাড়ি চলুন।
ইতিকার হাতটা ইনান শক্ত ভাবে ধরে আছে।গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসেই বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ স্থির চিত্তে তাকিয়ে থাকে ইতিকার দিকে।ইতিকা আড় চোখে বেশ কয়েকবার ইনানের দিকে তাকায়।কিন্তু বুঝতে পারছে না কি হয়েছে ছেলেটার।ইনান গাড়ি চালানো শুরু করে দেয়।ফ্লাটের সামনে এসে গাড়ি থামিয়ে ইতিকাকে নামতে ইশারা করে।
ইতিকা তার স্কুল ব্যাগ হাতে তুলে ইনানের সঙ্গে ঘরের ভেতর যায়।ইনান একটানে ইতিকার হাত থেকে ব্যাগটা ছাড়িয়ে নিয়ে সোফায় বসে। তার কান্ডে অবাক হয়ে যায় ইতিকা।
– এটা কোন ধরনের অভদ্রতা,ব্যাগ টানাটানি শুরু করেছেন কেন?
– আজ কার কার সাথে পরিচিত হয়েছো ইতিবউ?
– তা আপনাকে বলবো কেন?
.
ইতিকার কথায় ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে ইনান।স্কুল ব্যাগ থেকে ‘একাডেমি ডাইরিটা’ হাতে তুলে জোরে জোরে পড়তে থাকে।
– নাম; ইতিকা ইয়াসমিন। শ্রেণি;নবম।রোল;৭৮।
বাহ বাহ ভালো বেশ ভালো।
ইনানের অচরণ বড্ড অদ্ভুত লাগছে ইতিকার কাছে তবুও চুপচাপ তাকিয়ে রইলো সে।ইনান ব্যাগে বেশ ভালো ভাবে চেকিং করার এক পর্যায়ে, একটা চিঠি পেলো।চিঠিটা হাতে নিয়ে ইতিকার দিকে সূক্ষ্ম ভাবে তাকায় ইনান।
– এটা কি ইতিবউ?
– আমি জানি না
– আপনার ব্যাগ আর আপনি বলছেন জানেন না?
ইতিকা চুপচাপ রইলো।সে নিজেও বুঝতে পারছেনা এই চিঠি তার ব্যাগে কি করে এলো।
ইনান চিঠি খুলে বেশ জোরে জোরে পড়তে শুরু করে।
‘হেই ইতিকা,
.
তুমি খুব মিষ্টি মেয়ে।তোমার সঙ্গে যতবার কথা বলতে চেয়েছি তুমি আমায় ইগ্নোর করেছো।কিন্তু ইগ্নোর করার কারনটা কি?তুমি জানো ক্লাসের সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট,ইন্টেলিজেন্ট ছেলে আমি।আর তুমি আমাকেই পাত্তা দিচ্ছো না।আমি চাই আমাদের একটা ভালো বন্ধুত্ব তৈরি হোক।সর্বশেষ একটা কথা না বললেই নয় তুমি খুব মিষ্টি মেয়ে।দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে হয়।
ইনান চিঠিটা পড়ে পূর্ণ দৃষ্টি রাখে ইতিকার উপর।ইতিকা ঘাবড়ে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়ে,
– আরে বিশ্বাস করুন আমি জানি না এই চিঠি কে দিয়েছে।আমি, আমি,
– চুপ! তুমি খুব আদরে দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে হয় আমার বউয়ের প্রশংসা আমি এক পিচ্চি ইঁচড়েপাকা ছেলের কাছ থেকে শুনবো?পড়াশোনা করতে যাচ্ছেন আপনি, প্রেম করতে নয়।কোন ছেলের সাথে মেলামেশা করতে দেখলে ঠ্যাং ভেঙ্গে বাড়িতে বসিয়ে রাখবো।
– আমি ছেলেটাকে চিনি না।আর চিঠি ব্যাগে আসলো কি করে সেটাও জানি না।
– এদিকে আসেন আপনি।
– ক…কেন?
– আমি আসতে বলেছি।
ইতিকা ইনানের সামনে এসে দাঁড়ালে ইনান তাকে টেনে তার পাশে বসিয়ে দেয়।মাথায় হাত বুলিহে আদুরে সুরে বলে থাকে,
– মিসেস ইফতিহার ইনান, আপনি বর্তমানে বিবাহিত ভুলে যান আপনার অতিতের কথা আর অন্য কোন প্রেমিক পুরুষ আপনার জীবনে আসতে চাইলেও মনে করবেন সেইদিনের রাতের কথা।আপনার উপর রাগ উড়াতে নিজের হাতটাকে যেভাবে জখম করেছিলাম ঠিক আবার একই কাজ করবো।আপনার কোন ভুলে আমি আপনাকে শাস্তি দেব না।শাস্তিটা আমি নিজে গ্রহণ করবো।আপনার অন্যয়ের কারনে অন্য কেউ শাস্তি পাচ্ছে,কষ্ট পাচ্ছে কখনোই তা মেনে নিতে পারবেন না আমি জানি।তাই যা বলছি ভালো ভাবে মেনে চলুন।
ইনানের কথার উলটো পিঠে আর কথা বললো না ইতিকা।সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে তার জীবনটা ধীরে ধীরে ইনানময় হয়ে যাচ্ছে।যেখানে তার নিজের জীবনের উপর নিজের সিদ্ধান্ত তুচ্ছ।
.
