গল্পঃ ভাঙ্গা হৃদয় । পর্ব ০৭
ছোট্ট ছেলেটা ফ্লোরে গড়াগড়ি করে কাঁদছে আর তার সম্মুখেই, গলায় ফাঁস টানানো অবস্থায় ঝুলে
রয়েছেন স্বয়ং তোহফা! কি হৃদয় বিদারক মুহূর্ত!মাথা জিমজিম,ছমছম করছে,সইতে পারছি না আমি এরূপ
কষ্টের দহন।হাত, পা শীতল হওয়ার উপক্রমে। ছোট্ট ছেলেটার কান্না ভেতরটাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিচ্ছে
আমার।না জানি এখন তার উপর দিয়ে কিরূপ প্রভাব বিস্তার করছে। আহ! কি করুণ পরিস্থিতি জানি না
কেনো প্রতিবার আমাকেই সম্মুখীন হতে হয় এরূপ যন্ত্রণাময় মুহূর্ত। কি আমার অপরাধ কেনো এমন হয় ?
ধম বন্ধ হওয়ার উপক্রমে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে বেশ! থরথর করে, কাঁপছে, হাত-পা দু’টোই। নিতে পারছি না আর !
সইতেও পারছি না এরূপ কষ্ট, যন্ত্রণা, বেদনা! চোখ গুলো ঝাপসা হয়ে আসছে, বুক ফেটে যাচ্ছে। কষ্টের
তীব্র দহনে,জলন্ত আগুনে অন্তরমহল জ্বলে পুড়ে শেষ হওয়ার শিখরে।
.
হঠাৎ চিৎকার দিয়ে উঠলাম ! চারদিক বেশ অন্ধকার। যদিও বা ডিম লাইট জ্বালানো। পাশের রুম থেকে
সুমধুর কন্ঠ-স্বরে কোরআন তেলাওয়াত এর স্পষ্ট শব্দ কান নামক বিশেষ এক যন্ত্র দিয়ে শুনতে পাচ্ছি আমি।
বেশ একটা পরিচত কন্ঠস্বর বটে! পাশের রুমে গিয়ে দেখলাম, তোহফা। অতএব দরজার নিকটে দাঁড়িয়ে
বেশ খানিক সময় পর্যন্ত,তার সুমধুর কন্ঠ স্বরে কোরআন তেলাওয়াত শুনেছিলাম।মসজিদে আজান
দিচ্ছে, অবশ্য ফজরের। কোরআন তেলাওয়াত স্থগিত করে, নামাযের জন্য প্রস্তুতি গ্রহনের সময় আমাকে
দরজার নিকটে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, মূলত বেশ খানিক অবাক হয়েই তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
-তুমি?
উত্তরে আমি বললাম,
.
-হ্যাঁ ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো।তবে খুব সুন্দর কোরআন তেলাওয়াত করতে পারেন আপনি।
-প্রশংসার জন্য ধন্যবাদ।অবশ্য উঠেছো যখন,মসজিদ কাছেই রয়েছে, নামাজ পড়ে এসো। যদিও বা আমি
নামাজহীন মানুষদের মোটেও দেখতে পারিনা। অতএব চুপচাপ ওয়াশ রুমে গিয়ে ফ্রেস হওয়ার পর
শশুরের সাথে মসজিদে নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্য গমন আরম্ভ করলাম এবং মনে মনে ভাবলাম,ভাগ্যিস
সবই মাত্র দুঃস্বপ্নই ছিলো নতুবা এরূপ ধাক্কা আমি কোনো ক্রমেই সইতে পারতাম না। অতএব নামাজ
শেষে বাড়ি ফেরার পথে, আচমকা আমার হাত দু’টো মুষ্টি বদ্ধ আঁকারে ধরে শশুর যখন বললেন,
-শুনো বাবা তোমাকে কিছু বলার আছে আমার!তুমি হয়তো জানো না আমার মেয়ের ব্রেন ক্যান্সার লাস্ট স্টেজ!
-জানি আমি তবে এতে কোনোই সমেস্যা নেই আমার। আমি এই বিয়েতে মত দিয়েছি শুধুই আপনার নাতনী
সিহান এর জন্য। আপনি তো জানেনি বটে, আমার জীবন সম্পর্কে!আপনি চিন্তা করবেন না যতদিন এই
ভূবণে তোহফার শ্বাস চলবে ততক্ষণ আমি নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টায় বিভোর থাকবো,তোহফাকে
সবকিছু ভুলিয়ে,সার্বক্ষণিক সুখের বশীকরণে রাখার! অতঃপর কিছুক্ষণ নিঃশব্দে থাকার পর আমার হাত
দুটো ছেড়ে দিয়ে তিনি আবার বললেন,
.
