তুমি যদি জানতে | পর্ব -০৫ এবং শেষ
আমি তোমাদের কিছু হতে দেবো না।” ইয়াসিন সাতপাঁচ না ভেবে নাদিরা’কে বলল,
– “এসবে তোমার হাত থাকলে আমি কিন্তু তোমাকে এক চুল ও ছাড় দেবো না,তোমাকে তালাক দেবো,আমি তোমার সাথে থাকবো না।” পুলিশ ইন্টারোগেশন শেষে ফাইজা এবং নাদিরা’কে নিয়ে ইয়াসিন এবং ফাহিম সাহেব বাড়িতে চলে এলেন,ফাইজা মিম’কে ফোন করে বললেন,
– “কাজ টা তুমি ঠিক করলে না,তোমার এবং তোমার ওই অবৈধ সন্তানের কখনো ভালো হবে না।” অপর পাশ থেকে ইমান হাসতে হাসতে বলল,
.
– “তাহলে এসবের পেছনে তুমি’ই রয়েছ মা?” ফাইজা চমাকালো! ইমান একটু থেমে বললো,
– “আমি তোমার কালো ছায়া আর কখনো আমার স্ত্রী এবং অনাগত সন্তানের ওপর পরতে দেবো না।আমি মিম’কে নিয়ে আমার শশুর বাড়িতে থাকবো আর বাচ্চা হলেই অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমাবো এদেশে থাকবো না।” ফাইজা ছেলে’কে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করলেন কিন্তু পারলেন না,ফাহিম সাহেব হঠাৎ পেছন থেকে বলে উঠলেন,
– “তুমি আর কত নিচে নামবে ফাইজা?” ফাইজা অসহায় ভাবে মেয়েদের দিকে তাকাতেই ওরা বলে উঠলো,
– “তোমাকে আর ‘মা’ বলে ডাকতে ইচ্ছে করে না।ভাইয়া ভাবি’কে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যাবে এবার তুমি খুশি হয়েছ মা?” ফাইজা কাঁদতে লাগলো,কারো মন গললো না,নাদিরা ইয়াসিন’কে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করল,ইয়াসিন বলল,
– “তুমি আমার ঘরে আসবে না।” নাদিরা বললো,
.
– “আমি মা হতে চাই।” ইয়াসিন ওর মুখের ওপরে দরজা লাগিয়ে দিয়ে বলল,
– “আমি বাবা হতে চাই না।” নাদিরা দরজার বাহিরে বসে কাঁদতে লাগলো,তবে ইয়াসিনের মন গললো না,সে চুপচাপ তার পুরোনো ডায়েরি খুলে মিমের ছবিতে চোখ বুলোতে লাগলো,ইমান’কে ফোন করে জিজ্ঞেস করলো,
– “তুই কি ওকে ভালোবেসে ফেলেছিলি ভাইয়া?” ইমান হাসতে হাসতে বললো,
– “শিক্ষা হয়ে থাকলে আর কখনো কাওকে নিজের ভালোবাসার মানুষের লয়ালিটি পরীক্ষা করতে বলবি না।
আর হ্যাঁ, আমি মিমের জন্য দেশে ফিরে এসেছিলাম মায়ের কথা শুনে না,ওকে আমি ভালোবেসে ফেলেছিলাম ওর জন্য আমার রাতে ঘুম হতো না আর তুই নাদিরার কথা শুনে ওকে ছেড়ে দিলি এই তুই ওকে ভালোবাসো বাব বাহ! যাগগে যা হওয়ার হয়ে গেছে।আমাদের নিয়ে এতো ভাবতে হবে না।”
শুশুর বাড়িতে ইমানের দিন গুলো ভালোই কাটছে এ বাড়িতে কেউ তাকে জামাই বলে ভাবো না,অরুণিমা প্রতিদিন তিনবেলা করে মিমের সাথে সাথে ওকে ও নিজের হাতে করে ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দেয় যেন উনি ওর নিজের মা।
প্রতিরাতে,রুহুল আমি সাহেব ইমান’কে সাথে নিয়ে ঘুরতে বের হয়,বাজারে যায় এ যেন নতুন কিছু না।ফাইজা ফাহিম সাহেব’কে বলল,
.
