গল্পঃ ভাঙ্গা হৃদয় । পর্ব ০৬
সংবাদ কানে পৌঁছানো মাত্রই বেশ খানিক মুচকি হেঁসেই চাচাতো ভাই সোহেল কে বললাম,
-আমি আসতো পারবো না! আমার এরূপ কন্ঠ স্বর শোনামাত্র যখন সোহেল বেশ
খানিকটা ক্ষুব্ধ হয়েই গম্ভীর গলায় বলল,কেনো ভাইয়া তখন, নিজেকে সংযোত রেখে বেশ একটা নরম কন্ঠ
স্বর প্রয়োগ করেই জবাবে আমি বললাম, সরি রে! অফিস থেকে আমায় প্রধান করা ছুটির সময় ফুরিয়ে
গিয়েছে তাই এখন আর চাইলেও আবার আমি গ্রামে আসতে মোটেও পারবো না!এতে আমার চাকরি টানা
হেঁচড়ার সম্মুখে পড়ে যাবে। এমনিতেও অফিস থেকে এটা স্পষ্ট কন্ঠ স্বরে আমায় বলে দেওয়া হয়েছে।
অতএব চাচাতো ভাই সোহেল আর তেমন কিছুই বলল না আমায়।নিরবে নিঃশব্দে ফোনটা রেখে দেয়।
অতঃপর আমিও দ্রুততার সঙ্গে তৈরী হয়ে অফিসের উদ্দেশ্য গমন শুরু করি। চাচা চাচির মৃত্যু সংবাদে
একদমই কষ্ট হচ্ছে না আমার!খানিকটা হলেও যন্ত্রণা হয়নি,আঘাত লাগেনি।বরং চো তৃপ্তি পাচ্ছি মনে।হাসি
পাচ্ছে খুব!যদিও বা স্বয়ং আমিই কোনো এক ভাড়াটে লোকের সাহায্যে গভীর রাত্রে চাচা চাচির ঘরে বিষাক্ত
দু’টো সাপ ছাড়িয়েছি, যার ফল সরূপ অত্যন্ত নিষ্ঠুর বেদনায় , যন্ত্রণায় , অজস্র ব্যথার বশীকরণের মূখ্যম শিকার হিসিবে বিবেচিত হয়ে , আটচল্লিশ সেকেন্ডের মধ্যেই তাদের দু’জনেরই মৃত্যু অনিবার্য, নির্ধারিত হয়।
তবুও কোনো আফসোস নেই আমার! কুকর্মের শাস্তি পেয়েছেন তারা। সত্যকে কখনোই ধাবিত করে রাখা
যায় না! এরূপ কথার প্রচলন যুগ যুগ ধরে মানুষের মুখে শোনা যায়। কখনো ভাবিনি , মনে মনে কল্পণাও
করিনি, আপন ভাই হয়ে ভাইকে কেউ এরূপ নৃশংস মৃত্যু উপহার দিতে পারে।
.