-হয়তো এসব কিছুই জানো না তুমি!যে আমার মেয়ের লাভ ম্যারেজ ছিলো। সন্তান জন্মানোর মাত্র পাঁচ
মাসের মাথায় আমার মেয়ের ক্যান্সার ধরা পড়ে। যার ফল সরূপ ভালোবাসার সংসার খানি ভেঙে যায়
তাদের। কারণ তার পক্ষে একজন ব্রেন ক্যান্সারে আক্রান্ত মেয়েকে দিন দিন এভাবে সামলানো মোটেও
সম্ভব নয়।ডিভোর্সের পর আমার মেয়ে খুব ভেঙে পড়ে ছিলো।প্রচন্ড পরিমাণ আঘাতে আহত হয়ে মৃত্যুর পথ
অবধি বেছে নিতে পিছু পা হয়নি সে।কিন্তু সন্তানের জন্য সে পথে আর পা বাড়াতে পারেনি।আমি উপলব্ধি
করি আমার মেয়ের যন্ত্রণা ঠিক কত-খানি তবে সে বৃথাই নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে প্রতিনিয়ত।
সেদিন ডাক্তার আমাকে স্পষ্ট বলেছিলেন,এই মুহূর্তে আমার মেয়ের একজন সঙ্গীর খুবই প্রয়োজন। যে
আমার মেয়েকে সার্বক্ষণিক বুঝতে,উপলব্ধিতে সক্ষম। যার সাথে আমার মেয়ে,ফিলিংস বা নানান কথা বার্তা
শেয়ার করতে পারবে।কারণ এই মুহূর্তে একাকী থাকা তোহফার জন্য বড়ই বিপদ জনক।এতে ক্যান্সার
নিরাময় হওয়ার পরিবর্তে অবনতির দিকেই বরং চো এগোবে।ডাক্তারের মতে তোহফার বাঁচার চান্স এখনো
বেশ রয়েছে।তবে তাকে এই পজিশনে অবশ্যই নিজের ভারসাম্যকে সতেজ রাখতে হবে।মোটেও ভারসাম্যহীন
হওয়া যাবে না।এই মুহূর্তে তোহফার পাশে বিশেষ এক জন অতিই প্রয়োজন।যে প্রতিনিয়ত তোহফাকে
সাপোর্ট করবে।সর্বদা পাশে পাশে রইবে,প্রতিনিয়ত বাঁচার আস্থা প্রকাশ করবে।যার সাথে থাকলে কখনো
কোনো ক্রমেই একাকী মনে হবে না তোহফার।
.
একমাত্র মেয়ে তোহফা ছাড়া আমার আর কেউই নেই শাহরিয়ার!আমি চাইনা আমার মেয়ে এভাবে ক্ষণে
ক্ষণে যন্ত্রণার বশীকরণের শিকার হয়ে ভূবণ ত্যাগ করুক।মূলত তোহফার দ্বিতীয় বিয়েতে সত্যি বলতে
কোনো ক্রমেই মত ছিলো না!শুধু মাত্র আমার অশ্রুসিক্ত নয়নের দিকে একবার চোখের পলক
ফেলা মাত্রই, মত প্রকাশ করতে এক প্রকার বাধই হয়ে ছিলো সে। দীর্ঘ এক শ্বাস নিয়ে খানিকটা গম্ভীর কণ্ঠ স্বর প্রয়োগ করেই ওনার কথার সব জবাবে আমি বললাম, -নিশ্চিন্তে থাকুন।নিজের দায়িত্ব-কর্তব্যে খামতি বলতে
কোনো কিছুই রাখবো না আমি। অতঃপর বাসায় চলে আসলাম।অবশ্য এখন আমায় ভাড়া বাসা ছেড়ে তোহফাদের বাড়িতেই থাকতে হচ্ছে। আজ একমাস অতিবাহিত হলো।খানিক সময় আগে ডাক্তার ফোন করে বেশ খানিক হাস্য উজ্জ্বল কন্ঠেই আমাকে বলেছিলেন,তোহফার কন্ডিশন কিন্তু দিন দিন অবনতির দিক পাল্টে উন্নতির দিকেই এগোচ্ছে। আপনি আপনার চেষ্টায় বিভোর থাকুন আশা করছি সে দ্রুততার সাথেই সুস্থতা লাভ করতে সক্ষম হবে।
ডাক্তারের কথাগুলো শুনে তখন বেশ খানিক খুশিও হয়েছিলাম বটে কিন্তু পরমুহূর্তেই আমার সব খুশি
দুঃখে,রুপান্তরিত হতে বাধ্য হয়।দুর্বল শরীর নিয়ে আচমকাই বমি করতে করতে সিড়ি থেকে পড়ে
যায় তোহফা!অবস্থা তেমন একটা ভালো না।মূলত এটা ক্যান্সারেরই একটা লক্ষণ।সিহান কে কোনো
মতে ঘুম পাড়িয়ে,তোহফাকে যখন ঔষুধ এগিয়ে দিয়ে বললাম,এটা খেয়ে নিন?তখন সে ঔষুধটা দ্রুতই
খেলেন এবং আমার হাত এক প্রকার পেছন থেকে টেনে ধরেই বললেন, এতো মায়া কেনো লাগাচ্ছো
আমায়?কেনো নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখাচ্ছো?
.
আমি তো বেশি দিন বাঁচবো না শাহরিয়ার?মরে যাবো!কিন্তু তোমার কাছে আমার বিশেষ একটাই
চাওয়া থেকে যাবে,আমার মৃত্যুর পর সিহানকে তার মায়ের কথা গুলো যথা সম্ভব ভুলিয়ে রেখো!আমি
জানি না সিহান এটা কি ভাবে মেনে নিবে তবে যেমনই হোক তোমাকে তো আমার কথা ওকে ভুলিয়ে
রাখতেই হবে। কেনো যেন আমার মনে হলো এটাই তোহফার শেষ কথা!এর পর আমি আর তোহফাকে দেখতে পারবো না তার সাথে আর কখনো কথাও বলতে পারবো না। তবুও মুখে হাসি রেখে জবাবে আমি বললাম,
-বিশ্বাস বা ভরসা রাখুন কিছুই হবে না আপনার।
চলবে…
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com