গল্পঃ ভাঙ্গা হৃদয় । পর্ব -০৩
অতএব দুঃখ লুকিয়ে বেশ খানিক হেসে উল্লাসিত কন্ঠেই ডাক্তার কে ইঙ্গিত করে আমি বললাম,এর
চেয়ে হয়তো আমার মৃত্যু অধিকই ভালো ছিলো? হঠাৎ করেই আমার এরূপ কন্ঠ স্বর শুনতে পেয়ে
ডাক্তার হয়তো বেশ খানিক হিমশিম খেয়ে উঠে।অতএব কিছুটা বিস্মিত হয়ে তিনি বললেন, ওহ!
অবশেষে তাহলে আটচল্লিশ ঘন্টা পর আপনি নিজের সেন্স ফিরেই পেলেন।আমিতো ভেবেছি আরও কিছু
ঘন্টা বা সময় লাগতে পারে!তা এখন কেমন লাগছে আপনার?
.
ডাক্তারের কথার জবাবে আমি বললাম, শারীরিক দিক দিয়ে ভালোই লাগছে তবে মানসিক দিক দিয়ে
ভালো নেই আমি। আচ্ছা সে কে? যিনি আমায় এখানে হাসপাতালে নিয়ে এসে ভর্তি করিয়েছেন?জবাবে বেশ
একটা গম্ভীর কণ্ঠেই ডাক্তারটি বললেন, আমার এক কাজিন আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছে,আসল কথা
হচ্ছে মূলত আপনার এরূপ করুণ বেদনা দ্বায়ক নির্মম অবস্থার জন্য আমার কাজিনের স….নাহ আমি বলতে
পারবো না আর!জানি না আপনি কি ভাবেই নিবেন বা রিয়েক্ট করবেন।
.
ডাক্তারের এরূপ কন্ঠ-স্বর শুনে বেশ কিছুটা উত্তেজিত হয়েই জবাবে আমি বললাম,
-বুঝলাম না ঠিক? -প্লিজ আপনি একটু স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করুন।
আমি বরং তাকে ডেকে নিয়ে আসছি। জাস্ট কিছুটা সময় একটু অপেক্ষা করুন।
কথাগুলো বলার পরপরই ডাক্তার চলে যাওয়ার কিছু সময় পরপরই সম্ভবত একজন মেয়েই আমার ক্যবিনে
প্রবেশ করেছিলেন।যার গলার কন্ঠ-স্বর সত্যিই মনো মুগ্ধকর।অতএব যখন তিনি বললেন,আমার দু’বছরের
সন্তানের জন্যই আজ আপনি এরূপ কষ্টের শিকার! তথা এক চোখের দৃষ্টি-হীন!
তখন আচমকা ওনার এরূপ কথা মুহূর্তেই আমাকে বেশ একটা চমকিত করে তুললো।অতঃপর কথার
উত্তরে যখন আমি বললাম,তারমানে?
.
পরক্ষণেই তিনি নরম কন্ঠ স্বরে বললেন,
-হ্যাঁ!আমার ছোট্ট নিষ্পাপ দু-বছরের সন্তানের জন্যই
আজ আপনি এক চোখের দৃষ্টি হারিয়েছেন।এভাবে
ক্ষণে ক্ষণে কষ্টের অতল গভীর সাগরে প্রতিনিয়ত
নাকানি চুবানি খাচ্ছেন? কিছুটা হলে ও উপলব্ধিতে
আমি সক্ষম। অনুভব করতে পারছি, এই মুহূর্তে
আপনার কষ্ট,যন্ত্রণা,বেদনা ঠিক কত-খানি তীব্র!আহ
অবুঝ আমার ছেলেটা যদি বুঝতো জানালা দিয়ে
যেটা ফেলে ছিলো সেটা আসলে এমন এক পানি
জাতীয় পদার্থ যা চোখের বেশ গভীরে প্রবেশ করলে
নির্দ্বিধায় অন্ধ হওয়াটায় স্বাভাবিক।আসলে সত্যি তো
এটাই ভুলটা আমারি ছিলো।ব্যস্ততার কারণে তেমন
একটা নজরও দেয়নি,পাশে বসে আমার ছেলেটা ঠিক
কি নিয়ে খেলা করছিলো। ল্যাপটপে কিছু গুরুত্বপূর্ণ
কাজে বেশ একটা ব্যস্তই ছিলাম।তবে আপনি চিন্তা
করবেন না। আপনার চিকিৎসার সমস্ত খরচ আমি
বহন করবো । দ্রুই আপনি আবারও আপনার ডান
চোখের দৃষ্টি ফিরে পাবেন।
.