– “পাশাপাশি অফিস তো? তুমি গিয়ে একটু ছেলে টা কে বোঝাতে পারছনা?” ফাহিম সাহেব বললেন,
– “ছেলে আমার বড় হয়ে গেছে,সে আমার খায় ও না পরে ও না আর তুমিই বা কেমন মা নিজের সন্তানদের মধ্যে পক্ষপাতিত্ব করছ?” ফাইজা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে মিম’কে ফোন করে বললেন,
– “আমার ছেলে’কে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে তুমি একদম ভালো করলে না আর আমি অভিশাপ দিচ্ছি,তোমার এ জীবনে সুখ হবে না।” ইমান তাচ্ছিল্য করে জিজ্ঞেস করলো,
– “আমি কনফিউজড তুমি কি সত্যি আমার মা? মিম আমাকে গত কয়েক মাস ধরে বাসায় ফেরার জন্য বোঝাচ্ছিল,বিশ্বাস করো আমি আর জীবনে ও বাসায় ফিরবো না।” ফাইজা কেঁদে ফেললো,তবে কোনো লাভ হলো না,এর মধ্যে নাদিরা সবাই’কে খুশির খবর দিলো ইয়াসিন ভণিতা না করে স্পষ্ট ওকে বলল,
– “আমি এখন বাচ্চা চাই না,নষ্ট করে দাও নয়তো আমি তোমার সাথে কোনো সম্পর্ক রাখবো না।” বাড়িতে সবাই মিলে ইয়াসিন’কে বোঝালো ইয়াসিন এই নিয়ে আর কোনো ঝামেলা করলো না।ইমা এবং ইস্পা ফাইজা’কে নাদিরার এতো যত্ন করতে দেখে বলল,
.
– “তুমি খুব ভালো’ই নাটক করতে পারো মা।” ফাইজা চুপচাপ মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন ওরা কোনো কথা বললো না,ফাহিম সাহেব বললেন,
– “বড় বউ মা কে একটু আদর যত্নে রাখলো আমার ছেলেটা এভাবে বাড়ির বাহিরে থাকতো না।” ফাইজা মুখ ফুটে কিছু বলতে চাইলে,ফাহিম সাহেব তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
– “অবশ্যই তুমি সেটা কখনো চাও না,আফটার অল তোমার ছোটো ছেলে,তোমার জান,প্রাণ,কলিজা।”
দেখতে দেখতে মিমের ডেলিভারি সময় চলে এলো আর ওকে যথা সময়ে হাসপাতালে নিয়ে আসা হলো।তবে ডেলিভারি হওয়ার পর বাচ্চার হঠাৎ করে শ্বাসকষ্ট এবং জন্ডিস সহ বিভিন্ন রকমের সমস্যা দেখা দিলো আর তাই শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শে বাবু’কে ইনকিউবেটরে রাখা হলো।মিমের জ্ঞান ফেরার পর ও ইমান’কে বলল,
– “আমার মেয়ে কোথায় বলো?” ইমান অনেক কষ্টে হাসিমুখে বললো,
– “বাবু একদম ঠিক আছে,তুমি এতো কেন ভাবছ?” মিম অস্থির হয়ে ইমান’কে জিজ্ঞেস করলো,
– “বাবু দুধ খাবে না? আমার বাবু কোথায় বলো?” ইমান মিমের কপালে চুমু খেয়ে বলল,
– “ঠিক আছে পাগলী,তুমি কেন এমন অস্থির অস্থির করছ?”
.
– “ও ঠিক নেই,আমি জানি,তুমি আমাকে কেন মিথ্যে বলছ?” ইমান মিম’কে জড়িয়ে ধরে বলে,
– “ওকে একটু ইনকিউবেটরে রাখা হয়েছে একদম ঠিক হয়ে যাবে ও।” মিম কাঁদতে কাঁদতে বলল,
– “শ্বাসকষ্ট হচ্ছে ওর? নিউমোনিয়া হয়নি তো?” ডক্টর আলিফ এসে মিম’কে বলে,
– “ভয় পেয়ো না মা,তুমি শুধুশুধু ভয় পাচ্ছ।” মিম একটু শান্ত হতে না হতেই নাদিরা ওকে ফোন করে বললো,
– “কেমন মা তুমি? জন্ম দিতে না দিতেই নিজের বাচ্চা টা কে মারতে বসেছ?” মিম নিজেকে সামলে রাখতে না পেরে বলে,
– “শুয়োরের বাচ্চা খুব তো বড়সড় ডায়লগ মারছ? আগে নিজে একটা সুস্থ বাচ্চা জন্ম দিয়ে দেখা! শুনলাম তোর স্বামী নাকি বাচ্চা চায় না? কি আশ্চর্য? লজ্জা নেই তোর? আরেক জন’কে ফোন করে ফালতু বকছ? অথচ তোর স্বামী তোর দিকে তাকিয়ে ও দেখে না আর তুই তার বাচ্চার মা হতে চলেছ? আহ! তোর কি কষ্ট? তাই না? আমার বাচ্চা’কে নিয়ে এতো ভাবিস না,কারণ আল্লাহ তাআ’লা আমাকে ফেলে দেবে না।” ইয়াসিন মিমের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ছুটে এসে ওকে বলে,
.