মূলত, বিলের ধারে বাবার অল্প খানিক জমি ছিলো। যাতে বাবা শিমের বীজ পুঁততেন। সেই জমিকেই কেন্দ্র করে
বাবা-মায়ের মৃত্যুর আগে, চাচার সাথে ঝগড়ার সূত্র পাত হয়। অবশ্য ঝগড়াটা চাচাই সর্বপ্রথম মূলত সৃষ্টি
করেছিলেন। যার পরের দিন ভোরে, চাচা এসে নিজের কৃতকর্ম,এবং আগের করা সমস্ত অন্যায় , শিকার করে
নিয়ে ক্ষমাও চেয়েছিলেন বটে। কিন্তু সেদিনই রাতে, চাচা-চাচি নিজের ভয়ঙ্কর চেহারা-খানি ঠিকই দেখিয়ে
দিলেন।উভয়ই বাড়িতে এসেছিলেন। বাবা-মা কে নানা ধরণের কথার ছলে, বশীকরণ করে, বিভিন্ন কায়দা
অবলম্বন করিয়া, জ্ঞানহীন করার পর তাঁরা আমার মা বাবাকে, ধান কাঁটার কাঁচি দিয়ে জবাই করেন! মৃত্যু
নিশ্চিত করার পর বাড়িতে আগুনের সূত্রপাত ঘটিয়ে, ক্ষণে ক্ষণে, ধাপে, প্রতিটি পর্যায় নিজেদের অভিনয়
নিখুঁত আঁকারে চালিয়েছেন। কোথাও কোনো খুঁত অবশিষ্ট রাখেননি উনারা! তবে কি আশ্চর্য! আমি কি
করেই বা জানালাম? সেটাই তো রহস্য! কিছু মানুষ রয়েছে যারা বেশি সম্ভবত কোনো সত্য দীর্ঘ সময়
একদমই চেপে রাখতে অব্যস্ত নয়। হয় আনমনে এসব ভাববে নতুবা নিজের সহযোগির সাথে একবার হলেও
আলাপ-আলোচনা করবে।তেমনই হলেন আমার চাচা চাচি উভয়ই।এছাড়াও গ্রামঅঞ্চলে এরূপ ঘটনা প্রায়ই
ঘটে। খানিক, জমি-জমা, রাগ প্রতিহিংসা নিয়েই মারা মারি, হত্যা , বা রাতের আঁধারে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার ব্যাপার খুবই স্বাভাবিক পর্যায়ের মধ্যেই পড়ে।
.
অতঃপর সব ভাবনার ইতি ঘটিয়ে অবশেষে
অফিসের সম্মুখে এসে উপস্থিত হলাম। ধীর পায়ে, ভেতরে গিয়ে বসের সাথে কিছু কথপোকথন শেষ
করার পর নিজের ডেস্কে এসে কাজে মন নিবেশ করার বিশেষ চেষ্টা চালাচ্ছি।বহু দিনের কাজ জমা।
দ্রুতই শেষ করতে হবে।অতএব অফিস ছুটির পড়ে অফিসের বস আমাকে স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, চোখের
অপারেশন টা দ্রুতই করাতে। যাতে আমি আজও না সূচক উত্তর প্রকাশ করেছি। যার ফল সরূপ খানিকটা
পেশার দেওয়ারও নিখুঁত চেষ্টা করেছিলেন তিনি।কিন্তু তাতক্ষণিক অফিস থেকে প্রস্থান আরম্ভ করেছিলাম।
এতো দিনে স্বয়ং আমিও প্রায়ই ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমি এক চোখের দৃষ্টিবিহীন । পরিশেষে ভাড়া
বাসায় চলে এসেছিলাম। আজ ছয় মাস পনেরো দিন শনিবার। সময়ের গতিতে আমার আর্থিক অবস্থারও
বেশ একটা উন্নত হয়েছে।কারো করুণার ভিত্তিতে নয় স্বয়ং নিজের পরিশ্রমের টাকায় মাস-খানিক আগেই
নিজের চোখের অপারেশন করিয়েছি। অফিসের বসের সাথেও আমার ভালো সু-সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
বিশেষ করে তোহফা ম্যাডামের ছোট্ট ছেলেটার সঙ্গে। তার দিকে তাকালে মনে হয় আমার হৃদয়ের ক্ষত
গুলোতে প্রশান্তির তীব্র বাতাস বয়ে যায়।
.