তাতক্ষণিক তিনি আরও কিছু বলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন
কিন্তু তার আগেই ওনার সব কথার উত্তরে আমি নরম
কন্ঠ স্বরে বললাম, কিছুই করার নেই। আমার ভাগ্যের
লিখনে যা ছিলো সেটাই বাস্তবে রুপ নিয়েছে তাছাড়া
আর কিছুই নয়!আমি হতাশ হয়নি। এতে একটুও কষ্ট
পাইনি।এর চেয়েও অধিক তীব্র আঘাত,যন্ত্রণা,নিয়ে
বেঁচে রয়েছি তার সম্মুখে এ ব্যথা আমার খুবই ক্ষুদ্র
খুবই। ওটুকু বাচ্চা ছেলে, হাতের কাছে যা পায়, যা
দেখে, ভালো লাগে, যার প্রতি আকৃষ্ট হয় তাই উঠিয়ে
নেয় স্বাভাবিক।অতঃপর আর তেমন কিছুই বললাম
না আমি।কেনো যেন বিরক্ত বোধ করছি। নিরবে একা
থাকতে ইচ্ছে করছে। আমার হাবভাব পূর্ণ আচরণ
গুলো দেখে ওনি হয়তো ভাবছেন আমি অসুস্থতা বোধ
করছি। আমার রেস্টের প্রয়োজন তাই তো বোধ হয়
তিনি নিরবে চুপচাপ চলে গেলেন। তবে ব্যন্টিজ দিয়ে
নিখুঁত ভাবে চোখ দুটো বাঁধা থাকায় দেখার সুযোগ
আর হয়নি তাকে। ঘুমাতে ইচ্ছে করছে প্রচুর! সবদিক
থেকে চিন্তা-দুশ্চিন্তা টেনশন গুলো আমায় তাদের
ভোগবিলাসের বস্তু হিসেবে চির চির করে খাচ্ছে।
অতএব এক সপ্তাহের মাথায় আমার চোখের ব্যন্টিজ
খুলে দেওয়া হয়।যার আট দিন পরপরই আমি কাউকে
কিছু না বলে হাসপাতাল ত্যাগ করে ভাড়া বাসার পথে
গমন আরম্ভ সবেই শুরু করেছিলাম। এক চোখের দৃষ্টি
হীন মানুষ যে ভাবে দেখতে পায় আমিও ঠিক তেমনই
দেখছি। মূলত আমি ওনার টাকায় নিজের শরীরের
এক দামি অংশের চিকিৎসা করতে মোটেও চাইনি
তাই তো চুপিচুপি হাসপাতাল ত্যাগ করতে বেশ বাধ্যই
হয়েছিলাম।কারণ খানিকের পরিচয়েই ওনাকে কিছুটা
হলেও উপলব্ধি অনুভব করতে সক্ষম হয়ে ছিলাম।
বেশ ভালো মনের মানুষ তিনি।
.
ভাবনার ইতি ঘটিয়ে হঠাৎ সামনেই শত শত লোকের ভীর দেখে কেনো যেন
থেমে গেলাম আমি।রাস্তার পাশেই একটা মেয়ে লুটিয়ে
পড়ে রয়েছে, অথচ কেউ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার
প্রয়োজনবোধ করছে না। বিবর্ষ তার চেহারা-খানি৷ কি
ভয়ংকর। মনে তো হচ্ছে মুখে কেউ এসিড মেরেছে?
