Breaking News

যতদূর চোখ যায় । পর্ব - ০২

ভেজা তুলোর মতো মিইয়ে গেছে নিতু। বেলকনির গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে সে।
কয়েক ফোঁটা অশ্রু জমে চোখদু’টো কেমন ঝাপসা হয়ে এসেছে।
বিধ্বস্ত মন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আনমনে কেঁপে কেঁপে উঠছিল সে।
জাফর এগিয়ে এসে তার পাশে দাঁড়িয়েছে। অন্ধ হোক, তা-ও এই লোকটাই আজ থেকে তার স্বামী।
তার বর। তার সব। যা মানসিকভাবে পীড়া দিচ্ছে খুব।
জাফর মাতাল কিংবা অত্যাচারী হলেও বোধহয় নিতুর অতোটা খারাপ লাগত না।
কিন্তু অন্ধ! কথাটা বারবার কাঁপিয়ে তুলছিল তাকে।
সদ্য বিবাহিতা নিতু, যে একটু আগেও নিজের অনাগত সুখকর মুহূর্তের কথা ভেবে শিউরে উঠছিল,
কিছুটা সময়ের ব্যবধানে তার পুরো ভাবনায় ভাটা পড়েছে।
এখন শুধুই হতাশা আর তীব্র হাহাকার।
কেন এমন হলো? কেন তার সাথেই হলো? কী কারণে?
জাফর আরো একটু কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে।
নিতু নীরব, নিঃস্তব্ধ। এরই মধ্যে এক পশলা কোমল হাওয়া ছুঁয়ে গেল তাদের।
উইন্ডচাইমগুলো টুংটাং শব্দ করে দুলছে। জাফর থমথমে গলায় বলে উঠল, “আপনি কাঁদছেন, রাইট?”
উত্তরের অপেক্ষা না করে আবারো বলতে শুরু করল, “আজ পর্যন্ত আমার জন্য কেউ কাঁদেনি, জানেন?
আজ কেউ একজন কাঁদছে, তা-ও আমার জন্য; আমার খুব ভালো লাগছে।
অবশেষে নিজের আপন কাউকে পেলাম! এটাই আমার জন্য ঢের।”
একটু থেমে বলল, “আপনার নিশ্চয়ই একটা অন্ধ লোকের সাথে ঘর-সংসার করতে ভালো লাগবে না?”
নিতু ইতস্তত করে প্রতিবাদ জানাতে যাচ্ছিল। শেষ অবধি জানাল না।
একজনের মন রাখার জন্য মিথ্যে বলে লাভ কী?
এরচে’ কঠিন সত্যটাই সে জানুক। জাফর নিচু আওয়াজে বলে চলল, “আমাদের সম্পর্ক এখন বৈধ।
এখন থেকে আমরা যা করব, তা-ই বৈধ। তাই আমি বলছিলাম কী,
একটা অন্ধ লোকের সাথে বাসর করতে যেহেতু আপনার যথেষ্ট আপত্তি আছে,
সেহেতু আমরা বাসরের কথা ভুলে যাই। আমরা বরং শুরু থেকে শুরু করি।
আই মিন, প্রথমে ডেটে যাব। কথা হবে, ভাব বিনিময় হবে। তারপর একদিন আমি প্রপোজ করব।
আপনি আমার প্রপোজাল অ্যাকসেপ্ট করলে তবেই আমরা ঘর-সংসার, বাসর এসব নিয়ে ভাবব।
কী বলেন?”
.
নিতু কোনোরকম জবাব না দিয়ে নীরবে সরে গেল। জাফর একা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করছে,
“তা হলে এই কথাই রইল, আজকে আমাদের ফার্স্ট ডেট।
ডেটের শুরু হবে দু’কাপ কফি দিয়ে। আপনি কফি বানাতে পারেন তো?”
প্রশ্ন করে খানিক নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল জাফর। নিতু ঘরে এসে মাথা নিচু করে বিছানায় পা দুলিয়ে বসে আছে।
তার চোখের কোলে জল। বুকের ভেতর একটা অতি সরু চিনচিনে ব্যথা।
এদিকে জাফর বলে চলেছে, “আপনি না পারলে অসুবিধা নেই।
আমি অন্ধ হলেও খুব ভালো কফি বানাতে পারি। অ্যান্ড আই
থিংক ওই কফি খাইয়েই একদিন আপনাকে পটিয়ে ফেলব।”
রসিকতায় একটুও হাসল না নিতু। জাফর বেলকনিতে দাঁড়িয়ে হাত নাড়াতে
নাড়াতে বলল, “কোথায় আপনি? চলে গেলেন নাকি?” বলতে বলতে
এগিয়েই আসছিল, তখন ফুলের টবে পা লেগে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল।
মাথাটা একেবারে দেয়ালের কোণে লেগেছে। জাফর আর্তনাদ করে মাথায়
হাত দিয়ে কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “কিছু হয়নি। আ’ম ফাইন।
” তার চোখে-মুখে বিগলিত হাসি। অথচ আঘাতপ্রাপ্ত স্থান, অর্থাৎ মাথা
থেকে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে৷ তাজা লাল রক্তে হাত ভরে যাচ্ছে তার।
.