পরান যেন সম্পূর্ণ জুড়িয়ে যায়, সন্তান হারানোর শত-শত ব্যথা কেনো জানি না শুকিয়ে যায়।আজ তোহফা ম্যাডামের
ছেলের জন্মদিন।অনেকেই উপস্থিত হয়েছে।তার সাথে আমিও।কেক কাটার পর যখন আমার অফিসের বস
এনাউন্সমেন্ট করে বলল,এগারো দিন পর একজন সুনাম-ধন্য ডাক্তারের সাথে তোহফা ম্যাডামের বিয়ে
ঠিক হয়েছে তখন কেনো যেন আমার হাত থেকে কেক এর ছোট্ট টুকরোটা ফ্লোরে পড়ে গিয়েছিলো।
ভালোবেসে কেঁকের প্রথম টুকরোটা আমার দিকেই এগিয়ে দিয়েছিলো ছেলেটা কিন্তু ভাগ্যে সইলো না
সঠিক জানিনা কেনো তখন আমার হৃদয় পুড়ছিলো। ভেতরটা ঝলসে যাচ্ছিলো।কিন্তু আমার কেনো এরূপ
যন্ত্রণা হচ্ছে,আমিতো তোহফা ম্যাডামকে ভালোবাসি না,এটা তো ভাবাও পাপ!তাহলে কেনো এনাউন্সমেন্ট
শুনে ফাঁকা বুকে যন্ত্রণা,বেদনা,কষ্ট এসে ভরাট হচ্ছে? আমি কেনো এতো কষ্ট পাচ্ছি?কেনো সইতে পারছি
না?কেনো অশ্রু এসে ভীড় জমাচ্ছে আমার চোখের কোণে?বেশিক্ষণ আর থাকতে পারিনি আমি।দ্রুতই
বসের বাসা ত্যাগ করতে খানিকটা ব্যাধ্যই হয়েছিলাম আমি।সেদিন কার পর থেকে বেশ খানিকটাই চুপসে
গিয়েছিলাম।আজ তোহফা ম্যাডামের বিয়ে।তবে বর আসেনি!যার সাথে তোহফা ম্যাডামের বিয়ে হওয়ার
কথা ছিলো,সে মূলত এখন সম্পূর্ণ পুলিশের তত্ত্বাবধানে রয়েছে।তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
চিকিৎসার অজুহাতে ভণ্ডামি নষ্টামি, ধর্ষণের চেষ্টা করার অপরাধে।বিয়েটা সেদিন হয়নি।তবে তার পরের
দিন, মত-অমত সবকিছুই বিচার,বিবেচনা করে আমার সাথেই তোহফা ম্যাডাম বিয়ে নামক এক
পবিত্র বন্ধণে আবদ্ধ হন।তবে বিয়ের প্রথম রাতে,যখন আমি জানতে পারলাম তার ব্রেন ক্যান্সার লাস্ট স্টেজ
তখন আমি সম্পূর্ণ হতবাক হয়ে পড়েছিলাম।মূলত তার বিয়ে করার কোনো ইচ্ছেই ছিলো না।তবে তিনি এক প্রকার বাধ্যই হয়ে দ্বিতীয় বিয়েতে মত পোষণ করেছেন।
.
তার প্রধান কারণ সরূপ স্বয়ং তার নিজের ছেলে।তিনি চেয়েছিলেন মৃত্যুর আগে সন্তান কে এমন
একজন বিশ্বাস যোগ্য মানুষের কাছে পদার্পণ করতে যে নিজের সন্তানের মতোই অধিক আদর,স্নেহ
মমতা,ভালোবাসা দিয়ে সার্বক্ষণিক মায়ের চাহিদা বরাদ্দ করতে সক্ষম।চোখের দৃষ্টির সন্নিকটে মা-ছেলে
উভয়ই ঘুমিয়ে রয়েছে।বেশ একটা মিষ্টিই লাগছিলো তাদের।সোফায় বসে রয়েছি,ভাবছি কেনো,প্রতিবার,
ধাপে,পর্যায়ে,ক্ষণে,ক্ষণে দুঃখ বেদনা,যন্ত্রণা আমাকেই চিহ্নিত করে?জানি না প্রভু কেনো প্রতিবার আমার
হৃদয়ই ভেঙে নিঃস্ব হয়ে যায়।অশ্রুসিক্ত নয়নে কখন যেন ঘুমে অচল হয়ে পড়েছিলাম।যখন আবার
চোখের পাতা মেলে তাকিয়ে ছিলাম তখন আমার বোধ হয় তাকানোটা মোটেও উচিত হয়নি।হৃদয় খানি
আমার মুহূর্তেই ভেঙে টুকরো টুকরোতে নির্দ্বিধায় রুপান্তরিত হয়ে যায়।ছোট্ট ছেলেটা ফ্লোরে গড়াগড়ি
করে কাঁদছে আর তার সম্মুখেই,গলায় ফাঁস টানানো অবস্থায় ঝুলে রয়েছেন স্বয়ং তোহফা!কি হৃদয়
বিদারক মুহূর্ত……
চলবে…..
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com