– “বাবু একদম সুস্থ হয়ে যাবে,তুমি প্লিজ প্যানিক করো না।” মিম ইয়াসিন’কে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে বলল,
– “তোর বউয়ের কি সমস্যা? ও কেন আমার সুখ দেখতে পারেনা?” ইয়াসিন তখন নাদিরা’কে ফোন করে যা-তা বলল,যা ওর সহ্য হলো না।তার বেশ কিছুক্ষণ পর ডক্টর শফিক এসে ইমান’কে বললো,
– “বাবুর অবস্থা ক্রিটিকাল এখন শুধু মাএ আল্লাহ তাআ’লা’ই ভরসা।” ইমান নিজেকে সামলে নিয়ে মিমের কাছে ছুটে এলো,কেমন যেন হয়ে গেছে মেয়ে টা? মিনিট খানেক বাদে ফাইজা মিম’কে ফোন করে বললো,
– “তুমি আমাকে কষ্ট দিয়ে ছিলেনা? এখন বুঝতে পারছ? কেমন লাগছে মা? এসব হচ্ছে আল্লাহ তাআ’লার বিচার,আল্লাহ তাআ’লা ছাড় দেয়,ছেড়ে দেয় না” ইমান বলেই ফেললো,
– “তোমার জীবনে ও ভালো হবে না মা! তুমি আমার জীবন টা জাস্ট জাহান্নাম করে ফেলেছ,তুমি কখনো আমার ভালো চাও না।
.
এখন আফসোস হচ্ছে, সেদিন কেন মিমের কথা শুনে,তোমাকে আর তোমাদের পুলিশে দিলাম না? নোংরামো বন্ধ করো আর শুনে রাখো আমার বিশ্বাস,আমাদের সন্তানের কিছু হবে না।” এভাবেই পাঁচ দিন কেটে গেলো,মিম জলজ্যান্ত পুতুলের মতো হয়ে গেছে মেয়ে টা।
রাতে,হঠাৎ ডক্টর নাসের এলেন,ইমান মিম দু’জনেই কাঁদতে লাগলো ভাবলো হয়তো বেঁচে নেই বাচ্চা টা। কিন্তু কিছুক্ষণ পর দিয়া এসে বাবু’কে মিমের কোলে দিলো,তখন চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে ছিলো বাচ্চা টা,মিম মেয়ে’কে বুকে জড়িয়ে ধরলো,ইমান মিমের গালে চুমু খেয়ে বলল,
– “বলেছিলাম না ঠিক হয়ে যাবে সব টা?” মিম ইমানের বুকে মুখ লুকোলো,সাথে সাথেই তখন কেঁদে উঠলো মেয়ে টা।”
.
ধীরে ধীরে সবাই কেবিন থেকে বেড়িয়ে গেলো,অরুণিমা মিমের কপালে চুমু খেয়ে বললো,
– “কেঁদে কেঁদে নিজের কি অবস্থা করেছে আমার মেয়ে টা?” রুহুল আমিন সাহেব ইমান’কে জড়িয়ে ধরে বলল,
– “ভয় নেই,আমরা আছি,আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে বাবা।” ইমান দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
– “আমি মিম’কে অনেক ভালোবাসি,ওকে সবসময় হাসিখুশি রাখতে চাই বাবা।”
অতঃপর ঠিক চার মাস পর ইমান মিম এবং মেয়ে’কে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় চলে এলো,ফাইজা বিভিন্ন কথা বলেও ছেলে’কে আটকে রাখতে ব্যার্থ হলো।
তারপর নাদিরা’র বলা মিথ্যে কথা গুলো জানার পর থেকে ইয়াসিন ওর থেকে আরো দূর সরে যেতে লাগলো,ইয়াসিনের মানতে খুব কষ্ট হচ্ছে কি করে ও নাদিরার বলা মিথ্যে কথা গুলো বিশ্বাস করে মিম’কে ভুল বুঝলো? নাদিরা ওকে কিছু ফেইক ছবি দেখিয়ে বলেছিল,
– “তুমি কি জানো? তুমি মিমের কাছ থেকে ঠকে যাচ্ছ? মিম অন্য কারো সাথে কমিটেড,সবসময় কার সাথে ফিসফিস করে যেন কথা বলে ও? ও আবার তার বার্থডে ও প্ল্যান করছে কি আশ্চর্য?” অথচ সত্যি টা এই ছিল মিম ইস্পা,ইমা এবং ইমানের সাথে ইয়াসিনের বার্থডে প্ল্যান করেছিল আর ইয়াসিন নাদিরার কথায় বিশ্বাস করে মিমের প্রতি রাগ এবং ক্ষোভ থেকে নিজের জন্মদিনে নাদিরা’কে বিয়ে করে মিম’কে চমকে দিলে কাজেই ইমানের এখানে কোনো দোষ নেই,থাকার কথাও না কারণ ইয়াসিন নিজেই তাকে মিমের কাছে ঠেলে দিয়েছিল।
আর এদিকে অস্ট্রেলিয়ায় এসে দু’জনের সাংসারিক জীবন ভিন্ন মাত্রা পেলো,একদিন বিকেলে হঠাৎ মিম ইমান’কে জড়িয়ে ধরে বলে,
.