আচমকা আঁতকে উঠলাম আমি। অবাকের শেষ স্থান
অতিক্রম করে, মুখের কন্ঠস্বর থেকে আমার বেড়িয়েই
গেলো, মিহিকা ! কখনো ভাবিনি, আনমনে কল্পাণাও
করিনি শেষ পর্যন্ত মিহিকাকে এভাবে এরূপ অবস্থায়
দেখবো? কিন্তু ওর বর্তমান স্বামী কোথায়? মিহিকা কে
এসিড কে মারলো? কেনো মারলো? চোখের সামনেই
বারবার ব্যথায় কাতরে উঠছে মিহিকা কিন্তু কি দূর্ভাগী
সে! কতই না সময় ফুরালো সাহায্যের জন্যে কেউই
হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে না। আমার কি ওকে সাহায্য করা
উচিত? নাকী অনুচিত। মিহিকাকে দ্রুতই হাসপাতালে
নিয়ে যাওয়ার বিশেষ প্রয়োজন নাহলে হয়তো সে
আর, এ যাত্রায় বাঁচবে না!
.
জানিনি তখন আমার ঠিক কি এমন হয়েছিলো! এতো অপমান লাঞ্চনা, যন্ত্রণার
পরেও কেনো যেন আমি মিহিকাকে হাসপাতালের চৌকাঠ পর্যন্ত নিয়ে এসে ছিলাম বটে কিন্তু শেষ পর্যন্ত রক্ষা আর হয়নি মিহিকার! মৃত্যুর ছায়াতলে নিজেকে সমর্পণ করে পারি জমায় অনত্র ভূবণে।খবর পেয়েই
মিহিকার বর্তমান স্বামী ছুটে আসেন হাসপাতালে। যার আগমনের মিনিট খানিক পূর্বই আমি হাসপাতাল ত্যাগ
করে ভাড়া বাসায় চলে এসেছিলাম। সারা রাত নির্ঘুম, যন্ত্রণার বশীকরণের মূখ্য শিকার হয়ে,মুখ চাপা কান্নায়
ব্যথার আর্তনাদে কাতর হয়ে কাটানোর পর সকাল বেলা এক প্রকার না খেয়েই অফিসের পথে গমন শুরু
করেছিলাম। সেই কবে অফিসে জয়েন হওয়ার জন্য বলে দেওয়া হয়েছিলো আমায় কিন্তু আজ কত দিন
পরই বা যাচ্ছি। না জানি কি হয়! তবে চাকরি আমার এখন ভিষণ প্রয়োজন। অতঃপর অফিসে পৌছানোর
সঙ্গে সঙ্গেই বসের সাথে আমার সাক্ষাৎ কার অবশ্য বাধ্যতা মূলক ছিলো। বেশ একটা বয়স্ক মানুষই তিনি।
কাঁধে হাত রাখলেন আমার।খানিকটা মাথা উঁচু করে ভুরু ভাজ করে তিনি বললেন,
-তোমাকে তো বোধ হয় আরও অনেক আগে অফিসে
জয়েন হওয়ার জন্য জানিয়ে দেওয়া হয়েছিলো কিন্তু
এতো দিন পর Whey?
.
-সরি স্যার!কিছু ব্যক্তিগত সমেস্যায় ছিলাম।
-বুঝলাম! শুনো, আমার অফিসে আজ পর্যন্ত কেউ
ঘুষের সাহায্যে চাকরিতে জয়েন হয়নি।মূলত,দক্ষ,বুদ্ধি জ্ঞান,শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকলেই জাস্ট এনাফ! কিন্তু
আমার অবর্তমানে মাসেরও অধিক দিনের জন্য
অফিসের বিশ্বাস্ত লোক, অর্থাৎ ম্যানেজার কে সব কিছুর দায়িত্ব বহনের জন্য চিহ্নিত করেছিলাম। But
সেটা হয়তো আমার ভুল ছাড়া আর কিছুই ছিলো না।
কখনো ভাবিনি,মেনে নিতেও নিজের কাছে খুব একটা
কষ্ট-সাধ্য ব্যাপার হয়ে উঠছিলো।অফিসের সবচেয়ে
পুরনো ও বয়স্ক লোকটা যাকে কিনা আমি ম্যানেজার
ঘোষনা করেছিলাম স্বয়ং সেইই এভাবে একজন যোগ্য
ছেলের কাছ থেকে চাকরির বিনিময় এভাবে মোটা