কয়েক ফোঁটা মেঝেতেও পড়েছে। সেই রক্ত বৈদ্যুতিক আলোয় চিকচিক করছে।
মিনিট বিশেক পর দু’কাপ কফি নিয়ে ফিরে এসেছে জাফর। তার মাথায়
এলোমেলোভাবে ব্যান্ডেজ করা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, সে নিজেই
ব্যান্ডেজটা করেছে। তার কানের কাছে এখনও একদলা চিটচিটে রক্ত লেগে আছে।
নিতু দৃষ্টি নিচু করল। জাফর ট্রে নামিয়ে রেখে বলল, “ট্রাই ইট।
দিস ইজ ওয়ান অব দ্য বেস্ট কফি ইন দি হউল ওয়ার্ল্ড, আই সুয়ের!” খানিক চুপ থেকে
বলল, “যদিও নিজের ঢোল নিজে পেটানো ঠিক না। সত্যি বলতে এটা আমার
কথা না, মানুষের কথা। আজ অবধি যারা আমার হাতে বানানো কফি
খেয়েছে, সবাই এই একই কথা বলেছে। আমার হাতের কফির নাকি তুলনা
হয় না। প্লিজ, হ্যাভ। ফ’ মি!” আগ্রহ ভরে সামনের দিকে ঝুঁকে বসল জাফর।
নিতু কফির মগে চুমুক দিয়ে আবার ট্রে তে রেখে দিলো।
“দিস ইজ আওয়ার ফার্স্ট ডেট, সো আই ওয়ান্ট টু গিভ ইউ সামথিং।”
মাহতা জবাব দেয়নি। মাথা নিচু করে বসে আছে। জাফর পকেট হাতড়ে
একটি কলম বের করে এগিয়ে দিলো, “নিন। একটি অতি সাধারণ কলম।
আই থিংক, আপনি এখন ভাবছেন, প্রথম ডেটে আর কিছু না দিয়ে পুরনো কলম দিলাম কেন?
এটার উত্তর আমি দেব না। যখন আমার ব্যাপারে পুরোপুরি জেনে যাবেন,
তখন নিজে থেকেই বুঝতে পারবেন, এই কলম আমি কেন দিয়েছি।
” বলতে বলতে বিছানার উপর কলমটা রেখে দিলো জাফর৷
নিতু একবার সেটার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
.
“কফিটা কেমন ছিল? দারুণ, রাইট?”
এতক্ষণ চুপ থাকার পর নিতু এবার ফনা তোলা সাপের মতো ফোঁস করে উঠল,
“জঘন্য ছিল। এরকম বাজে কফি আমি জীবনে খাইনি।
” বলেই মুখ কালো করে একরকম ফুঁসতে ফুঁসতে উঠে গেল নিতু।
জাফর সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় মগটি হাতে তুলে নিয়ে আবার নামিয়ে রাখল।
নিতু যে মগ থেকে কফি খেয়েছে, সেটাতে চুমুক দিলো। ঢোক গিলতেই
অস্বস্তিতে ডুবে গেল সে। ধুর! ভুল করে চিনির বদলে লবণ দিয়ে ফেলেছে।
এই মুহূর্তে জাফরের মরে যেতে ইচ্ছে করছে। নিজের মুখে একগুলো
সুনাম করার পর এমন একটা কান্ড ঘটে গেল! নিতু কী ভেবেছে কে জানে!
খুব ভোরে, তখনও কেউ জেগে উঠেনি। কাউকে না জানিয়ে চুপিসারে বেরিয়ে
এসেছে নিতু। আর এক মুহূর্ত ওই বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে করছিল না তার।
বাড়িটা এবং বাড়ির মানুষগুলোর প্রতি যে পরিমাণ ঘৃণা জন্মেছে, সেটা
এক জীবনে ফুরাবার নয়। ওদের কথা ভাবতেই ঘেন্নায় গা জ্বলে যাচ্ছে নিতুর।
কী করে পারল ওরা? কী করে পারল নিজেদের অন্ধ ছেলের জন্য অন্য
একটি মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিতে? কী করে পারল নিজের স্বার্থের জন্য
অন্য একটি মেয়েকে ব্যবহার করতে? আর জাফর? সে-ও কি কম? নিজে
অন্ধ হয়েও সেটা আড়াল করে বিয়ের কাজ সেরে ফেলল। তার আগে একটিবার
জানতেও চাইল না, কনে রাজি কি না। একটিবার খোঁজ নিল না, কনে তার
ব্যাপারে জানে কি না। সবকিছু আড়াল করে বিয়েটা সেরে ফেলল। একেবারে
বাসরঘরে উদয় হলো গিয়ে। তার কি একটু লজ্জা-শরম থাকা উচিৎ ছিল না?
একটুও না? অতোটা নির্লজ্জ কেউ হয়?