– “জন্মদিনে তোমার কি গিফট চাই বলো বলো?” ইমান বললো,
– “তুমি আর মেহেরিমা’ই আমার জীবনের বেষ্ট গিফট আমি আর কি চাইবো বলো?” মিম ইমানের কথা শুনে হাসতে হাসতে মেয়ের কপালে চুমু খেলো এবং তার ঠিক দশ কি পনেরো মিনিট বাদে ইস্পার কাছ থেকে নাদিরা’র মিসক্যারেজ হওয়ার টা খবর পেলো।
এসব শুনে মিমের মন টা কেন যেন খুব খারাপ হয়ে গেলো? তারপর ও ইমান’কে বললো,
– “মাঝরাতে তোমাকে একট রূপকথার গল্প শোনাবো।” ইমান মিটিমিটি হেসে ওকে কোলের মধ্যে টেনে নিয়ে বলল,
– “তাই বুঝি? মাঝরাতে কেন? এখুনি বলো?” মিম বললো,
– “মেয়ে’কে খাইয়ে ঘুম পরাবো,কি বদ মতলব তোমার ছাড়ো ছাড়ো?”
ঠিক রাত বারোটা’র সময় মিম ইমান’কে জড়িয়ে ধরে বলতে শুরু করলো,
– “ওয়ান্স আপন এ টাইম,একটা রাজকুমার ছিল যে নিজের ছোটো ভাইয়ের জোড়াজুড়ি তে তার প্রেমিকা’র লয়ালিটি টেস্ট করতে করতে তার প্রেমে’ই পরে গেলো।
.
অতঃপর নিজের ছোটো ভাইয়ের দ্বারা,সেই রাজকুমারী ঠকে গেছে জানতে পেরে রাজকুমার তৎক্ষনাৎ দেশে ফিরে এলো এবং তার বেশ কয়েকমাস পরে সে সেই রাজকুমারীর বাবার কাছে তার আদুরে মেয়ে’কে বিবাহ প্রস্তাব দিলো,রাজা রাজকুমার সম্পর্কে ঠিকঠাক খোঁজখবর নিয়ে রাজকন্যা’কে তার হাতে তুলে দিলো।
তারপর তারপর তাদের মাঝে প্রেম-ভালোবাসা হলো এবং এখন তারা এক কন্যা সন্তানের জনকজননী,অতঃপর…
– “অতঃপর রাজকন্যার কাহিনি গুলিয়ে গেলো।” ইমানের কথা শুনে মিম লজ্জায় দু’হাত দিয়ে মুখ লুকোলো।ইমান মিমের কানে ফিসফিস করে বলে,
– “হ্যাপি বার্থডে টু মি বউ! আমাকে হ্যাপি বার্থডে বলো?” মিম ইমানের পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরে বলে,
– “আপনি জানেন আপনি একটা অসভ্য?” ইমান হাসতে হাসতে বললো,
– “তুমি যদি জানতে আমি এমন,তাহলে কি বিয়ে করতে? বলো বলো?” মিম পালিয়ে যেতে চাইলে ইমান ওকে বুকে জড়িয়ে নিলো,তখন সাথে সাথে মেহেরিমা কেঁদে উঠলো আর দু’জনের মুখে মুহূর্তে সুক্ষ্ম হাসির দূতি খিলে গেলো।
<>সমাপ্ত<>
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com