ইনানের মামা বাহরুল ইসলাম আজ বেজায় রেগে আছেন।তার মাথা সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো।ইনানের অপেক্ষা করতে করতে তিনি বিরক্ত হয়ে শুয়ে পড়েন।শরীরটা বড্ড খারাপ যাচ্ছে।
অতীতে তিনি ব্যবসায় জড়িত থাকলেও রাজনীতি প্রিয় বন্ধু সাহাবের প্ররচণায় রাজনীতিতে যুক্ত হোন।কিন্তু বাহরুল ইসলামের জনপ্রিয়তা তুখোড় ভাবে বেড়ে গেলে সেই প্রিয় বন্ধুর মনেই হিংসার সঞ্চার হয়।ধীরে ধীরে একে অপরের শক্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
ইনান তার বাবা মায়ের একমাত্র আদরের সন্তান।কিন্তু ধীরে ধীরে ছেলেটি তার মামার সঙ্গে মেতে উঠে রাজনীতিতে।বাহরুল ইসলামের হাতের লাঠি হয়ে উঠে ইনান।তারপর থেকেই পিতামাতার সঙ্গে এতটা দূরত্ব ইনানের।
বেশ কিছুক্ষণ পর ইনান রুমে ডুকেই হুড়মুড় করে বাহরুল ইসলামের পাশে বসে যায়।
– মামু তোমার তো বেশ বড় আঘাত লেগেছে কিন্তু তুমি আমায় জানাও নি কেন?
– এখন কি আর তোমার খোঁজ পাওয়া যায়?ঘর সংসার নিয়ে ব্যস্ত তুমি।
– ছাড় এইসব কথা।
কোন কু*ত্তার বাচ্চা তোমার সাথে এমন করেছে আগে সেটা বলো।আমার কলিজায় হাত দিয়েছে ফল প্রচন্ড খারাপ হবে।
– তুমি কিছু করতে পারবে না।আর যা হয়েছে তার দায় তোমারো কোন অংশে কম নয়।
– মানে কি?কি বলছো তুমি মামু।যা বলছো সোজাসাপটা বলো প্যাচানো কথা আমার একদম পছন্দ নয়।
বাহরুল ইসলাম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন ইনানের দিকে।
– ‘সাহাবের’ লোক আমার গাড়িতে হামলা করেছে।
– কারনটা?
.
– তোমার জেদেই এমনটা হয়েছে। মেয়েটাকে বিয়ে করলে কেন?
– আমার ইচ্ছে হয়েছে আমি করেছি।তাতে তোমার শত্রুর এতটা জ্বলছে কেন?
– সাহাব আমার সাথে ডিল করেছে মেয়েটাকে যদি মারতে পারি তবে সব শত্রুতা চুকিয়ে দেবে কিন্তু তুমি কি করেছো?সরাসরি মেয়েটাকে বিয়ে করে এনেছো।এতে লাভটা কি হলো?বরং শত্রু শত্রু খেলা দিগুন বেড়ে গেছে।
– অদ্ভুত কথা বলছো তুমি মামু।শত্রুর সঙ্গে মিত্রতা করে কেউ কখনো পার পেয়েছে?পায়নি।তুমিও পেতে না। ইলেকশন এলে দুজনের মাঝে আবার দাঙ্গার সৃষ্টি হতো।
– সেটা ভবিষ্যতের কথা।বিয়েটা করা উচিত হয়নি তোমার।যাই হোক এমন অনাবশ্যক একটি মেয়েকে মেরে ফেললে দেশের ক্ষতি হয়ে যেত না।
বাহরুল ইসলামের কথায় বেশ রেগেই গেলো ইনান।চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সারা রুম জুড়ে পায়চারি করতে থাকে।রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে চুলগুলোকে মুষ্টিবদ্ধ করে।
– ইতিকা অনাবশ্যক নয় মামু।সে আমার জন্য আবশ্যক।আরেকটা কথা তোমরা তোমাদের শত্রুতা নিয়ে এই শহর উলটে ফেলো তাতে আমার কিছু যায় আসে না কিন্তু আমার বউয়ের দিকে যেন কোন আচঁ না আসে।
ইনানের বিরোধাভাস কথায় চমকে যায় বাহরুল।ইনানের দিকে দৃষ্টি রেখে দু’বাক্য করার সাহস পেলেন না।
– আমি আসছি, সাহাব উদ্দিনের বিষয়টি তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও।নিজের যত্ন নিও।
ইনান বড় বড় পা ফেলে চলে যায়।অপরদিকে বাহরুল ইসলাম তার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
– তোকে তোর পরিবার থেকে আলাদা করেছি এই দিন দেখার জন্য নয়।
.
চলবে…
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com