অংকের টাকা দাবী করবেন তথা পরবর্তীতে মিথ্যা
যুক্তি ও অভিযোগের ভিত্তিতে অপমান করে বেরও
করে দিবেন Just কল্পনাও করতে পারছি না আমি।
অতএব যখন আমি আবার অফিসে ব্যাক করি তখন
প্রথমত এ সব কিছুই আমার কাছে সম্পূর্ণ লুকানো
হয়েছিলো কিন্তু সত্যি তো আর গোপন থাকেনা
বেশিক্ষণ।তখন খুব একটা খারাপই লেগেছিলো বটে
যখন ওনাকে চাকরি থেকে বহিষ্কার করেছিলাম আমি
কিন্তু কিই বা আর করার!এদের মতো নিচু মন
মানসিকতার লোককে তো আর এভাবে বিশ্বাস করে
কাজে রাখতে পারিনা!তোমার চিন্তার কোনো কারণ
আবশ্যক নেই।নির্দ্বিধায় রোজ অফিসে আসতে পারো
আশা করছি আর কোনো সমেস্যা হবে না তোমার।
কথাগুলো বলার পরপরই কিছুক্ষণ দীর্ঘ শ্বাস টেনে
নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে পড়লেন তিনি।অতএব
আমিও নিশ্চুপ নির্দ্বিধায় নিজের সেই পুরনো ডেস্কে
এসে কাজে মনোনিবেশ করা আরম্ভ করলাম।অতএব
দীর্ঘ সময় অতিক্রম হওয়ার পর অফিস ছুটির পর
না জানি কেনো তবে বেশ একটা দ্রুতই ভাড়া বাসায়
ফিরে এসেছিলাম।বাবা ফোন দিয়েছে,নরম কন্ঠস্বরে
বললেন,
-তোর মায়ের কন্ডিশন ধীরে ধীরে অবনতির দিকে
এগোচ্ছে বাবা!যত দ্রুত সম্ভব কিছু একটা ব্যবস্থা
করতেই হবে।
.
বাবার হৃদয় বিদারক কথা গুলো এখনো ক্ষণে ক্ষণে
কাঁদাচ্ছে আমায়!কষ্ট যন্ত্রণায়,জলন্ত দহনে বুকের
ভেতরটা যেন পুড়ে যাচ্ছিলো আমার।আজ পাঁচ দিন
অতিক্রম হলো,নতুন ম্যানেজার সবেই জয়েন্ট হয়েছে
অফিসে।দেখিনি এখনো তাকে!তবে যখন তাকে
দেখলাম তখন আচমকা চমকে না উঠা ছাড়া মূলত
আর কোনো উপায় অবশিষ্ট ছিলোনা আমার নিকট।
ইতস্তিত,বিরক্ত বোধ করছি ম্যানেজার পদে মিহিকার
স্বামীকে এভাবে চোখের দৃষ্টির সন্নিকটে দেখতে
পাওয়াকে কেন্দ্র করে।মিহিকার স্বামীও হয়তো
আশ্চর্য হয়েছে বেশ!কল্পনাও করেনি বোধ হয়,স্বয়ং
আমাকে একই অফিসে এভাবে দেখবেন তিনি!ডেস্কে
বসে গুরুত্বপূর্ণ ফাইল নিয়ে কাজ করছিলাম,যে কাজ
মূলত দু’চোখ বিহীন করা অসম্ভব! তবুও চেষ্টা
করছিলাম,ভুলও হয়েছে বটে এবং সেই ভুল কেই
কেন্দ্র করে অনাবরত কথা শুনিয়েই যাচ্ছেন নতুন
ম্যানেজার অর্থাৎ মিহিকার স্বামী।ধীরে ধীরে তার
ব্যবহার গুলো যখন দূর্ব্যবহারে পরিণত হচ্ছিলো
তাতক্ষণিক হঠাৎই কেউ এসে ঠাঠিয়ে কোষে দু’টো
থাপ্পর বসিয়ে দেন অবশ্য মৃত মিহিকার বর্তমান
স্বামীর গালে।এতে যতটা না আশ্চর্য হয়েছি তার
চেয়েও তীব্র আকারে আশ্চর্য,অবাক হয়েছি তাকে
দেখে যে কিনা মূলত আচমকা এসে মিহিকার স্বামীকে
থাপ্পর মেরেছেন।স্বয়ং ইনিই সেই যার অবুঝ দু’বছরের
সন্তানের জন্য আজ আমি এক চোখের দৃষ্টি বিহীন….
.
চলবে…
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com