.
ক্ষোভে ফুঁসে উঠছিল নিতু। বাসে চড়ে বাসায় পৌঁছতে অনেক বেলা হয়ে গিয়েছিল।
তাকে দেখে মায়ের চোখ গোল। তিনি এগিয়ে এসে কিছু বলার আগেই নিতু নিজের
ঘরে ছুটে গিয়ে দুম করে দরজা বন্ধ করে দিলো।
বিকেলে দরজা খুলল সে। মা তখন কাছে এসে বসেছেন।
তিনি বিস্ময়ে নিতুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেও কিছু বলছেন না। নিতু বলল প্রথমে,
“কীভাবে পারলে আমার এত বড়ো সর্বনাশ করতে? তোমরা মা বাবা না শত্রু?
কেন আমার জীবনটা নরকে পরিণত করলে বলতে পারো?
আমি কী এমন পাপ করেছিলাম, বলো?”
“তুই কি কাউকে না বলে পালিয়ে এসেছিস?” নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলেন মা।
“বাঃ রে! একটা অন্ধ লোকের হাতে তুলে দিয়ে এসেছো। ভেবেছো
এবার বোঝা কাঁধ থেকে নেমেছে। এবার অন্ধ লোকের ঘর করুক। বাচ্চাকাচ্চা
পয়দা করুক। ঘর সামলাক। আর আমরা একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। এই ভেবেছিলে তোমরা, না?
” বিমর্ষ কণ্ঠে বলল নিতু।
.
মা আহত চোখে চেয়ে ঢোক গিলে বললেন, “কেন ভুল বুঝছিস আমাদের?
ক’টা দিন ছেলেটার সাথে থাকতি। একবার দেখেই এমন মন্তব্য করছিস?
তোর মনে আছে, একদিন তুই নিজেই আমাকে একটি বিখ্যাত প্রবাদের কথা বলেছিলি।
বলেছিলি, বইয়ের কভার দেখে যেন বইয়ের মান আন্দাজ না করি।
আমার পরিষ্কার মনে আছে, তুই একরকমই কিছু একটা বলেছিলি। বলেছিলি না?”
“এটা আমার জীবনের প্রশ্ন, মা! তুমি একটা প্রবাদ শুনে আমার
জীবনটাই ধ্বংসের পথে ঠেলে দিতে পারলে?”
“কী বলতে চাচ্ছিস? জাফর ধ্বংস? আমরা জাফরের সাথে তোর
বিয়ে দিয়ে তোর জীবন ধ্বংস করেছি?”
“নয়তো কী?”
মা একটু চুপ করে রইলেন। হঠাৎ বলে উঠলেন, “বিখ্যাত স্ক্রিন রাইটার
জাহাদ আলমের নাম শুনেছিস?”
“জেইনি সিরিজের লেখক?” বলে কপাল কুঁচকে তাকাল নিতু।
“হ্যাঁ, তাকে দেখেছিস কোনোদিন?”
“সিরিজ পুরোটা দেখেছি। কিন্তু লেখককে দেখিনি।”
“দেখতে চাস?” বলে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলেন মা।
“যদি চাই?”
.
“তা হলে ফিরে যা তোর শ্বশুরবাড়ি। গিয়ে দ্যাখ,
বিখ্যাত স্ক্রিন রাইটার জাহাদ আলম তোর জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে।
তার ডাক নাম জাফর।” বলে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন মা।
নিতু হতভম্ব হবে বসে আছে। জাফর সেই বিখ্যাত স্ক্রিনরাইটার,
যার লেখা সিরিজে প্রায় সময়ই ডুবে থাকত নিতু?
কিন্তু সেই বিখ্যাত লোকটা এমন মজা করল কেন তার সাথে?
নিতু যে চলে আসার আগে চিরকুটে লিখে এসেছে,
এই ধোঁকাবাজ পরিবার ছেড়ে চিরতরে চলে যাচ্ছি।
জাফর শুধু অন্ধ নয়, ধোঁকাবাজও। তাকে আমি কোনোদিন স্বামী হিসেবে মেনে নেব না।
এবার কী হবে? ভাবতেই ভেতরটা ধক করে উঠল তার।
কালকেই বিয়ে হলো  আর আজই ডিভোর্সের দিকে গড়াচ্ছে! কিন্তু…
বুকে উথালপাথাল ঢেউ নিয়ে মায়ের খুঁজে ছুটে গেল নিতু।
এ-ঘর, ও-ঘর খুঁজতে খুঁজতে লিভিংরুমে যেতেই সোফায় চোখ আটকে গেল তার।
সেখানে মাথা নিচু করে বসে আছে জাফর। নিতু চট করে নড়তে পারল না।
মনে হলো, হুট করে সে পাথরে পরিণত হয়েছে। দেহটা জমে গেছে একদম।
শুধু হৃদপিণ্ডটা চলছে। খুব জোরে চলছে। ধুকপুক আওয়াজ দিচ্ছে খুব।

চলবে..

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com